অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো #পর্ব-২

#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-২
#সাবিকুন নাহার নিপা

বিন্তীর সঙ্গে দেখা করে এসে শিশির প্রথম যে কথাটা বলল সেটা হলো,

“বিয়েটা কখন হবে?”

শিশিরের মা আর তুষার দুজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তুষার বলল,

“বাহ! ভালো তো!”

শিশির বলল, কী ভালো? বিয়েটা ঠিকঠাক হোক। তারপর ভালো।

শিশিরের মা নিশ্চিন্ত হলেন। ছেলের পাগলামী ভালোমতোই জানেন। বাবার চাপে পড়ে বিয়েতে রাজী হলেও পরে যদি কোনো কেলেঙ্কারি ঘটায় তাহলে মেয়েটা মুসিবতে পড়বে।

শিশিরের মা শিরিন তার স্বামী তারেক রহমানের মুখের উপর কখনো কিছু বলেন না। স্বামীর সিদ্ধান্ত সবসময়ই মেনে নেয়। কারণ লোকটা বিচক্ষন। কিন্তু এইভাবে ছেলের বিয়েটা মানতে পারে নি। বিন্তী আর শিশির দুজন আলাদা মেন্টালিটির মানুষ। বিন্তী পড়াশোনায় কতো ভালো! আর শিশির কে সবসময়ই ধরে বেধে পড়াশোনা করাতে হয়েছে। পড়াশোনা ছাড়া পৃথিবীর সব অকাজ ই ওর ভালো লাগে। ধরে বেধে পড়াশোনা করিয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করানোর দুই বছর পর শিশির ঘোষণা দিলো পড়াশোনা আপাতত স্থগিত। মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে সে এখন ক্লান্ত। যখন ম্যুড হবে তখন আবার শুরু করবে।

শিশিরের এই সিদ্ধান্ত পরিবার যেমন মানেনি তেমনি জোর করে ও’কে আর পড়াতেও পারলো না।

***
বিন্তীর বিয়ের সাজ খুব ই সাদামাটা। পরনের শাড়িটা ওদের এখানকার বাজার থেকে কেনা। গায়ের টুকটাক গয়না যা আছে সেগুলো শিশিরের মায়ের। তিনি যা পরে এসেছিলেন সেগুলোই বিন্তীকে দিয়েছেন। অন্য সময় হলে বিন্তী না করতো। কিন্তু এখন আর কিছুতে জোর করতে ইচ্ছে করছে না। বিন্তীর বিয়েটা এমন হবার কথা ছিলো না। কিন্তু হয়ে গেল। উপরওয়ালা ভাগ্যের চাকা কয়েক মিনিটে যে ঘুরিয়ে দিতে পারেন সেটা বিন্তী কাল টের পেয়েছে।

বিন্তীর বিয়ে ঠিক হয়েছিলো প্রেমিক সাব্বিরের সঙ্গে। চার বছরের প্রেম ছিলো দুজনের। বিন্তী ইন্টারমিডিয়েট এর পর ঢাকায় হোস্টেলে থেকে কোচিং করেছে। সেই হোস্টেলের রুমমেটের খালাতো ভাই সাব্বির। সেখান থেকেই আলাপ। সাব্বির ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। এক, দু’বার দেখা সাক্ষাৎ হবার পর সাব্বির বিন্তীকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলো। বিন্তীও সঙ্গে সঙ্গে এক্সেপ্ট করে নেয়। টুকটাক নিজেদের কথাবার্তা থেকে প্রতিদিন ই কথাবার্তা হতে থাকলো। এভাবে একসময় প্রেম টা’ও হয়ে গেল। প্রেমের সম্পর্কে ঝগড়াঝাটি মান অভিমান কম ছিলো বলে বিন্তী ভেবেছিলো ভালোবাসাটা বোধহয় একটু বেশীই আছে।

মাস ছয়েক আগে সাব্বিরের ভালো চাকরি হলো। বিন্তীর বাবাও মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলেন। বিন্তী পরিবার কে জানালো সাব্বিরের কথা। সাব্বির এতো তাড়াতাড়ি বিয়েতে রাজী না থাকলেও বিন্তীর অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যেতে পারে ভেবে রাজী হলো।

কিন্তু সমস্যা করলো সাব্বিরের পরিবার। বিন্তীকে নিয়ে তাদের অভিযোগ না থাকলেও ওর পরিবার নিয়ে তাদের অভিযোগের শেষ নেই। বিন্তীর বাবা খুব বেশী শিক্ষিত না, ওর বড় ভাই নেই। তার উপর বিন্তী বড় মেয়ে তাই সাব্বির কে সারাজীবন শ্বশুরবাড়ির বোঝা টানতে হবে।

এই নিয়ে অনেক তর্কও হয়েছে সাব্বির আর বিন্তীর। সবকিছুর পর ভালোয় ভালোয় বিয়ে ঠিক হলো। বিয়ের আয়োজন হলো। হঠাৎই গায়ে হলুদের দিন এসে সাব্বিরের মামা বিন্তীর বাবার সঙ্গে ঝামেলা শুরু করলেন। বিন্তীর বাবার পাঠানো ফার্নিচার তাদের পছন্দ হয় নি। সবকিছু ছোট হয়েছে। ফ্রিজ ছোট, ওয়ারড্রব ছোট। টিভি দেয়া হয়েছে একটা। একটা টিভি কোন আক্কেলে দিতে গেল। এসব কথাবার্তার এক পর্যায়ে বিন্তীর বাবাকে সাব্বিরের মামা বললেন,

“আপনারা ছোটলোক হইলেও আমরা ছোটলোক না। আমাদের আত্মীয়স্বজন, সমাজ নিয়া চলতে হয়। এইসব ছোটলোকী জিনিস দেখলে মানুষ হাসাহাসি করবে। আমাদের ছেলে তো আর নদীতে ভেসে আসেনাই। ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, ভালো চাকরি করে। তার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। ”

বিন্তী সব টা চুপ করে দেখলেও এবার আর প্রতিবাদ না করে পারলো না। শান্ত গলায় বলল,

“তাহলে আপনাদের ছেলেকে ছোটলোক বাড়িতে বিয়ে করতে পাঠাবেন না। আর যদি সে আসেও তবুও এই বিয়ে হবে না। আপনাদের মতো লোভী মানুষের বাড়িতে আমি যাব না।”

এই একটা কথার পর ঝামেলা আরও বেড়ে গেল। সাব্বির ফোন করে বিন্তীকে প্রশ্ন করলো, কেন ও এই কথাগুলো বলেছে! আর মামা তো ঠিক ই বলেছে। আত্মীয়স্বজনরা যদি বউয়ের বাড়ির জিনিসপত্র দেখে হাসাহাসি করে তাহলে কী মানসম্মান থাকবে!

বিন্তী খানিক্ষন চুপ করে থেকে বলল,

“তোমার বাড়ির লোকের গায়ে তো মানুষের রক্ত নেই। তোমার যদি তেমন না হয়ে থাকে তাহলে আর কখনো আমার সামনে আসবে না।”

এটাই ছিলো ওদের শেষ কথা। বিন্তীর বাবা, মা পরিবার বিন্তীকে অনেক গাল মন্দ করলেও বিন্তী চুপ করে থাকলো। আশেপাশের মানুষের নানান রকম কথাবার্তা, হা হুতোশ। এই মেয়েকে এরপর কে বিয়ে করবে! আরও একটা বোন আছে। সেটার বিয়ে কিভাবে দিবে। এরমধ্যে এসে তারেক রহমান জানালেন যে তিনি তার ছেলের সঙ্গে বিন্তীর বিয়ে দিবেন। বিন্তী অমত করলেও বাবা, মা ওর মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে রাজী হয়ে গেলেন।

***
শিশির আর বিন্তীর বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের পর শিশিরের বাবা বললেন যে বউ নিয়ে তারা আজ ই চলে যাবে। ফিরে গিয়ে বউভাতের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে হবে।

বিন্তীর বাবা মা মেয়ের বিয়ে দিতে পেরেই খুশি। শিশিরকে নিয়ে তাদের অভিযোগ নেই। আর বিন্তী এখন একটা রোবটের মতো আচরণ করছে। যে যা করতে বলছে তাই ই করছে।

***
মেয়ে বিদায়ের সময় বিন্তীর বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই ই খুব কাঁদলো। শিশির বলল,

“এতো কান্নাকাটির কী দরকার? মেয়েকে নিজেদের কাছে রেখে দিলেই পারে!”

তুষার বলল,

“তুই এসব বুঝবি না এখন। আগে মেয়ে হোক তারপর বুঝবি। ”

“এসব বুঝতে মেয়ে হবার দরকার আছে?’

“হ্যাঁ। আর ডোন্ট ওরি, বিয়ে যখন হয়েছে শিগগির বাচ্চাও হয়ে যাবে। ”

“অসম্ভব কিছু না। বাবা হয়তো এরপর এসে বলবে শিশির বিনী খুব ভালো মেয়ে। ও’কে একটা বাচ্চা দাও।”

তুষার হো হো করে হাসলো। বলল,

“একদম মনের কথা বলেছিস। কিন্তু তুই ভাবীকে বিনী বলে ডাকিস কেন!”

“স্বামীরা বউদের আদর করে ছোট নামে ডাকে। বাবাকে দেখিস নি, মা’কে কেমন শিরু শিরু বলে ডাকে।”

তুষার হেসে বলল,

“ওহ। তা ভাবী তোকে কী বলে ডাকবে? মা তো বাবাকে বাবুর আব্বু বলে ডাকে। তোকে কী বলে ডাকবে? ”

“সেটা বিনী ঠিক করবে। তোকে এতো ভাবতে হবে না।”

“আচ্ছা তোর মনের মধ্যে কী চলছে বল তো? দেখে তো মনে হচ্ছে বিয়ের লাড্ডু ভালোভাবেই হজম করছিস। ”

“কিচ্ছু চলছে না। বাবা বিয়ে করতে বলেছে তাই করেছি। আমি এমনিতেই ক্ষিদে সহ্য করতে পারি না। ভিক্ষে করে না খেয়ে শুকিয়ে মরতে চাই না। তাছাড়া আর একটা কথা হলো আমার এই চেহারা দেখে কেউ ভিক্ষেও দিবে না। তাই ওই রিস্কে যাই নি। তাই বিয়ে করেছি। বাকীটা বাবা সামলে নিক। ”

তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“এবার বুঝতে পেরেছিস মেয়েটার বাবা, মা কেন কাঁদছে? ”

“কেন?”

“তারা আঁচ করতে পেরেছে যে তাদের মেয়েকে বিয়ে দেয় নি। হাত, পা বেঁধে মাঝ নদীতে ফেলে দিয়েছে।”

****
শিশির গাড়িতে উঠে ঝুম্পার ম্যাসেজ পেল। ঝুম্পা লিখেছে,

“আই এম সরি বাবু। আর কোনোদিনও তোমার সঙ্গে ব্রেকাপ করবো না। বিকেলে একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর থেকে মন খারাপ। দেখেছি তিনটা কুকুর মিলে তোমাকে কামড়াচ্ছে। খাবলে খাবলে মাংস তুলে নিচ্ছে। দেখে খুব কেঁদেছি। শিগগিরী দেখা করো। আই মিসড ইউ। ”

ঝুম্পার আহ্লাদীপনা ছুটিয়ে দিতে শিশির বিন্তীর একটা ছবি পাঠালো। ছবিটা তুষারের মোবাইল থেকে নেয়া। শিশির লিখলো,

“আই এম এক্সট্রেমলি সরি বাবু। আমি তো তোমার ব্রেকাপ সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। তোমাকে ভুলতে একটা মেয়েকে বিয়েও করে ফেলেছি। ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here