আমার_হৃদয়ে_সে,৩০,৩১,৩২

#আমার_হৃদয়ে_সে,৩০,৩১,৩২
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩০

৪৮.
স্বপ্ন ছিল অন্যরকম।বিয়েতে ঢাকঢোল বাজবে।মেহমান আসবে।বড় আয়োজন করে খাবারদাবার হবে।আমি বধূ সেজে সবাইকে বিদেয় জানিয়ে স্বামীর ঘরে পদার্পণ করবো।সেই বাড়ির সবাই আমাকে “বউমা” বলে সম্বোধন করে সাদরে গ্রহণ করবে।কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে স্বপ্নটা আমার ভাটা পড়া নদীর মতন হয়ে গেল।হৃদয়ের বাবার অসম্মতিতেও এখন ছুটে চলছি সেই বাড়িতে।মানে হৃদয়ের বাড়িতে।হৃদয় আমার পাশে বসা।উদাসীন মনে সি.এন.জির বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে আমাকে অন্যহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখে।আমার মনে ওকে নিয়ে প্রচন্ড রকমের অভিমান!তার বাবা যেহেতু আমাকে বউ করতে রাজি নেই তাহলে কেন আমাকে সে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে?তার ভালোবাসার মান রাখতে কেন বাবার চোখে খারাপ হবে সে?সে কি বুঝে না ডিভোর্সিদের দয়া দেখাতে যেয়ে সমাজে বাপ-মায়ের মুখ ছোট্ট হয়ে আসে।এতটা দয়ালু কেন সাজতে গেলো এই ছেলে?আবারো আরেক দফা কেঁপে উঠলাম।এই মুহূর্তে কান্না করে দিতে ইচ্ছে করছে খুব।ভীষণ রকম কান্না।হৃদয় হালকা নড়ে উঠে।তার হাতের বাঁধন হালকা হয়ে আসে।আমি ওমনি ওড়না টেনে চোখের কোণের জলে মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি।হৃদয় আমার দিকে তাকিয়ে,

“পারিসা?আর কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছে যাবো।”

বলে হাতের বাঁধন আবার শক্ত করে নেয়।আমি চুপ করে রইল।মিনিট সাতেশ পর সি.এন.জি একটা দো’তালা বাড়ির সামনে এসে থামে।

“পারিসা?চলে এসেছি।নামো।”

আমি কেনজানি বসে থাকলাম।নামার মতন পায়ে শক্তি পেলাম না।হৃদয় ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে,
“মামা?ধরুন আপনার বিল?”

ড্রাইভার টাকাটা হাতে নেওয়ার পর হৃদয় আবার আমার দিকে ফিরে।দেখে এখনো বসে।সে আর না দাঁড়িয়ে আমার সিটের দিকে এগিয়ে আসে।কিছু না বলে ধপ করে তার দুইহাতে আমাকে তুলে নেয়।এ দৃশ্য দেখে আমিও যতটা না অবাক,ততটা ড্রাইভারও।তবে আমি লজ্জায় পেয়ে যাই।পরক্ষণে ড্রাইভার অবাক চোখে দুষ্ট চাহনি এঁটে উল্টো দিকে তাকিয়ে মুচকি মুঁচকি হাসে।তারপর বলে,

“যাই মা-আব্বা।তোমাদের জন্যে দোয়া রইলো।”
হৃদয় বলে,
“হ্যাঁ মামা।তারসাথে দোয়া করবেন আমার এই বউটার মনেও যেনো কোনো কষ্ট না থাকে।”

কথার পিঠে ড্রাইভার মৃদু হাসে।তারপর গাড়ি স্টার্ট করে চলে যায়।হৃদয় আমাকে তার দু’হাতের মধ্যে রেখেই সামনে হাঁটা ধরে।গন্তব্য সদর দরজা।সদর দরজার সামনে আসতে হৃদয় এবার আমাকে নিচে নামায়।আমি হৃদয়ের দিকে তাকাই।হৃদয় বলে উঠে,
“সরি বউ!তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।এছাড়া আর উপায় ছিল না।”

বলে হৃদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আমি হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সে আমাকে এখানে এভাবে নিয়ে এসে বেশ খুশি নয়।আমার মতন তারও মনে চাপা ব্যথা।সেও হয়তো চেয়েছিল তার পরিবারের প্রতিটি মানুষ আমাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করুক।কিন্তু ভাগ্য তা আমার সহায় না।দরজা খুললেই কিছু মানুষের দেখা যাবে হাসি মাখা মুখ।আবার কিছু মানুষের রক্তলাল চোখ।হৃদয় কলিংবেল চাপে।কয়েক মিনিট বাদে কেউ ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয়।আমি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি হৃদয়ের মা দাঁড়িয়ে। মানে আমার শাশুড়ী মা।আমি দেরী না করে উনাকে সালাম করে উঠি।উনি আমাকে দেখে যেন ভারী খুশি হলেন।চোখমুখ আনন্দে ঝলকে উঠলো।উত্তেজনায় পেছনে তাকিয়ে মুখ ফসকে কিছু বলতে যেয়ে চুপসে যান।আমাদের দিকে ফিরে গলার স্বর নিচু করে,

“বউমা কে নিয়ে ভেতরে যা।তোর বাবা তার রুমের ভেতর আছেন।”

উনার কথায় বুঝতে পারলাম হৃদয় যে আমাকে এখানে নিয়ে আসবে উনি তা আগে থেকেই জানেন।হৃদয় বললো,
“তো কি হয়েছে,মা?বিয়েটা কি আমি লুকিয়ে করেছি যে বাবার ভয়ে বউকে নিয়ে লুকিয়ে থাকবো?আর পারিসা তো খারাপ মেয়ে না।আমি সৎ,নৈতিকতা সম্পূর্ণ একজনকে আমার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছি এটা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।”

হৃদয়ের মার মুখটা আরে উজ্জ্বল হয়ে গেল।তিনি দরজাটা আরো মেলে দেন।হৃদয় আমার ডান হাত ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়।আমি চারপাশে একবার চোখ বুলাই।নিচে তেমন কাউকে চোখে পড়লো না।তবে হ্যাঁ,কিচেনের দরজা বরাবর অল্প বয়সী একটা মেয়েকে দেখলাম।মেয়েটা কি যেন রান্না করছে।দেখেই বুঝা সহজ সে এই বাড়িতে কাজ করে।সে আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখমুখ হাতে করে ফেলে।লাফ মেরে বলে উঠে,

“ভাবী আইছে।ভাবী আইছে।”

ওর গলার ধ্বনি খুব উঁচু ছিল,পুরো বাড়িটা যেন বেজে উঠলো।হৃদয়ের মা মেয়েটিকে থামাতে কিচেনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন।কিন্তু উনার চলার গতি হঠাৎ থমকে গেলো বামপাশে তাকাতে।আমি এবং হৃদয় উনার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে সেদিকে তাকাই।তাকিয়ে একজন বুড়া মতন লোক।অবশ্যি বেশি বুড়া না।এই বয়স ৫৬/৫৭ এর মতন হবে।উনি আমাদের দেখে চোখে থাকা চশমা চোখজোড়া থেকে তরতর করে খুলে ফেলেন। কপালের চামড়া ঘন করে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে আনেন।হৃদয় তা উপেক্ষা করে আমাকে বলে উঠে,

“আমার বাবা।সালাম করো।”

আমি সালাম করে উঠলাম।উনি আমার সালামের জবাব দেননি।সরাসরি হৃদয়ের দিকে তাকান।বলেন,

“এ তোমার বউ?”
“হ্যাঁ,বাবা।”
“অতঃপর আমাদের না জানিয়ে নিয়েই আসলে।”
“উপায় ছিল না।”
“এক্সকিউজ শুনছি না।এনেছো ভালো করেছো।এবার সংসার করো।”

বলে চশমাটা আবারো চোখে এঁটে শক্ত চোখমুখে যে রুম থেকে বেরিয়েছেন সেই রুমে আবার পা বাড়ান।সেকেন্ডের ভেতর রুমে ঢুকে যান।আমাদের সবার চোখের সামনে দরজা ভিড়িয়ে দেন।হৃদয় আমাকে শুধায়,

“রুমে চলো পারিসা।”

রুমে আসতে হৃদয়কে ফ্রেশ হবার কথা বলে বাথরুমে ঢুকি।দরজা চাপিয়ে ফ্লোরের উপর জবুথবু বসে পড়ি।চেপে রাখা চোখের বাঁধ এবার উন্মুক্ত হয়ে যায়।ঝরঝর করে পড়তে থাকে দুই চোখের অশ্রু!বুকের মাঝখানটা ভেঙ্গেচুরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।আর যে আমি পারছি না,হবে আল্লাহ!কেমন অগ্নি পরিক্ষায় ফেললে তুমি!কি পাপ করেছি!কি পাপ!জীবনটা আমার এতটা সাদা খাতার মতন কেন কিছু লিখতে গেলেই কলমের কালি ফুরিয়ে যায়!ঠায় এভাবে কিছুটা সময় বসে থাকি।হঠাৎ মনে পড়ে হৃদয়কে আমি ফ্রেশ হয়ে আসার কথা বলেছি। এতটা সময় পার হলো হৃদয় ডাকে নি ত?এমন সময় ওপাশ থেকে হৃদয়ের গলার স্বর,

“পারিসা?পারিসা?”

কথার রেশে বুঝা যাচ্ছে আগেও অনেকবার ডেকেছে।আমি নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করি।সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াই।মাথার এলোমেলো চুলগুলো কানের দুই পাশে গুঁজে কল ওপেন করি।
মুখে কয়েক কোষ পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বের হই।বের হতেই হৃদয় সামনে পড়ে।আমার দুই হাত ধরে ফেলে।

“এতক্ষণ লেগেছে কেন বউ তোমার?কাঁদছিলে তুমি?”
“আরেক নাহ।কাঁদবো কেন!?যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হৃদয়কে পাশ কেঁটে বিছানার দিকে আসি।হৃদয় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমি ফের আবার পেছন ফিরি।বলি,

“এখনো দাঁড়িয়ে আছেন?”

ভাবলাম হৃদয় এবার বাথরুমে ঢুকে পড়বে।তা না করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসে।নিষ্পাপ চোখে তাকায় ছোট বাচ্চাদের মতন।
“এই হৃদয়কে তোমার ভরসা হয়না?একটুও ভরসা হয়না?”

ওর ওমন প্রশ্নে ওর চোখের দিকে তাকাই।বলে,
“পারিসা?বাবার ওমন ব্যবহারে আমিও দুঃখিত।বাবার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।তবে,বাবা আমাদের নিয়ে এই বিয়ের মনোমালিন্যটা দেখো একদিন ঠিকই চুকে যাবে।তোমাকে তার বউমা না শুধু,নিজের মেয়ে বলে কাছে টেনে নেবে।কারণ তুমি লক্ষী মেয়ে।লক্ষী মেয়েদের থেকে কেউ কখনো মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না।”

বলে হৃদয় আমার গালে আলতো ছুঁয়ে।আবার বলে,
“কেঁদেছিলে এতক্ষণে, না?তুমি বলো নি।কিন্তু দেখো তোমার চোখের ভাষা আমাকে তাই বলে দিচ্ছে।কেনো কাঁদো তুমি?কেনো?কান্নাটা যে হৃদয়ের বুকের মাঝখানটা জ্বলেপুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে।শুনো আমার মনোকান্না?কেনো আমাকে কষ্ট দাও!কেনো বউ?কেনো?!”

চোখের অশ্রু চেপে রাখতে পারলাম না।অবাধ্য পানি গড়গড়িয়ে আবারো বেয়ে পড়লো!

চলবে……

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩১

চোখের অশ্রু চেপে রাখতে পারলাম না।অবাধ্য পানি গড়গড় করে আবার বেয়ে পড়লো!গালে থাকা হৃদয়ের আলতো হাতটা পানিগুলো পরম স্নেহে মুছে নিল।তারপর কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বললো,
“বউ কাঁদে না আর।শুয়ে রেস্ট নাও।আমি ফ্রেশ হয়ে খাবার নিয়ে আসতেছি।”

বলে হৃদয় আমাকে ছেড়ে বাথরুমে চলে যায়।আমি তাকিয়ে থাকি তার গোপন পথে।চোখের দৃষ্টি হঠাৎ আবেগী হয়ে ওঠে।এই ছেলেটাকে যত দেখছি বরাবরই মুগ্ধ হচ্ছি।এতটা সুন্দর করে মানুষ কীভাবে পারে স্নেহ করতে!কীভাবে পারে সান্ত্বনা স্বর শুনিয়ে তার অপর মানুষটিকে খুব আগলে কাছে টেনে নিতে !এতটা উদার হৃদয়ের কেন মানুষটা?আমি কি পারবো না এই মানুষটির দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে নিতে?সব অতীত,দুঃখকষ্ট,সবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যতা এড়িয়ে এই মানুষটিকে খুব করে ভালোবাসতে?

“বউ মা?”

মনের উল্টাপাল্টা ভাবনার ছেদ ঘটে শাশুড়ী মার কন্ঠস্বরে।মনে মনে নিজেকে ধাতস্থতা করে দরজার দিকে এগিয়ে ছিটকিনি টা খুলে দিই।তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি।উনি আমার হাসির পিঠে কেনজানি হাসলেন না। আমাকে পাঁশ কেঁটে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।আপনাআপনি হাসিটা আমার আবার ঠোঁটে চেপে গেলো।উনি চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বলেন,
“হৃদয় কোথায়?”
“জ্বী মা,উনি ওয়াশরুমে।”
“ওহ।”

বলে উনি আমার দিকে ফেরেন।আমার কাছে আসেন।আমার দুই কাঁধে হাত রাখেন।আমি চমকে ফের উনার দিকে তাকাই।এবার উনার মুখটা কেনজানি খুব মলীন মলীন দেখাচ্ছে।চোখের কোলে কিছু পানি চিকচিক করছে আমি তা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি।উনি বলেন,

“বউমা?তোমার শ্বশুরের কথায় একদম মন বেজার করবে না।আসলে ছেলেটা হঠাৎ উনার অগোচরে কিছু করে ফেললাম তো তাই এ নিয়ে একটু মন খারাপ আর কি।আসলে আমার উনাকে আগে বলা উচিত ছিল বিষয়টা।কিন্তু কেন যে বলি নি নিজেও জানি না।তবে,দেখো পরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।এই রাগ আর থাকবে না।আর রাগ তখন তো একদমই না যখন আমাদের ছোট্ট নাতি-নাতনীটা হাঁটি হাঁটি পায়ে এসে বলবে,দাদ দাদ দাদ..আবার দু দু…।”

উনার শেষ কথাগুলোতে লজ্জা পেয়ে গেলাম।
তবে শাশুড়ী মা বলে কথা লজ্জা জিনিসটা তো আর উনার সামনে দেখানো যাবে না।তাই লজ্জাটাকে ঢাকতে মুখে মুচকি হাসি টানলাম।উনি আবার বললেন,

“খাবার নিয়ে আসতেছি।সকালে কিছুই তো খাও নি,না?”
“নাহ, খেয়েছি মা।”
“মিথ্যা কথা!তুমি কিছুই খাওনি।হয়তো রাতেও খাওনি।কেননা রাতে না খেলে মুখ শুকনো শুকনো দেখায়।তোমাকে তাই দেখাচ্ছে।চেয়ারে বসো তোমার জন্যে এবং হৃদয়ের জন্যে খাবার নিয়ে আসতেছি।”

বলে উনি এক সেকেন্ড দাঁড়ালেন না।বেগতিক পায়ে দ্রুত হেঁটে গেলেন।উনাকে দেখে আজ আমার কেনজানি আমার আগের শাশুড়ী মার কথা মনে পড়ে গেলো!ইনার মতো আমার সেই শাশুড়ী মাও এভাবে কথা বলতেন।তবে,ইনি সম্ভবত একটু রসিক ধরনের।আর উনি গম্ভীর।ধরনের প্রকারভেদ আলাদা হলেও ভালোবাসা,মায়ার দিক দিয়ে দুজনকে এক লাগছে।একদম এক।উনার চোখেও যেই ভালোবাসা দেখেছিলাম।ইনার চোখেও সেই ভালোবাসাটা দেখলাম!চোখে পানি এসে গেলো।ওড়না টেনে দুই চোখ চেপে ধরলাম।বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেয়ে তরতর করে ওড়নাটা নিচে নামিয়ে নিলাম।হৃদয় ওয়ারড্রবের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

“পারু?দাঁড়িয়ে না থেকে বসো।ক্লান্ত তুমি।দাঁড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে তো।”

বলে এলোমেলো চুলের গোছাতে চুলে হাত বুলাতে থাকেন।তবে তার এহেন কথায় বেজার মুখটা মুহূর্তে ফিক করে হেসে উঠে।তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠি,
“এত কেয়ার?নতুন নতুন সবাই এরকম কেয়ার।পরে আবার তাকে অসহ্যকর বস্তুর মতন লাগে।”

আমার কথা শুনে হৃদয়ের চুলের গোছায় হাত থেমে যায়। সরু চোখে তাকায়।তবে ওর চোখজোড়া দেখে আমার কেনজানি ভয় ভয় লাগছে খুব।ওর চোখ জলজ্যান্ত আগুনের মতন দেখাচ্ছে।টুপ করে একটু ছুলেই যেন গরম ধোঁয়া বেরুবে।সে চোখজোড়া নিয়েই আমার দিকে ধীর পায়ে এগুতে থাকে।আমি বড়সড় একটা ঢোক গিলে পিছু হটতে থাকি।ভয়ে বুকটা ধুকপুক করছে।গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।পিছু হটতে হটতে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে যায়।এবার আর উপায় না দেখে বলে উঠি,

“আর এ’কথা বলবো না।প্লিজ?ওই চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকায়েন না।ভয় করে খুব!”

“কান ধরো!”
“কী!কান ধরবো মানে?”
“বলছি কান ধরো!”
উঁচু গলার স্বর।আবারো আরেক দফা ভয় পেয়ে কেঁপে উঠি। কান ধরি।বলেন,
“দশবার উঠবস করবে।”
“কী উঠবসও করতে হবে?”

হৃদয় সেই গরম চোখেই তাকিয়ে।উঠবস না করলেও দেখি এই ছেলে ছাড়বে না আমাকে।মেরেই ফেলবে!মাগোমা এই ছেলের মার খেলে আর দ্বিতীয়বার শ্বাস নেওয়ার নাক থাকবে না।তারচে মারের থেকে উঠবস করাই ভালো। উঠবস করতে যাবো।ওমনি হৃদয় দয়ার ফুরসত খুলে ফেলে।হাত উঁচিয়ে বলে,

“থাক লাগবে না আর কষ্ট করা।এবার বলো ওরকম নীচক কথা আর কখনোই বলবে না!বলো!?”
“আ-আচ্ছা আর বলবো না।”
“হাত ছুঁয়ে বলো!”

বলে ওর ডান হাত মেলে দেয়।আমি আমার কম্পিত হাত ওর হাতে উপর আলতো রাখি।বলি,
“প্র-মি-জ!”

এবার হৃদয় চোখমুখ স্বাভাবিক হয়ে আসে।মুখে আগের মতন সেই রাগ ভাবটা আর নেই।তাকে স্বাভাবিক দেখে বুকে স্বস্তি আসে।লম্বা করে একটা হাঁক ছাড়ি।সে ঘুরে বিছানার দিকে ছুটে যেতে আমি ধপ করে তার ডান হাতটা ধরে ফেলি।ঘুরে তার সামনে পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তার কপালের উপর লেপটানো ভেঁজা চুলগুলোতে চাপ করে একটা চুমু বসিয়ে দিই। আমার এহেন কান্ড দেখে হৃদয় বরাবর বাকরুদ্ধ।সাথে বিস্ময়ের শীর্ষে।আমি বলে উঠি,
“আপনার ডেভিল মুখে তাকিয়ে তখন ভেঁজা চুলের প্রতি অবাধ্য ইচ্ছেটা লুকিয়েছি।এখন ইচ্ছেটা পূরণ করেছি।আহা শান্তি!”

এমন সময় মা রুমে ঢুকেন।প্লেট ভরা খাবার আনেন।তাগাদা করে বলেন,
“হৃদয়কে নিয়ে তাড়াতাড়ি খেতে বসে।বউমা রাত থেকে কিছুই খায়নি।”

“রাতে কিছু খাইনি” কথাটা শুনে হৃদয় বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকায়।আমি মাথা নত করে ফেলি।মা রুম থেকে বেরুবার পরপরই সুযোগ পেয়ে যায় হৃদয় আবারো রফাদফা করতে।হাত চাপড়ে ধরতেই বলে উঠি,

“কালরাত আপনার জন্যে খেতে পারি নি,ডেভিল!”

৪৯.
এভাবে হৃদয়ের সাথে আরো দুই তিনদিন হাসিতামাশা, দুষ্টভরা খুনশঁটি এবং আনন্দে দিনগুলো পার হয়।তবে এরমাঝে আমার শ্বশুর আমার সাথে এক শব্দও কথা বলেনি।আমি উনার রুমে খাবার নিয়ে গেলে উনি বারান্দায় চলে যান।কথা বলতে চাইলে তা এড়িয়ে যান।কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকেন।মোটকথা উনি আমার সাথে কিছুতেই কথা বলতে চাচ্ছেন না।এসব নিয়ে মাঝে মাঝে মনখারাপ হয়েছে। রুমের দরজা বন্ধ করেও বার দুয়েক কেঁদেছিও। হৃদয়ের কথা ভেবে নিয়ে পরক্ষণে নিজেকে আবার ধাতস্থতা করার চেষ্টা করেছি।

৫০.
এখন বিকেল।সন্ধের নাস্তা বানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছি।চায়ের কেটলিটা চুলায় বসিয়ে ডাইনিং এ এসেছি টেবিলটা গোছাতে।টেবিলে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা পিরিচ ছিল সেগুলো রেকে রাখি।গ্লাস ছিল সেগুলোও রেকে রাখি।দরজায় কলিংবেলের বাজে।মা সম্ভবত রুম থেকে বেরুলেন।তিনি আমার পেছনে দিয়ে যেয়ে দরজা খুলে দেন।আমি তখন আরও ওটা খেয়াল করিনি আর সেদিকে।আমাকে হুট করে পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে।পেছন ঘুরে তাকিয়ে হতবাক!মুখ হা করে থাকি।হাসনা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ভাবী?হোয়াট আ সারপ্রাইজ!তোমাদের না জানিয়েই চলে আসলাম।”

আমি হেসে উঠে ওর সাথে নাকে নাকটা ঢলে নিলাম। হৃদয়ের সাথে বিয়ে হবার পর থেকে মেয়েটির সাথে আমার একদিনও দেখা বা কথা হয়নি।আমাদের বিয়ের সেই প্রথম থেকেই শুনেছি তার ফাইনাল পরিক্ষা চলতেছে।পড়ার ভীষণ চাপ।তাই আসতে পারছে না।পরিক্ষা শেষ হলে একবারে আসবে।আজ হয়তো পরীক্ষাটা চুকিয়ে বাসায় ফিরেছে।মেয়েটি নেক্সট বছর ক্লাস টেনে উঠবে।একটা গার্লস হোস্টেলে থাকে।সেখান থেকেই পড়াশুনা করছে।বাসায় রাখে কারণ সে নাকি বাসায় পড়তে চায়না।মেয়েটিকে আমি হৃদয়ের পাঠানো কয়েকটা ফটোতে দেখালম।একদম সিমসাম,শ্যামলা গাঁয়ের রং।বেশ মায়াবী মায়াবী দেখতে।এখন বাস্তবে দেখে তারথেকেও আরো মায়ায় পড়লাম মেয়েটার।গালে হাত ছুঁয়ে বললাম,

“সারপ্রাইজটা বেশ ছিল ননদী।আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।”
“ভাবী,শুনো?কিছু খাবো এখন।প্রচন্ড খিদে লেগেছে।তারপর তোমার সাথে জমিয়ে আড্ডা দেব।”
“আচ্ছা,ঠিক আছে।ফ্রেশ হয়ে আসছি।ভাবী ভাত বাড়ছি।”

হাসনা মাথা নেড়ে এক পা বাড়িয়ে আবার থেমে গেলো।ঘাড় বেঁকে,
“ভাবী ভাইয়া কোথায়?”
“হয়তো বাইরে।”
“কলেজে গেছে আজ?”
“হ্যাঁ।সেই দুপুরের পরই ফিরে এসেছে।”
“এখনো ভাইয়ার আড্ডা গেল না?আসুক আজ বাসায়।নতুন বউ রেখে এখনো আড্ডায় পড়ে আছে?বুঝামু!”

বলে হনহন পায়ে ওর রুমের দিকে চলে গেল।শাশুড়ী মা সেদিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন,

“বউ মা?হাসনা একটু বেশিই মিশুক ধরনেরর।ওর কথায় কিছু মনে করো না।”
“আরেহ নাহ মা!কি মনে করবো!”

চলবে…

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩২

৫১.
আজ হঠাৎ করে আমার মা-বাবা আমার শ্বশুর বাড়িতে আসেন।হাতে করে ফল,মিষ্টি,সন্দেশ,রসমালাই,দই,খির এবং বাহারী পদের জাঙ্কফুড খাবার আনেন।বাপের বাড়ির লোকদের দেখলে মেয়েরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।কি থেকে কি করবে ভেবে পায়না।আমার কেনজানি সেরকম হচ্ছে না।মা-বাবাকে সেই প্রথমে আসার পর “কেমন আছেন”এটুকু বলেই শেষ।তারপর থেকে স্তব্ধ মুখে শাশুড়ী মা বসার সোফার একপাশে দাঁড়িয়ে আছি।আর সবার কথা শুনতেছি।আমার মা খেয়াল করেছেন আমি চুপচাপ।কথা বলার মাঝে বলে উঠলেন,
“পারিসা যে চুপচাপ?মনখারাপ তোর?”

আমি এবার হালকা নড়ে উঠলাম।জোরপূর্বক হাসলাম।বললাম,
“নাহ মা।মনখারাপ কেন হবে।”

পাশ থেকে শাশুড়ী মা বললেন,
“বউ মা?রুনু কি বানাচ্ছে না বানাচ্ছে।তুমি গিয়ে একটু দেখো ত।”

আমি মাথা নেড়ে কিচেনে এলাম।রুনুর ইতোমধ্যে সব ধরনের নাস্তা বানানো শেষ।শুধু লেবুর শরবতটা ছাড়া।রুনু আপাকে লেবু কাটতে বলে আমি আর দেরী না করে জগে পানি ঢেলে নিলাম।লেবু শরবত বানানো শেষ হলে সব হলরুমের টি-টেবিলে জড়ো করলাম।আমার শাশুড়ী মা পরিবেশন করাতে ব্যতিব্যস্ততুর হয়ে যান বাঁধ সাঁধেন।বলেন,
“আপা, বেয়াই সাহেব কোথায়?উনাকে যে দেখতে পাচ্ছি না?”

শাশুড়ী মা বলেন,
“আছে কোথাও।বাইরে হয়তো।”
“ওহ আচ্ছা।তবে বেয়াই সাহেব আমাদের পছন্দ করবেন না।”
বলে বাবা হো হো করে হেসে উঠেন।বাবার কথায় আমার বুকের অতলে কোথাও একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে নিই।শাশুড়ী মা বলেন,
“আরেক নাহ সেরকম কিছু না।আপনার বেয়াই এমনিতেও একটু খিটখিটে স্বভাবের।তাই আর কি।”

তারপর এভাবে সবাই কথা বলতে থাকলেন।হাসনা কোথা থেকে এসে আমাকে টেনে তার রুমে নিয়ে গেলো।বললো,
“ভাবী?একটা কথা বলবো?”
“হ্যাঁ,বল?”
“তোমার চেহারা এবং তোমার মার চেহারা প্রায় সেইম।মা মেয়ে দুজন একরকম দেখতে!আল্লাহ!”
“হ্যাঁ,আমি এবং মা দেখতে একরম।এটা সবাই বলে।”
“তবে একটা দিক দিয়ে বৈসাদৃশ্য ভাবী?”

প্রশ্নসূচক চোখে তাকালাম হাসিনার দিকে।হাসনা হেসে উঠে বললো,
“তোমার বাম পাশের গালে একটা তিল আছে।যা তোমার মার গালে নাই।”
“সেটা অবশ্যি..!”

কথা বলার মাঝপথে থেমে গেলাম।কেননা বাইরের থেকে আমার শ্বশুরের গলার স্বর শুনতে পেলাম।উনি আমার বাবাকে কিছু বলছেন।আমি হাসনাকে পাশ কেঁটে হর্ণপায়ে দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম।কান যুগল ক্ষিণ করলাম স্পষ্টত ওই মানুষগুলোর কথাগুলে শুনতে।আমার শ্বশুর খুব শুকনো গলায় বললেন,
“জ্বী, এতদিন আপনাদেরই খুঁজতেছিলাম।যাক ভালো হলো আজ দেখা হলো।’
” জ্বী,কিছু কিছু বলবেন,বেয়াই সাহেব?”
“অবশ্যই। বলতেই তো বললাম দেখা হলো ভালো হয়েছে।”
“বলুন কী বলবেন?আচ্ছা আগে আপনি বসুন।”

আমার শ্বশুর বসলেন।আমি অবশ্যি আমার শ্বশুরের মুখটা দেখতে পেলাম না কেমন ভঙ্গিমাতে আছে।কেননা আমি উনার পেছনের দিকে।মানে উনি যেখানে বসলেন সেখান থেকে এই রুমটা পেছনমুখী।

“মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তার আগে আপনাদের কি ছেলের বাবার সাথে একবার কথা বলার প্রয়োজন বোধ হয়নি?আচ্ছা কথা বললেন না ভালো কথা সেটা বাদ।অন্তত বলা উচিত ছিল আপনাদের মেয়ের আগে এক জায়গায় বিয়ে হয়েছে।একটা অবিবাহিত ছেলের গলায় কীভাবে পারলেন একটা বিবাহিত মেয়েকে ঝুলিয়ে দিতে?কত স্বপ্ন ছিল আমার ছেলেকে নিয়ে।কত আশা করেছি ছেলেকে নিষ্কলুষ,সামাজিক,ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করাবো।বিয়ে করা বউকে নিয়ে আত্মীয়দের থেকে কোনোরকম খোঁটা শুনতে হবে না।তাদের সামনে মুখ ছোট্ট করতে হবে না।বড় মুখ করে বউকে নিয়ে সবার সামনে দাঁড়াবো।হাসবো কথা বলবো।সেই মুখটা আমার রাখলেন না।আমার সব আশা-ভরসা আপনারা শেষ করে দিলেন!এতটা অবিচার কীভাবে করতে পারলেন?আপনাদের যদি এক ছেলে থাকতো তাহলে আপনারা কি কখনো পারতেন আপনাদের সেই এক ছেলের জন্যে একটা ডিভোর্সি মেয়ে বিয়ে করাতে?!”

আমার চোখ বেয়ে গড়গড় করে অশ্রু বেয়ে পড়লো। এতক্ষণে যা নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম তাই ই হলো।
বুক চেপে ধরলাম।বুক থেকে যেন আগুন বেরুচ্ছে ।পেছন থেকে হাসনা আমার পিঠে হাত রাখলো।আমি স্পষ্ট চোখে দেখতে পাচ্ছি আমার বাবার চোখমুখে খুব হতাশ হতাশ ভাব।তিনি চোখে এঁটানো থাকা চশমাটা এক ঝটকায় চোখ থেকে খুলে ফেললেন।টেবিলের উপর রাখলেন।হয়তো নিজেকে ধাতস্থতা করে বললেন,

“দেখুন?বেয়াই সাহেব?আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু একদম নয়।আমরা ভাবলাম আপনি হয়তো আমাদের পারিসার ব্যাপারটা জানেন।কেননা,পারিসা হৃদয়কে আপনাদের তার ব্যাপারে বলতে অনেকবার বলেছিলো।যেদিন হৃদয় তার আপনার স্ত্রীকে, ভাই-ভাবীকে এবং অন্যান্য আত্মীয়দের নিয়ে আমার স্ত্রীর বোনের বাসায় হাজির হয় এনগেজমেন্ট করতে।সেদিন আমরা বুঝলাম হয়তো আপনারা সবাই জানেন।আর রাজিও।আপনি যে রাজি ছিলেন না তা স্পষ্ট ছিলাম না।কেননা সেদিন আপনি গ্রামে ছিলেন।আর হ্যাঁ,বিয়েটা হতো না।হৃদয়ের তাড়াহুড়োর কারণেই হয়েছে।আর আপনি যে বললেন আপনার ছেলের জন্যে নিষ্কলুষ একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করাতেন!আপনি কি জানেন?আমার মেয়ে অভি,মানে পারিসার প্রথম স্বামীর সাথে একদিনও সংসার হয়নি?”

আমার বাবার মুখে শেষ কথাটা শুনে হৃদয়ের ভাবা বৈচিত্র্য ভঙ্গিমায় হেসে উঠলো।চোখের চশমা চোখ থেকে নামলো।বললো,
“হৃদয়ও আমাকে এই কথা বললো।বড়ই হাস্যকর কথা!আটমাস সংসার করার পরও বলছেন সংসার করে নাই?তা তার সংসার টা কি এলিয়েন এসে করলো আপনার মেয়ের বদৌলতে?নাকি কোনো পিশাচ!”

শাশুড়ী মা বলেন,
“দয়া করে তুমি একটু চুপ করো!আল্লাহর দোহাই লাগে!”

হৃদয়ের বাবা ওমনি শাশুড়ী মার দিকে হাত উঁচিয়ে থামতে ইঙ্গিত করেন।শাশুড়ী মা চুপ করেও থাকতে পারছেন না।মুখটা আরো কিছু বলতে উসখুস করে উঠে।পরক্ষণে হৃদয়ের অগ্নিশর্মা চোখে বলেন,
“চুপ করো দিলওয়ার তুমি!”

কথার গতি একটু উঁচুই ছিল।শাশুড়ী মা চুপ হয়ে যান!মুখটা অন্যদিকে ফিরে রাখেন।হয়তে কেঁদে দিয়েছেন।আমার বাবা শুধান,
“সংসার বলতে আপনি ভুলটা বুঝলেন।আমার মেয়ে অভির ফ্যামিলি,অভিদের সংসারের সব সামলাতে।তবে যার সাথে বিয়ে হয়েছে তারসাথে কখনো আমার মেয়ের কথা হয়নি।!মেলামেশাও হয়নি!আর আমাদের ফ্যামিলি, আমাদের মেয়ে কেমন তা একটু ভালো করে খুঁতিয়ে দেখার আপনার প্রতি আমার অনুরোধ রইলো, বেয়াই সাহেব।”

“দেখেছি।জেনেছি সব।আপনার মেয়ে ভালো।ফ্যামিলি ভালো।তবে কথা হলো, ডিভোর্স হয় কীভাবে?ডিভোর্স হবার পেছনে অবশ্যই অবশ্যই না কারণ ছিল!”
“জ্বী,ছিল।ভুল বোঝাবুঝি ছিল।দেখুন বেয়াই সাহেব,আমার মেয়ের প্রথম স্বামী মেয়েকে প্রথম থেকেই ভুল বুঝেছিলো মিথ্যে কিছু কথায়,আর মিথ্যে কিছু প্রমাণে।ভুল বুঝার পর মেয়ের সাথে ওই ছেলের অনেক মিসআন্ডার্সটেন্ডিং হয়েছিলো।মেয়ে তাকে বহুবার বুঝানোর চেষ্টা করেছিল।কিন্তু সে বুঝে নি।তারপর মেয়ে উপায় না পেয়ে আটমাস পর আমাদের বাড়ি চলে আসে।আমরাও মেয়েকে বুঝি নি।মেয়েকে আমরাও দোষ দিয়েছি।আসলে আমার মেয়ের কোনো দোষ ছিল না।দোষ ছিল ওই ছেলের যেই অন্য লোকের কথায় আমার মেয়েকে অবিশ্বাস করেছে কোনোকিছু না বিচারবিবেচনা করে।পরে ছেলে তারজন্যে অনুতপ্তও হয়।আমার মেয়ের কাছে মাফ চাইতে আসে।আমার মেয়ে ক্ষমা করেনি।ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়।আমি জানি না আপনি এসব বিষয় জানেন কিনা।যদি না জানেন হৃদয়ের আশা করি সব জানতে পারবেন।”

“আমার জানতে হবে না কিছু আর।এরকম বাহানা দেবার ইস্য বহুৎ দেখেছি।সর্বশেষ এটুকুই বলবো আমার মনে যেহেতু আপনারা,আমার স্ত্রী এবং আমার ছেলে আমার মনে অনেক বড় আঘাত দিয়েছে আমি আপনাদের মেয়েকে আমার পক্ষ থেকে বউ হিসেবে সমথর্ন দেব কিনা জানি না।ভালে থাকবেন।”

বলে হৃদয়ের বাবা তনহন বসা থেকে উঠে নিজের রুমের দিকে চলে যান।আমি দরজা থেকে সরে বেলকনিতে চলে যাই।শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা দুইহাতে চেপে ধরি!ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি।কিছুক্ষণ এভাবেই চলতে থাকে।হাসনা আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।কিছুতেই পারছি না।কীভাবে শান্ত হবো আমি?কীভাবে?আমি যে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি হৃদয়কে বিয়ে করে!হৃদয়ের বাবার মানসম্মান,আমার মানসম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছি!আবারো অস্ফুট কেঁদে উঠলাম।এমন সময় পেছন থেকে,

“পারিসা?”

আমার মার গলার ধ্বনি।দ্রত চোখের পানি মুছে নিলাম।নিজেকে ধাতস্থতা করে পেছন ফিরে মার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম।পরে দেখি মার পেছন পেছন বাবাও এলেন।মা কিছু না বলে আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলেন।কেমন ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলো উঠলেন,

“ভালো থাকিস,মা।যে যাই বলুক চুপ করে থাকিস।আল্লাহর দিকে তাকিয়ে ধৈর্য্য ধরিস।
পরের বাড়িটা বড্ড কঠিন রে মা!বড্ড কঠিন।”

বলে মা আমাকে আরো চেপে ধরেন।বাবা পেছন থেকে বলেন,
“দেরী হয়ে যাচ্ছে।চলো।”

মা আমার কাঁধ থেকে মাথা তুললেন।চোখের কোণে হয়তো পানি জমেছে।তা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলেন।বললেন,

“আসি রে, মা।গেলাম।ফোন করিস।”

আমি স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম।মা যে চলে যাচ্ছে একটা শব্দও বের করতে পারলাম না।!নড়তেও পারলাম না!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here