আঁখির আড়ালে,পর্বঃ-০২
সাদিয়া_সৃষ্টি
ভোরবেলা হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় সবাই কাঁপছে। গত রাতে বৃষ্টির প্রভাব তখনও রয়েছে। যার জন্য ঠাণ্ডার পরিমাণ একটু বেশিই প্রতি সকালের তুলনায়। তবে দুপুর হতে হতে রোদের আগমন ঘটলে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তখন মনে হবে কেন বৃষ্টি হচ্ছে না। মানব মন সত্যিই অদ্ভুত। যখন শীত শীত করবে তখন রোদের আশা রাখবে আর যখন গরম পড়বে তখন ভাববে, কেন একটু বৃষ্টি হয় না। গ্রামের সবার চিন্তা ভাবনা এখন এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। মকবুল মির্জা জরুরি তলব করেছেন শোনার পর সবাই হুড়হুড় করে চলে এসেছে ঠাণ্ডা-গরমের কথা না ভেবেই। তবে এখন ঠাণ্ডায় কাঁপছে। তবুও সবাই নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষায় আছে কখন মকবুল মির্জা এখানে ডাকার কারণ বলবেন। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মকবুল মির্জা বলে ওঠেন,
— সবার কাছ থেকে প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আসলে এত সকালে সবাইকে ডাকার ইচ্ছা আমার ছিল না। তবে জরুরি একটা কথা সবাইকে বলতেই এখানে ডাকা হয়েছে। আশা করি কথাটা নিজের পরিবারের ছোট বড় সবাইকে আপনারা বুঝিয়ে দিবেন। আসল কথায় আসি। আসলে গত রাতে আমার বাড়িতে কি হয়েছে সেই ঘটনা কেউ কেউ জানেন। আমার বাড়িতে এক ছেলে এসেছিল আহত অবস্থায়। গত রাতেই আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। এখন সে আমার বাড়িতেই আছে। সে যেহেতু গ্রামের বাইরে থেকে এখানে এসেছে, তাই সে আমাদের অতিথি। তার আপ্যায়নের ব্যবস্থা আমি যথাযথ চেষ্টা করব। সে যদি আপনাদের কাছে কিছু চায় তাহলে আপনারা তাকে সেটা দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তার পক্ষ থেকে সব খরচ আমার। তবে বেশি কথা বলবেন না। অন্যদেরও বেশি কথা বলা থেকে বিরত রাখবেন। আপনাদের পরিবারের সবাইকে সেটা জানিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
সবাই সমস্বরে বলে ওঠে,
— জ্বি, আমরা বুঝেছি।
— তাহলে আপনারা এখন আসুন। আবারো ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই সময়ে ডাকার জন্য।
সবাইকে যাওয়ার কথা বলতেই এক এক করে সবাই সেই স্থান ত্যাগ করতে থাকলেন। মকবুল মির্জা সবাই চলে যাওয়ার পর নিজের লাঠি ধরে উঠে পড়েন। তারপর নিজের ঘরে যেতে উদ্যত হন। কিন্তু বাঁধ সাধে তার বড় ছেলে।
— ওই ছেলে এ বাড়িতে কত দিন থাকবে?
— দেখা যাক, কতদিন থাকে।
— মানে? কি বলতে চাচ্ছেন আপনি আব্বা?
— বাবার মুখে মুখে বেশি কথা বলতে নেই। যাও এখন। আর দেখো, ছেলেটা উঠে পড়েছে কিনা?
ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলেন। তারপর নিজের লাঠিতে হালকা ভর দিয়ে চলা শুরু করলেন। বাবা চলে যেতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর কয়েকদিন। তারপর আবার গ্রাম ছেড়ে তাকে শহরে যেতে হবে। না জানে ছেলেটা কতদিন থাকবে? আদৌ থাকবে কি না? এমনিই গত রাতে তো ভয়ও পেয়ে থাকতে পারে। কিছুক্ষণ ভেবে সে নিজেও চলে গেল বিহানকে দেখতে।
বিহানের ঘুম ভাঙল বেশ দেরি করে। সময়টাকে ঠিক সকাল বলা যায় না। সূর্য আকাশে বেশ উঁচুতে উঠে পড়েছে। রোদের উত্তাপ বেশি হলেও মেঘের ভেসে চলার কারণে কিছু সময়ের জন্য কমছে, আবার কিছু সময়ের জন্য বাড়ছে। যেন সূর্য আর মেঘেদের মধ্যে লুকোচুরি খেলা চলছে। জানালা বেয়ে হঠাৎ আসা রোদের জন্য বিহানের ঘুম ভেঙে যায়। উত্তাপ কিছু সময়ের জন্য বেড়ে গিয়েছিল। তার উপর গরম লাগার পাশাপাশি বাতাসের কোন ব্যবস্থা ছিল না। একটি ছোট ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করে কিছু সময়ের জন্য ঘোরের মধ্যে চলে গেলেও পরে গত রাতের কথা চিন্তা করে সব বুঝতে পারল। নিজের ক্ষতে কিছু অদ্ভুত লেগে থাকতে দেখে আন্দাজ করল ভেষজ ওষুধ হতে পারে। এই সম্পর্কে তার ধারণা কম। নিজের মাথায় হাত চলে গেল। ঘুম ভাঙলেও ঘুম ঘুম ভাবটা তখনও যায় নি তার। মাথা ব্যথার পাশাপাশি তীব্র ঘুমও পেল তার। মনে হলো নিজের চোখ বন্ধ করলে কিছু সময়ের মধ্যে আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে পারবে। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। তার ঘুম সাধারণত অনেক হালকা। একটু কিছু হলেই ভেঙে যায়। সেই জায়গায় আজ হঠাৎ করে এতোটা ঘুম আসার কারণ বুঝে উঠতে পারল না বিহান। গত রাতের আঘাতের জন্য নাকি হঠাৎ করে অন্য পরিবেশে আসায়? কারণ উদ্ধার করতে না পারায় আরও অসহ্য লাগল তার। সেই সময় সেই সময় একটা পুরুষালি কণ্ঠ পেয়ে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। শব্দের উৎস সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে বয়সে বড় হবেন বলেই মনে হলো। সে জোরপূর্বক মুচকি হাসার চেষ্টা করল। তারপর কিছু বলতে গেলেই ছেলেটি বলে উঠল,
— শেষ পর্যন্ত আপনার ঘুম ভাঙল? সেই সকাল থেকে কয়েকবার দেখে গিয়েছি। এখন কেমন লাগছে?
ব্যথা না সেরে গেলেও কমেছে অনেকটা। তবুও ঘুমের জন্য হালকা জড়ানো গলা একটু জোর দিয়েই বলল,
— ভালো।
— থাক, এখন আপনাকে কথা বলতে হবে না। আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন, ভালো লাগবে। আসুন আমার সাথে।
বলেই বিহানের জবাবের অপেক্ষা না করে হাঁটা ধরল ছেলেটা। বিহানও কোনরকমে উঠে কিছুটা খোঁড়াতে খোঁড়াতেই হাঁটা শুরু করল। বাড়ির উথানে এসে পৌছুতেই মকবুল মির্জার তেজি গলা পাওয়া গেল,
— কি করছিস কি? ছেলেটাকে ধরে আন, নাহলে পড়ে যাবে তো।
— আনছি, আব্বা।
বলেই বিহানকে ধরে কলের পাড়ে নিয়ে যেতে লাগল সে। মকবুল মির্জা তখন রোয়াকে বসে বসে নিম গাছের ডাল চিবুচ্ছিলেন। বিহানকে হাত মুখ ধুয়ে আসতে দেখে তিনি মুখ ধুয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। মকবুল মির্জার ছেলে বিহানের হাত ধরে খাবারের ঘরে নিয়ে গিয়ে মেঝেতে এক জায়গায় বসিয়ে দিল। তার সামনে ছোট টেবিল টেনে রাখার পর নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল। মকবুল মির্জার স্ত্রী আর ছেলেদের বউয়েরা খাবার আনতে লাগলেন এক এক করে। বিহানের খাবার আলাদা করে দিয়েই আবার সে স্থান সাথে সাথে ত্যাগ করলেন। মকবুল মির্জা খাবার থালায় বাড়তে বাড়তে বলে উঠলেন,
— তোমার নাম কি বাবা?
এতক্ষণ বিহান নিরব দর্শকের মতো সব শুধু দেখে যাচ্ছিল। মূলত সে বলার মতো কোন কথা কিংবা করার মতো কোন কাজ পাচ্ছিল না। তাই সবাই যা যা করছিল, তাই দেখে যাচ্ছিল শুধু। অপেক্ষায় ছিল কারো প্রশ্ন করার। নাহলে এমন অজেনা জায়গায় এসে হুট করেই কথা বলা শুরু করা কিছুটা বেমানান লাগত তার। তাছাড়া নিজের বাবার বয়সী কেউ সামনে আছেন, তার আগে কথা বললে কেমন হবে সেই নিয়েই দুশ্চিন্তায় ছিল সে। একেই তো গ্রাম এলাকা, তার উপর পুরোটাই অচেনা, জায়গা ও মানুষ উভয়ই। মকবুল মির্জার প্রশ্নে তার ধ্যান ভাঙল।
— বিহান আহমেদ।
বিহানের ছোট উত্তর। তবে এতে মকবুল মির্জা সন্তুষ্ট হলেন কি না সেটা তার চেহারা দেখে বোঝা গেল না। বিহান কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকল। মকবুল মির্জা আবার প্রশ্ন করলেন,
— গত রাতে কি হয়েছিল? সম্পূর্ণ খুলে বলো। আর তুমি আমার থেকে ছোট এজন্য ‘তুমি’ করে বললাম। ঠিক আছে?
— জ্বি। আমি গত রাতে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। অন্ধকারে হঠাৎ গাড়িও নষ্ট হয়ে গেল। তারপর কাউকে পেতেই তার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই তারা আমাকে মারা শুরু করে। আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমার কথা শোনে নি। আমার গাড়ি যদি এখনও ওখানেই থাকে তাহলে ওটা ঠিক করে দিলে আর মূল সড়কের পথ দেখিয়ে দিলেই আমি চলে যেতে পারব। আর কিছু লাগবে না। তাই যদি গাড়ি টা ঠিক করা যেত তাহলে আমি সেদিনই চলে যাবো।
— আমি দেখছি বিষয়টা। যতদিন না সব ঠিক হয় ততদিন আমার বাড়িতে থাকতে পারো।
আরও কিছু কথা চলল তাদের মধ্যে। এর মাঝে খাবার খাওয়াও শেষ হলো। যাওয়ার আগে মকবুল মির্জা বিহানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
— ও হচ্ছে আমার বড় ছেলে রবি। চাইলে ওর সাথে এই গ্রাম ঘুরে দেখতে পারো।
কিছুটা ইতস্তত করেই বলে উঠলেন মকবুল মির্জা। চেনা নেই, জানা নেই ছেলেটাকে গ্রাম দেখানো কি ঠিক হবে সেই নিয়েই দ্বিমতে ছিলেন তিনি। তবুও হঠাৎ করেই বলে ফেললেন কথাটা। অবশ্য এটাও ঠিক, গাড়ি ঠিক করতে কতটা সমস্য লাগবে সেটাও তো জানা নেই। তবে পরে যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে বিহানের ব্যবস্থা করা যাবে ভেবেই ক্ষান্ত হলেন তখনের জন্য। যাওয়ার আগে রবিকে বলে গেলেন,
— বিহানের কিছু লাগে কি না দেখো। ওর দায়িত্ব এখন তোমার।
__________
— ওগো কে হে তুমি? বিলাতি বাবু? নাম কি তোমার?
কারো মুখে এমন সম্বোধন শুনে বিহান নিজের জায়গায় থেমে গেল। নিজের থেমে যাওয়ার কারণ, তার মনে হয়েছে কেউ তাকেই ডেকেছে। কারণ এই গ্রামে আপাতত গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত সেই নতুন। তাই ডাকলে হয়তো তাকেই ডাকা হবে। কিন্তু কোন মেয়ে তাকে এভাবে ডেকেছে ভাবতেই তার মধ্যে এক শিহরণ বয়ে গেল। কারণটা তার অজানা। অজানা কেউ, যাকে এই পর্যন্ত দেখেই নি সে, তার এক ডাকেই এমন শিহরণের কারন বের করতে পারল না বিহান। পিছনে ঘুরে তাকাল। এক পলক তাকিয়ে থমকেও গেল। আশেপাশে অনেকগুলো বাচ্চা, সাথে ২-৩ জন সমবয়সী মেয়ের মাঝে কাজল আঁখির অধিকারিণী তাকে এভাবে ডেকে বুঝতে দেরি হলো না। কিন্তু সেই কাজল চোখের অধিকারী মেয়ে যে ডেকেছে তার কোন প্রমাণ পেল না। শুধু মনে হলো যে সে ডেকেছে। হাত পা তখন হালকা কাঁপছে। হঠাৎ দেখলে বোঝা যাবে না। মস্তিষ্কে তার বারবার খেলে যাচ্ছে কথাগুলো। সে দেখল, মেয়েটার সাথে তার সমবয়সী মেয়ে ৩ টাও হেসে চলেছে। চোখে চোখ পড়তেই এবার বিহানের পাশাপাশি সেও থমকে গেল। বিহান মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেই কাজল দেওয়া চোখ জোড়া। দৃষ্টি মেয়েটার হাত পা কিংবা মাথা কোন দিকেই যায় নি বিহানের। যেন তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে চোখ জোড়া। শুধু চোখটার উপরের দৃষ্টি আটকে আছে। বাকি সব যেন ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। শুধু স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে চোখ জোড়া। কারো চোখের প্রতি যে এতোটা মুগ্ধতা জন্মাতে পারে সেটা আজ না দেখলে বিহান বুঝতই না।
অন্যদিকে দিশা নতুন কাউকে গ্রামে রবির সাথে হাঁটতে দেখে সকালের কথা মনে করল। তার বাবা তাকে আর পরিবারের সবাইকে বলেছিল যে একটা ছেলে এসেছে গ্রামে। দিশা তার পরিচয় জানতে চাইলে বাবা বলতে পারেন নি। তাই দিশা ভেবেছিল অন্যসময় যাবে। সখিদের সাথে গল্পে মত্ত হয়ে পড়ায় প্রথমে বিহানকে খেয়াল করে নি। হঠাৎ রুবিনার কথায় সে খেয়াল করে রবির সাথে একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে। কৌতূহল আটকে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল তখন রুবিনা ধীর আওয়াজে বলে উঠল,
— দেখ দেখ, দেখেই মন এ কেমন যেন হচ্ছে। ইনি নাকি এই গ্রামে নতুন?
রুবিনার কথায় সে বিরক্ত হলেও সেটা লুকিয়েই মজার ছলে এমন প্রশ্ন করে বসেছিল। ওর প্রশ্ন করার ধরনে রুবিনা, মাহিরা আর সাবিহা হেসে উঠলে সেও তাদের সাথে বিরক্তি ছেড়ে হেসে উঠে। কিন্তু বিহানের চোখে চোখ পড়ায় থমকে যায়। তবে দিশা সেখানে বসে রইল না। সে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে একেবারে বিহানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
— আপনি কে?
বিহান শুরুতে দিশাকে এতো কাছে আসতে দেখে ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে জবাব দিল,
— বিহান। এইখানের রাস্তা দিয়ে আসার সময় আসলে আক্রমণ হয়েছিল, তাই ওই বাড়িতে… আছি… এখন… যাচ্ছি…
বিহান যে নিজেকে কতটা সামলে নিতে পারল সেটা বল যায় না। নিজের কথাগুলো অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। কি বলবে কি বলছে সেটাই বুঝতে পারছে না। তাই এক পর্যায়ে থেমে গেল। অন্যদিকে দিশা সবটা বুঝতে পেরে বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। বিহানের ইচ্ছা করল এই কাজল চোখের অধিকারিণীর নাম জানতে। কিন্তু গ্রাম এলাকায় নাম জানতে গিয়ে না মার খেতে হয় সেই ভেবে চুপ করেই থাকল। দিশা নিজ থেকেই বলে উঠল,
— আমি দিশা, খন্দকার বাড়ির মেয়ে। কোন সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন।
এর মাঝে রুমি দিশার সাথে কথা বলছে ছুটে এলো। দিশাকে কিছু বলতে আসবে তার আগেই তার কানে ভেসে এলো,
— দেখ দেখ, আজ আরেক পোলার পিছে পড়ছে, আগেই কইছিলাম, মাইয়ার স্বভাব ভালা না।
কথাটা শুনে আর সেখানে থাকতে পারল না। গ্রামের অতিথির সামনে এমন কথা বললে তার কি অবস্থা হয়েছে সেটা প্রকাশ করার মতো না। আর না রুমি প্রতিবাদ করার মতো মেয়ে। তাই নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে কান্না করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। দিশা বলে উঠল,
— এসব কথায় কান দিবেন না। কোন সমস্যা হলে কারো না কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারেন। লজ্জা পাবেন না।
দিশা আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই রবি বিহানের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব না করেই পিছনে তাকিয়েছিল সে। বিহানকে দিশার সাথে কথা বলতে দেখে সাথে সাথে পিছনে চলে যায়। বিহানকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে ওঠে,
— ওর সাথে আর কথা বলবে না। ও সুবিধার না। একটু সমস্যা আছে।
বিহানের খটকা লাগলেও কিছু বলল না। রবির কথা যেন সে কানেই নিল না। আরও কিছু দূর যেতে যেতে পিছনে ফিরে তাকাল। সাথে সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল ওদের। চোখে চোখ পড়তেই দিশার কেঁপে ওঠাও যেন বিহান বুঝতে পারল। সে নিজেই চমকে উঠল। এমন কথা সে কেন ভাবছে?
__________
অন্ধকার রাত। আশেপাশে মানুষ নামক কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। চাঁদের আলোয় পথ আলোকিত হলেও এই সময়টায় কেউ জেগে থাকে না শান্তিপুর গ্রামে। অবশ্যই মধ্যরাতে কারো জেগে থাকার কথাও না। বিশেষ করে গ্রাম এলাকায়। এমন সময় অশরীরীদের আগমন ঘটার পাশাপাশি আরও অনেক কথা প্রচলিত। তাই ঘুমের রাজ্যেই ডুবে থাকে গ্রাম বাসী। বনের শেষ প্রান্ত ঘেঁষে সকলের অজান্তে যে রাস্তা তৈরি হয়েছে, সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে ৫ টি ট্রাক। রাস্তায় আওয়াজ করে চলেছে। যারা তার কাছাকাছি ঘরে অবস্থান করছে, তারা সাধারণত মাটিতে পাটি আর কাপড় পেতেই শুয়ে থাকে। মাটির ভেতরের কম্পনের কারণে সেই আওয়াজ তাদের কানেও এলো। একটা বাড়ির বউ জেগে গেল এমন শব্দে। কান পেতে শব্দটা আবার শোনার চেষ্টা করল। রাতে কোন আওয়াজ না হওয়ায় বেশ ভালো মতই শোনা যাচ্ছে। তিনি ভয় পেয়ে সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু শব্দ থামল না। কারো কান পর্যন্ত না পৌঁছুলেও শব্দ চলতেই থাকল। আর এক পর্যায়ে ক্ষীণ হয়ে এলো তা।
চলবে।