#আমি_জান্নাত
#পর্বঃ০৩
#ফারজানা_আক্তার
সন্ধ্যা গনিয়ে রাত নেমে এলো, আমি আম্মুর সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাজারো বায়নাতে মেতে আছি, আম্মু খানিকটা বিরক্তি হয়েছে বোধহয়। আমি আম্মুর সাথে খুনসুটি করতেছি একটা আয়না এনে দেওয়ার জন্য আমায় এমন সময় আব্বু আর ভাইয়ার চেঁচামেচির সুর কর্ণকুহর হলো আমাদের। আমি আর আম্মু দৌড়ে গেলাম ড্রয়িংরুমে। যেয়ে দেখি নাহিদ পায়ের উপর পা তোলে বসে আছে আমাদের ড্রয়িংরুমের সোফায়। ভাইয়ার রাগ উঠে গেছে নাহিদের প্রবেশ দেখে আমাদের ঘরে তাই নাহিদকে মারার জন্য বারংবার ছুটে যাচ্ছে নাহিদের দিকে কিন্তু আব্বুর জন্য পারছেনা আব্বু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ভাইয়াকে আর নাহিদ মুচকি হাসতেছে এসব দেখে। আব্বুর মনেও ভয় আছে, আব্বু জানে ভাইয়া যদি এখন নাহিদকে মারে তবে নাহিদের কিছুই হবেনা কিন্তু ভাইয়ার ক্ষতি ঠিকই হবে, নাহিদ চাই ভাইয়া নাহিদের গায়ে হাত তুলুক আর সেই সুযোগে নাহিদ ভাইয়াকে জেলখানায় বন্ধি করতে পারবে। আমি নাহিদকে দেখে সামনে পা এগুতে পারছিনা আর, পা গুলো যেনো থমকে গেছে। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে খুব। নাহিদের চেহারা দেখলেই কষ্টে যেনো বুকটা ছিঁড়ে যায়, নিজের অজান্তেই চোখ দু’টো ভিজে উঠে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিলাম। আম্মু শক্ত করে আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে রেখেছে। আম্মুর চোখে ভয় দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। আম্মুকে শান্তনা দিয়ে বললাম চিন্তা না করার জন্য। তারপর নিজের রুমে যেয়ে একটা নিকাব নিয়ে ঢেকে ফেললাম নিজের চেহারা আর হাতে নিলাম ধারালো ছুরি। হনহনিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে যেতে লাগলাম কিন্তু আম্মু যেতে দিচ্ছেনা কোনোমতে। আম্মু ভয় পাচ্ছে নাহিদ যদি আবারো কিছু করে দেয় আমাকে সেটা চিন্তা করে। আম্মুকেও সাথে নিয়ে প্রবেশ করলাম ড্রয়িংরুমে। আমাকে দেখে ভাইয়া আর আব্বু দৌড়ে এলো আমার কাছে আর বলতে লাগলো আমি রুমে যেতাম কিন্তু আমি তো জানি আমি রুমে চলে গেলে এই নরপশুটা আমায় ভিতু ভাবতে শুরু করবে, আমি ভিতু নয়, আমি দুনিয়াকে দেখিয়ে দিবো মেয়েরাও পারে।
আমাকে দেখে নাহিদ দাঁড়িয়ে গেলো, মুখের হাসিটা যোনো ধোঁয়াশা হয়ে গেলো নাহিদের। হয়তো আমি এভাবে সামনে আসবো ভাবেনি সে। কপালে দেখলাম বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতেছে যা সে হাত দিয়ে মুছে নিচ্ছে বারংবার। আমি আব্বু ভাইয়া আর আম্মুকে বললাম
“চুপ অনেক থেকেছি, মুখের উপর পাল্টা জবাব দেওয়ার সময় এসেছে, প্লিজ তোমরা আমাকে আর বাঁধা দিওনা, শেষটা আমি দেখেই ছাড়বো”
আমার এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছুই বলেননি আম্মু আব্বু ভাইয়া। কিন্তু ভাইয়ার চোখে আগুন দেখতে পাচ্ছি আমি, পৃথিবীতে কেউ যদি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আমায় তবে সে হলো আমার বড় ভাই ইমতিয়াজ।
নাহিদ হঠাৎ করে ডাক দিলো আমায় জান্নাত সুন্দরী বলে, আমি আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে ছুটে গিয়ে লাগিয়ে দিলাম ওর গালে একটা থাপ্পড়। শরীরের সব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় দেওয়াতে কিছুটা ঝুঁকে গেলাম আমি। নাহিদ মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা এটার জন্য, হঠাৎ এমন থাপ্পড় খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে দাঁড়ানো থেকে সোফায় বসে যায় ধপাস করে। আমি সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে আছি নির্ভয়ে। আমার পাশে এসে আব্বু আর ভাইয়া দাঁড়িয়েছে, সাহস আরো বেড়ে গেছে আমার। নাহিদ ক্ষেপে গিয়ে লাফিয়ে দাঁড়ালো। নাহিদ আমাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি বলা শুরু করি
“তোর মতো নরপশুকে ভয় পায়না আমি, তোকে ধন্যবাদ দিতে চাই রে আমি, আমার সৌন্দর্য নষ্ট করে তুই আমার ক্ষতি নয় বরং লাভ করেছিস। আমি দিন দিন একদম বেপর্দা হয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু এমন সময় তুই এই জগন্য কাজ করে আমাকে আবারও ফিরিয়ে দিলি আমার আসল দুনিয়ায়। তুই জানিস নাহ তুই আমার কত বড় উপকার করেছিস। তাই তোকে ক্ষমা করে দিলাম, যা চলে যা আর কখনো আমার সামনে আসবিনা। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখবি তোর চাওয়া কখনো পূর্ণতা পাবেনা। তুই আজকের পর থেকে আমাকে যত দেখবি ততই জ্বলবি। তোকে আমি জিততে দিবোনা কিছুতেই নাহ।”
চোখ বড় বড় করে নাহিদ আমার কথাগুলো শুনলো তারপর গটগট পা ফেলিয়ে চলে যায়। নাহিদ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কিছু বলতে চেয়েও বলেনি। হয়তো আমাকে নতুনভাবে দেখে অবাক হয়েছে কিছুটা, আমার সাহস দেখে অবাক হওয়ারই কথা কেননা একটা সময় ছিলো যখন নাহিদকে দেখে আমি একদম চুপসে যেতাম, রাস্তার এক কোণে চলে যেতাম, নাহিদকে দেখলেই খুব দূর থেকে নয়নার হাত শক্ত করে ধরে ফেলতাম আর আজ সেই আমি নাহিদের চোখে চোখ রেখে এতোগুলো কথা বললাম, নাহিদের অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক। আর আমার হাতের ধারালো ছুরি দেখে হয়তো নাহিদ একটু হলেও ভয় পেয়েছে কারণ নাহিদ একা আসছে আমাদের বাসায় আর আমরা পুরো পরিবার আছি একসাথে। তাই নাহিদ দ্রুত চলে যায়।
নাহিদ চলে গেলে গেলে ভাইয়া আমার মাথার উপরে হাত রেখে বলে
“নাহিদকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমার মনের আগুন জ্বলতেই থাকবে বোন, কিভাবে পারলি তুই ওকে ক্ষমা করতে?”
প্রত্যুত্তরে ভাইয়াকে বললাম
“নাহ ভাইয়া ওকে শাস্তি আমিই দিবো, ও যে আশায় আমাকে এসিড আক্রান্ত করেছে ওর সে আশা আমি কখনোই পূরণ হতে দিবোনা। একটু সময় দাও আমায় তোমরা, আমি দেখিয়ে দিবো ওর এসিড আমাকে দমাতে পারেনি।”
ভাইয়া আর আব্বুর চোখে দেখি জ্বল, আমারো খুব ইচ্ছে করছে ওদেরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কিন্তু আমি আমার দূর্বলতা কারো সামনে প্রকাশ করতে চাইনা। প্রতিবাদ আমি করবোই কিন্তু মারপিট করে বা ঝগড়া ফাঁসাদ করে নয় মুখের উপর পাল্টা জবাব দিয়ে।
____________
সকালে ঘুম থেকে উঠে সোজা ভাইয়ার রুমে চলে গেলাম, গিয়ে দেখি ভাইয়া ঘুম আর বালিসের পাশেই ভাইয়ার ফোন রাখা। পা টিপে টিপে খাাটের পাশে গেলাম, তারপর আস্তে করে ফোনটা নিয়ে দ্রুত আমার রুমে চলে এলাম। রুমে এসেই ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফোন নিয়ে। চোখ বন্ধ করে ফোনের সামনের ক্যামরা অন করে মুখের সামনে ধরলাম, অজানা একটা ভয় যেনো আঁকড়ে ধরেছে আমায়। আমি কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিনা, প্রায় ৫মিনিট পর নিজেকে শক্ত করলাম, ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই ছিঁটকে পড়লাম আমি, ফোনটা হাত থেকে পরে গিয়ে চার হাত দূরে চলে গেলো আমার থেকে আর আমি বসে পরলাম দেওয়াল ঘেঁসে, নিজের চেহারা দেখে নিজেই হতবাক আমি, আমি চিৎকার করতে যেয়েও থেমে গেলাম কারণ আমি আমার দূর্বলতা বাহিরে প্রকাশ করতে চাইনা, আমি নিজেকে নতুন করে গড়তে চাই।
দেওয়ালের সাথে কতক্ষণ গা টেকিয়ে বসে ছিলাম মনে নেই, কেনো জানি খুব কেঁদেছি নিজের চেহারার এই অবস্থা দেখে, এই কারণেই আম্মু আমাকে নিজের চেহারা দেখতে দিচ্ছিলোনা। খুব কষ্ট হচ্ছে খুব, ভেতরটা যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে। এলাকার সবার চেয়ে সুন্দর মেয়েটি এখন সব মেয়ের সামনে তুচ্ছ, ভাবতেই চোখগুলো ভিজে আসছে বারংবার।
___________
সকাল ১০টার দিকে রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিংয়ে গেলাম, যেয়ে দেখি ভাইয়া আর আব্বুর মুখ গম্ভীর, ভাইয়ার ফোন খুঁজে পাচ্ছেনা তাই তারা সবাই চিন্তিত।
আমি আস্তে আস্তে ভাইয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভাইয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা দিলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ভাইয়া আমার দিকে। ভাইয়াকে কিছু বলতে না দিয়ে আমি বললাম
“ভাইয়া ক্ষমা করে দিও তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার ফোন ধরলাম তাই আর তোমার ফোনের পাসওয়ার্ড আমার নামে সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম তাই লক খুলতে ঝামেলা হয়নি। আমি আসলে আমার নতুন চেহারার সাথে পরিচয় হতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমরা আমাকে সেই সুযোগ দিচ্ছিলেনা তাই এই পথ বেছে নিতে হয়েছে আমায়। বিশ্বাস করো আমি খুব ভালো আছি আমার নতুন চেহারা নিয়ে আর প্লিজ ঘরের সব আয়না জাতীয় জিনিস ওই বন্ধ রুম থেকে এনে ঘরটাকে সাজিয়ে দাও আবার। এমন মনমরা ঘর একদম ভালো লাগেনা।”
ভাইয়া জানিনা কি বুঝেছে তবে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। আর আমার কপালে চুমু দিয়ে বলেছে
“তুই পারবি বোন, তোর সব সিদ্ধান্তে আমি তোর পাশে আছি সবসময়ই।”
আম্মুও এসে জড়িয়ে ধরেছে আমায়। আমাকে এতো শক্ত দেখে সবাই খুব খুশি হয়েছে।
নাস্তা শেষে আমি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম
“আমি কিছু বলতে চাই তোমাদের সবাইকে, আমার সিদ্ধান্তে সবাইকে পাশে চাই আমি। থাকবে তো আমার এই যুদ্ধে আমার পাশে তোমরা “?
আব্বু বললো
” বল, তোর সব সিদ্ধান্তে আমরা তোর পাশে আছি”
একরাশ সাহস নিয়ে বলতে শুরু করলাম____
#চলবে