আঁখির আড়ালে,পর্বঃ-০৩
সাদিয়া_সৃষ্টি
আরেকটি নতুন সকাল। বিহানের জন্য শান্তিপুরে তার ২য় দিন। গ্রামে হুটহাট বৃষ্টি, আবার বৃষ্টির পর প্রচণ্ড রোদ দেখেই যেন একদিন কেটে গেল। তারিখ মনে করার চেষ্টা করেছিল একবার। কিন্তু বাংলা পঞ্জিকার তারিখ সে কখনোই দেখেনি। যার জন্য সময়টা আন্দাজ করতে পারল না। এই যেমন গতকাল কড়া রোদের মুখোমুখি হয়েছিল। আর তারপর রাতে একটানা বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির রেশ সকালেও কাটে নি। এখনো দেখে মনে হচ্ছে কিছু সময়ের মধ্যে মাগরিবের আযান দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আসলে সময়টা সকাল। সূর্যের দেখা না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। আজ কি তাহলে গ্রামটা ঘুরে দেখা হবে না? সেই কাজল কালো চোখ… নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো। মাথা জোরে জোরে এদিক ওদিক নাড়িয়ে মাথা থেকে চোখ সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। আগের চিন্তা আবার ভাবার চেষ্টা করল। কত তারিখ হতে পারে। কিন্তু কোন ভাবেই মেলাতে পারল না। পারবে-ই বা কি করে? সেজন্য সেই সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান থাকতে হবে, যা বিহানের এই পর্যন্ত এক বিন্দুও নেই। তাই বেশি না ভেবে বর্ষাকাল ধরেই বিছানা ছাড়ল। ঘুম থেকে ওঠার পরও কারো দেখা মেলে নি। রবির অপেক্ষা করছিল। ভেবেছিল আজও হয়তো সকালে দেখা করতে আসবে। কিন্তু সে আসে নি। তাই নিজেই উঠে পড়ল। হাতে গামছা নিয়ে কলপাড়ে চলে গেল। হাত মুখ ধুয়ে আশেপাশে তাকাল। গতকাল-ই বিহানের সুবিধামত থাকার সব ব্যবস্থা রবি করে দিয়েছে। বিহানের জন্য যাবতীয় সামগ্রী কিনে দিয়েছে। তবে সমস্যা ওই এক জায়গায়, লুঙ্গি। বারবার মনে হচ্ছে খুলে পড়ে যাবে। এক হাত দিয়ে ধরে রাখাও অদ্ভুত দেখায়। তাই ধরতেও পারছে না, আবার ছাড়তেও পারছে না এমন একটা অবস্থা। রাতে তো ঘুম-ই আসছিল না তার এই ভয়ে যে সকালে উঠে যদি দেখে লুঙ্গি জায়গা মতো নেই। কিংবা অন্য কেউ ঘরে চলে আসলো। মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে তখন। তাই অনেক ভেবে দুই পায়ের মাঝে নিচের লুঙ্গি কোনা করে ধরে গিঁট বেঁধেছিল। কিছু না হোক, খুলবে না অন্তত। কিন্তু পরেও ভরসা হচ্ছিল না বলে চাদর চেয়ে এনেছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে চাদর নেই ঠিক জায়গায়। ভাগ্যিস লুঙ্গিতে গিঁট বেঁধেছিল।
খাবার খাওয়ার সময় মকবুল মির্জার কাছ থেকে জানতে পারল যে রবি কাজের জন্য শহরে গিয়েছে। মকবুল মির্জা এও বললেন যে তার আরেক ছেলে আসবেন দুপুরে। কিছু দরকার পড়লে যেন তার সাথে কথা বলে। বিহান সম্মতি জানিয়ে খাওয়ায় মন দেয়।
অপিরিচিত জায়গায় সঙ্গিহীন হওয়ার কারণে এক ঘরে বসে থাকার মতো ছেলে বিহান না। তাই খাওয়া দাওয়া করে ঘরে পায়চারী করেছে বেশ কিছু সময়। কয়েকবার লুঙ্গি ঠিক করেছে। কাজ না পেয়ে শুধু পায়চারী করেও সময় কাটাতে পারছিল না। খাওয়ার আগে মকবুল মির্জাকে জিজ্ঞেস করেছি গাড়ি ঠিক হতে কত সময় লাগবে। মকবুল মির্জা বলেছিলেন, যে গাড়ি ঠিক করে সে শহরে গিয়েছে। তার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিহান কিছু না বললেও মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিল। যে কাজের জন্যই এখানে আসুক বা আটকে পড়ুক, একবার যখন আটকে পড়েছে, ঘোরা তো হবে। সেটাই ভালো। তাই শেষমেশ ঠিক করল গতকাল যে বাচ্চা ছেলেগুলোর সাথে পরিচয় হয়েছিল, তাদের সাথেই ঘুরবে দরকার পড়লে। যেই ভাবা সেই কাজ। লুঙ্গি আবার ঠিক করে দে দৌড়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। মকবুল মির্জার বাড়ি থেকে কিছু দূর যেতেই সামনে পড়ে চায়ের দোকান। সেখানে কিছু সমবয়সী ছেলেদের দেখে তাদের সাথেই বসে পড়ল। অনেক ধরণের কথা তুলে প্রথমে সখ্যতা গড়ে তুলল। কিছু সময়ের মধ্যে সফল ও হলো নিজ কাজে। তাদের কাছ থেকেই জানতে পারল মকবুল মির্জা সম্পর্কে। তার ৩ ছেলে সম্পর্কে। বড় ছেলে রবি মির্জা, মেজ ছেলে শাকিল মির্জা আর ছোট ছেলে মুন্না মির্জা। মকবুল মির্জা গ্রামের সবার কাছে কেমন সেটাও জানতে পারল। তবে কিছু অবাক হওয়ার মতও কথা শুনল। যেটা শুনে সন্দেহ নামক অনুভূতি তার মস্তিষ্কে হানা দিল। বিশেষ করে গতকাল থেকেই লক্ষ্য করেছে গ্রামটা। একেবারেই আলাদা। মকবুল মির্জা কি কাজ করেন এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারল না। যার জন্য ওই সন্দেহ আবার চেপে বসল বিহানের মাথায়। ইচ্ছা করল গোয়েন্দাগিরি করতে। কিন্তু পরবর্তীতে এই গ্রামের জন্য মকবুল মির্জার অবদানের কথা শুনে সেসব চিন্তা বাদ দিল। আশেপাশে তাকিয়ে আবার উঠে দাঁড়াল। ওর সাথে সাথে আরও কয়েকজন উঠে দাঁড়াল। বিহান ঠিক করল তাদের সাথেই ঘুরবে। আগের দিন রবি এদিক ওদিক যেতে দিচ্ছিল না। বিহানের মনে হচ্ছে রবি শুধু কিছু নির্দিষ্ট জায়গায়-ই তাকে ঘোরাচ্ছে। তাই আজ সব জায়গায় ঘুরবে যতক্ষণ না শাকিল ফিরে আসে। দেখা যাবে শাকিল ও তাকে সব জায়গায় যেতে দিচ্ছে না। আর কৌতূহল জিনিসটাকে বিহান একদম-ই দমিয়ে রাখতে পারে না। ছোট থেকেই অজানাকে জানার অপার আকাঙ্ক্ষা থেকে সে যেন হয়েছে ভবঘুরে। সব কিছু জানতে চায়। আর কিছু জানতে না পারলেই সন্দেহ করে। আর তার ষষ্ট ইন্দ্রিয় যেন তাকে জানান দিচ্ছে এই ঘোরাটা তার জন্য রোমাঞ্চকর হবে। সাথে বন্ধুবান্ধব থাকলে যদিও আরও ভালো লাগত। তবে তাদের সাথে যোগাযোগ করা তো আর সম্ভব না।
__________
রাগে কড়মড় করছে দিশা। গ্রামের মানুষদের মন থেকে রুমির জন্য খারাপ চিন্তা গুলো যেন জাচ্ছেই না। নিজের বাড়ির মেয়ে বউ দের আর ছেলেদের কানেও রুমিকে নিয়ে খারাপ চিন্তা ঢোকাচ্ছে যেন। এর আগেও শাসিয়েছে সে। কিন্তু কোন কাজে দিচ্ছে না। দিশার ইচ্ছা করছে রাগে সবাইকে একটা শাস্তি দিতে। কিন্তু যেই শাস্তির কথা মাথায় এসেছে সেটা সে চাইলেও দিতে পারবে না। বলির পাঠার মতো করে তো চাইলেই আর সব মানুষের ধড় থেকে মাথা আলাদা করতে পারবে না এক কোপে। কিন্তু এদের বোঝানোও সম্ভব হচ্ছে না। এর বদলে আরেক চিন্তা আসলো তার মাথায়। সব গুলোর বাড়িতে কোন না কোন ছেলে পাঠিয়ে রুমির মতো অবস্থায় ফেলতে। তারপর বুঝবে যে কাজটা করে নি সেই কাজটার জন্য শাস্তি পেলে কেমন লাগে। কিন্তু পুরো গ্রামের মানুষের বাড়ি আর কয়টা ছেলেকেই পাঠাবে? এমনিই গ্রামের বড়রা তার সাথে সবাইকে মিশতে মানা করে দিয়েছে। তবুও বাচ্চারা আর সমবয়সীরা যেটুকু কথা বলে, সময় কাটায়।
বিহান যাওয়ার পথে আবার ওই বাড়ির সামনে এসে পড়ল। অবশ্য পড়ার-ই কথা। বাড়িটা একেবারে গ্রামের মাঝ বরাবর। আর গ্রাম ঘুরতে গেলে ওই রাস্তা দিয়ে বেশির ভাগ সময় যাওয়া হয়। তাছাড়া গ্রামের প্রান্তের রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কেউ গত ২-৩ দশকে ওই রাস্তা ব্যবহার করেনি। গ্রামের রাস্তা হওয়ায় সেটাকে অশরীরীদের আবাস বলা হয়েও থাকে। তাই, বিহান সেই রাস্তার পথ সম্পর্কে এখনো অবগত নয়। চেনা জায়গা দিয়ে ঘোরাফেরা করছে অন্যদের সাথে। দিশার বাড়ির সামনের দৃশ্য একই রকম। উঠোনে বাচ্চাদের সাথে খেলা করছে। আবার হঠাৎ করে খেলা বাদ দিয়ে বসে পড়ছে। আবার হুট করেই খেলার মাঝে ঢুকে পড়ছে। বিহানের হাসি পেল। খেলার মাঝে যখন তখন উঠে পড়তে আজ পর্যন্ত কাউকে দেখেনি। এমন বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে খেললে তো সেই খেলা শেষ হতে কয়েক দিন ও লেগে যেতে পারে। বিহান একবার কল্পনা করল। কানামাছির বদলে দিশা ঘোড়দৌড় খেলছে। উত্তেজনায় পরিপূর্ণ একটি মুহূর্ত। এমন সময় দিশা ঘোড়া থামিয়ে এক কোণে গিয়ে বসে পড়ল। চুলোয় যাক প্রতিযোগিতা, আমি বিশ্রাম নিব- এমন এক মুহূর্ত। সে ইশারা করে কিছু বাচ্চাকে নিজের কাছে ডাকল। বিহানের ডাকে ৫ তা ছোট ছোট মেয়ে খেলা ছেড়ে তার কাছে চলে এলো। তাদের মুখে হাসিরঝলক। যেন বিহানের সাথে দেখা করে বেশ খুশি তারা। বিহান সবার মাঝে থেকে বলে উঠল,
— তোমরা এখ কি করছ এখানে? অন্যদের তো দেখলাম, স্কুলে গিয়েছে সবাই। তোমরা যাও নি?
— আমরা তো স্কুলে যাই না।
— কেন?
— আপনি যাওয়ার সময় কোন ছেলেকে স্কুলে যেতে দেখেছেন?
— না। দেখিনি।
— আমাদের গ্রামে শুধু ছেলেরা স্কুলে যায়, মেয়েরা যায় না। শুধু দিশা বুবু-ই স্কুলে গিয়েছে আমাদের গ্রামের মেয়েদের মধ্যে থেকে। চাচা নিজেই পরিয়েছে বুবুকে।
বিহান অবাক হলো। একটা গ্রাম, যেখানে ছেলেরা স্কুলে যায় কিন্তু মেয়েরা যায় না। তবে শুধু দিশা একাই স্কুলে গিয়েছে। দিশাকে ছেলেদের সাথে স্কুলে পড়ার কথা কল্পনা করে বিহান একটু নড়ে উঠল। একদিনের পরিচিত মেয়ের জন্য অদ্ভুত সব অনুভূতি হানা দিচ্ছে বিহানের মনে। নিজেকে সামলে রাখা দায় হয়ে পড়েছে যেন। কিন্তু তার এখন দিশাকে জানতে চাওয়ার ইচ্ছা প্রবল। কি এমন আছে এর মধ্যে যে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ এর থেকে দূরে থাকতে বলছে? কেন ওর সাথে মিশতে দিচ্ছে না কেউ?
দিশা খেলার সময় খেয়াল করল বাচ্চাদের কোলাহল কমে গিয়েছে। অনেকক্ষণ দৌড়েও কারো নাগাল পাচ্ছে না। তাই নিজের চোখে বাঁধা কাপড় সরালো এক টানে। সামনে বিহানকে বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে দেখে বেশ রেগে গেল। একেই তো আগে রাগ ছিল। সেটা কমানোর জন্য খেলতে এসেছে। এখন এই ছেলেটা তাকে খেলতেও দিচ্ছে না। যেটা তার রাগকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সে তেড়ে বিহানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কোমরে দুই হাত রেখে রাগী গলায় বলল,
— কি হচ্ছে এখানে?
বিহান কারো আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকাল। দিশাকে এতো কাছ থেকে দেখে সে আবার কেঁপে উঠল। আজকাল কাপাকাপির স্বভাব বেড়েই চলেছে যেন বিহানের। এতো কাপাকাপি করলে দিশার সম্পর্কে জানবেই বা কি করে?
— কি হলো? কথা বলছেন না কেন?
— ওদের সাথে কথা বলছিলাম।
— আর মানুষ পেলেন না?
— কেন? কি হয়েছে?
— আমি তো ওদের সাথে খেলছিলাম।
— আপনি তো একেবারে ১০ বছরের বাচ্চা, যে খেলছেন।
বিহানের কথায় বাচ্চাগুল হেসে ফেলল। দিশা রেগে বলে উঠল,
— আমি ১০ ক্লাস পাশ করেছি, আপনি আমাকে বাচ্চা বললেন কি করে?
— তাহলে যা বলব সেটা করতে পারবেন?
— বলে দেখুন।
— আমাকে গ্রাম ঘোরানোর দায়িত্ব আপনার এখ থেকে জতদিন আমি এখানে আছি।
— মানে?
— বলেছিলাম আপনি বাচ্চা মেয়ে, এসব পারবেন না?
— দেখিয়ে দেবো। বলুন কোথায় ঘুরবেন?
— কিছুক্ষণ আগেই তো বললাম, আপনাদের পুরো গ্রাম ঘুরব।
— চলুন, কোথায় যাবেন? আমিও দেখি। পারি কি পারি না।
বিহান তো দিশার এই কথা শুনে মনে মনে একবার লুঙ্গি ধরে নেচে নিল। এতো দ্রুত যে দিশার সাথে ঘুরতে পারবে সেটা সে ভাবেও নি। এখন দিশার সাথে বেশির ভাগ সময় থাকতে পারলে তার সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবে। এটাই তো চায় সে। গ্রামে আসার পর তো এই একটাই কাজ পেয়েছে। এর পাশাপাশি যদি গ্রামে আদৌ কোন জটিল বিষয় থেকে থাকে তাহলে সে সম্পর্কেও জানা হবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা – যাকে বলে!
দিশা আবার বলে উঠল,
— কি হলো? চলুন।
— আমি যাবো না।
— কেন?
— এখন যাবো না তাই।
— কিছুক্ষণ আগেই তো বললেন?
— সময় দেখেছেন? এখন খাওয়ার সময়। ঘোরার সময় না। আমি ঘোরার সময়ে ঘুরব। এখন খেতে যাব।
দিশা কিছু সময়ের জন্য ফ্যালফ্যাল চোখ এ তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। বিহান সুড়সুড় করে সেখান থেকে চলে গেল আর দিশা টেরও পেল না। নিচ থেকে ঝুম্পা ডেকে উঠল,
— আপু, খেলবে না? উনি তো চলে গিয়েছেন।
চলবে।