অফুরন্ত প্রণয়,পর্ব-৫,৬
তারিন_জান্নাত
পর্ব-৫
কুচকুচে কালো কুঁকড়ানো চুল কোমড় অবধি ছাড়িয়ে রেখেছে ইয়াশা। আরশিতে নিজের প্রতিবিম্বকে স্থির দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকলো নির্নিমেষ।কুঁকড়ানো চুল,গোলগাল ভরাট মুখশ্রি,ভরাট শরীর এসব নিয়ে প্রণয়ের জোয়ার পা ডুবানো নিচক বোকামি বৈ কিছু নয়। শ্লেষপূর্ণ হাসি হেসে চুল থেকে চিরুনি নামিয়ে রাখলো ইয়াশা। চোখ ছলছল করছে ইয়াশার। কর্ণকুহরে আজো স্পষ্ট শুনতে পায়, শৈশব,কিশোরী কালে আত্মীয়-স্বজন,সহপাঠীদের বিদ্রুপাত্মক কথা,হাসি।তাকে নিয়ে সমালোচনা। মনে পড়লেই হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তার। ইয়াশার বয়স এখন উনিশের কোটায়। বিবাহোপযোগী যুবতীও বটে সে এখন।
ড্রেসিং টেবিলের উপরে কালো ফোনটির দিকে একপলক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ইয়াশা। মেজাজ ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছিলো লোকটির দেওয়া বাক্সে থেকে ফোনটি দেখে। হুট করে অচেনা এক যুবক এসে তার হাতে ফোনের বাক্স ধরিয়ে দিলো,আর সে নিয়ে নিলো। কতোটা বোকা,গাধী সে আজ প্রমাণ হলো। ফোনের স্ক্রিন পুনরায় জ্বলতে জ্বলতে নিবে গেলো। ইয়াশা চাপা ক্রুর হাসলো শুধু। ব্যাপারটা যদি ফাহিম জানতো।তুলকালাম বাঁধাতো সে। সেজন্যই তো সে বাক্সটির ভেতর তার সঙ্গে নিয়ে আসা সাইন্স ফিকশন বইটি রেখে পুনরায় পেপার মুড়িয়ে দিলো। আরো কিছু ছিলো একটা প্যাকেটে। কী সেটা দেখার আগ্রহবোধ করলোনা ইয়াশা। তার একটা ফোন অবশ্যই লাগতো। তবে সেটা পরিবার থেকে দেওয়া। কোন অচেনা পুরুষের থেকে নয়। ফোনটা তক্ষুনি ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করেছিলো তার। নেহাৎ এতো দামী একটা ফোন সে নষ্ট করতে পারেনা। যার জিনিস তাকেই ফেরত দিয়ে দিবে ভাবলো।
ইতিমধ্যে বিকেলের বেলুনের ঘটনাটা মনে পড়লো। তখন সে প্রায় সে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো।ইয়াশা চট করে মনে মনে আওড়ালো,
–” লোকটা জাদু-টোনা জানে না তো?আমার উপর কালুজাদু করলে?”
নিজের ভাবনা নিজেই হতভম্ব হলো ইয়াশা। তার জায়গা থেকে সে অবশ্যই ঠিক। তার এখনো কিশোরী কালের একটা ঘটনা মাঝে সাঝে মনে পড়ে। গ্রীষ্মের ছুটিতে তার নানুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো।বয়স তখন ষোল। প্রতিবেশী এক মামাতো ভাই তাকে প্রেমপত্র দেয়। ষোল বছর বয়সী আবেগীকন্যা প্রেমপত্র গ্রহন করে।মিষ্টি মিষ্টি কথার জালে নিজেকে বুলিয়ে ফেলে। তখনও মুখোশের আড়ালে থাকা চেহারার সম্পর্কে বোধগম্য ছিলোনা সে। প্রেমের সপ্তম দিন জানলো ছেলেটির আসল অভিসন্ধি। জানলো এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্রের কাহিনী। সেদিন থেকেই ইয়াশা নিজেকে শক্ত করে ফেললো।
–” নওশাদ! না খেয়ে ফোনে কি করছিস?”
মায়ের কন্ঠে চোখ তুলে তাকালো নওশাদ। ভাই-বোন গুলো সব এক এক করে নওশাদের দিকে চোখ তুলে তাকালো। এক নজর দেখে চোখ নামিয়ে নিঃশব্দে খাবারে মনোযোগ দেয়। সুজলা ছেলের মুখপানে চেয়ে আছেন উত্তরে আশায়।
নওশাদ হালকা কেশে বলল,
–” একজন কে ফোন দিচ্ছি।”
–” সেটা ঠিক আছে,তবে আগে খেয়ে নে তারপর ফোন দিস।”
তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নওশাদ।ডানহাত বেসিংএ ধুতে ধুতে বলল,
–” ইট’স ভেরি ইম্পর্রেন্ড!”
নওশাদ শব্দ তুলে পদযুগল চালিয়ে নিজ কক্ষে চলে গেলো। নওশাদের চাচাতো বোন প্রিয়ন্তি তার বাকি ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চাইলো, ‘ব্যাপার কী?’। প্রিয়ন্তির ইশারায় তার ভাই-বোন মহল অর্থাৎ রাফি,তৌফিক, মিরাজ,নিশাত মাথা দু’প্রান্তে নাড়িয়ে নাবোধক বুঝালো। যার অর্থ তারা বুঝতে পারছেনা আসল কারণ।
তৌফিক সুজলাকে বললেন,
–” বড়মা, বিগ-ব্রো কে কেমন যেনো আপসেট দেখাচ্ছিলো তাই না?”
সুজলা জবাবে বললেন,
–” অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে বোধহয়। তাই এমন করছে। বিশ্রাম নিক ও।”
রাফি আফসোস স্বরে বললাম,
–” কোথায় আমরা বিগ-ব্রো এর সাথে খাবো বলে এতরাত অবধি অপেক্ষা করলাম। আর সে আমাদের রেখেই আধখাওয়া ভাত রেখে উঠে গেলো এটা কোন কথা?”
মিরাজ ধমকে বলল,
–” চুপচাপ খা। হয়তো ভাই ক্লান্ত।এতো প্যাঁচাল পারিস কেন?”
মিরাজের ধমকে সবাই খেতে লাগলো।
ব্যালকনিতে থাকা ফুলের টবটা সজোরে লাথি মারলো নওশাদ। রাগটা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে রূপ নিয়েছে এখন। নিজেকে কেমন দিশেহারা লাগছে তার।অনুভব করলো শরীর বেয়ে ঘাম ঝড়ছে তার। শিরা-উপশিরা রাগে ফুলে উঠেছে যেনো।দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ক্যাটক্যাট শব্দে তুলে ফোনের কি-বোর্ডে টাইপ করলো,
–” ফোন রিসিভ করেন। আপনার সাথে কথা আছে।”
ফোনটা হাতে রেখে অপেক্ষা না করে রেখে দিলো। গায়ের টি-শার্টটা খুলে সোফায় ছুঁড়ে মারলো। এসির ট্যাম্পেরেচার বাড়িয়ে শুয়ে পড়লো। দশমিনিট পর হঠাৎ মেসেজ টুন বেজে উঠে।তড়িৎ গতিতে শুয়া থেকে উঠে ফোন হাতে নিলো নওশাদ। স্ক্রিনে মেসেজ নোটিফিকেশন জ্বল জ্বল করে ভাসছে।সেখানে আঙুলে চাপ বসিয়ে মেসেজটা দেখে মেজাজ খিঁচে উঠলো আবারো।
ইয়াশা নওশাদের সর্বশেষ মেসেজটা উপেক্ষা করতে পারলোনা। তাই দশমিনিট পর উত্তর দিলো। তাতে লেখা ছিলো,
–‘ আমি কোন অসভ্য লোকের সাথে কথা বলবো না। আর আপনি আপনার ফোনটা এসে নিয়ে যাবেন। আমি লোভী নয়।যে চকচকে দামী ফোন দেখো আপনার সাথে কথা বলতে উতলা হয়ে যাবো।যত্তসব!’
নওশাদ মূঢ়কন্যাটির মূঢ়তা দেখে অধর কিঞ্চিৎ ফাঁক করে হাসলো।সে ফোনটা দিয়েছিলো যোগাযোগ রাখতে।আর বিড়ালচোখী ভাবলো তার উল্টো।সে নাকি লোভ দেখাচ্ছে।নওশাদ আবারও লিখলো,
–” অবশ্যই আসবো। তবে কখন সেটা বলতে পারছিনা। তবে একটা অনুরোধ কথোপকথন টুকু সক্রিয় থাকুক।’
পর পর আরেকটা মেসেজ পাঠালো নওশাদ,তাতে লেখা ছিলো,
–” অসভ্যতামি কীভাবে করে জানিনা।তবে এবার থেকে অসভ্য হওয়ার চেষ্টা করবো।বিড়ালচোখী!”
ইয়াশা ঘুমঘুম চোখে লেখাটা দেখলো। কোন প্রতিক্রিয়া করলোনা।পরের লেখাটা দেখে হঠাৎ আঁতকে উঠলো। দ্রুত ফোনটা বন্ধ করে দিলো ইয়াশা। উত্তেজিত মস্তিষ্ক নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
তার কাছে ফোন থাকলেও ফোন সম্পর্কে মোটামুটি অল্প ধারণা আছে। তার মায়ের কাছেও স্মার্টফোন আছে। তবে একটা সূক্ষ্ম কারণে এখন সে ফোনটায় ইয়াশা হাতও লাগায় না। তবে ইয়াসির ফোন দিলে কথা বলে শুধুমাত্র।তার বাইরে ছুঁয়েও দেখেনা।
নওশাদ দ্রুত ঘুমানোর চেষ্টা করলো।কাল তাকে অফিসে যেতে হবে। তার বাবা দেশে বাইরে যাওয়া-ই অফিসটা এখন তাকে সামলাতে হবে। যদিও নওশাদের বাবা নূর মোস্তফা করিম ছেলেকে যথেষ্ট ছাড় দিচ্ছেন। ছেলের বয়স সবে সাতাশ হলো।আর কিছুদিন ঘুরাফেরা করুক,আনন্দ করুক তার পরেই উনার ব্যাবসায় বসাবেন।আপাততে ছেলের উপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছেন না।
নওশাদের চোখজোড়া ঘুমে ঢলে পড়লো।
(চলবে)
অফুরন্ত প্রণয়’
#তারিন_জান্নাত
৬.
||পনেরো দিন পর||
ড্রয়িংরুম থেকে চেঁচামেচির শব্দ কর্ণগোচর হতেই বই থেকে মনোযোগ ভ্রষ্ট হলো ইয়াশার।এলোমেলো চুল পেঁছিয়ে হাত খোঁপা করে ড্রয়িংরুমের উদ্দেশ্যে পদযুগল বাড়ালো। ড্রয়িংরুমে এসেই ইয়াশার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেনো। পুরাতন বাড়ি থেকে ইয়াশার দুই চাচি,এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা এসেছে। ইয়াশাকে দেখেই তার সেজো কাকি পান খাওয়া গালে হেসে বলল,
–” আরে ইয়াশা যে, কেমন আছিস মা? আয় আয় এদিকে আয় কতদিন দেখিনি তোকে?”
ইয়াশা দাঁত কটমট করে মনে মনে বলল,’যেনো কয়েক যুগ পর দেখা হচ্ছে।ন্যাকামির শেষ নেই এদের।ইয়াশা রান্নাঘরে নজর রাখলো। তার মা অতি ব্যাস্ত সহকারে নাস্তা পানির আয়োজন করছে। ইয়াশা তার ছোট কাকির দিকে তাকিয়ে সালাম দিলো। সেজো কাকি,ছোট কাকি উভয় সালামের জবাব দিলো।ইয়াশা আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
–” জেঠি-মা আসেনি?”
ছোট কাকি উত্তরে বললেন,
–” না রে ইয়াশা,বড় ভাবির অসুখ। কিন্তু তোর সুমনা আপু এসেছে।”
সুমনার নাম শুনে রাগ আরো বাড়লো ইয়াশার। জেঠি মা না আসায় যতটা খুশী হয়েছিলো সুমনা আসায় দ্বিগুন মন খারাপ হলো ইয়াশার। ইয়াশা তার ছোট-কাকির পাশে বসলো। তখনি ছাদের সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে আসতে লাগলো সুমনা,আর আরিফা,তনয়া। আরিফা আর তনয়া সেজো কাকির মেয়ে। আরিফা এসে ইয়াশাকে বলল,
— “কেমন আছো আপু?”
–“ভালো আছি, তুই?
সুমনা ফোঁড়ন কেটে বলল,
–” ভালো তো থাকবি-ই বড়লোক বাড়ি থেকে সম্মন্ধ্য যে আসলো।”
সুমনার কথায় তনয়া ফিক করে হেসে দিলো। ইয়াশা না বুঝে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আরিফা বলল,
–” তুমি বুঝি এজন্যই অখুশি আছো সুমনা আপু।”
আরিফার কথায় তার মা ধমকে উঠে বলল,
–” এসব কেমন কথাবার্তা আরু।বড়দের সাথে এভাবে কথা বলে?”
আরিফা সুমনার দিকে তাকিয়ে বলে,
–” আপু ও তো ছোটদের সাথে ঠিকমতো ব্যাবহার করতে জানেনা।”
ইয়াশার চিন্তিত মুখে আরিফার হাতে হাত রাখলো।এতে আরিফা থেমে চুপচাপ বসে থাকে। ইয়াশা উঠে রান্নাঘরে চলে গেলো।চাপা রাগ মেশানো
কন্ঠে বলে উঠলো,
–” মা এসব কী? তিনমাস হয়নি এখনো ওদের যাওয়ার।আবার কেন আসতে বলেছো? তুমি জানোনা ওদের আচরণ কেমন? আমাকে অপমানিত হতে দেখে তোমার ভালো লাগে তাই না?”
মিনু উৎকন্ঠা হয়ে বলল,
–” ইয়াশু,আমি আসতে বলিনি তাদের। তোর বাবাই বলেছে। সেদিন ইয়াসমিন যে বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলো,আমি না করে দিয়েছিলাম।তাই তোর বাবাকে ধরলো। পরিবার ভালো শুনে তোর বাবাও রাজি হয়ে গেলো।আমার বারন শুনলো না।”
ইয়াশা রক্তিম চোখমুখ নিয়ে বলল,
–” হ্যাঁ আমি তো বোঝা হয়ে গেছি তোমাদের জন্য। আমার খাওয়া-দাওয়ার খরচও সামলাতে পারছো না।অতিরিক্ত খাই যে। তাই বিদায় করতে চাইছো? আমি ভাইয়াকে বলবো সব।”
মিনু আঁতকে উঠলেন,
–” এই এই সোনা-মা ইয়াসিরকে বলিসনা।তুই তো জানিস সে তোর ব্যাপারে কতোটা পজেটিভ। এসব শুনলে রেগে যাবে।ওকে শুনাতে নিষেধ করেছে তোর বাবা।”
–” যা ইচ্ছে করো তোমরা। আমি পাত্রপক্ষের সামনে আসবোনা বলে দিলাম।বার বার অপমানিত হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া শ্রেয়।”
ইয়াশা আর দাঁড়ালো না। ক্রোধান্বিত চেহারা নিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেলো। দরজা আঁটকে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো ইয়াশা। নিজেকে মাত্রাতিরিক্ত অসহায়বোধ হচ্ছে তার। কেন কেউ বুঝেনা তাঁকে। ইয়াশা ডানটা হাতটা একনাগাড়ে দেওয়ালে আঘাত করে বলতে লাগলো,
–” আমি কারো দয়া-করুনা চাইনা। চাই না কেউ বাধ্য হয়ে আমার সাথে সম্পর্কে গড়ুক।কারো কামনার বস্তুও হতে চাই না।”
ইয়াশা ভেজাচোখে হাতের দিকে দৃষ্টি রাখলো। টকটকে লাল হয়ে আছে হাতটা। হাতের চিনচিন ব্যাথাটার কাছে মনে ব্যাথাটায় জিতে যাচ্ছে।
–” আজকে অফ-ডে ব্রো চলো না
কোথাও ঘুরতে যাই?”
নওশাদ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে তৌফিকের দিকে তাকালো একবার। তৌফিক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। নওশাদ বুঝতে পারলো তৌফিককে হয় প্রিয়ন্তি নয় নিশাত পাঠিয়েছে।
নওশাদ শান্ত কন্ঠে বলল,
–” আমি এখন ব্যাস্ত আছি তৌফ।”
–” তাতে কী ব্রো? লাস্ট চৌদ্দ দিন থেকে তুমি ব্যাস্তই আছো। কিন্তু ব্যাস্ততাকে সবসময় আঁকড়ে না রেখে মাঝেমাঝে সময় বের করা উচিত। ফ্রী-টাইম কখনো আমাদের এসে হাতছানি দিয়ে ডাকবেনা ব্রো।আমদেরই খোঁজে নিতে হয়।”
নওশাদ তোফিকে কথা শুনে কিছু
একটা ভেবে বলল,
–” সবাইকে বিকালে রেডি থাকতে বলিস।”
তৌফিক চোখমুখে আমোদিত ভাব এনে মাথা নাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
তৌফিক যেতেই নওশাদের মুখশ্রীতে অভিমান এসে ভিড় জমলো।স্বাদে সে ব্যাস্ত থাকেনি। ইচ্ছেকৃতভাবে নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রেখেছে সে। নাহলে কেউ একজনের কথা মনে পড়তে পড়তে মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছিলো তার। দহনে পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাচ্ছে সে।অথচ মনের আড়ালে থাকা মেয়েটি কী সে খেয়াল রাখে?
চাপা অভিমানে দগ্ধ হৃদয় নিয়ে নওশাদ ফোনটা হাতে নিলো।মেসেজ অপশনে গিয়ে কিছু টাইপ করতে চাইলো। আবার আঙুলের চলাচল থামালো। গত একসপ্তাহ ধরে ইয়াশাকে বিরক্ত করা ছেড়ে দিয়েছে। টানা এক সপ্তাহ মেয়েটিকে অনবরত ফোন আর মেসেজ দেয় নওশাদ। অথচ মেয়েটি কেমন নিশ্চুপ।না ফোন তুলে,না মেসেজের রিপ্লাই করে। এতোটা অবহেলা নওশাদ কখনো পায়নি।তাই সে গত একসপ্তাহ ধরে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। আজ মনটা সহ্যসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে।নিজেকে ধমাতে না পেরে অবশেষে নওশাদ লিখেই ফেললো,
–‘ আমি অবহেলা সহ্য করতে পারিনা।আর সেই আপনি-ই আমাকে অবহেলা করছেন।’ মেসেজটা সেন্ড করে কিছুক্ষণ নিরব থাকলো নওশাদ।এরপর বিছানার হেডবোর্ডে মাথা ঠেকিয়ে চোখজোড়া বুঁজে নিলো।
বিকেলের দিকে সবাই রেডি হয়ে ড্রিয়ংরুমে এসে দাঁড়ালো।এবার অপেক্ষা নওশাদের। নওশাদ তার অভ্যাসমতো সবশেষে সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে লাগলো। সুজলা মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকলো নওশাদের দিকে। ভরাট শরীরে যুবকটাকে দেখলে চোখ জুরিয়ে যায় সুজলার।যেনো এক রাজপুত্র।সাদা শার্টটা শরীরের সঙ্গে সেঁটে আছে। নওশাদ সম্পূর্ণ তার বাবার মতো দেখতে। সুজলা চোখ সরিয়ে নিলেন ছেলের উপর থেকে।মায়ের নজরও লেগে যায় তার সন্তানদের।
যথাসময়ে ইমরোজ আর সায়ন এসে উপস্থিত হয়।
নওশাদ সবার দিকে এক পলক চেয়ে দেখলো,একজন কে না দেখে নওশাদ গলা উঁচিয়ে ডাকতে গেলো।তার আগেই রাফি হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।
মিরাজ বলল,
–” আস্তে আয় পড়ে যাবি নইতো।”
পরিবারের ছোট সদস্য দশ বছরের প্রান্তিকা।প্রিয়ন্তির ছোট বোন রাফিকে
দেখে একগাল হেসে বলল,
–” রাফি ভাইয়া গু কালারের শার্ট পড়েছো কেন?”
প্রান্তিকার কথায় মিরাজ ধমকালো
–” এই বেদ্দপ! এসব কী কথা?”
নওশাদ বলল,
–” ওকে ধমকাচ্ছিস কেন? ঠিকই তো বলেছে।এই রাফি যা শার্টটা চেঞ্জ করে আয়।”
রাফি বড় ভাইয়ের মুখের উপরে কিছু বলার সাহস পেলনা। চোখ গরম করে প্রান্তিকার দিকে তাকিয়ে রাফি আবারও নিজের কক্ষে চলে গেলো।
নওশাদ আর নিশাতের মা হচ্ছেন সুজলা, মিরাজ, প্রিয়ন্তি,আর প্রান্তিকার মা পিয়ালি, তৌফিক আর রাফির মা হচ্ছেন উর্মিলা। সবাই তাদের মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
বাবার জোরাজুরিতে ইয়াশা এবার নিরুপায় হয়ে পাত্রের সামনে এসে বসলো। মাথা তখনো নিচু করে রেখেছিলো ইয়াশা। ইয়াশার বাঁ পাশে তার সেজো কাকি,ডানপাশে আরিফা।কিছু দূরত্বে সুমনা আর তনয়া বসা। ইয়াশার ছোট কাকি ইয়াশার মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াশার বাবা পাত্রের বাবার সঙ্গে ব্যাবসায়িক বিষয়ে আলাপ টুকটাক আলাপ করছেন। ইয়াশা নতজানু হয়ে বসে আছে।
জাবির শুধু এক পলক দেখেছিলো ইয়াশাকে। মেয়েটির চেহারা চোখ ধাঁধানো সুন্দর। গোলাপি মুখশ্রী।কিন্তু একটু বেশি ফ্যাট মেয়েটি। সে তো একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার।নিঃসন্দেহে তার সঙ্গে একজন স্লিম ফিটনেসের মেয়ে যায়।এই মেয়েটি…?
বিশাল আপত্তি নিয়ে হাসফাস করতে লাগলো জাবির। জাবির বাকি তিনটা মেয়ের দিকে তাকালো আঁড় নজরে।স্লিম হলেও চেহারায় তেমন শ্রী নেই। তার ভাবনা চুরমার করে দিয়ে জাবিরের মা বলে উঠলেন,
–” ভাইজান আপনার মেয়ে মাশা-আল্লাহ অনেক চমৎকার দেখতে।আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”
পাশ থেকে সুমনা বলল,
–” হ্যাঁ আন্টি আমাদের ইয়াশু দেখতে সত্যিই চমৎকার। তবে একটু মোটা তাতে কী? দেখতে ভালো হলেই হয়।”
জাবিরের মা জয়নাব কপাল কুঁচকে তাকালেন সুমনার দিকে। মনেমনে বললেন মেয়েটাতো ভারি ঠোঁটকাটা স্বভাবের। উনি ক্রুর হেসে বললেন,
–” হ্যাঁ সেটাই দেখতে ভালো হলেই হয়।”
জাবির সুমনার কথায় ক্রুদ্ধ হলো। মেয়েটা মোটা তা বলে কু-সুন্দর তো নয়। তাছাড়া মেয়েটির দুই আনার রূপ ও নেই,অথচ বড় বড় কথা। জাবির সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলো।
খাওয়া-দাওয়ার মাঝ পর্যায়ে নওশাদের ফোনটা বেজে উঠলো। বাঁ হাতে ফোনটা বের করে আচমকা অপ্রত্যাশিত কাঙ্খিত নাম্বারটা দেখে বিমূঢ় হয়ে গেলো নওশাদ। তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাকিরা নওশাদের এহেন আচরনে ভড়কে যায়।প্রশ্নবিধ দৃষ্টিতে তাকালেই নওশাদ ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
— ” তোরা খা আমি দুই মিনিটেই আসছি।”
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাদের থেকে আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো নওশাদ। ফোনটা দ্রুত রিসিভ করে হ্যালো বলতেই,ফোনের অপাশ থেকে ফুঁপিয়ে কান্নারত ঝাঁজালো গলায় ইয়াশা বলল,
–” আপনি আসছেন না কেনো হ্যাঁ?”
নওশাদের হৃদয় কথাটা শুনে আনন্দে চনমনিয়ে উঠে।অস্পষ্ট গলায় বলতে চাইলো,
–” আমি…!
ইয়াশা আরো তীর্ব্র গর্জন দিয়ে বলল,
–” আপনি এসে আপনার ফোনটা নিয়ে যান। এক্ষুনি এসে নিয়ে যাবেন।রাগ লাগছে ফোনটা দেখলে আমার।আপনি এসে না নিলে আমি ফোনটা ভেঙে ফেলবো।”
এইপাশে নওশাদ বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু শুনে গেলো।মুখ দিয়ে আর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারলো না সে।
(চলবে)