অফুরন্ত প্রণয়,পর্ব-৯,১০

অফুরন্ত প্রণয়,পর্ব-৯,১০
তারিন_জান্নাত

ইয়াশার চিৎকারে ইতিমধ্যে অনেকের কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি এসে তার উপর এসে থুবড়ে পড়ে। রিদিতা আর আরিফা চমকে গেলো ইয়াশার চিৎকারে।তারা দ্রুত এগিয়ে আসে ইয়াশার নিকটে। ইয়াশার দৃষ্টি তখনো নিবদ্ধকৃত অচেনা যুবকটিকে খোঁজে চলার উভিপ্রায়ে। অবশেষে বিপরীতমুখী দাঁড়ানো যুবককে দেখতে পায় ইয়াশা। সেদিকে যাওয়ার জন্য পদযুগল বাড়াতেই রিদিতা এসে হাত ধরে ফেলে ইয়াশার।
ইয়াশার হাত ঝাঁকিয়ে রিদিতা বলে,
–” কিরে চেঁচিয়ে কাকে কী বলছিলি?”
ততক্ষণে আরিফা এসে ইয়াশার অপরপাশে
দাঁড়িয়ে বলে,
–” কী হয়েছে আপু? কেউ কি তোমাকো টিজ করেছে।”
ইয়াশা রোষাগ্নি কন্ঠকে চাপিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,
–” কিছু না। কেউ টিজ করেনি।”
রিদিতা আর আরিফা ইয়াশার মৃদু কন্ঠ শুনে কেমন যেনো অনুভব করে। ইয়াশার স্বাভাবিক কন্ঠ শোনায় একরকম,বর্তমান কন্ঠটা শোনালো অন্যরকম।তারা বুঝলো ইয়াশা হয়তো নিজের রাগ অথবা উত্তেজনা চাপাতে চাচ্ছে।যার দরুন কন্ঠটা এমন শোনাচ্ছে।
তাদের কথোপকথনের মধ্যে ফাহিম এবং তার মা এসে উপস্থিত হয়।ভাগ্রক্রমে তারা এতক্ষণ ছিলোনা।যার ফলে ইয়াশার অদ্ভুত ব্যবহার তাদর দৃষ্টিগোচর হয়নি। সূর্যের সোনালি আলোয় ইয়াশার ফোলা ফোলা গাল ভীষণ আকর্ষণ করছে নওশাদকে।
ইতিমধ্যে ইয়াশার অনেকগুলো ছবি ক্যামেরা বন্দী প্রায়। ইয়াশার তখনকার আচরণের কথা পড়লে পেট ফেটে হাসি বের হতে চাচ্ছে নওশাদের।
ঝলমলে রোদের তাপ বাড়তে শুরু করে ধীরে ধীরে।
কিটকট চেয়ারে বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য দৃষ্টিগোচর করতে ব্যস্ত ইয়াশা।অদূরে নীল পানির দিকে চেয়ে আছে সে।নিতান্তই মনের সাথে আলাপ-আলোচনায় মত্ত সে। তার বাবা বলেছিলে দুইদিন বাদে অর্থাৎ শুক্রবারে সন্ধ্যায় জাবিবের সাথে তার বাগদান হয়ে যাবে। তার বাবা এমনটা বলেছে তাকে। এদিকে কড়া কন্ঠে এটাও জানালো যে ইয়াসিরকে কোনকিছু যেনো না জানায়।ইয়াশা চেয়েও তা করতে পারছেনা।কারণ তার ভাইয়ের এখন পরীক্ষা চলছে।
ঘোর কাটলে আবারও সম্মুখীন হয় অপ্রিতিকর মুহূর্তের। ইয়াশা আরিফা আর রিদিতার দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লো। দু’জনে ফোনে ব্যস্ত। ফাহিম আর তার ফুফি কী যেনো আলোচনা করছে। ইয়াশা পুনরায় সামনে দৃষ্টি ছুঁড়লো। নওশাদ প্রায় ইয়াশার কাছাকাছি চলে এসেছে।এক্ষুনি ঘুচে যাবে এই দূরত্ব। ইয়াশা সটান হয়ে বসলো। ততক্ষণে নওশাদ ইয়াশার পাশে থাকা কিটকট চেয়ারে বসে জায়গা দখল করে নিলো। ইয়াশার প্রাণপাখি এবার যায় যায় অবস্থা। হৃদপিণ্ডটা লাপিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আজ সতেরো দিন পর মানুষটা তার পাশে। ইয়াশা সামনের দিকে নজর রাখলো। চোখের পাতা কাঁপতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। খুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। ইয়াশার মনে মনে বলছে,
— ” আল্লাহ আমাকে অচেতন করে দাও।রক্ষা করো এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে।”
কিন্তু ইয়াশা অচেতন হয়নি।তবে তার হাত মুখ ঘামতে শুরু করে দিয়েছে। ইয়াশা বুঝতে পারছেনা তার সাথে এমন হওয়ার কারণ কী হতে পারে?
ইয়াশা সাহস যুগিয়ে স্বল্প পরিচিত যুবকটির দিকে তাকালো। নওশাদ বিনা সংকোচে এতক্ষণ চেয়ে ছিলো ইয়াশার দিকে।ইয়াশা তাকালেও চোখ সরায়না নওশাদ। বরং অদ্ভুত তৃপ্তি পাচ্ছে সে।ইয়াশাকে তীব্র অস্বস্তিতে ফেলে।ইয়াশা দৃষ্টি নত করে চোখ সরালো।
ডানপাশে আবারও তাকালো ইয়াশা।রিদিতা,আরিফা ব্যস্ত। একটু পর
ইয়াশার কর্ণগোচর হলো সেই সুমিষ্ট পুরুষালী কন্ঠ,
তাকে বলছে,
–” আমি কোন ক্রিমিনাল নয়। তবে একজনের মায়াজালে বন্দী।”
ইয়াশা চট করে তাকালো। ইতস্তত বোধ নিয়ে বলল,
–” আপনার ফোন আমি আনিনি। আপনি আসবেন জানলে অবশ্যই আনতাম।”
নওশাদ মৃদু কঠিন কন্ঠে বলে,
–” আমি ফোন নিতে আসিনি।”
–” তবে..?
নওশাদ তখনি কিছু বলেনি।একটু পর বলে,
–” আপনি জানেন আমি কোথায় থাকি?”
ইয়াশা আঁড়চোখে নওশাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
–” না।
নওশাদের সরল প্রশ্ন,
–” জানতে চান?
ইয়াশার মাঝে অদৃশ্য কৌতূহল এসে ভীড় জমালো।
সাবধানে উপর-নীচ মাথা নাড়ালো,
নওশাদ অদ্ভুত হেসে আচমকা উঠে দাঁড়ালো। ইয়াশা পিলে চমকে উঠে নওশাদের আচরণে।
নওশাদ পরহিত কালো হুডিটা খুলতে খুলতে বলে,
–” আমি নওশাদ।
আর কিছু জানার থাকলে রাতে ফোন অথবা মেসেজ দিবেন।”
মূঢ় ইয়াশাকে একঝাঁক নিগূঢ় জালে ফেলে চলে যায় নওশাদ। ইয়াশা বিমূঢ় হয়ে চেয়ে থাকলো। মুখে অকৃত্রিম চিন্তার চাপ।তন্মধ্যে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো নওশাদের শ্বেতাঙ্গ উন্মুক্ত পেশিবহুল বাহু।ইয়াশা অনুভব করলো নওশাদ নামক যুবকটির কথায় অদ্ভুত সম্মুহনী ক্ষমতা আছে।এই সম্মোহনী তার মস্তিককে প্রশ্নের জালে ছুঁড়ে নিজে উদাও হয়ে যায়।
–“ছেলেটা কে ইয়াশা?”
রিদিতার কথায় ইয়াশা তড়িৎ গতিতে তার দিকে তাকালো।এরপর পুনরায় সামনে তাকিয়ে বলে,
— “কোথায়?”
–ওই যে একটু আগে ছেলেটা কী নাম জানি বলল।ভালোভাবে শুনিনি।”
ইয়াশা বিপাকে পড়লো।রিদিতা সব শুনেনি তো।পরক্ষণেই ভাবলো শুনলে সেও সব জানাবে ওকে।
ইয়াশা বলল,
–” পরিচিত হচ্ছিলো আরকি।”বলেই হাসলো।
ইয়াশা কথায় রিদিতা ঠোঁট চেপে হাসলো। মনে মনে বলল,
–” সব প্ল্যানের মাস্টারমাইন্ড আমি।আর তুই আমার থেকে লুকাচ্ছিস?”
ইয়াশার এখন একটু স্বস্তি মিললেও পরে তা মিলিয়ে যায়। ফাহিম কেমন সন্দিহান মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মুখভঙ্গি দেখে বুঝতে পারলো সে সব দেখেছে। ইয়াশার মাথা ঘুরাচ্ছে এখন। লুকাতে গিয়ে সে নিজেই গর্তে তলিয়ে যাচ্ছে। একটা সত্যির বদলে কয়েকটা মিথ্যা।রিদিতা ইয়াশার উদ্রান্তরূপ দেখে থমকালো। ক্ষীণ আওয়াজে বলল,
–” আচ্ছা!”
সাহেদা খানম তাদের দিকে ফিরে বললেন,
–” নাস্তা করবিনা তোরা? আয় জলদি।বাড়ি ফিরতে হবে তো।”
তিনজনে সাহেদার কথায় সায় জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো।রিদিতা,আরিফা, সাহেদা খানম কিছু একটা বিষয়ে কথা বলছে। ইয়াশা তাদের থেকে পিছিয়ে। হাঁটতে ইচ্ছে করছেনা তার। পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো ইয়াশা।
ফাহিম কপালে সরু ভাঁজ তুলে বলল,
–” তুই কী বোকা?”
ইয়াশা হকচকালো।অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হেসে বলল,
–” কী বলতে চাইছিস?
–” এই যে,তুই একটা অচেনা ছেলের সাথে কথা বলছিলিস আর সেটা আমরা কেউ দেখিনি।”
ইয়াশা করুণ মুখে চেয়ে বলল,
–“তুই দেখেছিস?”
ফাহিম ধমকের সুরে বলল,
–“না দেখলে বলছি কীভাবে? আমি,আরিফা,রিদিতা উভয়ে দেখেছি।তোর কোন ধারণা আছে মাকে আমি কতরকমের কথা বলে ব্যস্ত রেখেছি। ফিরলেই তো দেখতো আদরের ভাই-জিয়ের কির্তীকলাপ।”
ইয়াশা রুষ্টস্বরে বলল,
–” ফাহিম? না জেনে কথা বলবিনা একদম।উনাকে আমি চিনি না,কখনো দেখিনি।হাতে গুনা কয়েকবার কথা হয়েছে শুধু তাতেই এতকথা?
আর আমার বিষয়ে নাক গলাবি না তুই। খবরদার।
ইয়াশা রেগে ফাহিমকে রেখে চলে যায়। ফাহিমের চোখজোড়া ছলছল করে উঠে। অতিশিগ্রই তার প্রিয় মানুষটিকে হারাতে চলেছে সে।চাপা দহন নিজের অন্তরঃস্থলের কুঠিরে আঁটকে রেখে ঠোঁটে
হাসি এনে বলে,
–“তুই সুখে থাকলেই আমি খুশী!”

(চলবে)

“অফুরন্ত প্রণয়’
#তারিন_জান্নাত

১০.
বাড়ির গেইটের সামনে একটি ছেলের রক্তাক্ত নিথর দেহ পরে থাকতে দেখে আঁতকে উঠেন ইউসুফ সাহেব। আশেপাশে আতংকিত চোখে তাকিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসলেন। নিথর হয়ে পরে থাকা দেহটির গায়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক। নাকের নিচে নিজের দুই-আঙুল রাখলেন। শ্বাস ধীরে ধীরে চলাচল করছে।
ইউসুফ সাহেব ভয়ে গম্ভীর হয়ে দেহটির পাশে বসে রইলেন কিছু সময়।উনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন।বা কী করা উচিত। কেউ দেখলে দোষটি সম্পূর্ণ উনার উপর আসতে পারে নিশ্চিত।কারণ দেহটি ঠিক তাদের গেইট বরাবর শায়িত। বিষয়টা সন্দেহভাজন। কেউ কী তাহলে ফাঁসাতে চাচ্ছে? এমনে এমনে তো এখানে আসা সম্ভব নয়? কেউ কী দেখেনি।ইউসুফ সাহেব বেশ ঘাবড়ে গেলেন।দুইদিন পর মেয়ের বিয়ে।তার পূর্বে এমন রক্তারক্তি ঘটনা লোক সম্মুখে গেলে ভালোই বদনাম জুটবে। ইউসুফ সাহেব লোকটিকে হসপিটালাইস করার সিদ্ধান্ত নিলেন।পরক্ষণে ভাবলেন এতো গভীর জখম পুলিশ কেইস হতে পারে। ইউসুফ সাহেব দিক দিশা হারিয়ে অফিস ব্যাগ পুনরায় কাঁধে চাপিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। দেহটি এভাবে সারারাত বাইরে রেখে নিশ্চিতে উনি থাকতে পারবেন না। তার উপর ভারী পুরুষালী শরীর একা হাতে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়াও তার পক্ষে অসম্ভব।
ড্রইংরুমে এসে ইউসুফ সাহেব দেখলেন ইয়াশা সবেমাত্র রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছে। হাতে ঠান্ডা পানির বোতল। ইউসুফ সাহেব সর্বপ্রথম ইয়াশার হাত থেকে পানির বোতল কেড়ে নিলেন। ঢকঢক করে অর্ধেক পানি পান করলেন।ইয়াশা তার বাবা আচরণে হকচকালো। গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলো তার বাবার উপর।দেখলো কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম,আর চোখেমুখে ক্লান্তির চাপ। সে ধীরপায়ে জায়গা ত্যাগ করতে উদ্যত হলো।
–” ইয়াশা মা?”
ইয়াশা ভড়কালো বাবার আচরণে।গত তিন-চার দিন ঠিক মতো কথাও বলেনি ইয়াশা।ইউসুফ সাহেব ইয়াশার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো।এরপর চোরাচোখে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
–” আমার সাথে একটু বাইরে আয় তো।একটা সমস্যা হয়েছে।”
ইয়াশা তার বাবার ভীতগ্রস্ত দৃষ্টি দেখে থমকালো।সচরাচর তার বাবা কখনো তাকে বাইরে নিয়ে কোন সমস্যার কথা বলেনি।ব্যাপারটায় সে হতবাক।ইয়াশার চাহনি লক্ষ করে ইউসুফ সাহেব বলল,
–” বাইরে চল মা।সব প্রশ্নের উত্তর পাবি।”
ইয়াশা মাথা নাড়ালো। ইউসুফ সাহেব স্বস্থির নিঃশ্বাস নিয়ে ইয়াশাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরুলেন। উনি চাইলে ব্যাপারটা উনার স্ত্রী-কে বলে সামলাতে পারতেন।কিন্তু সেটা অসম্ভব। মিনু আরা কাজের চেয়ে আহাজারি করেন বেশি। অস্থির মেজাজের মানুষ।কাজটা হবেই না উল্টো বিগড়ে দিবেন। সে অনুযায়ে ইয়াশা সম্পূর্ণ বিপরীত। সে পরিস্থিতি বুঝে আচরণ করতে সক্ষম।
গেটের বাইরে এসে এবার ইয়াশাও ভয় পেয়ে গেলো।ইয়াশা দ্রুত তার বাবার দিকে তাকালো।উনার মুখেও চিন্তার চাপ ল্যাপ্টানো।এতক্ষণে আসল কারণটা ইয়াশা বুঝলো।এবং বলল,
–” এখন কী করবে বাবা? লোকটি কী মৃত?
–” না না বেঁচে আছে,অচেতন। বুঝতে পারছিনা
কী করবো।”
তার উপর কাউকে ডাকার সাহস পাচ্ছিনা।জানলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে।এখানকার মানুষ গুলোকে তো চিনিস? রোহিঙ্গাদের চেয়েও খারাপ। ”
ইয়াশা ভাবনায় পড়ে গেলো। একটু পর কিছু একটা ভেবে পুনরায় বাড়িতে গেলো। বোতলভর্তি পানি নিয়ে আসলো। এরপর তার বাবাকে দিয়ে বলল,
–” বাবা উনার মুখে পানি ছিটিয়ে দাও দেখো জ্ঞান ফিরে কি-না।
ইউসুফ সাহেব দেরী না করে তাই করলেন।কিছুসময় পানি ছিটানোর পর ছেলেটার চোখ পিটপিট করতে লাগলো। ইউসুফ সাহেবের ভয়টা হালকা নিভলো।একটু পর ছেলেটি সম্পূর্ণভাবে চোখ মেললো। চোখের সামনে অচেনা মুখ দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো। ইউসুফ সাহেব বললেন,
–” এই ছেলে? তোমার এ অবস্থা হলো কি করে?আর এখানেই বা আসলে কী করে?”
ছেলেটি নিরুত্তর রইলো।যেন কিছুই শুনতে বা বুঝতে পারেনি। ইয়াশা সেটা বুঝতে পেয়ে বলল,
–” বাবা আমার মনে হয় উনি ব্যাথার কারণে কথা বলতে পারছেনা না।আমি ডাক্তারকে আসতে বলবো?”
–” কিন্তু ডাক্তার জানতে চাইলে ছেলেটা কে? আঘাত কীভাবে পেয়েছে? আর এখানেই বা আসলো কেন? তুই জানিস লোকে জানলে কী বলবে?তারা বলবে নিশ্চয় আমি মেরেছি।
তার চেয়ে ভালো হয় ছেলেটিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে চলি।সুস্থ হলে নাহয় চলে যাবে।”
ইয়াশা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার বাবার ভয় পাওয়ার কারণটা টের পেলো। সেই অনেক আগের এক ঘটনার সূত্র ধরে তিনি এমনটা করছেন।আবার তার বাবা জান দিয়ে দিতে রাজি তবে সম্মান হারাতে নয়।কিন্তু ইয়াশার আজ অদ্ভুত কারণে হাসি পাচ্ছে।যে মানুষটি আজ পর্যন্ত অচেনা কোন ছেলেকে বাড়ির আশেপাশে ভিড়তে দেয়নি,সে মানুষ আজ আতংকিত হয়ে ঠিক-ভুল বিবেচনা না করে অচেনা ছেলেটিকে বাড়িতে জায়গা দিতে চাইলো।
–“কিন্তু বাবা আঘাত গুরুতর হলে?”
–” হবেনা, ধর ছেলেটাকে।অসুস্থ মানুষের পাশে থাকা উচিত আমাদের। সে যে-ই হোক।”
ইয়াশা বিব্রতবোধ করছে। ইতস্তত বোধ করে বলে,
–” বাবা ছেলেটাকে আমি চিনিনা। এভাবে কীভাবে স্পর্শ করি।আমি বরং মাকে ডাকি।”
ইউসুফ সাহেব ধমকে বললেন,
–” না একদম না। তোকে ধরতে হবে না।আমিই দেখছি।”
ইউসুফ সাহেব আলতোভাবে ছেলেটির হাত ধরে টানলেন। ছেলেটি যেনো হালকা শক্তি পেলো।নিজের ভারী শরীরটাকে হেলিয়ে-দুয়িলে মাটি থেকে তুলল। এরপর ইউসুফ সাহের কাঁধে মাথা রাখলো।এতে ইউসুফ সাহেব মায়া হলো।উনি বরফগলা হয়ে গেলেন। মানুষ্যত্ববোধটা প্রখড় হয়ে উঠে উনার মধ্যে।ছেলেটার বয়সী নিজেরও একটা ছেলে আছে তার।ভিনদেশে সেও যদি এমন আঘাত পায়।তাহলে হয়তো তার ভালোকাজের জন্য ছেলেটিকে কেউ না কেউ সাহায্য করবেই।
ইয়াশা নির্বোধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এরপর গেট লাগিয়ে সেও তার বাবার পিছুপিছু গেলো। পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলো,
–” কোথায় নিয়ে যাবে বাবা?”
উনি সরল কন্ঠে বললেন,
–” ইয়াসিরের রুমটা তো খালি। সেখানেই নিয়ে যায়।যা তো দরজাটা খুলে দে।তোর মাকে।কিছু বলিস না এখন।কাল সকালে জানাবো আমি।আর বাড়িতে তোর সেজো আর ছোটমা আছে তাদের যা বলার আমিই বলবে।”
ইয়াশা মাথা নাড়ালো শুধু। এরপর নিজের রুম থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে তার বাবাকে দিলো। ইউসুফ সাহেব দরজাটা লাগালেন। ইয়াশাকে বলল,
–” কাবার্ড থেকে ইয়াসিরের শার্ট আর প্যান্ট আছে কি-না দেখতে।থাকলে নিয়ে আয়।”বলেই অচেনা ছেলেটির ক্ষতস্থানে তুলার সাহায্য স্যাভলন লাগিয়ে মুছতে লাগলেন।উনি লক্ষ করলেন ছেলেটির দৃষ্টি কেমন যেনো নিশ্চল।উনি বললেন,
–” তা বাবা তোমার নাম কী? এভাবে আঘাত পেয়েছো কীভাবে?”
ইউসুফ সাহেব ছেলেটির চোখেমুখে এবার অস্থিরভাব লক্ষ করলেন। মাথার পাশের রগগুলোও কেমন ফুলে উঠছে। তাই উনি জিজ্ঞেস করলেন,
–” কী হয়েছে? এমন অস্থির লাগছে কেন?”
ছেলেটি হঠাৎ ভড়াট আওয়াজে বলে উঠে,
–” আঙ্কেল আমি বুঝতে পারছিনা আমার সাথে কী হচ্ছে। আমার নামটাও মনে পড়ছেনা।মাথার ভেতরে এক অদ্ভুত শব্দ করছে যেনো কেউ পোকামাকড় ঢুকিয়ে দিয়েছেন।”
উপস্থিত বাবা মেয়ে উভয়ে চমকে গেলো।ইয়াশা চোখ বড় বড় করে ছেলেটির দিকে তাঁকালো।ইয়াশার বাবার দৃষ্টি তখন ইয়াশার দিকে।ইউসুফ সাহেব বুঝতে পারলেন ছেলেটি মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে,যার ফলে মস্তিষ্ক থেকে পূর্বের স্মৃতি মুছে গিয়েছে।উনি এবার আরো দুঃচিন্তায় পড়লেন। ইয়াশা হতবুদ্ধি হারিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে থাকলো ছেলেটির দিকে। আর ছেলেটি?
অধরকেণে বাঁকা হাসির রেখা টেনে অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ইয়াশার দিকে। একটু পর হঠাৎ বাম চোখ টিপ মারলো। ইয়াশা তা দেখে কেঁপে উঠে। তার বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে।তার আগেই ছেলেটি আর্তনাদ করে বলে উঠে,
–” উফ! আঙ্কেল আমার মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।”
ইউসুফ সাহেব দ্রুত কপালের কাটা অংশ মুছতে মুছতে বললেন,
–” আরেকটু সহ্য করো চলে যাবে।এ-কি মাথার পেছন দিয়েও তো দেখছি আঘাত পেয়েছো কীভাবে রক্ত ঝড়ছে।”
ছেলেটি ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে বলে,
— ” আঙ্কেল আমার ভয় করছে।আপনি আমাকে দিন আমি নিজে নিজে মুছে নিবো।আসলে আমার মনে হচ্ছে আপনি মুছে দিলে ব্যথা বেশি পেতে পারি।”
ইউসুফ সাহেব তাই করলেন স্যাভলন লাগানো তুলা ছেলেটির হাতে দিয়ে, ইয়াশাকে বলল,
–” পেয়েছিস?”
ইয়াশা স্তম্ভিত ফিরলেই চোখমুখে তীব্র আতংক নিয়ে বাবার দিকে তাকায়।মেয়ের এরূপ দিষ্টি দেখে উনি বিরক্ত হয়ে নিজেই উঠে এলেন,
–” দেখি সর তুই আমি দেখছি।”
ইয়াশা সরে দাঁড়ালো।
–” আঙ্কেল আমাকে একটা লুঙ্গি দিলে ভালো হয়। আসলে হাঁটুতেও ব্যাথা করছে।”
ইউসুফ সাহেব ভাবলেন ইয়াশাকে পাঠাবে।পরক্ষণে মত বদলে বললেন,
–” ইয়াশা, তুই দাঁড়া আমি লুঙ্গি নিয়ে আসছি।তোকে নানা প্রশ্ন করতে পারে ওরা।”
বলেই উনি বেরিয়ে গেলেন। ইয়াশা ভয়ে তটস্থ হয়ে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো।কতোটা সাহস থাকলে একটা মানুষ এমন একটা কাজ করতে পারে ভাবতে লাগলো ইয়াশা। মানুষটা কী পাগল?
ইয়াশা চাপা আতঙ্কিত কন্ঠে ক্রোধ ঢেলে বলল,
–” আপনি কী পাগল? বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছেন? তাও এভাবে? সত্যিই কী ব্যাথা পেয়েছেন? নাকি সব নাটক?”
নওশাদ ইয়াশার কথা শুনে হাসলো শুধু। ইয়াশা তাকিয়ে দেখতে লাগলো নওশাদের হাসি। নওশাদের মুখ আজই প্রথম দেখলো সে।তাও কেমন অদ্ভুত রক্তাক্ত অবস্থায়। ইয়াশা নওশাদের সুন্দর মুখটির তাকিয়ে বলল,
–” এমনটা না করলেও পারতেন।
নওশাদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
–” আমি সব করতে পারি।এবার আপনার বাবাকে সব বলে দিতে এসেছি আমি।”
ইয়াশা ভয় পেয়ে বলে,
— ” কী বলবেন?”
তখনি দরজা ঠেলে ইউসুফ সাহেব প্রবেশ করলেন।উনাকে দেখে নওশাদ এবং ইয়াশার কথার সমাপ্তি ঘটে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here