#অবেলার_প্রেম
#পর্বঃ১
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
আমার ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে ঠিক হয়েছে আমারই বড় বোনের সঙ্গে। আপু সবটা জানে, আমাদের দীর্ঘ দুটি বছরের ভালোবাসার কথা, আমাদের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী তো আপুই ছিলো- তারপরও সে এই বিয়েতে কীভাবে মত দিলো,জানা নেই! আর দিগন্ত, ও-ই বা কীভাবে মত দিলো? আমি কোনোভাবেই মানতে পারছি না ব্যাপারটা। কোনোভাবেই না! আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কী মানতে পারতো? যার পাশে নিজেকে দেখতে চেয়েছি সবসময়, তার পাশে বড় বোনকে কীভাবে সহ্য করবো আমি? কীভাবে তাকে ডাকবো ‘দুলাভাই’ বলে? আমার জিভ দিয়ে এই শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব না,কক্ষনো না। আপুর পা ধরে তাকে বুঝালাম, মানা করে দিতে। বিনিময়ে উত্তর পেলাম, ‘আমার হাতে কিছু নেই। বাবাকে গিয়ে বলতে পারলে বল।’
বাবাকে যমের মতো ভয় করি আমি। তাকে কোনোদিন বলতে পারব না। আপু জানে এটা,জেনেই এই কথা বলেছে। নিজেকে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় লাগছে। পাগলের মতো মা’কে গিয়েও বলেছি, কেঁদেছি, অনুরোধ করেছি- আমার জীবনটা কেড়ে নিও না তোমরা। মা শোনেননি বরং মেরেছেন- লুকিয়ে প্রেম করেছে বলে। আমার আশেপাশে কেউ নেই। কোনো সাপোর্ট নেই। যাদেরকে আপনজন ভাবতাম তারাই আমার বুকে ছু’রিকাঘাত করল! আর যাকে নিজের জীবন ভাবতাম, সে আমার নিঃশ্বাসটুকু কেড়ে নিলো। এখন আর বেঁচে থেকে লাভ কী? আপুর সঙ্গে তাকে কখনো মেলাতে পারব না,সহ্য করতে পারব না। তাই আমি চলে যাচ্ছি চুপচাপ, সবাই ভালো থাকুক….
***
তিরিশ টাকার দিস্তা কাগজ দিয়ে খাতা বানিয়ে আজীবন কাল ব্যবহার করে এসেছে ফাগুন। আজকেও সেই দিস্তা খাতাকেই ব্যবহার করল নিজের ভেতরের কথাগুলো লিখবার জন্য। গত চারদিন ধরেই তার মাথায় মৃ’ত্যুর মতো বড় চিন্তাটি জেঁকে বসেছে। যে জীবনে দিগন্ত নেই,সে জীবন রেখে লাভ নেই- এমনই স্লোগানে মুখরিত মন প্রাঙ্গণ। বাবা-মা,বড় আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করেছে তবুও। পারেনি। যারা পাশে থাকবার কথা ছিল, তারা নেই। নিজ নিজ স্বার্থ সিদ্ধি লাভ করবার জন্য উন্মুখ সকলেই। কেউ একটিবারও ফাগুনের মনের মধ্যে চলা ঝড়ের গতিবেগ উপলব্ধি করতে পারল না। আর কাউকেই বোঝানোর দরকার নেই। ও’কেই যখন এত ঝামেলা তখন ও-ই চলে যাবে। এরচেয়ে ভালো সমাধান ওর ডিকশনারীতে অন্যটি নেই।
খুঁজে খুঁজে তেলাপোকা মা’রার ওষুধ নিয়ে এসেছে ফাগুন। তোশকের তলায় লুকিয়ে রাখা আছে। প্রথমে গলায় ফাঁ’স দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। গুগলে সার্চ করে যতগুলো সু’ইসা’ইড করার উপায় জেনেছে,তার মধ্যে বি’ষ পান করেই মৃ’ত্যু সহজ সবচেয়ে। খাবে তারপর চুপচাপ শুয়ে থাকবে। দিগন্তের ছবিখানা বুকে জড়িয়ে আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাবে। আর কোনোদিন সে ঘুম ভাঙবে না। এমন কঠিন মুহূর্তে এসেও ফাগুন নিজের বুদ্ধির তারিফ করতে ভুললো না। এত বুদ্ধিমতী কাউকে পেয়েও হারাতে চলেছে দিগন্ত, এই নিয়ে আফসোসও করল ক্ষণকাল, এরপর কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি….
নিলুফার রান্না করছিলেন, তার কপাল ঈষৎ কুঁচকানো। ফাগুন পা টিপে টিপে রান্নাঘরে উঁকি মারল, একবার মা’কে দেখেই চলে যাবে। এটাই শেষ দেখা। কিন্তু নিলুফার তাকে দেখে ফেললেন। গলায় বিরক্তি এবং রাগ মিশিয়ে গাঁক গাঁক করে চেঁচালেন,
-‘আমাকে একটু সাহায্য ও তো করতে পারিস নাকি? আমি একা ক’দিক সামলাবো? আজকে বিকেলে ও বাড়ি থেকে লোক আসবে আংটি পরাতে। সেই আয়োজন কিছুই হয়নি। এতবড় শেয়ানা মেয়ে,অথচ কাজের বেলায় খুঁজে পাওয়া যায় না! চোখমুখের অবস্থা দেখো, বিরহে একেবারে ম’রে যাচ্ছে!’
অন্যসময় চোখে জল চলে এলেও আজ ফাগুন স্থির,মোটেও মন খারাপ করল না। বরং খারাপ লাগল এই ভেবে, সে চলে গেলে এই বকাগুলো আর কোনোদিন শোনা হবে না! মৃ’ত্যুর পর কী হবে তার,আর কোনোদিন কী পরিবারের দেখা পাবে? মায়ের রাগ, বাবার বিরক্তি, আপুর বাঁকা চোখের চাউনি- সব কিছুকে মিস করবে সে। সবচেয়ে বেশি মিস করবে ও’কে… ও যে ফাগুনের প্রাণ ছিল! ওর নিঃশ্বাসই যে ফাগুনকে আরেকটি সকাল দেখার জন্য উৎসাহী করে তুলত! মানুষ নে’শা করলে যেমন পাগল হয়ে থাকে নে’শার জন্য, তেমনই দিগন্তের জন্য সবসময় পাগল হয়ে থাকত ফাগুনও। দিগন্ত ওর নে’শা,ওর সবকিছু! ভাষায় প্রকাশের সাধ্য নেই। সেই নে’শা কেটে যাচ্ছে, অথচ ফাগুন সবসময় ওর নে’শাতেই ডুবে থাকতে চেয়েছিল!দিগন্তের সাথে ওর জীবনটা সামাজিক ভাবে জুড়ে দিলে খুব কী ক্ষতি হতো?
ফাগুন একটিও কথা না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে আসে। বাবা বা আপু- কাউকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। তাদের প্রতি এতটাই বিতৃষ্ণা জমে গেছে যে,মৃ’ত্যুর সময়টাতেও তাদের ছায়া মাড়াতে ইচ্ছে করে না। এই বিতৃষ্ণার পেছনের কারণ কী দিগন্তকে হারানো? নাকি অন্যকিছুও আছে?
নাহ, আর যে ভাবা যাচ্ছে না। যত ভাবছে ততই অতীতের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। দিগন্তের গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠস্বর, ওর ঠোঁটের উপরের বাঁকা কাটা দাগ, দু’গালের ডিম্পেল- সবকিছু আখিপল্লব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ফাগুন তোশক তুলে ওষুধ গুলো বের করল। চোখটা বন্ধ করে একশ্বাসে সবগুলো ওষুধ পেটে চালান করে দিলো পানি দিয়ে। তারপর নিঃশ্বাস ছাড়লো। একটু বমির মতো পেল, নিজেকে সামলে বিছানায় চুপ করে শুয়ে পড়ল সে। হাতের মুঠোয় দিগন্তের ছবি। যেটা চুরি করে রেখেছিল একদিন…যেটা দেখে দেখে অনেক রাত পার করেছে সে। যেটাতে অজস্র চুমুর ছোঁয়া… সেই ছবিখানা চোখের সামনে তুলে ধরতেই গরম বারিপাত বর্ষিত হলো দু’চোখ জড়িয়ে… তেল চিটচিটে তুলতুলে গাল দু’খানা ছুঁয়ে গেল তারা। ম’রতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে! চোখজোড়া ভারী ভারী লাগছে। জীবনের শেষ সময়টুকু দিগন্তের স্মৃতিচারণ করে কাটানো যাক?
★
(অতীত)
ঘন বর্ষার বিকেল। তিনদিন যাবত থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। ফাগুনের বৃষ্টি ভালো লাগে, কিন্তু এতটাও না! বিকেল বেলায় ম’রা রোদের আলোয় নিজেকে রাঙাতে না পারলে দিনটাই কেমন যেন ম’রা ম’রা লাগে। বৃষ্টির কারণে ছাদেও উঠা হচ্ছে না। যাচ্ছে তাই অবস্থা! বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাই আপন মনে বই পড়ে যাচ্ছিল সে। কোনো একাডেমিক বই নয়, উপন্যাসের বই। কঠিন প্রেমের গল্প। পড়তে পড়তে কখনো বা লজ্জায় লাল হচ্ছে,কখনো বা অদ্ভুত শিহরণে কাঁপছে গোটা শরীর। একটা জায়গা পড়ে জিভ কামড়ে ফাগুন ভাবল, এরকম কঠিন ভালোবাসা তার জীবনে এলে মন্দ হয় না! জীবনে বৈচিত্র্য থাকা চাই।
নিলুফার ঝাড়ু হাতে ঘরে ঢুকলেন। মেয়েকে এলোমেলো ভাবে শুয়ে গল্পের বই পড়তে দেখেই চেঁচালেন।
-‘তুই আবার বই আনছিস? এসব কে দেয় তোকে? আজকে তোর বই…’
নিলুফার এগিয়ে আসতেই ধপ করে উঠে বসে ফাগুন। মা কেন যে এসব বই সহ্য করতে পারেন না,জানা নেই ফাগুনের। লুকিয়ে লুকিয়ে বান্ধবীর থেকে ধার করে এনে পড়ে। কলেজের লাইব্রেরি থেকে এনে পড়ে। মাঝে মাঝে টিফিনের টাকা জমিয়ে নিজে কিনে পড়ে। দরজাটা লাগাতে আজ ভুল হয়ে গেছে! ইশশিরে.. মায়ের চিৎকারের ঠ্যালায় ঘরে থাকা দায়। বই হাতেই ফাগুন ছাদে চলে এলো তাই। ছাদে পা রাখবে, ওমনি ঝুপুৎ করে বৃষ্টির আগমন। কী ঘন বর্ষার জল, ঠান্ডা বাতাস, ফাগুনের মন খারাপ ভাব উড়িয়ে নিয়ে গেল। বইটা সিড়িঘরে রেখে নিজেকে নামিয়ে দিলো খোলা আকাশের নিচে। দু’হাত দু’দিকে মেলে ধরে চড়কির মতো ঘুরপাক খেতে লাগল সে। খেয়ালই করল না,একজোড়া জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখ তাকে দেখছে। ক্ষণিকের নিরবতা….
সিগারেট টানতে ছাদে এসেছিল দিগন্ত। দু’দিন আগেই ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরেছে সে। পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে দিগন্ত। বয়সটা ভালোই, অথচ ওর কৃষ্ণ কালো চোখজোড়া যেন শিশুমনের ইঙ্গিত দেয়। সিগারেট খেতে খেতেই বৃষ্টি নামা দেখল সে। সেই সাথে আরও একজনের উপর চোখ নিবদ্ধ হলো তার। পাশের বাসার ছাদের উপরে হুট করে নেমে আসা আসমানের পরী যেন..দু’হাত দু’দিকে মেলে যখন আকাশ পানে মুখ তার, দিগন্ত খুব করে তার চেহারাটা দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি পেড়েছে। অবশেষে যখন তাকাল, দ্রুত চোখজোড়া নামিয়ে নিলো সে। ওমন সুন্দর চাউনির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মাথা ঘোরায় যে!
আসমানী পরীটাকে দেখতে গিয়ে নিজেও যে ভিজেছে এতক্ষণ, দিগন্তের খেয়ালই হয়নি। চোখ নামিয়ে নেওয়াতে সে অবাক হয়ে দেখল, ভিজে জুবুথুবু অবস্থা! দিগন্তের হাসি পেয়ে গেল চট করে। এত বড় হয়েও বুদ্ধি হাটুর নিচেই রয়ে গেল! একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে সে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আরেকটিবার দেখতে ইচ্ছে করছে পরীটাকে,কিন্তু চোখ তুলে তাকানোর তীব্র ইচ্ছা যে অস্বস্তিদের কাছে পরাজয় স্বীকার করল। পরীটা তখনো যে তাকে দেখে যাচ্ছে, সেটা না তাকিয়েও বুঝতে পারল। চুপচাপ সরে যাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু তিন কদম হেঁটে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হলো তাকে।
সে দাঁড়ায়নি, অচেনা কিন্তু পরিচিত কণ্ঠস্বর তার পা’জোড়াকে থামিয়ে দিয়েছে।
-‘এই মিস্টার, আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলেন কেন?’
অদ্ভুত প্রশ্ন! দিগন্ত তো খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ওকে দেখেছে। এটার সাক্ষ্য দেবে আকাশ, বাতাস, গাছগুলো, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গুলোও। অথচ পরীটা বলছে,ওকে লুকিয়ে দেখেছে দিগন্ত? হুশ…..!
দিগন্ত ঠোঁটে হাসে, একটা নাই নাই হাসি, বাহির থেকে সে চিরগম্ভীর, গাম্ভীর্য বজায় রেখে জবাব দিলো,
-‘মিথ্যে বলবেন না ম্যাডাম, আমি মোটেও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখিনি আপনাকে।’
ভড়কে গেল অপরপক্ষ। কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে দেখো! লজ্জা পেল দিগন্ত, দ্রুত চোখ সরিয়ে অন্যত্র তাকাল। বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে একেবারেই। গুড়িগুড়ি ফোঁটা পড়ছে এখন, আকাশ ঝকঝক করছে। আকাশের সমস্ত কালি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। দূরে কোথাও বাজ পড়ার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই।
পরীটা খালি চুপ থেকে কী ওমন দেখছে তার দিকে? দিগন্তের বুক দুরুদুরু, জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের সামনে এতটা নার্ভাস লাগছে তার! ভারী অদ্ভুত,সবসময় আত্মবিশ্বাসী থাকা ছেলেটা হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেল কেন? কোথায় চলে গেল সব আত্মবিশ্বাস?কে নিয়েছে কেড়ে? পরীটা?
দিগন্ত বুক দুরুদুরু নিয়েই তাকাল এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, পরীটা এগিয়ে এসেছে৷ একদম ছাদের কিনারে, তার হাত দুটো চ্যাপ্টা রেলিংয়ের উপর রাখা। উৎসুক মুখটায় শতশত পানির ছিঁটে…
সৌন্দর্যও পবিত্র হয়? একেই বুঝি বলে পবিত্র সুন্দর? দিগন্তও নিজের অজান্তে দুই পা এগিয়ে গেল। আশ্চর্য!! তার কর্মকান্ড সে কিছুই টের পাচ্ছে না। সমস্ত চিন্তা-চেতনা বোধও বা কে গায়েব করে দিলো? এই বয়সেও এতটা আবেগী মন! ইশশিরে…!
-‘তার মানে আপনি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলেন না?’
ঠোঁট ভাঙলো ফাগুন, ভিজে যাওয়া গলাটি তরঙ্গের সৃষ্টি করল। সেই তরঙ্গ ধীরে ধীরে মিশে যেতে লাগল দিগন্তের বুকে, গভীর থেকে গভীরে…
দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে প্রত্যুত্তর করল সে,
-‘হুম। আমি কাউকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখিনি।’
যেন সব বুঝে গেছে, এমন ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিমায় ফাগুনের ফের প্রশ্নবাণ,
-‘আচ্ছা, তার মানে আপনি ইচ্ছে করে ওমন হাবাইত্তার মতো দেখছিলেন আমাকে? হা করে?’
দিগন্ত ভড়কে গেল। বৃষ্টির কলতান শেষ, রোদ উঠছে ঝিকমিক করে। আকাশে কোনো পাখিরও দেখা নেই, একজোড়া কপোত-কপোতী শুধু দাঁড়িয়ে..কী যেন কারণে তাদের দু’জনের মনের মধ্যেই শত ডানার প্রজাপতিরা উড়ে চলেছে।
দিগন্তকে ভড়কাতে পেরে ফাগুনের আনন্দ হচ্ছে মন বাড়িতে। সে নিচু হয়ে ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকানোর চেষ্টা করল, তবুও দিগন্তের চোখের কার্নিশে সেই হাসি ধরা পড়ে গেল খুব সহজেই। তার অন্তর নেচে উঠল। মেয়েটা তাহলে ইচ্ছে করে এমন বলছে? কোনো সত্যিকারের রাগ বা বিরক্তি নয়? সবটাই মেকী? আচ্ছা! দিগন্ত একহাতের উপর আরেক হাত ভাঁজ করে রেখে নির্বিকার স্বরে জবাব দিলো,
-‘হ্যাঁ,দেখছিলাম। হাবাইত্তার মতো হা করেই দেখছিলাম। এর আগে কখনো পরী দেখিনি তো,তাই।’
সস্তা ফ্লার্ট, ফাগুনকে বিব্রত করে তুলল এবার। এ যেন শীতল স্নায়ুযুদ্ধ দু’জনার, এ যেন না বলা ডিবেট- দু’জনকেই জিততে হবে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে কথার বাণে- দু’জনেই মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফাগুনের এরপরের বাক্যবাণ কী হতে পেরে তা জানার জন্য তীক্ষ্ণ নজর তাক করে রেখেছে দিগন্ত, মনের মধ্যে শত কথার মেলা। কোনোভাবেই এই মেয়েকে জিততে দেওয়া চলবে না।
দিগন্তকে আশ্চর্য করে দিয়ে ফাগুন হেসে উঠল। খলখল ধ্বনিতে দিগন্তের আপাদমস্তকে শিরশিরানি অদ্ভুত, নাহ- এই মেয়েকে কথার বাণে নয়, ভালোবাসার বাণে জর্জরিত করতে হবে। এই মেয়ে শুধু আসমানের পরীই না, দিগন্তের অন্তরতম প্রদেশের রাণীও বটে! দিগন্তের শক্ত মুখ একটু একটু করে নরম হতে লাগল। ওদিকে হাসি না আঁটকেই ফাগুন বলল,
-‘আমি আসমানের পরী? বহুবার শুনেছি। নতুন কিছু বলুন, সস্তা মার্কা ফ্লার্ট করতে আসবেন না আমার সঙ্গে।’
মনঃক্ষুণ্ন হলো। দিগন্তের চেহারায় কী যেন একটা চট করেই উড়ে চলে গেল। একটু মলিন দেখালো বৈকি, ফাগুন সেটা লক্ষ্য করেই চুপসে গেল। এভাবে বলাটা উচিত হয়নি। উনি কী কষ্ট পেলেন? কথার প্রসঙ্গ ঘুরাতে নাকি উনাকে কষ্টের হাত থেকে উদ্ধার করতে- কে জানে কেন, চটজলদি প্রশ্নবাণ ছোঁড়া শুরু হলো।
-‘আপনাকে এর আগে তো দেখিনি। এই বাসায় নতুন?’
একটু স্বস্তি মিললো যেন, তবুও চেহারার সেই পূর্বের উজ্জ্বলতা ফিরে এলো না। নিজের পুরোনো খোলসে ফিরে গেল আবার, গম্ভীর কণ্ঠটি নাড়িয়ে জবাব দিলো,
-‘হুম। আমার ফ্যামিলি মাস দুয়েক আগেই উঠেছে। আমি দু’দিন আগে এসে জয়েন করলাম।’
ইশশিরে…! বুকে গিয়ে লাগলো কী? ফাগুন গোল চোখে তাকিয়ে। কী ঘন সেই গলার স্বর! কী মাদক মেশানো! ফাগুনকে অদ্ভুত ভাবে টানছে শুধু। এর আগে এরকম কখনো হয়নি। কাউকে একবার দেখায়ই তার প্রতি ভালো লাগা! অসম্ভব!
ফাগুন চট করে ঘুরে দাঁড়াল। ওড়নাটা ঠিক করার বাহানায় বলল,
-‘বৃষ্টি তো শেষ হয়ে গেল। গরম লাগছে এখন। আমি নিচে চললাম।’
দাঁড়াল না, পাশের বিল্ডিং এ একটি থমথমে মুখ রেখে সে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল। বুকচিঁড়ে বেরিয়ে আসা গাঢ় শ্বাসটাকে কোনোভাবেই আঁটকাতে পারল না দিগন্ত। মেয়েটার এমন হুড়মুড় করে চলে যাওয়ার মানে কী? সে কী দেখতে এতই অসুন্দর? তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুটো মিনিট কথা বললে ক্ষয়ক্ষতি তো কিছু হতো না…
ভাবনা গুলো মন পিঞ্জরে বন্দি করে দিগন্তও পা বাড়ালো বাসার উদ্দেশ্যে। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে গেল, মেয়েটার নামটাই জানা হলো না! কী আশ্চর্য!
(চলবে)