আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন,১০ পর্ব,১১

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন,১০ পর্ব,১১
লেখা: জবরুল ইসলাম
১০ পর্ব

সেতারা বেগম মেয়েটির পায়ের দিকে তাকালেন।
না, এই পা কখনও মাটিতে পড়েছে বলে মনে হয় না।
বড়ই দুশ্চিন্তার ব্যাপার। এই ইস্তিরি দেওয়া মেয়েকে ছেলের বউ করে করবেনটা কি? সে কি উঠোনে ধান নাড়তে পারবে? পায়ের যা অবস্থা ধান নাড়তে গেলে দেখা যাবে রক্ত বের হয়ে হুলস্থুল কাণ্ড।
এরকম নানান আগডুম-বাগডুম চিন্তা করলেও মানব মন সুন্দরের পূজারী। তাছাড়া পাড়ার চাচী-ফুপিরা চোখ উল্টে ফেলবে বউ দেখে। সেতারা বেগমের মনটা নিমিষেই গর্বে ভরে উঠলো।

সিক্তা যে একেবারেই কাজকর্ম পারে না তা কিন্তু না৷ সে গ্যাসের চুলোয় মোটামুটি সবই রাঁধতে পারে। কিন্তু এখানে লাকড়ি দিয়ে আগুন ধরানোর যুদ্ধ দেখলে সেতারা বেগমের নিজেরই দুঃখ লাগে।
সিক্তা ছাত্রী হিসেবে ভীষণ মেধাবী ছিল। কিন্তু সেতারা বেগমের আনাড়ি ছেলেটি মেয়ে পটাতে এতোটাই দক্ষ যে বেচারি সিক্তার পালিয়ে আসা ছাড়া উপায়ই ছিল না। শহুরের অর্ধ শিক্ষিত এই মেয়েটির গ্রামের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেশ হিমশিমই খেতে হয়েছিল। দেশ ভেঙে জাদুঘরের প্রাণী দর্শনের মতন লোকজন দেখতে আসে। সিক্তা কেবল ড্যাবড্যাব নয়নে তাকিয়ে থাকে। যেখানে গ্রামের লোকজন সারাক্ষণ সিনেমায় বুঁদ হয়ে থাকে। সিক্তা সেখানে নভেল পড়ে দিন কাটায়।
গ্রামের মানুষ ভেবে পায় না, বাড়ির বাচ্চাদের পর্যন্ত তারা মেরে-ধরে পড়তে বসায়। সেখানে এই মেয়েটি সারাদিন এতো আনন্দ নিয়ে বইয়ে কি পড়ে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে,

— ‘কিতা ফড় সারাদিন? এতো ফড়ালেখা ভালা লাগে কিলা?’

সে উত্তরে বলতো নভেল পড়ি। তারা আবার প্রশ্ন করতো,

— ‘নুবেইল কিতা?’

— ‘উপন্যাস।’

সিক্তা বুঝতে পারে লোকজন ঠিক বুঝতে পারছে না। তাই আবার বুঝিয়ে বলে,

— ‘ছবির মতোই গল্প কাহিনী আছে বইয়ে।’

তখন তারা চওড়া মুখে হাসে। আয়েশ করে জিজ্ঞেস করে সিক্তাও ছবি দেখে কি-না। প্রিয় নায়ক-নায়িকা কে? মান্না না-কি শাকিব খান? অসংখ্য কৌতূহলী প্রশ্ন। সিনেমার গল্প করলেই জমে উঠে আড্ডা। কিন্তু সিক্তার ভালো লাগে গ্রামের লোকদের মুখে ভূতের গল্প শুনতে। প্রায় সবারই নিজস্ব জীন-ভূতের গল্প আছে। বিশ্বাস না করলে আল্লাহ পাকের কসম করে বলবে বিশ্বাস করো ভাবি আমার আব্বা নিজের মুখে গল্প করেছেন। সেবার কনাই চাচা, সোনাই চাচা, ইদ্রিস চাচা আর আমার আব্বা রাতে গিয়েছিলেন হাওরে মাছ ধরতে। তারা জাল পাতিয়ে নৌকায় বসে তাস খেলতেন। জেগে কাটাতেন সারারাত। কারণ ঘুমালেই জাল চুরি হয়ে যায়। একবার সবাই তাস খেলছিলেন হঠাৎ আব্বার চোখ আকাশের দিকে যেতেই দেখলেন নীলগঞ্জ গ্রামে এক ঠ্যাং আরেক ঠ্যাং করিমগঞ্জ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইয়া মোটা আর লম্বা এক লোক। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরনে। মুখের মধ্য আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। আব্বা আগে থেকেই এসব শুনেছেন। জানেন তাকালেই ক্ষতি। তাই ফিসফিস করে সোনাই চাচাকে বললেন উপরের দিকে তাকাইও না সবাই দোয়া-দরুদ পাঠ করে বুকে থুথু দাও। সোনাই চাচা কৌতূহলে কানি চোখে তাকিয়ে দেখলেন আগুন মুখে নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বিড়বিড় করে পড়লেন ইউনুস নবীর মাছের পেট থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া, ‘লা ইলাহা ইল্লা আংতা, সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জ্বালিমিন।’
সোনাই চাচার দেখাদেখি ইদ্রিস চাচা পড়লেন, শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া৷
আব্বা পড়লেন আয়াতুল কুরসি। কনাই চাচা আবার কানি চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেন কিচ্ছু নাই।

সিক্তা বিস্মিত হয়ে বলে,

– ‘সত্যি?’

– ‘ইয়াল্লা বিশ্বাস খরো ভাবি আল্লা পাকের কসম হাচা।’

তখনই পিয়াস ঘরে এসে ঢুকে। বিস্মিত সিক্তা ভূতের গল্পটি তাকে শোনায়। সত্য কি-না বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু পিয়াস একটুও অবাক না হয়ে তার নিজের আরেকটা ভূতের গল্প শুরু করে। সে নিজেই একবার ওয়াজ থেকে আসার সময় ‘পথ হারাউরী’ নামক পেত্নীর পাল্লায় পড়ে সারারাত একটি জমির চারপাশে ঘুরেছে। তারপর ফজরের আজান পড়ায় তার হুশ চলে আসে। দেখে সে উল্টাপাল্টা হেঁটে কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছে নিজেও জানে না। তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে বাড়ি ফিরেছে।

সিক্তা ধীরে ধীরে পাড়াপড়শির কাছে দর্শনীয় প্রাণী হয়ে গেল।
এর কিছুদিন পর সেতারা বেগমের সঙ্গে নানান বিষয়ে ঝগড়াঝাটি লাগতে শুরু হলো। মেয়ে কাজকর্ম জানে না। পঙ্গুর মতো বসে বসে খায়। সমস্যার একটা সমাধান বের করলেন পিয়াসের বাবা ময়নুল সাহেব। তিনি ইলাশপুর মাদ্রাসারই বাংলা শিক্ষক।
ঠিক করলেন বউমাকে দিয়ে টিউশনি করাবেন। ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে এসে পড়বে। গ্রামের স্কুল-মাদ্রাসার ছাত্রদের বাংলা, ইংলিশ, গণিত পড়াতে বউমার সমস্যা হবে না।
এদিকে মাধ্যমিক পাসের পর পিয়াসকে দিয়েছিলেন ফার্মাসিস্টে ডিপ্লোমা কোর্স করতে। পড়ালেখার পাশাপাশি সে ফার্মেসিতেও কাজ করেছে। কিন্তু কোর্স শেষ না করেই মেয়ে নিয়ে পালিয়ে এলো। ময়নুল সাহেব ছেলের বেকারত্বেরও সমাধান বের করলেন। বাড়িতেই ছেলে ফার্মেসি দেবে৷ গ্রামে এতোকিছু জানতে হয় না। শুধু স্টেথোস্কোপ, ইঞ্জেকশন আর ওষুধ পত্রের ব্যবহার জানলেই চলে। পিয়াস যেহেতু পড়ালেখার পাশাপাশি ফার্মেসিতেও ছিল সুতরাং কোনো সমস্যাই হবে না৷ গ্রামের লোকজনও জানে পিয়াস এগুলো নিয়ে পড়ালেখা করেছে। কিন্তু সবদিকেই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল নারায়ণ মাস্টার। ময়নুল সাহেব বিরক্ত হয়ে গেলেন। শালার বেটায় পুরো এলাকার বাচ্চা-কাচ্চাদের নিজের বাড়িতে ফ্রি টিউশনি করায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফ্রি চিকিৎসা দেয়। ফলে বউমার টিউশনি হচ্ছে না, ছেলেরও ফার্মেসি ব্যবসা জমছে না।
কি একটা ঝামেলা। ঝামেলাটি মিটে গেল কিছুদিন আগে। পথের কাটা নারায়ণ মাস্টার আর নেই। মাস খানেকের ভেতরেই সিক্তার কাছে ছাত্রছাত্রী পড়তে এসে হুলস্থুল অবস্থা। টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে বেকার ছেলে পিয়াসের ফার্মেসির জন্য ওষুধপত্র সহ আনুষঙ্গিক সমস্ত কিছু শুরু করলেন কেনাকাটা। এসব নিয়েই শেরপুর থেকে লঞ্চে ফিরছিলেন। তখনই জিসানের ফোন আসে।

— ‘আসসালামু আলাইকুম। কি অবস্থা জনাব, আপনি ক’দিন থেকে মাদ্রাসায় আসছেন না দেখছি।’

— ‘ব্যস্ততার জন্য ছুটি নিয়েছি জিসান ভাই। পারিবারিক কিছু কাজকর্ম আছে৷ আপনি কেমন আছেন?’

— ‘কেমন আছি আজ দেখা হলেই বলব। বিকেলে একবার দেখা করুন। একটু জরুরী আলাপ ছিল।’

— ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

এতো ব্যস্ততার মধ্যেও বিকেলে জিসানের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হচ্ছে ময়নুল সাহেবের। মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে কেবল উনার সঙ্গেই জিসানের ভালো সম্পর্ক হয়েছে।

আজ তিনদিন হয়ে গেল অন্তরা পড়তে আসে না৷
সায়মা রোজই দেরিতে ঘুম থেকে উঠে তাই এখনও জানে না অন্তরা পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। পড়তে না আসার জন্য অবশ্য সেদিন জিসানের বাড়াবাড়িই দায়ী। জিসানও বুঝতে পারছে এরকম করা উচিত হয়নি৷ কিন্তু ঘুম থেকে উঠে তার কি যে হল। কেন জানি ভেতরে সারাক্ষণ কেবল অস্থিরতা কাজ করে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে অন্তরাকে তার অসম্ভব ভালো লাগে৷ মাঝেমাঝে মনে হয় অসহায় মেয়ের প্র‍তি এটা তার করুণা বোধহয়। পরক্ষণেই মনে হয় আচ্ছা যদি করুণাই হবে, তাহলে মেয়েটির হাত ধরতে ইচ্ছে করবে কেন? ভোরে অন্তরার ঘুম ঘুম মুখ দেখে ইচ্ছে করবে কেন বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরি? কেন ইচ্ছা করবে ওর নাকে নাক ঘষতে? অশ্রু ভেজা চোখের দিকে তাকালে বুকে সুখের ব্যথা হয় কেন? সেদিন রাতেই বা কেন স্বপ্নে দেখল সায়মার সেই কচুপাতা রঙের শাড়ি পরে পড়তে এসেছে অন্তরা। তারপর দ্রুত স্বপ্ন দৃশ্য পাল্টে গেল। দেখতে পেল স্বামী-স্ত্রী। বাসর রাত তারা ঘরের বাইরে কাটাচ্ছে। জিসান যে খুব খুশি হয়ে বাইরে বেরিয়েছে তাও না। অন্তরা গাল ফুলিয়ে বলল রুমে দমবন্ধ লাগছে। চল তো আজ আমরা যেদিকে চোখ যায় বেরিয়ে পড়ি। দাঁড়াও বিয়ের শাড়িটা একটু পাল্টিয়ে নিই। সে আরেকটি লাল শাড়ি পরে নিল। সেটার রঙ কি লাল ছিল? জিসান ধরতে পারছে না। লালের মতোন। খয়েরি হবে বোধহয়। গুছিয়ে সুন্দর করে কুচি দিয়ে পরেছে। খোলা চুল। খানিকটা পেটও দেখা যাচ্ছে। অন্তরা হাত ধরে টেনে বলল চল বাইরে। দ্রুত স্বপ্ন দৃশ্য পাল্টে গেল। তারা একটি নদীর পাড়ে৷ রুপালি সুতোর মতন একটা নদী। চাঁদের আলোয় সবকিছু দিনের মতন দেখা যাচ্ছে। নদীর পাড়ে একটি গাছের নীচে অনূভুতিহীন রোবটের মতো বসে আছে একজন মাঝি। গায়ের রং সবুজ। যেখানে বসেছে তার চারধারেও গাঢ় সবুজ ঘাস৷ দূরে একটি সবুজ রঙের গরুও দেখা গেল। জিসান বিস্মিত হয়ে বলল, ‘অন্তরা দেখো সবুজ গরু আসল কোত্থেকে? গরু কি সবুজ হয়? তাছাড়া রাতে গরু মাঠে থাকে না-কি? আর এদিকে দেখো মাঝির গায়ের রং ও সবুজ। এরকম কি মানুষ হয়?’

অন্তরা ভাবলেশহীনভাবে বলল,

– ‘গরু কি আমি চিনি না-কি? আমি কি কখনও গরু দেখেছি? আজই না মাত্র আমি মুক্ত হলাম। বাইরে কি আমি কোনোদিন বের হইছি? আর মানুষ আমি কয়জন দেখছি? সবুজ রঙের থাকতেও পারে।’

স্বপ্নে জিসানও বিশ্বাস করে নিল অন্তরা বন্দী ছিল। সে গরু-টরু কোনোদিন দেখেনি৷ অন্তরা মাঝিকে দেখিয়ে বলল চল নৌকা চড়ি। তারা দু’জন নৌকা নিয়ে মাঝখানে গেল। হঠাৎ অন্তরার পেছন দিকে দু’টা পাখনা দেখে জিসান বলল, সেকি তোমার পাখনা কোত্থেকে এলো?
অন্তরা উড়তে উড়তে বলল, আমি চলে যাচ্ছি। আমি এখন থেকে মুক্ত বিহঙ্গ৷ আমার আরাধনায় যে সব সময় ছিল মুক্ত বিহঙ্গের জীবন।
জিসান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আমাদের বাসর রাত? আমার আরাধনায় যে ছিলে তুমি?
অন্তরা খানিক্ষণ চুপ করে কিছু ভাবল। তারপর বলল, সব আরাধনা স্রষ্টা কবুল করেন না।
তাহলে একবার তো তোমাকে ছুঁয়ে দেখি। বিয়ের রাত বলে কথা।
অন্তরা আকাশে উড়তে উড়তে বলল, ঠিকাছে কেবল একবারই ছুঁবে৷
মাঝি নৌকা নিয়ে কিনারায় এলো। তারা সবুজ গরুর আড়ালে চলে গেল।
অন্তরা তাড়া দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি ছুঁয়ে নাও বাবা। আমার সময় নাই৷ কতকিছু ঘুরে দেখতে হবে।
জিসান প্রথমে সবুজ ঘাসে হাঁটু ভেঙে দাঁড়িয়ে অন্তরার কোমর জড়িয়ে ধরে। তারপর শাড়ির আঁচলের ফাঁকে উঁকি দেওয়া মোমের মতন পেটে নাক ডুবিয়ে দেয়।
অন্তরার সমস্ত শরীরের লোম নাড়া দিয়ে উঠে৷ কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না৷ সুখের ব্যথায় নিজের অজান্তেই চোখবুঁজে নিচের ঠোঁটে কামড় পড়ে। এক হাত খামচে ধরে জিসানের চুল। জিসান হঠাৎ ছেড়ে দেয়। অন্তরার মনে হল কেউ তাকে স্বর্গ সুখ থেকে বঞ্চিত করল।
রেগে গিয়ে বলল, ‘ছেড়ে দিলে কেন?’
‘ওমা একবার ছুঁয়ে দেওয়ার চুক্তিই তো ছিল।’
‘হ্যাঁ তাইতো’ বলে মাথা চুলকে কি যেন ভাবে। তারপর পাখনা মেলে উড়তে যাচ্ছিল। আবার ফিরে এসে বলল
‘আচ্ছা ছুঁয়ে দিলে এমন লাগে কেন?’
‘কেমন লাগে?’
‘কেমন যেন। আচ্ছা আবার ছুঁয়ে দাও তো একটু।’
জিসান আবার সবুজ গরুটির আড়ালে নিয়ে যায়। আবার অন্তরা মুক্ত বিহঙ্গের জীবনের দিকে পা বাড়ায়। আবার ফিরে এসে বলে, ‘আচ্ছা ছুঁয়ে দিলে এমন লাগে কেন? বারবার ইচ্ছা করে।’
জিসান মুচকি হেঁসে বলল,
-‘তুমি কিছুই জানো না কেন বল তো। বাসর রাত কি কেউ এভাবে বাইরে কাটাতে আসে?’
– ‘আমি এতোকিছু জানি না-কি? আমি তো বন্দী ছিলাম। আচ্ছা বাসর রাতে কি করতে হয়?’
জিসান মুচকি হেঁসে বলল, ‘এইযে আমরা ছুঁয়াছুঁয়ি করলাম এসবই।’
– ‘তাহলে চল আমরা বাসর ঘরে চলে যাই, তোমাকে রেখে আমার মুক্ত বিহঙ্গের জীবনে যেতে ভালো লাগছে না।’
তখনই বেরসিক ইমরাজ চেয়ারম্যানের ডাকে জিসানের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ফজরের নামাজে যাওয়ার জন্য ডাকছেন। সে গেল না।
ঘন্টা খানেক বাদে অন্তরা এসে দরজায় নক দেয়। গলা শুনে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয় জিসান। তার পরনে শর্ট প্যান্ট৷ গায়ে কালো সেন্টু গেঞ্জি৷ তার যেন পুরোপুরি স্বপ্নের ঘোর কাটেনি। অন্তরাকে দেখে বাড়াবাড়িটা শুরু করল তখনই।
–চলবে..

লেখা: জবরুল ইসলাম

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১১ পর্ব
.
ফজরের নামাজে গেল না জিসান। ডাকে সাড়া না পেয়ে ইমরাজ সাহেব একাই চলে গেলেন।
ঘন্টা খানেক বাদে অন্তরা এসে দরজায় নক দেয়। গলা শুনে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল জিসান। তার পরনে শর্ট প্যান্ট৷ গায়ে কালো সেন্টু গেঞ্জি৷ এলোমেলো চুল। লাল টকটকে চোখ।

অন্তরা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

–‘সে কি, আপনি এই অবস্থায় কেন? আমি চলে যাব না-কি আজ?’

জিসানের যেন মনে হল স্বপ্ন এখনও চলছে৷ সে তাড়াতাড়ি বলল,

— ‘না না, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি কাপড় পরে নিচ্ছি।’

জিসান তাড়াতাড়ি একটা নীল পাঞ্জাবি পরে অন্তরাকে ডাকল। অন্তরার কেন জানি স্যারকে আজ অস্বাভাবিক লাগছে। চোখে ঘোর। চেহারায় অস্থিরতা।

অন্তরা ফিক করে হেঁসে বলল,

–‘আপনি সাতসকালে হাত-মুখ না ধুয়ে দাঁত ব্রাশ না করে পাঞ্জাবী পরে বসে আছেন কেন?’

জিসান আচমকা উঠে এসে অন্তরার হাত ধরে বলল, ‘আচ্ছা আমি এক্ষুণি বালতির পানি দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নেব। তুমি এই সুযোগে সায়মার কচু পাতা রঙের শাড়িটি নিয়ে আস।’

— ‘কি বলেন এসব। শাড়ি এনে কি হবে? হাত ছাড়েন আমার।’

— ‘প্লিজ শাড়িটি আনো, তারপর বলছি। সায়মা ঘুমোচ্ছে। তাড়াতাড়ি যাও।’

অন্তরা কোনো কিছু না বুঝেই শাড়ি নিয়ে এলো।
জিসান বাইরে গিয়ে বলল, ‘রুমে গিয়ে শাড়িটি পরে নাও প্লিজ। তোমাকে এই শাড়িতে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে৷’ জিসানের চোখের দিকে তাকিয়ে অন্তরার মনে হল পরে ফেলি। মানুষটা দেখতে চাচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে সে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। দ্বিধাদ্বন্দে একপর্যায়ে কেঁদে ফেলল অন্তরা।

জিসান আঁজলা করে মুখ ধরে বলল,

–‘কাঁদছো কেন?’

অন্তরা ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে বলল,

— ‘দয়া করে আপনি আমাকে প্রেমে ফেলবেন না। আমি চাইনা প্রেমে পড়তে। তবুও কেন আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না।’

— ‘তুমি নিজেকে কন্ট্রোল করবে কেন? প্রেমে পড়লে সমস্যা কি?’

— ‘আপনাকে সায়মা পছন্দ করে। আমি চাইনা প্রেমের কলংক লাগাতে। চাই না চাচার অবাধ্য হতে। তাছাড়া যত কষ্টই হোক এ বাড়িতেই আমি থাকতে চাই৷ এই পরিবার আমার পরিবার। এই পরিবারের সঙ্গে আমার রক্তের বন্ধন আছে। তারা যখন নিজেদের মতো বিয়ে দিয়ে বের করে দিবেন তখনই যাব৷ আড়ালে-আবডালে আমি প্রেম করতে চাই না।
আমি তখন খুবই ছোট। এখানে আসার বছর খানেক হল। একদিন চাচা আমাদেরকে নিয়ে গেলেন এক পীর সাহেবের কাছে।
চাচার তখন খুব বেশি পীর ফকিরে বিশ্বাস। সায়মার বড় ভাইও তখন দেশে ছিলেন। তার মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ের আলাপ চলছে৷ বিয়ে করে ইংল্যান্ড যাবে। চাচা একদিন আমি সহ সবাইকে নিয়ে গেলেন জর্দা পীরের কাছে৷ পীর সাহেব জর্দা দিয়ে মুখ জবজবে করে পান খান। সেই পানের পিক ভক্তরা একটা তাগারিতে পানি মিশিয়ে তুলে রাখে। চাচা আমাদেরকে সেই ‘পিক’ খেতে বললেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম সবাই রক্তের মতো লাল টকটকে পানের পিক আয়েশ করে খাচ্ছে। যারা আসে সকলেই খায়। তাতে শরীরের রোগ বালাই দূর হয়৷ এলাকার সবাই সেটাকে সর্ব রোগের মহা ঔষুধ বলে। ঘেন্না করে খেলে হবে না। তাতে অমঙ্গল আসবে, ধ্বংস হবে। আগ্রহ নিয়ে পিক খাওয়ায় অনেক ছেলে বিলেতি বউ পেয়েছে বলেও লোকমুখে প্রচলিত আছে। সবাই খেল। সায়মার বড় ভাইকে ইংল্যান্ড যাওয়ার কামনায় একটু বেশিই খাওয়ানো হল। আমি পারলাম না। অন্যদের খাওয়া দেখেই বমি পাচ্ছিল। বারংবার থুথু ফেলছিলাম। পীর সাহেব সেটা টের পেলেন কি-না জানি না৷ কিন্তু সবার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিলেন। আমি সামনে গেলাম। চাচা পীর সাহেবকে বললেন মেয়েটির বাবা-মা নাই আমিই লালন-পালনের দায়িত্ব নিয়েছি। পীর সাহেব আচমকা রেগে গেলেন। চোখ বন্ধ করে বললেন এই মেয়েকে গৃহ বন্দী করে রাখতে হবে। বংশের সর্বনাশ করবে। এই কুলক্ষ্মীনি, সর্বনাশী, অপেয়াকে আমার সামনে থেকে সরাও। এই মেয়ে যার আশেপাশে থাকবে তারই অমঙ্গল হবে। বিপদ আসবে৷
চাচাও আমার উপর রেগে গেলেন। গৃহবন্দীর বদলে রেখে আসলেন একটি এতিমখানায়। তখনই আমি বুঝতে পারি এই পরিবার ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। সায়মার জন্য আমার টানে৷ চাচার জন্য টানে। নিজেকে একা মনে হয়। এদিকে চাচি পঙ্গু হয়ে আছেন। কাজের মেয়ে দিয়েও তাদের চলছে না। চাচা একদিন দেখা করতে আসলেন। আমি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম তাদের কথামতো চলব। আমাকে যেন বাড়িতে নিয়ে যান। চাচা সেদিন নিয়ে আসলেন। এরপর থেকে আমার দ্বারা কোনো ক্ষতি হতে দেইনি এই পরিবারের। তাদের কোনো কথার অবাধ্য হইনি। অথচ সায়মা যাকে পছন্দ করে তারই সঙ্গে আমি লুকিয়ে প্রেম করার পথে পা বাড়াচ্ছি। ছিঃ আমি এতো অকৃতজ্ঞ স্বার্থপর হলাম কবে থেকে। আর আসবো না আপনার কাছে পড়তে।’
এই কথাগুলো বলেই অন্তরা ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। তিনদিন হয়ে গেল সে আর পড়তে এলো না।
কি করবে। কার সঙ্গে কথা বলবে কিছুই খোঁজে পাচ্ছিল না জিসান।
মাদ্রাসার বাংলা স্যারের সঙ্গে তার ভালো একটা সম্পর্ক আছে। ক’দিন থেকে তিনিও খুব ব্যস্ত দিনকাল কাটাচ্ছেন। মাদ্রাসা থেকেও ঘন ঘন ছুটি নিচ্ছেন। জিসান আজ বিকেলে দেখা করার জন্য ফোন করেছিল। তিনি আসলেন। জিসানের থেকে বয়সে অনেক বড় হলেও তাদের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুত্বের কাছাকাছি।
মাদ্রাসার মাঠেই বসলেন।
সবকিছু খুলে বলল জিসান। অন্তরাকে বিয়ে করতে চায়। তার বাবা ঢাকায় একজন সফল বিজনেসম্যান। সে ইংলিশে অনার্স করে এখন মাস্টার্সে পড়ছে।
ময়নুল সাহেবকে বেশ চিন্তিত দেখা গেল। তিনি মাঠের ঘাস ধরে টানছেন।

তারপর মুচকি হেঁসে বললেন,

–‘ভালো প্রস্তাব। বিয়ে করবেন। আপনার অবস্থাও ভালো। কিন্তু চেয়ারম্যানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি না। তবুও আপনার জন্য আমি যাব। মেয়েটিরও কেউ নাই শুনেছি৷ আপনার সাথে বিয়ে হলে মেয়েটিও সুখী হবে।’

ময়নুল সাহেব পরেরদিন জুম্মার নামাজ পড়ে চেয়ারম্যানের কাছে এসে প্রস্তাবটি দিলেন। কিন্তু তাকে বিস্মিত করে অনেকটা মুখস্থের মতোই চেয়ারম্যান বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।
ময়নুল সাহেব ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেন জিসানের অবস্থান। তবুও তিনি একটা কথাই বললেন,
–‘অন্তরাকে এখন বিয়ে দিতে চাচ্ছি না।’

ময়নুল সাহেব অনেকটা সরলভাবে বললেন,
— ‘কি যে বলেন চেয়ারম্যান সাহেব। মেয়ের তো বিয়ের বয়স অনেক আগেই হয়ে গেছে। তাছাড়া এমন পাত্র কি আর পাবেন? মেয়েটির মা-বাবা কেউ নেই, একটা ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হোন।’

চেয়ারম্যান প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,

— ‘শুনলাম আগামীতে মেম্বারিতে দাঁড়াচ্ছেন?’

খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন ময়নুল সাহেব,

— ‘এই আরকি লোকজন চাচ্ছে।’

— ‘আমি আপনার সঙ্গে এমনিতেই দেখা করতে যেতাম। বলছিলাম কি আপনি পরেরবার দাঁড়ান। এবার আখলাছুর দাঁড়াবে। আমি তাকেই সাপোর্ট দেব। আপনাকে সে টাকা দিবে প্রয়োজনে। তবুও এবার না দাঁড়ালে আমি খুশি হব।’

ময়নুল সাহেবের চেহারা ধুপ করে নিভে গেল। তবুও স্বাভাবিকভাবে বললেন,

— ‘আখলাছুর যে একাই দাঁড়াতে হবে তা কেন? হাজার জন দাঁড়ালেও জনগণ আখলাছুরকে চাইলে তাকেই ভোট দিবে।’

চেয়ারম্যান সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললেন,

— ‘আখলাছুর আগেই বলেছিল আপনি দাঁড়াবেনই। আমি ভেবেছিলাম কথা বললে সমাধানে আসবেন। কি আর করার।’

ময়নুল সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,

— ‘তা বিয়ের প্রস্তাব কি আরেকটু ভেবে দেখবেন। ইংলিশ স্যার কিন্তু বড়ই ভালো মানুষ। আপনাদের বাড়িতেই যেহেতু আছেন দেখতেই পাচ্ছেন।’

— ‘ভাবাভাবির কিছু নাই। মেয়েকে বিয়ে দেব না এখন৷ আপনি আসতে পারেন।’

ময়নুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে গেলেন। তাকে চা-পানের ভদ্রতাটুকুও দেখানো হল না।
এরপরের ব্যাপারগুলো দ্রুত ঘটতে লাগল।
বিয়ের প্রস্তাবে চেয়ারম্যান মনে মনে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলেন। তবুও ভদ্রভাবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন। এর কিছুদিন পর মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল জিসানকে ডেকে জানালেন চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে তার লজিং ছুটে গেছে। আপাতত মাদ্রাসার সভাপতির বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কালই একজন নিতে আসবে। সবকিছু গুছিয়ে রাখতে জানিয়ে দিলেন। জিসান কি করবে ভেবে পেল না৷ অন্তরার সঙ্গেও দেখা হচ্ছে না। তবুও বক্কর আলীকে নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে রাখল। পরেরদিন সভাপতির লোক এসে তাকে নিয়ে গেল।
–চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here