আমার_অপ্রিয়_আমি,পর্বঃ৮

আমার_অপ্রিয়_আমি,পর্বঃ৮
রিলেশন_সিরিজ
Ipshita_Shikdar(samia)

শ্যাম্পেইনের মাদকতার মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে অন্ধকারচ্ছন্ন ঘরটায় বসে আছে এক আধুনিকা। পড়নে তার কালো জাম্পসুট, চুলগুলো আলুথালু, লেপটানো মেকআপ, চোখজোড়া সম্পূর্ণ বেদনাময় সবমিলিয়ে এক বিধ্বস্ত নারী। সে ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে শুরু করলো তার অতিত,

সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে ধারণা তখন শূণ্য, বস্তুত জীবনটা উপভোগ করাতেই ব্যস্ত আমি। তবুও প্রেম-ভালোবাসায় কৌতুহল ছিলো ধারণাতীত। এই কৌতুহল থেকেই হয়তো আমার জীবনসুধায় আগমন ঘটেছিলো তার…

কলেজের পাশেই ছিলো ভার্সিটি। যার পরিবেশটা অত্যন্ত মনোরম, গাছগাছালি এবং পুকুরও ছিলো। তাই প্রায়শয়ই কলেজ শিক্ষার্থীরা সেখানে যেতো সময় কাটাতে এবং আড্ডা দিতে। একদিন আমিও গেলাম বন্ধুদের সাথে… পুকুরের দিকে যাওয়ার সময় পায়ের নিচে কিছু থাকায় স্লিপ করে পুকুরে পড়ে যাই। বলা বাহুল্য সাঁতার সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছিলো না আমার এমন কি এখনও নেই। তাই পুকুরে পড়ার খাণিক বাদেই মনে হচ্ছিলো সেই গভীর পানির অতলে ডুবে যাচ্ছিলাম। তখনই এক সুদর্শন যুবক আমাকে পানির মাঝেই বুকে টেনে নেয়। আমি টলমলে চোখে শুধু দেখলাম তার ছোট ছোট মায়াবী নয়নযুগল।

কে বলেছে শুধু পুরুষই নারীর চোখে তার সর্বনাশ দেখে কিংবা নারীই শুধু সর্বনাশী? নারীও যে পুরুষের চোখে নিজেকে ডুবিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। কোনো এক মধুময় লগ্নে পুরুষও তো নারীর জন্য সর্বনাশা।

জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে কারো বাহুডোরে আবিষ্কার করলাম। খেয়াল করে দেখলাম যার চোখজোড়ায় মুগ্ধতার বন্ধনে আমি বন্দিনী হয়েছিলাম সেই ছেলেটিই আমাকে তার বুকে ঠাই দিয়ে রেখেছে। আমার জ্ঞান ফিরতেই সে একজনকে বলে উঠলো,

— নিশাত, আমাকে পানি দে তো! একটু খায়িয়ে দেই তাহলে লো লাগবে মেয়েটার।

ছেলেটাকে একজন মেয়ে পানির বোতল দিতেই সে বোতলের ক্যাপ খুলে আমার ঠোঁটের কাছে তা এগিয়ে দেয়। আমিও সম্মোহিতের মতো তা পান করে যাচ্ছি। ছেলেটা চোখজোড়ায় গম্ভীরতার ছাপ এনে রাগান্বিত স্বরে বলতে লাগলো,

— এই মেয়ে দেখেশুনে চলতে পারো না নাকি! আরেকটু হলে তো সোজা পরপার চলে যেতে… হাঁটার সময় মন কোথায় থাকে, হ্যাঁ? দেখে তো মনে হচ্ছে কলেজ স্টুডেন্ট তা এটুকো সেন্স নেই। আজকালকার ছেলেমেয়েদের এই এক সমস্যা কোনো কাজে সামান্য কমনসেন্স টুকু থাকে না বা আমার কিছু হলে বাবামার কি হবে এই সেন্সও থাকে না! যত্তসব!

ছেলেটা আপনমনে আমাকে বকে চলেছে কিন্তু তাতে আমার কি! আমি তো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই মায়াবী ও মুগ্ধকর চোখজোড়ায়। হয়তো ডুব দিয়েছিলাম তার নয়নযুগলের মায়ার সাগরে আর সাঁতার না জানায় তলিয়েই যাচ্ছিলাম তখনই সে আমার হাত হালকা ঝাঁকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো,

— ঐ কোনদিকে ধ্যান দিয়ে বসে আছো, হ্যাঁ? আমি এতক্ষণ যা যা বলেছি তার একটাও কানে নাওনি। আজকালকার পোলাপাইন এত্তো বেয়াদব যে বলার বাইরে…

আমি মাথা নিচু করে তার বকা শুনছি। পাশে তাকিয়ে দেখি আমার বন্ধুবান্ধব এক কোণে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছে। যা দেখে আমি বুঝতে পারলাম তারা এখানে আসতে ভয় করছে। তবে আমার ভয় লাগছে না বরং ভালো লাগছে এই শাসনগুলো। আসলে ছোটবেলা থেকে বাবামায়ের কাজের ব্যস্ততার জন্য তাদের শাসন বা ভালোবাসা তেমন একটা পাইনি। আর যাদের থেকে কিছুটা পেতাম তাদের সঙ্গও ছাড়তে হয়েছে বাবামায়ের চাকরির জন্য। তাই ইচ্ছে নয়, স্বপ্ন আমার জীবনে এমন কারো থাকার যে আমাকে এই ভালোবাসাযুক্ত শাসনগুলো করবে…

যখন এসব আকাশকুসুম ভাবছিলাম তখনই এক ছেলে পাশ থেকে বলে উঠে,

— কাব্য ছাড়তো মেয়েটাকে! বাচ্চা মানুষ ভুল করে ফেলেছে তাই এবারের মতো ছাড় দাও। তাছাড়া ইচ্ছে করে তো আর করেনি… মানুষ মাত্রই তো ভুল।

— হুম, এই মেয়ে যাও তুমি। পরবর্তী সময় থেকে সাবধান থাকবে কারণ সবসময় কেউ এসে পড়বে না তোমাকে বাঁচাতে। এটা জীবন কোনো মুভি বা গল্প নয়।

আমিও মাথা নিচু করে সায় জানিয়ে ভিজে কাপড়ে চুপচাপ উঠে চলে গেলাম বন্ধুদের কাছে। তাদের মধ্য থেকে সায়ন আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো… ভার্সিটির গেট পেড়িয়ে বের হবো এমনসময় যা শুনলাম যে সব প্রেমানুভূতির জায়গা দখল মুঠোভরতি রাগ।

— দেখ! দেখ! এ বয়সেই কেমন ছেলে বন্ধুদের নিয়ে চলাফিরা করে। এসব উচ্ছৃঙ্খল মেয়েদের সাথে থেকে আরও মেয়েরা খারাপ হয় আর বদনাম হয় সম্পূর্ণ নারী জাতি।

আমি ধীর পায়ে সেই ব্যক্তিটির দিকে এগিয়ে যেয়ে বললাম,

— আপু উপস্ কিছুক্ষণ আগে আপনি ‘আপু’ ডাক শোনার যোগ্যতা হারিয়েছেন। সে যাই হোক আপনি তো আমার চরিত্রকে এবং আমাকে খুব সাবলীলভাবে বর্ণনা করলেন। তাহলে এখন আমার প্রশ্ন হলো, আপনি কি আমাকে চিনেন? যদি না চিনে থাকেন তাহলে আমার ক্যারেকটার নিয়ে কথা বললেন কি করে বা আমি কেমন তা বললেন কি করে?

— এতো চেনাজানা লাগে নাকি মানুষের আচারব্যবহার দেখেই বোঝা যায়। যেভাবে ছেলেটার হাতে হাত রেখে হাঁটছো আবার আশেপাশে আরও ছেলেপেলে।

— ওহ! তাহলে তো আপনি পুরো একজন অন্তরগামী। তবে যে সে অন্তরগামী নয় হাতুড়ি অন্তরগামী। মানে হাতুড়ি ডক্টোরের মতো আর কি! যার যোগ্যতা নাই ৫ পয়সার কাজ করার অথচ ভাবটা এমন যেনো সারা রাজ্যের দায় তার উপর।

— ইউ বিচ!

কথাটা শুনে নিজের রাগ আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম চর দিয়ে বসলাম তার গালে। আর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম,

— মেয়ে তোর সাহস তো কম না একে তো ইশানি চৌধুরীর চরিত্রে আঙ্গুল উঠাস আবার আমাকে গালি দিস। এই চোখ নামা নাহলে এই চোখজোড়া আমি আমার পোষা কুকুরকে খাওয়াবো! তুই দেখিসনি আমি পুকুরে পড়েছিলাম এন্ড আই এম সিক সো আমাকে তো ধরেই নিতে হবে কারো না কারো। আর বাকি রইলো অন্যদের কথা তারা আমার ফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড না। মানে ছেলেমেয়ে একসাথে দেখলেই কুচ তো চাক্কার হে। আরে মেয়ে তারা তো ভাইবোন, কাজিনস্, আর এই জামানায় ফ্রেন্ডস্ও হতে পারে। তুই জাস্ট তোর নাম বল এই ভার্সিটি থেকে যদি এক্সপেল করিয়েই আমি দম…

মেয়েটা মাথা নিচু করে আমার কথাগুলো শুনছে। আমি আরও কিছু বলবো তার আগে কাব্য এসে আমার হাত ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে বলে উঠলো,

— মেয়েটা তো ভুল কিছু বলেনি। এতোগুলো ছেলে নিয়ে চললে প্রত্যেকেই তোমাকে খারাপ বলবে। পার্থক্য কেউ আড়ালে কেউ সম্মুখে কিন্তু জানবে সবাই খারাপই। কারণ কারো এতো সময় নেই যে তোমাকে নিয়ে গবেষণা করবে তোমার সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য। তারা প্রথমত যা দেখবে তা থেকেই ধারণা নিবে তুমি কেমন। এজন্যই বলা হয় ফাস্ট ইমপ্রেশন ইজ দ্যা লাস্ট ইমপ্রেশন। ইন শর্ট তুমি মদের গ্লাসে মদ খাও আর কোকাকোলা তোমাকে মানুষ মদখোরই মনে করবে। তাছাড়া এতগুলো ছেলের সাথে মিশা মুসলিম মেয়েদের বা কোনো ভদ্র ফ্যামিলির মেয়েদের নিদর্শন নয় হয়তো তোমার নিয়ত নেক তবে তাতো মানুষ দেখবে না। যাই হোক অনেক সিনক্রিয়েট হয়েছে তুমি এখন যেতে পারো।

আমি ততক্ষণে কাব্যর কথাগুলোর মাঝে যেনো হারিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ এতো সুন্দর ভাবে কেউ কোনোদিন আমায় শাসন করেনি কিংবা বোঝায়নি। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে সেখান থেকে বচলে গেলাম। যাতে তার জীবনে সম্পূর্ণরূপে ঠাই পেতে পারি।

তারপর থেকে প্রায়শয়ই মেয়ে বান্ধুবীদের নিয়ে সেখানে আড্ডা দিতে যেতাম, অবশ্য আড্ডা তো শুধু বাহানা ছিলো তার মুখশ্রীর দর্শন। আমি কথার মাঝেই তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম তবে আড়চোখে নয় সরাসরি। কারণ ভালোবেসেছি তো প্রকাশের জন্যই লুকিয়ে রাখার জন্য নয়। সেও বিষয়টা খেয়াল করে মৃদু হাসতো কিন্তু কিছু বলতো না। তাই একদিন সাহস করে তার ফোন নম্বরটা চেয়েই বসলাম আর সেও বিনা প্রশ্নে দিয়ে দিলো। রোজ কথা বলতাম আমরা, কখনো ফোন কলে তো কখনো মেসেজে। একদিন না কথা বললে যুগ পেড়িয়ে গিয়েছে বিরহের। ধীরেধীরে সেও আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিলো তা আমি তার আচারণেই বুঝতে পারতাম। একদিন ভেবেই ফেললাম তাকে নিজের মনে কথা জানাবো।

কালো রংয়ের গাউন, মেসি বান, আর কানে ডায়মন্ডের কানের দুল পড়ে তৈরি হয়ে মিনার গার্ডেনে বসে আছি। হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপও আছে। কাব্যকে গতকাল রাতে কল করে বলে দিয়েছিলাম এখানে এসে আমার সাথে এখানে দেখা করতে। দূর থেকে এক যুবককে এদিকে এগুতো দেখছি। হুম, আমার প্রিয়তমই আসছে তাই আড়ালে চলে গেলাম। সে গার্ডেনের মিডেল বেঞ্চির সামনে দাঁড়িয়ে আশেপাশে আমাকে খুঁজছে কারণ আমি আমার অবস্থান সেখানেই বলেছিলাম। আমি হঠাৎ করে এসেই তার সামনে হাটু গেড়ে বসে বলতে শুরু করি,

— কাব্য আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। আমি ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে কিংবা কবিতাময় করে কথা বলতে পারি না তাই সোজাসাপ্টাই বলছি। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ছোটবেলা থেকে বাবামায়ের ভালোবাসা, আদর, যত্ন ইত্যাদি ছাড়া বড় হয়েছি। এর কারণ ছিলো তাদের ব্যস্ততা এবং আমার প্রতি উদাসীনতাও হয়তো। তাই এসবের জন্য জীবনের প্রতিটা মুহূর্তেই তৃষ্ণার্ত ছিলাম আমি। অথচ তুমি কিছুদিনেই আমার জীবনকে কতটা সুখকর ও তৃপ্তিকর করে দিলে। তাই প্রেম নিবেদন নিয়ে এলাম তোমার সম্মুখে। ফিরিয়ে দিয়ো না আমায় নাহলে যে সব পেয়েও হারিয়ে বসবো!

— দেখো এটা সত্য আমার তোমাকে ভালো লাগে, বড্ড পছন্দ করি তোমায়, অনুভূতিও আছে তোমায় নিয়ে। তবে ভালোবাসি কিনা তা ঠিক জানি না। তাই কি করে…

কাব্যকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আমি তার ঠোঁটজোড়া এক আঙুল চেপে ধরে বললাম,

— অনুভূতির বীজ যেহেতু রোপণ করতে পেরেছি ভালো যদি নাও বাসো আমি ঠিক তোমার মনে আমার জন্য ভালোবাসা তৈরি করে নিবো। তবে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না। কারণ তুমি যে আমার শূণ্য কুটিরে একরাশি আশার আলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here