অনুভূতির_সংঘাত_১০

অনুভূতির_সংঘাত_১০
ছামিনা_বেগম

-হেই , ইয়াং লেডি ? হোয়াট আর য়‍্যু ডুয়িং ?

বৃষ্টি হেসে তাকাল ফোনের স্ক্রিনের দিকে । হাতে ধরা পাত্রটি স্ক্রিনের সামনে ধরে বলল,
– বলো তো কিই ?

সাইফ একমুহূর্ত ভালো করে দেখে বলল ,
– ক‍্যারামেল পুডিং ! ইস !কতদিন তোর হাতের রান্না খাই না !
– আসছো তো দুদিন পরে । তখন যত খুশি খেয়ো । যা বলবে রান্না করে খাওয়াবো ।
– হুম, হুম । আমার তো ভাবতেই জিভে জল এসে যাচ্ছে । এখন শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা … সময় গুলো কেন যে কাটছে না !অপেক্ষা এত কষ্টকর কেন হয় বলতো ?

সাইফের কথা শুনে বৃষ্টি হাসল । মুখে বললেও সাইফের মন অন‍্য কথা বলে উঠল । এতদিনে সত্যিই অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে তার । অবশেষে বৃষ্টি তার হবে । স্ক্রিনের ভেতর দিয়েই সাইফ মুগ্ধ হয়ে দেখল গৃহিণীবেশী বৃষ্টিকে । এই বৃষ্টিকে দেখলে কে বলবে ইতিমধ্যে কর্পোরেট দুনিয়ার একজন পাক্কা বিজনেস উইমেন হয়ে উঠেছে সে। যে কিনা মাত্র পাচঁ বছরে বাবার ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন গুডস সাপ্লাইয়ের ব‍্যাবসাকে ন‍্যাশনাল লেভেলে পৌঁছে দিয়েছে । দিনরাত যন্ত্রের মতো পড়ে থাকে ব‍্যাবসার পেছনে , সাথে অসুস্থ বাবার দেখভাল করার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাইকেও মানুষ করার দায়িত্বটাও অনেকটা আপনাআপনি এসে চেপে বসেছে । সাইফের মনে হল বৃষ্টির চোখ গুলো সামান্য ফোলা ফোলা লাগছে । সে কি কান্না করেছে ? কিন্তু কেন ? কারণ জিজ্ঞেস করে বিব্রত করতে চাইল না সাইফ । কারণ এই বৃষ্টি আর আগের মতো মন খুলে কথা বলে না । সাইফ জানে জিঞ্জেস করলেও সঠিক উত্তর পাবে না সে । বৃষ্টি নিজের সমস্যার কথা গুলো খুব সন্তপর্ণে এড়িয়ে যাবে ।

– মিতুল আপা , বিরিয়ানীর চালটা বের করো তো । ওই কাবার্ডে আছে …

হাতের ইশারায় মিতুলকে দেখিয়ে দিল বৃষ্টি । বৃষ্টিরা আসছে বলে পুরোনো কাজের মেয়ে মিতুলকে আগেই খবর দিয়ে রেখেছিল কামাল । আজ বিকেলেই সে এসে পড়েছে । বৃষ্টির কথা মতো মিতুল বিরিয়ানির চালের প‍্যাকেট বের করল । তা দেখে সাইফ বলল,

– তা হঠাৎ এতো আয়োজন কিসের রে ? আজকেই তো গেলি মাত্র ! ছোট মামার তো এসব খাবার টোটালি বারণ । আত্মীয় আসবে নাকি ?

এতক্ষণের যাবতীয় উৎসাহে ভাটা পড়ে গেল এই সামান্য একটি কথায় । বৃষ্টি ফ্রাই প‍্যান চুলায় বসিয়ে দিয়ে হাসল একটু । অল্প জল গরম করে পরিমাণ মতো চিনি ঢেলে দিয়ে বলল ,

– জানো হয়তো , আমাদের ওপর তলায় ভাড়াটিয়া বসিয়েছিল বড়োআব্বু ।

সাইফ মাথা নেড়ে বলল ,

– হ‍্যাঁ , আব্বু বলেছিল একদিন ।

– হুম । ওরা কাল নিজেদের বাসায় সিফ্ট হচ্ছে । তাই আব্বু আজ ওনাদের ডিনারের দাওয়াত করেছে । তারই প্রিপারেশন চলছে ।

সাইফ ভ্রু তুলে সর্বজান্তার ভঙ্গি করে বলল , ওহ !
তারপর মিতুলকে উদ্দেশ্য করে বলল ,

– মিতুল আপা , তুমি চুপ করে আছ কেন ? আমাকে জিজ্ঞেস করবে না কেমন আছি ? নাকি ভুলে গেছ আমায় ?

মিতুল আঁচলে হাত মুঁছে হেসে তাকাল স্ক্রিনের দিকে । বলল ,
– ভুলব কিভাবে ?এখনো তো আগের মতোই আছেন ।

– কি যে বলো মিতুল আপা ? আমি কি এখনো সেই পনেরোর সাইফ আছি বলো ? সবাই তো বলে আমাকে দেখে নাকি চেনাই যায় না ।

মিতুল দাঁত বের করে হাসল ।

– ভুল কিছু বলে না তো সবাই । আগেই এত ফর্সা ছিলেন আর এখন পুরো সাদা হয়ে গেছেন । খালি গলার স্বরটাই যা এখনো আগের মতো আছে ।

মিতুলের কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছে এমন ভান করল সাইফ । চুপসে যাওয়া গলায় বলল ,

-আপা, এভাবে বলতে পারলে তুমি ? তোমার কথা যদি ঠিক হয় তাহলে ওখানে গেলে লোকে তো আমাকে দেখে শ্বেতী রোগী বলে ডাকবে । কি ভয়ঙ্কর হবে বিষয়টা, ভাবো একবার !

সাইফের কথার ধরনে বৃষ্টি , মিতুল দুজনেই হেসে ফেলল । বৃষ্টিকে হাসতে দেখে একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল সাইফ । উদ্দেশ্য সফল হয়েছে তার । অনেকক্ষণ থেকে এই স্বতস্ফূর্ত হাসিটাকেই মিস করছিল সে । হাসলে মেয়েটাকে এত স্নিগ্ধ লাগে , অথচ সে যেন হাসতেই ভুলে গেছে । বৃষ্টির সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর কল কাটলো সাইফ । তাড়াহুড়ো করে ব্রেকফাস্ট সেরে বাবার জন্য টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে একটা চিরকুট রেখে দিল । নাজিম হক এই সময়টায় জগিং করতে বেরোন । সমবয়সীদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেশ বেলা করেই ফেরেন তিনি । মা আপাতত বাড়িতে নেই । তিনি ইনানের কাছে গেছেন নাতির অসুস্থতার কথা শুনে । ইনান এখানেই এক প্রবাসী ভারতীয় ছেলেকে বিয়ে করেছে তিন বছর হল । আজ রাতে ফিরবেন তিনি । সাইফ ঘরের দ‍রজা লাগিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই মনে হলো ইনডাকশনের সুইচটা কি সে অফ করেছিল ? সাইফ আবার ছুটল ঘরে । সত্যি সত্যিই সে সুইচ অফ করেনি । সুইচ অফ করে হাতের কব্জি উলটে সময় দেখে চোখ কপালে উঠল । অনেকটা দেরি হয়ে গেছে তার । গাড়িতে বসে ছুটল কর্মস্থলে । সময় মতো হসপিটালে পৌঁছতে না পারলে সব গুলো এপোয়েন্টমেন্ট ডিলে হয়ে যাবে ।ইস !এত অলস কেন সাইফ ! সকালে এলার্মটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেছে তবুও ঘুম ভাঙেনি ওর । তার ওপর বৃষ্টির সাথে কথা বলতে গিয়ে আরো দেরি হয়ে গেছে । মা থাকলে অবশ্য সাইফকে এত তাড়াহুড়ো করতে হয় না । তিনি রোজ ঠিক সময় মতো জাগিয়ে দেন সাইফকে । আচ্ছা , বিয়ের পর বৃষ্টি এই কাজটা ভালোবেসে করবে কি? ভাবতেই সাইফের ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গেল।

বছর তিরিশের যুবক সাইফের জীবনের লম্বা সময় চলে গিয়েছে একতরফা ভালোবেসে । মাঝে একবার মরিচিকার পেছনে ছুটছে ভেবে এখানকারই এক মেয়ের সাথে লিভ ইনে ছিল । কিন্তু দুমাস কেটে যাওয়ার পর আর ভালো লাগেনি । আদ‍্যপান্ত বাঙালিয়ানায় বড়ো হওয়া সাইফের কাছে প্রেমিকা জেসির উড়ুক্কু মনোভাব আর অতি মর্ডান আচরণে বেশ বিরক্তই হয়ে ছিল বলা যায় । সেই তুলনায় মরিচিকার পেছনে ছুটে চলাকেই ঠিক মনে হয়েছিল সাইফের । আর তার অনির্দিষ্ট গন্তব্যের ফলাফল এত সুমিষ্ট হয়ে ধরা দেবে সে কি কল্পনা করেছিল ? করেনি । বরং বিধাতা হয়তো ওর ওপর সুপ্রসন্ন হয়েছেন । তাই তো এবার সে ফাইনালি নিজের করে পেতে যাচ্ছে প্রিয় মানবীটিকে । কল্পনায় লাল বেনারসীতে বিয়ের সাজে বৃষ্টিকে কল্পনা করেই আরেক দফা পুলকিত হল সাইফ ।

*****

তুলনকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই পুতুল খেয়াল করল তুলনের ডান গালটা যেন একটু বেশিই লাল হয়ে আছে । একটু ফুলেও আছে কি ? ঘরের জানালায় পর্দা সরিয়ে অবাক হয়ে গেল পুতুল । তুলনের গালে তিন আঙুলের ছাপ অল্প অস্পষ্ট হলেও ভালো মতোই বোঝা যাচ্ছে কেউ চড় মেরেছে ওকে । চোখের জলের রেখা গালেই শুকিয়ে গিয়ে কেমন ডোরা ডোরা দাগ হয়ে আছে । পুতুল রাগে কাঁপতে লাগল । ভেবেই পেল না কার এত দুঃসাহস হয়েছে। মা কি মেরেছে ? নাহ , মা তুলনের গায়ে কখনো হাত দেয় না । বৃষ্টি তো হবে না । ও মারলে তুলন ওর কাছে কখনো ঘুমাতো না । তাহলে কে ? ছোট ভাবি ? নাহলে আর কে হবে ? রাগে পুতুলের কপালের শিরা ফুলে উঠতে করতে লাগল ।

রোজ সন্ধ্যার আগে তৌফিককে সুজি অথবা খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ায় ঈষা । আজো তাই গল্প বলার ছলে ভুলিয়ে ভালিয়ে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিল । তুলনকে সামনে এসে দাড়াতে দেখে মুখ তুলে চাইল ঈষা । পুতুল চাপা অথচ রাগত স্বরে বলল ,

– তুমি তুলনকে চড় মেরেছ ?

ঈষা চমকে ওঠে । হাতে ধরা চামচটা বাটিতে পড়ে ঝনঝন শব্দ হয় । পুতুল ভ্রু কুঁচকে তাকায় । ঈষা তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,

– পাগল হয়েছিস ! আমি কেন মারতে যাব তুলনকে ?

হিসহিসিয়ে বলে ওঠে পুতুল ,
– একদম মিথ‍্যে বলবে না ভাবি । বলো , কেন মেরেছ তুলনকে ? কি দোষ করেছে ও যে তোমার ওকে চড় মারতে হলো ?

তৌফিকের মুখে আর এক চামচ খিচুড়ি পুড়ে দিয়ে কড়া চোখে চেয়ে ঈষা বলল ,

– মারব না তো কি পুজো করব ? ওই টুকু মেয়ে দেখ কি হাল করেছে তৌফিকের ! খামচে মাংস তুলে নিয়েছে । এখনই এতো শয়তানের হাড্ডি বড়ো হলে না জানি কি হবে ?

– মুখ সামলে কথা বলো ভাবি । ভুলে যেওনা কার সম্পর্কে বলছ তুমি । মানছি , তৌফিককে খামচি দিয়েছে তুলন । তার মানে এই না যে তুমি অতটুকু একটা মেয়েকে থাপ্পড় মেরে বসবে । এখনো লাল হয়ে ওর গাল । যদি ভুলেভালে কানে লেগে যেত । তখন কি হতো ? …তুলনের মা হতে তো বলিনি তোমাকে । কমপক্ষে ওর চাচির ভূমিকাটাই তো ভালো করে পালন করার চেষ্টা করো । তুলন ভুল করে তৌফিককে খামচি দিয়েছে । কিন্তু কেন দিয়েছে সেটা জানার চেষ্টা করছ ? করনি । করবে কেন ? তুমি তো শুধু তোমার সন্তানকে নিয়েই…….

– পুতুল , কি হচ্ছে এখানে ?

শেফালী বেগমের কন্ঠস্বর শুনে শান্ত হয়ে যায় পুতুল । তিনি হাতে তসবি জপতে জপতে একবার ঈষার দিকে আর একবার পুতুলের দিকে তাকিয়ে সোফায় বসে পড়েন । কঠিন দৃষ্টিতে একবার ঈষার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় পুতুল । ঈষাও তোফিকের মুখে জোরজবরদস্তি খিচুড়ি পুড়ে দিতে চাইলে তৌফিক মুখের খাবার উগলে দিয়ে কান্না জুড়ে দেয় । ঈষা প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় এতে । রাগে গজগজ করতে করতে জোর করে খাওয়াতে চেষ্টা করলে প্রতিবার তৌফিক মুখ থেকে খাবার ফেলে দেয় । ঈষা ক্রোধান্বিত হয়ে চড় মারতে উদ‍্যত হতেই পুতুল বাগড়া দিয়ে বসে ,

– তুমি ওকে জোর করছ কেন ? ও যতটুকু খেতে পারে ততটুকুই তো খাবে নাকি । নাকি তুমি জোরজবরদস্তি ওর পেটে জায়গা বানাবে ? সরো , দাও আমাকে ?

পুতুল তৌফিককে সরিয়ে নেয় ঈষার থেকে । তৌফিককে কোলে নিয়ে জিঞ্জেস করে ,

– আব্বুটা , আ করো তো ..আআআআ ..

তৌফিক মাথা দুলিয়ে না করে । সে খাবে না আর ।

-আর খাবে না ? পেট ভরে গেছে ?

তৌফিক আবার ও মাথা নাড়ায় । পুতুল তৌফিকের পেটে হাত দিয়ে সুরসুরি দিয়ে বলে ,

– দেখি দেখি পেট টা কোথায় ? এই তো ,এখনো অনেক জায়গা আছে তো …নাও আ করো …. আআআ …. এই তো । আমাদের তৌফিক তো গু..ড বয় …তাই না ?

পুতুল হেটে হেটে তৌফিককে আরো কয়েক চামচ খিচুড়ি খাইয়ে দেয় । নীরব আক্রোশে ঈষা তরপাতে থাকে । অযথাই রান্নাঘরে গিয়ে খুটখাট শব্দ করে । পুতুল এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে ।

(চলবে.….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here