অফুরন্ত প্রণয়,পর্ব-৭,৮

অফুরন্ত প্রণয়,পর্ব-৭,৮
তারিন_জান্নাত

রৌদ্রস্নাত স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে কষ্টের প্রলেপ ল্যাপ্টানো। ঘন ভ্রুদ্বয় একত্রে কুঞ্চিত করে কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখলো নওশাদ।ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে চোখ তুলে একবার রোদমিশ্রিত গাঢ় নীল রঙের আকাশটার দিকে দৃষ্টিপাত করলো সে। নিগূঢ় আকাশটার দিকে চেয়ে নওশাদ ভাবলো,এই মুহূর্তে আকাশের রঙ গাঢ় নীল না হয়ে হালকা ধূসর হলে কী খুবই মন্দ হতো?
ফোনটা পুনরায় নওশাদের হাতে জায়গা পেলো।
হালকা শান্ত মেজাজি মন নিয়ে নওশাদ ডায়াল করলো রিদিতার নাম্বার। প্রথমবারে ফোন বাজতে বাজতে কেটে যায়।দ্বিতীয় বার রিসিভ হয়। রিদিতা হ্যালো বলতে যাবে তার আগেই নওশাদ উদ্ধিগ্ন কন্ঠে বলল,
–” রিদিতা? আমি নওশাদ,চিনতে পেরেছেন?”
রিদিতা হালকা চমকে গেলো।পরে নিজেকে
সামলে বলল,
–” হ্যাঁ ভাইয়া পেরেছি। কেমন আছেন আপনি।”
নওশাদ সরল কন্ঠে বলল,
–” ভালো। রিদিতা আপনার সাথে ইয়াশার যোগাযোগ হয়েছে?”
রিদিতা কুঞ্চিত ভ্রু মেলে বলল,
–” না ভাইয়া। একদিন কথা হয়েছিলো শুধু।ব্যস্ততার কারণে আমিও আর ফোন দিতে পারিনি।’
একটু থেমে রিদিতা আবার বলল,
–” কেন ভাইয়া? কিছু কী হয়েছে? আপনার সাথে ইয়াশার যোগাযোগ হয়েছে?”
নওশাদ নিচের ঠোঁট কামড়ে একটু চুপ থাকলো।এরপর হঠাৎ রিদিতার সকল প্রশ্ন এড়িয়ে বলল,
–” আপনি একটু কষ্ট করে ইয়াশার বাসায় যাবেন? উনি কেমন আছেন সেটা একটু কাইন্ডলি আমাকে মেসেজে বলবেন। যাবেন?”
রিদিতা হঠাৎ ঠোঁট টিপে হাসলো। এরপর বলল,
–” আচ্ছা ভাইয়া আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।রাখছি তাহলে?”
–” হ্যাঁ অবশ্যই।আরেকটু কষ্ট করে উনার পছন্দের খাবার,যা যা খেতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে সেগুলো নিয়ে যাবেন।আমি পেমেন্ট করে দিবো আপনাকে।”
রিদিতা কপট রাগ নিয়ে বলল,
–” ভাইয়া আপনি পেমেন্ট করবেন কেন? আমার ফ্রেন্ডের জন্য আমি এতটুকও করতে পারবোনা?”
নওশাদ রিদিতা ভুল ভাঙ্গাতে বলল,
–” স্যরি! টনশনে মাথা খারাপ হয়ে গেছে বোধহয় আমার।প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।”
নওশাদ কল কাটলো। মনটা আকুপাকু করছে তার।নিজেকে স্থির রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো সে। অতঃপর গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে এমন একজন ব্যাক্তি যে নিজের রাগ,কষ্ট,বিরক্তি,অস্থিরতা কিছুই আঁড়াল রাখতে পারেনা। স্বচ্ছ আয়নার মতো সব দৃশ্যমান হয়ে উঠে তার মুখশ্রীতে। নওশাদ ভাবলো তার কী ভেতরে যাওয়া উচিত নাকি এখান থেকেই বাড়ি ফিরে যাবে?
দোনোমোনো করতে করতে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করলো নওশাদ। টেবিলের কাছাকাছি এসে সবার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করলো।তাতে লাভ হয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ তারা উভয়ে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নওশাদের দিকে। নওশাদ নিচু হয়ে লাচ্চির গ্লাসে চুমুক দিলো আধখাওয়া খাবারগুলো তার সামনে পরে রইলো চরম অবহেলায়। চোখ তুলে পুনরায় তাকালে দেখে, সবার নজর এসে তার উপর থুবড়ে পড়ছে।
সে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে হঠাৎ ধমকে উঠলো,
–” খাচ্ছিস না কেন?আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখছিস?”
নিশাত দ্রুত স্বরে বলল,
–” কিছু না ভাইয়া,এমনি দেখছিলাম।”
বলেই হাসলো নিশাত। ইমরোজের দৃষ্টি তখন নিশাতের উপরে নিবদ্ধ।সায়ন বলল,
–” ইমরোজ? শালার মুখকান দেখ? নিশ্চয় কোন গড়বড় আছে।”
ইমরোজ সায়নকে বলল,
–“চুপ থাক।সবসময় বেশি কথা বলিস।”
সায়ন চুপ মেরে গেলেও শকুনের দৃষ্টি নিয়ে নওশাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
মিরাজ খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলল,
–” আর কোথাও যাবি তোরা?”
মিরাজের প্রশ্নে সবাই তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।কয়েক সেকেন্ড সবার নিশ্চুপ ভাবুক ভঙ্গিমায় দেখে প্রিয়ন্তি বলল,
–” ভাইয়া ‘চন্দ্রিমা উদ্যানে’ গেলে ভালো হয়।বিকেলের আমেজটা বেশ লাগে আমার।”
মিরাজ সবার দিকে তাকালো।সকলের মুখভঙ্গি দেখে বুঝলো তাদেরও মত এক।

নিজেকে রুমে আঁটকে রাখলো ইয়াশা। আজ দুপুরের খাওয়াও হয়নি তার। ইয়াশার পাশে আরিফা বসে নওশাদের দেওয়া ফোনটা দেখছে। চোখমুখে অদ্ভুত হাসির রেশ তার। ইয়াশার হাতে ফোন দেখে বিমূঢ় হয়ে যায় আরিফা। বয়সে দুই বছরের ছোট হলেও ইয়াশার সাথে আরিফার বন্ডিং বেশ ভালো।তাই ইয়াশা গোপন না করে সত্যিটা জানিয়ে দিলো।
ফোন দেখতে দেখতে আরিফা বলল,
–” আচ্ছা আপু, উনার নামটা কী?”
ইয়াশা ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে বলল,
–” জানিনা।”
–” আল্লাহ! নাম জানো না? আচ্ছা দেখতে কেমন? নিশ্চয় সুন্দর? আমি কিন্তু কল্পনা করে ফেলছি কেমন দেখতে?
ইয়াশা চাপা বিরক্তি নিয়ে বলল,
–” উফফ! আমি কিছুই জানি না আরিফা।
লোকটি কে? কোথায় থাকে? কী করে? বা তার উদ্দেশ্য কী সেটাও জানিনা। দেখতে কেমন সেটার কথা বাদ-ওই দিলাম।”
একটু থেমে হঠাৎ শান্ত কন্ঠে বলল,
–” তবে লোকটার কন্ঠস্বর কেমন তা জানি। যদিও আবার কখনো শুনি তবে দশজন লোকের ভেতর থেকে আমি ওই স্বল্প পরিচিত কন্ঠটি চিনতে পারবো।”
আরিফা দুষ্টুমির ভঙ্গিতে হেসে বলল,
— ” হাহ! অসম্ভব, দশজন লোকের কন্ঠস্বর একসাথে শুনতে গেলে একি শুনাবে।আলাদা করা যাবেনা।”
ইয়াশা ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,
–” সম্ভব! আমি চিনতে পারবো।”
— ” আচ্ছা!”

দরজার করাঘাতে দুই বোনের কথামালার ইতি ঘটে।ফোনটা লুকিয়ে আরিফা দরজাটা খুলল। সামনে আস্ত স্বল্প চেনা এক যুবতিকে দেখে আরিফা হেসে বলল,
–” কেমন আছো আপু?”
রিদিতা মুচকি হেসে বলল,
–” ভালো আছি তুমি কেমন আছো?
–” আমি ভালো।ভেতরে আসেন আপু।
রিদিতা ভেতরে আসলো। ইয়াশা তখন মেঝেতে হাঁটু ভেঙে ‘দ’ ভঙ্গিতে বসে ছিলো। রিদিতাকে হঠাৎ দেখে চমকালো সে।কারণ রিদিতা অতি প্রয়োজন ছাড়া কখনো না জানিয়ে তাদের বাড়িতে আসেনা। আজকের হঠাৎ আগমনে সে চমকালো। ইয়াশা শান্ত হাসি হেসে বলল,
–” কি রে? কেমন আছিস?”
রিদিতা সূক্ষ্ম চাপা অভিমান নিয়ে বলল,
–” আমি তো ভালো আছি,তুই-ই ভালো নেই দেখছি।তোদের বাড়িতে এতকিছু হয়ে যাচ্ছে আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলিনা?”
ইয়াশা রিদিতাকে বলল,
–” আমি নিজেই জেনেছি সকালে। তার উপর সারাদিন রুম থেকে বের হয়নি। বিকালে একপ্রকার বাধ্য হয়ে মেহমানদের সামনে গিয়েছি।”
রিদিতা ইয়াশার পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছে। সে নওশাদের কথা ভাবছে। রিদিতা তো অবুঝ নয় যে একটা ছেলের অনুভূতি বুঝবেনা। নওশাদের আচরণে বরাবরেই সে বুঝতে পারছে নওশাদ ইয়াশাকে পছন্দ করে।এবং তা মাত্রাতিরিক্ত। নাহলে এতোটা অস্থির হয়ে ফোন করতোনা।ইয়াশার খবর জানতে চাইতো না। রিদিতা ইয়াশার মুখোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। রানী গোলাপি শার্টটার কারণে পুরো মুখশ্রী গোলাপি হয়ে আছে। রিদিতা মুগ্ধ হয়ে দেখে ইয়াশার আদুরে মুখটা।
ইয়াশার দিকে হাতে থাকা প্যাকেট গুলো বাড়িয়ে দিলো রিদিতা,
–” এই নে তোর ফেবারিট চকলেট মুজ কেক,আর স্ট্রবেরী সুইস রোল কেক এনেছি।”
ইয়াশা প্যাকেট হাতে নিয়ে আরিফা দিলো। বলল,
–” যা আমাদের জন্য পিস করে কেটে নিয়ে আয়।আর মাকে বলিস নাস্তা দিয়ে যেতে।”
আরিফা যেতেই ইয়াশা রিদিতাকে বসতে বলে ওয়াসরুম গেলো চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিতে।
সেই ফাঁকে রিদিতা ইয়াশার বিয়ের ব্যাপারটা সহ সব নওশাদকে জানিয়ে দিলো।

নওশাদের কাছে এখন গোটা দুনিয়াটা কঠিন মনে হচ্ছে। চরম অধৈর্য হয়ে সে অদ্ভুত কাজ করে ফেললো। হাতের ফোনটা সজোরে আঘাতে দু-ভাগ হয়ে গেলো। পাশ থেকে সায়ন কেঁপে উঠলো। নওশাদের কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
–” নওশাদ কী হয়েছে? ফোন ভাঙলি কেন?”
নওশাদ শক্ত চোয়াল-সমেত মাথা নুইয়ে রাখলো। মাথাটা কেমন যেনো করছে তার।হঠাৎ তার ইমরোজের কথা মনে পড়লো।সে-ই পারে সব সমস্যার সহজ সমাধান দিতে। নওশাদ রক্তিম মুখ তুলে, ভাঙা কন্ঠে বলল,
–” ইমরোজকে ডাক!’
সায়ন তাই করলো। দ্রুত ইমরোজকে ডাকতে গেলো।সবাই উদ্যানে এসে হাঁটাহাঁটি করলেও নওশাদ আর সায়ন নিরিবিলি জায়গায় বসেছিলো এতক্ষণ।

(চলবে)

অফুরন্ত প্রণয়’
#তারিন_জান্নাত

৮.
ধরণী জুড়ে সায়াহ্নের আমেজ। কোথাও হৈ-হুল্লোড় তো কোথাও নিস্তব্ধতা। এমন একটা প্রহড়ে গভীর মনোযোগে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘পরিণীতা’ বইটি পড়ছিলো। বলাই বহুল্য বই পড়লে ইয়াশার নিজের মনকে চিন্তামুক্ত রাখতে পারে।বই পড়ার সময় তার ভাবনায় কখনো অন্য ভাবনার অস্তিত্ব এসে কড়া নাড়তে পারেনা। যখনি কোন বই সম্পূর্ণ পড়ে সমাপ্ত করতে পারে তখনি ইয়াশার কোমল মনটা সতেজতায় পূর্ণ হয়ে উঠে।

বইয়ের জগতে বিচরণকৃত মস্তিষ্ক আচমকা বিকট শব্দে মনোযোগ ভ্রষ্ট হয় ইয়াশার। নাক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস টেনে চোখ তুলল সে। সেই বিরক্তির মুখ দৃশ্যমান হলো।ইয়াশা ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
–” কিছু লাগবে?”
হেসে একগাল পানের পিচকারি ইয়াশার বাথারুমে ফেলতে চাইলো তার সেজো কাকিমা। ইয়াশা হটাৎ রেগে উঠে বলল,
–” এসব কী হচ্ছে সেজো-মা? পানের পিচকারি ফেলার আর জায়গা পাচ্ছোনা? এখানে ফেলতে এসেছে?”
শেফালি ভ্রু-তে ভাঁজ তুলে ইয়াশার দিকে চেয়ে লাল দাঁতের হাসি দিয়ে বলল,
–” আরে বেসিং এ ফেলবোনা,কমোডে ফেলবো।”
বলেই উনি বাথরুমের দিকে ছুটলেম। ইয়াশা ক্রুড় নিঃশ্বাস ফেলে পাশে শায়িত আরিফার দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লো। মেয়েটা কী শান্তভাবে ঘুমাচ্ছে।শ্যামলা তৈলাক্ত চেহারা চিকচিক করছে।তার সেজো কাকি আর তনয়া চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটা মানুষ আরিফা।সহজ,সরল, এবং তার মনটাও স্বচ্ছ।অথচ তনয়া,সেজো কাকি,সুমনা আর তার মা সবসময় তাকে কটু কথা শুনাতে পিচপা হয়না। তন্মধ্যে ইয়াশার ছোট কাকি অন্য ধাঁচের মহিলা।কথা কম বলে,মনের ভেতরকার খবর ইয়াশা জানেনা।তবে তার সাথে কখনো খারাপ আচরণ করেনি।
শেফালি ইয়াশার ফেসওয়াস দিয়ে মুখমণ্ডল ভালোমতন ধুয়ে ওয়াসরুম থেকে বের হয়। ইয়াশার তোয়ালে ধরতে নিলে ইয়াশা বলে উঠে,
–” সেজো-মা আমার তোয়ালেতে মুখ মুছোনা প্লিজ।মায়ের কাছে গামছা আছে।”
অগত্যা শেফালি নিজের পরিহিত শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে ইয়াশার বিছানায় বসলেন। একসময় ইতিউতি না করে সরাসরি বললেন,
–” ইয়াশা! গত ঈদে ইয়াসির বিদেশ থেকে যে পোশাকটা পাঠিয়েছিলো তোর জন্য। ওইটা নাকি তনয়ার খুব পড়তে মন চাইছে। বান্ধবী না কার জানি বিয়েতে পড়বে। ওইটা দেতো।”.
ইয়াশার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি নিয়ে বলল,
–” ওইটা তো তনয়ার ফিট হবেনা।”
–” হবে হবে! দর্জির কাছ থেকে ছোট করাবে।”
মায়ের কন্ঠে সজাগ হয়ে উঠে আরিফা।দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো।ইয়াশা চুপচাপ উঠে কবার্ড থেকে একটা এ্যাশ কালারের গাউন বের করলো,সঙ্গে একটা শপিংব্যাগ।
–” দুঃখীত সেজো-মা ভাইয়ার দেওয়া পোশাকটা দিতে পারছিনা।তবে এইটা তনয়াকে দিও। আমি একবার পরেছি শুধু।এই নাও।”
ইয়াশা গাউনটা তার সেজো-মার হাতে ধরিয়ে দিলো।এরপর শপিং ব্যাগটা আরিফার দিকে দিয়ে বলল,
–” এটা তোর,দেখ পছন্দ হয় কিনা।”
আরিফা শপিংব্যাগটা হাতে নিলো।তার ভেতর থেকে ডার্ক ব্লু কালারের গাউনটা দেখে হেসে বলল,
–” তোমার চয়েস কখনো খারাপ হয়না আপু!”
শেফালি তেঁতে উঠে বলে,
–” ওর জন্য নতুন কিনেছিস,তনয়ার জন্য কিনতে পারিস নি?”
ইয়াশা সরল কন্ঠে বলে,
— ” আমি কেন কিনতে যাবে ওর জন্য।”
শেফালি তীব্র আক্রোশে ইয়াশার কক্ষ ত্যাগ করেন।
ইয়াশা পুনরায় বই হাতে নিয়ে বিছানায়
বসতে বসতে বলে,
–” তোর মা একটা চিজ আরু। সবসময় আমার পছন্দর জিনিসের উপর নজর থাকে তার।”
আরিফা চুপ থাকলো শুধু।মুখে তার রা নেই।

গুলশানের একটা ফ্ল্যাটে ভাড়ায় থাকে ইমরোজ আর সায়ন। ফ্ল্যাটটা মূলত ব্যাচেলারদের জন্য। কর্মস্থল নিকটে হওয়ায় এই ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় তারা। ইমরোজ নওশাদকে তখন কোনরকম শান্ত করে নিজেদের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে সে। রাফি আর তৌফিককে দিয়ে নিশাত,প্রিয়ন্তি আর প্রান্তিকাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় মিরাজ। গত কয়েকদিন যাবৎ মিরাজ কাজের সূত্রে নওশাদের সাথেই ছিলো।কাজের মাঝে নওশাদের মুখের উপর ল্যাপ্টানো নিগূঢ় যন্ত্রণাকে এতদিন সে ক্লান্তি হিসেবে ধরে নিয়েছিলো।তবে আজ এই নিগূঢ়তম কাহিনীটা বুঝতে পারলো সে।
কপালে হাত রেখে চোখজোড়া বুঁজে রেখেছে নওশাদ।আসার পর থেকে একটা বাক্যও উচ্চারণ করেনি। ইমরোজ আর সায়ন চেহারার ফ্যাকাশে ভাব তুলে নওশাদকে পর্যবেক্ষণ করছে।
সায়ন বলল,
–” নওশাদ আমার মনে হয় তোর যাওয়া উচিত সেখানে।যদি বিয়েটা হয়ে যায়?”
নওশাদ তখনো চুপ রইলো। সায়ন আবার বলল,
–” যদি বিয়ে হয়ে যায় তাহলে তো তুই একটা দাবাংমার্কা ছ্যাকা খাবি।”
সায়নের কথা শেষ হতেই হঠাৎ নওশাদ শুয়া থেকে উঠে বসে। নিচ থেকে নিজের একটা জুতা কুঁড়ে নিয়ে সায়নের দিকে ছুঁড়ে মারলো। বেচারা সায়ন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সে ভেবেছিলো নওশাদ অধিক শোকে কাতর হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে যাবে।কিন্তু ঘটলো তার বিপরীত।সায়ন স্পষ্ট রাগ দেখতে পাচ্ছে নওশাদের চেহারায়।জুতাপেটা খাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে সে দ্রুত দাঁড়িয়ে বলল,
— ” স্যরি স্যরি দোস্ত ভুল হয়ে গেছে।”
সায়নের কথার মধ্যে ইমরোজ আর মিরাজ কানে আঙুল ঢুকিয়ে দিলো। অতিরিক্ত রেগে গেলে নওশাদের মুখে ভাষা তখন জগন্য হয়ে যায়।
সায়ন করুন কন্ঠে বলে,
–” ভাই মাফ চাইছি।স্ল্যাং থামা তোর।”
নওশাদ ছোট টেবিলে লাথি মেরে মিরাজকে বলল,
–” আমি না আসা অবধি অফিস তুই সামলাবি। আর বাবাকে আমি বলে দিবো।কাজে কোন গড়বড় না হয় যেনো।” বলেই নওশাদ বেরিয়ে গেলো।
সায়ন ইমরোজ আর মিরাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
–” দেখছস শালা কতো খারাপ? বন্ধুরে কেউ এমনে গালি দেয়। আমরা কী পর?”
ইমরোজ হাসতে হাসতে বলল,
–” ছাড় তুই জানিস না নওশাদ কেমন। গালি তুই আজ প্রথম শুনছিস? রাগালি কেন ওকে”
নওশাদ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের জন্য ফোন কিনতে যায়। এরপর গেলো কক্সবাজার যাওয়ার উদ্দেশ্যে এয়ার-টিকেট কাটতে।

দুইদিন পর||

সমুদ্রের তীরে বালুচরে দাঁড়িয়ে সূর্য উদয় দেখতে ব্যস্ত ইয়াশা। মৃদু সোনালি আলোয় ইয়াশার টানা ধূসর আঁখিদুটি দেখতে চমৎকার লাগছে। আশেপাশে অনেকে এসময়ে তাদের প্রিয়তম-প্রেয়সীদের নিয়ে সূর্য উদয় দেখতে ব্যস্ত।
ইয়াশার থেকে কিছুটা রিদিতা,আরিফা, আর ফাহিম এবং তার মা বসা।যে যার মতো গল্পে ব্যস্ত। ভোর চারটায় পরিচিত গাড়ি রিজার্ভ করে তারা সি-বিচ এ আসে।
ইয়াশা সচরাচর ঘুরাঘুরি কম করে। কিন্তু গতকাল রাত থেকে মনে অদ্ভুত ভাবে ইচ্ছে জাগে এখানটায় আসার। কেউ যেনো তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে। ইয়াশার যষ্ঠেন্দ্রিয় কিছু একটা সংকেত দিলো তাকে। সে দ্রুত একবার ডানদিকে আরেকবার বামদিকে তাকালো। পুনরায় বামদিকে দৃষ্টিপাত করলো সে। কালো হুডি পড়া ক্যামেরা হাতে যুবকটি ইয়াশাকে তাকাতে দেখে হাত নাড়ালো। মাথায় কালো ক্যাপ, কালো মাস্ক। ইয়াশার বুকটা আচমকা ধড়ফড়িয়ে উঠে। সে নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। যুবকটির চোখজোড়া,এবং হাতজোড়া দৃশ্যমান। নওশাদ ইয়াশাকে দেখে মাস্কের আঁড়ালে মুচকি হাসলো।
ডানহাত উঁচিয়ে ইয়াশাকে বিদায় জানালো।
এরপর মানুষের ভিড়ে নিজেকে আড়াল করে নিলো। ইয়াশা উদ্ধিগ্ন হয়ে যায়।চেহারায় কঠিন্য ভাব ফুটিয়ে, ক্রোধমিশ্রিত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
–” পালাচ্ছেন কেন? আপনি কী ক্রিমিনাল? চেহারা লুকিয়ে রেখেছেন কেন?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here