#অন্য_মানুষ (পর্ব ৩)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
আজ থেকে প্রিয়া মাত্রই অন্য কারো। তার সাথে জড়িয়ে গেলো অন্য মানুষের জীবন। কখনো কখনো ভালোবাসার মানুষটাকে ভালো থাকার জন্য ভালোবেসেও ছেরে দিতে হয়।
চোখ দুটু অসম্ভব লাল হয়ে আছে শান্তের। বারান্দায় চেয়ারে বসে সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে আর চোখ বন্ধ করে আছে সে।
চোখ খুলে তাকিয়ে আছে বাইরে আকাশে ফুটে উঠা চাঁদ টার দিকে। সে কতো সুন্দর ভাবেই প্রকৃতিকে খুটখুটে অন্ধকার থেকে আলোকিত করে রেখেছে। আর তার জীবন প্রদিপ টা কেন এতো নিভু নিভু হয়ে আছে?
রুমে এসে অনলাইনে আসতেই একটা মেসেজ আসলো ফোনে,
‘খুব ঘুম না আপনার? হুম ঘুম হবেই তো। আপনার তো কিছু হারায়নি। হারিয়েছে আমার।’
এতোক্ষন অফলাইনে ছিলো দেখে হয়তো ভেবেছিলো, শান্ত ঘুমিয়ে পরেছে। একটা শ্বাস নিয়ে এক্টিভ স্ট্যাটাস অফ করে অফলাইনে চলে গেলো সে। সে তো নিজেও চায় যে প্রিয়া ভালো থাকুক। তাহলে কেন এখন তার অনুভুতি গুলো মাথা চারা দিয়ে উঠে বুকের বা’পাশ টায় চাপ দিয়ে ধরে আছে?
সকাল হলে প্রিয়াকে ডেকে নিচে নিয়ে গেলো তার মা। তার শাশুড়ি ও ননদ এদেরকে নাস্তা সার্ভ করে দিতে। কিন্তু প্রিয়া মুখের উপর ‘পারবো না’ বলে সেখান থেকে চলে গেলো। প্রিয়ার এমন বেয়াদবি অপমানিত করেছিলো তার শশুর বাড়ির লোকদের। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো প্রিয়ার দিকে।
বিষয়টাকে আর বাড়তে দিলো না রিয়া। হাসি মুখে সবাইকে নাস্তা দিতে দিতে বললো,
– বিয়ে হয়ে গেছে তো তাই হয়তো মন মেজাজ ভালো নেই।
প্রিয়ার শাশুড়ি চুপ করে থাকলেও প্রিয়ার চাচি শাশুড়ি বলে,
– এতো মেজাজ নিয়ে শশুর বাড়িতে চলতে পারবে না সে।
রিয়া ও তার মা বিষয়টা হেসে কথা বলে উড়িয়ে দিলো। তারপর সকলে খাওয়ায় মন দিলো।
রিয়া রুমে এসে প্রিয়ার মাথায় ছোট্ট একটা ধাক্কা দিয়ে বলে,
– এসব কি শুরু করেছিস তুই? শশুর বাড়ির লোকজনদের সাথে এমন আচরণ করছিস কেন? শুন, বাকি জীবনটা কিন্তু তোকে তাদের সাথেই কাটাতে হবে। সো তাদের সাথে ভেবে চিন্তে কথা বলতে হবে তোকে। সবার মন রক্ষা করে চলতে হবে।
প্রিয়া কেঁদে দিয়ে বলে,
-আমি কি করবো আপু? আমি ওদের কাউকেই কখনো নিজের সাথে মানিয়ে নিতে পারবো না। অনেকের ভালোবাসাই তো পূর্ণতা পায়। তেমন করে আমার ভালোবাসা যদি পূর্ণতা পেতো, তাহলে কি খুব বেশি খারাপ হয়ে যেত আপু?
রিয়া এবার শান্ত হয়ে বললো,
– দেখ শান্ত ভালো ছেলে এটা আমিও জানি। বাট শুধু ভালো দিয়ে তো আর দুনিয়া চলে না। ভালো ক্যারিয়ারও হতে হয়। যেটা শান্তর টোটালি অনিশ্চিৎ। সে কখনোই তোকে সুখি করতে পারবে না। কিন্তু হাবিব তোকে অনেক সুখে রাখবে দেখিস। অনেক সুখে থাকবি তুই।
প্রিয়া রেগে কাঁন্না অবস্থাতেই বলে,
– আমার সুখ নিয়ে তোমরা কেন এতো ভাবছো? আর হাবিবের ক্যারিয়ার দিয়ে আমি কি করবো, ওর প্রতি তো আমার কখনোই ভালোবাসা তৈরি হবে না। ভালোবাসা ছারা কি কারো সাথে সারা জীবন কাটানো সম্ভব আপু?
এবার প্রিয়ার কথার কোনো উত্তর খুজে পেলো না রিয়া। দুই বোনের চিন্তা ধারাই দুই রকম। রিয়ার মতে, শুধু ভালোবাসা দিয়ে সংসারে সুখি হওয়া যায় না। স্বামীর ক্যারিয়ারও ভালো হতে হয়।
আর প্রিয়ার মতে, স্বামীর ক্যারিয়ার দিয়ে কিভাবে সুখ নির্ণয় করা যায়, যেখানে ভালোবাসাই থাকবে না?
(দুজনের কথাই অযৌক্তিক নয়। তবে কার কথাটা বেশি যৌক্তিক তা পাঠক/পাঠিকা রা কমেন্ট বক্সে বলবেন)
দুপুরে খেয়ে চলে গেলো হাবিব’রা। কিন্তু প্রিয়া যায়নি তাদের সাথে। সে কয়েকদিন পর যাবে। শশুর বাড়ির লোকজন বিষয়টা মানতে না চাইলেও হাবিব মানিয়েছে সবাইকে।
সন্ধার পর প্রিয়াকে ছাদে ডাকলো শান্ত। প্রিয়াও চলে গেলো। ভাবেছিলো হয়তো শান্ত তার ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু না, শান্তর সামনে যাওয়ার পর নিরাশ হলো সে।
শান্ত তার দিকে চেয়ে বলে,
– শুনলাম, তুমি নাকি তোমার শশুর বাড়ির লোকদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছো?
প্রিয়া সোজাসুজি ভাবে বলে,
– হুম, আর সামনেও করবো। ওদের কাউকে সহ্য হয়না আমার।
শান্ত বললো,
– এসব করে লাভ কি?
প্রিয়া বললো,
– এসব করলে তারা আমায় ওখান থেকে তাড়িয়ে দিবে। হয়তো আমার স্বামীও আমায় ডিবোর্স দিয়ে দিবে।
শান্ত একটু হেসে বলে,
– এরপর কি করবে?
প্রিয়া কড়া ভাবে বলে,
– একা একা কাটিয়ে দিবো সারা জীবন। তবুও অন্য কাউকে মেনে নিতে পারবো না।
– এস বাচ্চামো করে কি লাভ প্রিয়া? আর পাগলও নিজের ভালো বুঝে। তুমি কেন হাতে ধরে তোমার শান্তিটা নষ্ট করে দিবে বলো? ভাগ্যকে মেনে নাও, এক সময় সব ভুলে সুখে থাকবে।
– আমি চাইনা এতো সুখ।
– তো কি চাও?
– আপনাকে, নয়তো কাউকে না।
– কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না।
– আমি তো বাসি।
শান্ত নিজেকে কন্ট্রোল করে কড়া গলায় বলে,
– ব্যাস অনেক হয়েছে প্রিয়া। যদি শশুর বাড়ির সবাইকে আপন করে নিতে না পারো তাহলে আর কখনো আমার মুখও দেখবে না তুমি।
বলেই সেখান থেকে চলে গেলো শান্ত। আড়ালে গিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো হাত দিয়ে।
,
,
বাবার কাশির শব্দে এক গ্লাস পানি বাবার সামনে নিয়ে গেলো শান্ত। বাবা পানিটা খেয়ে নিজেকে শান্ত করে বসলে শান্ত বলে,
– ঠিক আছো বাবা?
বাবা আবার কেশে বলে,
– জানিনা আমার মাঝে কি রোগ বাসা বাধছে।
শান্ত বাবাকে শুইয়ে দিয়ে বলে,
– চিন্তা করোনা, ভালো কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো তোমায়।
রুমে গিয়ে বসলে তার ছোট ভাই প্রান্ত এসে বলে,
– ভাইয়া, কলেজে বেতন ও পরিক্ষার ফি সব জমে আছে। কালকের মাঝে পরিশোধ না করলে পরিক্ষা দিতে দিবে না।
শান্ত কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
– কতো?
– ভাইয়া ১৯০০ টাকা।
শান্ত মানিব্যাগ বেড় করে দেখে তাতে ২৫০০ টাকার মতো আছে। যা বাবাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য রেখেছিলো। তার মাঝে ২০০০ প্রান্তকে দিয়ে দিয়ে বলে,
– ভালো ভাবে এক্সাম দিস।
প্রান্ত চলে গেলে সোজা হয়ে শুয়ে পরে শান্ত। বাবাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য টাকা ম্যানেজ করতে হবে। আবার কয়েক তারিখ পার হলেই বাড়ি ভাড়াটাও দিতে হবে। চারদিকের টেনশন যেন মাথা থেকেই সরে না তার।
পরদিন সন্ধায় একসাথে বসলো সবাই। শান্তর বাবা-মা, ছোট ভাই সবাই। শান্তর বাবা বলে,
– হাসানের ছেলে কয়দিন আগে বিদেশ থেকে ফিরেছে। ওর সাথে কথা বলেছি আমি। শান্তর জন্য একটা ভিসার ব্যাবস্থা করে দিতে বলেছি। সেও রাজি হয়েছে।
শান্ত চুপ করে রইলো। তার মা বলে,
– কি বলছেন এসব? শান্ত এতো লেখাপড়া করেও শেষে কিনা বিদেশ গিয়ে কাজ করবে?
বাবা বলে,
– তো আর কি করার আছে? দেশে থেকে কি কিছু করতে পেরেছে? কোথায় জানি চাকরি করছে তাও ১৫-১৬ হাজার বেতন। সংসারের খরচও ঠিক মতো চলেনা তাতে। আর ভিসাও খারাপ না, ইতালির ভিসা।
মা আবার বলে,
– আমি মা হয়ে আমার ছেলেকে টাকার জন্য এতোদুর পাঠাবো?
বাবা বলে,
– টাকা ছারা পুরুষ মানুষের কোনো মুল্য নেই। এখন আর তেমন কেউ ছেলের শিক্ষা খোজে না। খোজে শুধুই টাকা। বুঝতে পেরেছো? ভিসার জন্য হয়তো ৮-১০ লাখের মতো লাগতে পারে, ওটা আমি এদিক সেদিক থেকে ম্যানেজ করে দিবো। ওখানে গিয়ে অল্প অল্প করে শোধ করে দিবে। আমিও আর কয়দিন থাকি জানিনা। যাওয়ার আগে ছেলেকে একটু লাইন করে দিতে পারলেই শান্তি পাই। তোর মতামত কি শান্ত?
শান্ত নিচের দিকে চেয়ে বলে,
– তোমরা যা ভালো মনে করো তাই আমার মতামত।
বলেই উঠে হাটা ধরলো শান্ত। মা বললো,
– তো ছেলেকে একটা বিয়ে করিয়ে দিলে ভালো হবে। তারপর না হয় বাইরে যাবে।
বাবা বলে,
– একবার গিয়ে ধুরে আসুক। হাতে টাকা পয়সা হোক, তারপর বিয়ের বিষয়ে ভাববো। এখন শুধু প্রয়োজন ওর নিজেকে গোছানো।
শান্ত আর কিছু না বলে সোজা রুমে এসে বসলো। কতো হাজার হাজার মাইল দুড়ে চলে যাবে সে। কি করছে কি খাচ্ছে দেখার কেও থাকবে না সেখানে? মাস শেষ হতেই বাড়ি থেকে ফোন দিয়ে বলবে,
– টাকা কবে পাঠাবি?
,
,
আজ কয়েকদিন হয়ে গেলো প্রিয়ার সামনেও যায়নি শান্ত। অনেক কল মেসেজ এমনকি বাসায় এসেও শান্তর সাথে একটু কথা বলতে পারেনি সে। ইদানিং তার দম বন্ধ হয়ে আসা অনুভূতি গুলো কথা কাউকে কিভাবে বুঝাবে সে? কাউকে বুঝালেও৷ কেও বুঝবে না।
হাবিবকেও অনেক ইগনোর করছে সে। যার কারণে হাবিবও তেমন একটা বিরক্ত করে না তাকে। কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে গেছে তার জীবন। শান্তকে কেন ভালোবেসেছিলো, তার মাঝে এমন কি আছে তা এখনো জানেনা প্রিয়া। ওসব কারণ জানতেও চায় না। সে শান্তকে ভালোবাসে এতটুকুই জানে।
– তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে শান্ত।
সিড়ি বেয়ে বাসায় ঢুকতেই শান্তকে কথাটা বললো রিয়া। শান্ত তার দিকে চেয়ে বলে,
– জ্বি বলুন।
– এখানে না, আলাদা বলতে হবে।
– আচ্ছা চলুন।
শান্ত দুই হাত বুকে গুজে বলে,
– জ্বি এবার বলুন।
রিয়া কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
– প্রিয়া খুব বেশি পাগলামি করছে। এমনটা চলতে থাকলে হয়তো খুব শিগ্রই পাগল হয়ে যাবে সে।
শান্ত বলে,
– কয়দিন পর দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ওকে বুঝাবেন আপনারা।
– তাকেই বুঝানো যায়, যে বুঝতে চায়। কিন্তু প্রিয়া কোনো ভাবেই বুঝতে চায় না। ওর এমন কষ্ট আমার আস সহ্য হচ্ছে না ভাই। ভেবেছিলাম বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিচ্ছু হচ্ছে না। তাকে একটু শান্তুিতে বাচতে দাও তুমি। দুরে কোথাও চলে যাও তাকে নিয়ে। সুখে থাকো তোমরা। সে হয়তো পাগলই হয়ে যাবে এভাবে থাকলে।
To be continue……..