অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৩৩,৩৪

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৩৩,৩৪
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৩৩

পড়ছিলাম “তুলকালাম (সম্পর্কে ও ব্যবসায়)” অধ্যায়টি। আমি ভেবে পেলাম না সম্পর্কে কিংবা ব্যবসায় আবার কবে তুলকালাম ঘটলো? আর ব্যবসায় বলতে কিসের ব্যবসায়ের কথা বলছে? ভাবনা বাদ দিয়ে পড়া শুরু করি।

“একদিন আমি ফোন দিলাম। সে ফোন ধরলো না। এমনটা এরমাঝে কখনোই হয়নি। বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম, ধরলো না। আমার মনে ভীতি সঞ্চার হলো। পরপর দুদিন তার সাথে যোগাযোগ করার কোনোরকম সুযোগই পেলাম না। ফোন কেন ধরেনি বা ব্যাক করেনি সেটা ভালোমতো জানার চেষ্টা করলাম আমি৷ তার কাছে থেকে সরাসরি না। গোয়েন্দা লাগিয়ে বের করেছি কারণটা। কারণ হলো তার বাবার বিজনেস। বাবার বিজনেসে ঝামেলা হওয়ায় তিনি একাকী সেটা সামলানোর দায়ভার গ্রহণ করেছেন। ওরে আমার মাদার তেরেসা! দেশসেবা করে উল্টে দিচ্ছেন। এখনও কলেজের গন্ডি পেরুতে পারেননি তিনি এসেছেন অফিসের পাট চুকাতে। চুকাক! বাবার ঝামেলা মেয়ে মিটাক তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। সে ঝামেলাটা সমাধান করেছে তার বন্ধুকে দিয়ে। যেনতেন বন্ধু না, একদম ছেলেবন্ধু। রাগে আমার নিজের চুল ছিঁড়ে ফিলতে ইচ্ছে করছিলো। কেন, আমাকে বলা যেত না? আমি পারি না সল্যুশন করতে? নাকি আমার টাকা কম? নাকি বুদ্ধি?

সন্ধ্যায় ফোন দিতেই দেখি ওয়েটিংয়ে। বাহ! খুব ভালো। ওয়েটিংয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কল ঢুকে গেল আর সে রিসিভও করলো। আর তখনই একগাদা ঝাড়লাম তাকে। রাগের মাথায় ওর ফ্রেন্ডদের নিয়েও অনেক কথা শোনালাম৷ সে প্রায় কেঁদেই ফেললো। কাঁদলেও আমার মন গললো না বরং মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ফোন কেটে দিলাম। আমি কাশবনেই ছিলাম। ফোন কেটে ডায়েরি লিখতে বসলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি, সে আসছে। তড়িঘড়ি করে ডায়েরি লুকিয়ে পাবজি খেলতে বসে গেলাম। আসলে তো খেলছি না, সবটাই ভান। সে এসে পাশে বসলো, টু শব্দও করলো না। আমি আঁড়চোখে তাকে দেখলাম। অপলক তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকার পর যখন সে গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেল তখনই আমি বললাম,
“কাঁদছিলে কেন তখন?”
তখনও তার চোখ ভেজা। সে মাথা নিচু করে চোখের পানি মোছার বৃথা চেষ্টা করলো। আমি ওর থুতনি ধরে চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে কান্নার কারণ জানতে চাইলে সে বললো, আমি নাকি সবসময় রেগে থাকি। আমিই নাকি তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে ফেলতে পারি। শুনে তো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমি ওর ক্ষতি করবো? সিরিয়াসলি? আমি বললাম, কিহ! আমি? জবাবে সে বললো, সে নাকি আমি সামান্য রেগে কথা বললেও সারারাত ঘুমাতে পারে না, সারাদিন কিছু খেতে পারে না। আর সে-ই প্রিয় আমাকে যদি সে রেগে কিছু বলে আর আমি যদি তার সাথে আর কথাই না বলি, যদি তাকে ছেড়ে চলে যাই তাই সে আমার সাথে কখনোই মিসবিহেইভ করে না। ভেবে খুব খারাপ লাগলো যে সে ভাবে আমি তাকে ছেড়ে চলে যাবো। তাকে আমি এখনও বিশ্বাস করাতে পারিনি, বোঝাতে পারিনি আমার ভালোবাসাটা। অবশ্য আমি বোঝাতে যাইওনি।
আমাকে হারানোর ভয়েই নাকি সে কখনো আমার কোনো কথার বিরুদ্ধে যায় না। আমাকে ছাড়া বাঁচা নাকি তার পক্ষে অসম্ভব। এত পাগলী কেউ হয়? আমারও তো ওকে ছাড়া দমবন্ধ লাগে৷ কই আমি তো এসব ওকে কখনো বলতে যাইনি। আমারও মনে হয় ওকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু বেঁচে তো থাকবো। সব কথা কি আর মুখে বলতে হয়? কিছু কথা রাখতে হয় একান্ত গোপনে। ওর মধ্যে গোপন রাখার ব্যাপারটা নেই, যেটা আমার মধ্যে প্রবল। এজন্যই ওর সাথে আমার প্রায়ই রাগারাগি চলে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

বললাম, “এত সহজ তোমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়া? এত সহজে মুক্তি দিবে আমাকে? মনে তো হয় না।” ঘাসের উপর নিশ্চুপ শুয়ে থাকি আমরা দুজন। দুজনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ।
আমার মনে ভাবনারা তীব্র হট্টগোল লাগিয়ে দিয়েছে। যেন ভেতর থেকে বলছে,
‘তুমি জানো, তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা আমি কখনো ভাবি না? ভাবলেই দম আটকে আসে আমার। আর বলছো ছেড়ে যাওয়ার কথা? এত সহজে তোমাকে আমি ছাড়ছি না, আর তুমিও আমাকে না।’

আমি আবার জানতে চাইলাম,
“যদি আমাদের বিয়ে না হয় তখন কি হবে?”
সে সহজ গলায় বললো, বিয়ে না হলে সে সোজা মরে যাবো।

এই কথা শুনলে হয়তো অন্য প্রেমিকরা খুশিতে ডিগবাজি খেতো। কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। আমার জন্য কেন কারো জীবন থমকে যাবে? আমি কে? আমার জন্যই কি ও পৃথিবীতে এসেছে? তা তো না। ও এসেছে নিজের উদ্দেশ্য নিয়ে। সেসব ছেড়ে ও কেন আমার জন্য জীবনটা থমকে দিবে? একথা শোনার পর তাৎক্ষণিক বললাম, “তাহলে এখনই ছেড়ে যাচ্ছো না কেন? ছেড়ে চলে যাও৷ তোমার সাথে আমি আর নেই।”

একথা সেকথার পর সে এবার আমাকে জেরা করতে শুরু করলো। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
‘তুমি সবসময় ছেড়ে যাওয়ার কথা কেন বলো? কষ্ট হয় না একটুও?’
‘না।’ স্বাভাবিকভাবেই বললাম। আমার মেজাজ ভীষণ চটে গেছে ওর লেইম কথাবার্তা শুনে।

সে আবার বললো, ‘আমাকে একটুও ভালোবাসো না?’
এই কথার জবাব আমি দিলাম না। মিথ্যে বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। ওকে কি করে বোঝাই ভালোবাসি বলেই তো হারাতে দিতে চাই না। তাই বলে…
‘বলো?’
‘ভালোবাসার কথা আসছে কেন?’
‘ভালোবাসার কথাই তো।’

আর কথা না বাড়িয়ে আমি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, “আমার জন্য যদি তোমার এক চুল পরিমাণ ক্ষতি হয় না, আমি তোমাকে ছাড়বো না। আর যদি আমার জন্য মরার চেষ্টা করেছো তো কবর থেকে উঠিয়ে আবার মারবো তোমাকে। কথা ক্লিয়ার?”

এই কথার পর সে কই যে হারিয়ে গেল কে জানে। মেয়েটা বড্ড ওভারথিঙ্ক করে। যাইহোক, সেদিন আরও কিছুক্ষণ থাকার পর সে অযথাই রেগেমেগে চলে গেল। আমি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। তৎক্ষনাৎ কি যেন মনে হওয়ায় দৌড়ে গিয়ে ওর হাত ধরে বললাম,
“এত্ত ওভারথিঙ্ক করো কেন তুমি? একটু বাস্তববাদী হও পাগলী!”
আমি জানি এটা শোনার পর তার মন ভালো লাগায় ছেয়ে যাবে। তারপরও সে কেন যেন আর পেছনে ফিরে তাকালো না৷ চলে গেল গন্তব্যে। রাগ মেটাতে এসে আবার রাগ করেই চলে গেল। অদ্ভুদ একটা মেয়ে।”

এতটুকু পড়ে ডায়েরী রেখে দিলাম। অদ্ভুত আমি না সে নিজে। হারাতে দিতে চায় না সেটা মুখে বললো না। তার পুরোটাই তো অভিনয়ে ভরা ছিল। আমি কিভাবে ধরবো তার অভিনয়? তার ভাষ্যমতে তো আমি বোকা। সে যদি লুকিয়ে আমাকে দেখে আমার জানার তো কথা না। সে যদি আমাকে দেখে পাবজি খেলায় মেতে ওঠার ভান করে তা তো আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব না। ভালোবাসায় এত গোপনীয়তা চলে না। গোপন রাখবে তাই বলে ভালোবাসাটাও তো আর গোপন রাখা যায় না। সেটাই যদি গোপন থাকে তো সেটাকে কি আর ভালোবাসা বলা যায়? যাকগে! সেসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
নামাজ-দোয়া, অন্যান্য কাজ শেষে বিকেলে শান্তি কুঠিরের উঠানে বসে আছি সবার সাথে। নাকীব এলো খানিক বাদেই। এসেই আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গেল। ওর চেহারায় কিছু একটা ছিল। আমি জানতে চাইলাম, “কি হয়েছে?”
“আপু, রাফিন ভাইয়াকে দেখেছি আজ।”

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, “আমিও দেখেছিলাম।”
“সত্যিই?” ভীষণ অবাক হলো নাকীব।
“হু।”
“কবে?”
“ঝিলি এক্সিডেন্ট করতে গিয়েও বেঁচে গেছে বললাম না? রাফিনই ওকে সেদিন রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়েছিলো। ঝিলি সবসময় যার কথা বলে, ওর ভালো ভাইয়া। সে-ই রাফিন।”
নাকীব মাথায় হাত দিয়ে বললো, “সিরিয়াসলি?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “হু।”

নাকীব বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। আবার খানিক বাদেই ফিরে এসে বললো,
“কাশবনে তোমরা যেখানে মিট করতে সেই জায়গাটা একজন কিনে নিয়েছে। মস্ত বাড়ি উঠছে ওখানে।”

আমার বুক ধ্বক করে উঠলো। কেন আমি জানি না। ঐ জায়াগাটা আমার অনেক বেশি প্রিয়। যদিও এখন আর যাওয়া হয় না। তাও মনের মধ্যে একটা আশা ছিল যে, জায়গাটা তো আছেই, যাবো কোনো একদিন। কিন্তু এখন তো একেবারেই যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

নাকীব বললো, “আপু, আশ্চর্যের বিষয় কি জানো? বিল্ডিংটা উঠছে একদম অন্যরকম শেইপে। কেমন যেন খাপছাড়া। বোঝা যায় না কোনদিকে দরজা আর কোনদিকে কি?”
“তৈরী হলে তবেই বুঝবি।”
“হয়তো।”
নাকীব চলে গেল। আমার ভীষণ ইচ্ছে হলো কাশবনে গিয়ে ডায়েরিটা পড়ি। কিন্তু ওখানে তো কাজ চলছে। যাওয়া কি উচিত হবে? যাকগে এমনিই পড়ি ডায়েরিটা।

ছাদে গিয়ে ডায়েরী খুলে বসলাম। এবারের অধ্যায়ের নাম, “বিপজ্জনক ভ্রমণ ও আদুরে আলাপ”।

“এরমধ্যেই জানতে পারলাম সে কাউকে না জানিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। অথচ ভার্সিটি যাবে বলে বেরিয়েছিলো। আমার প্রেয়সীর অজান্তে আমি রোজ ওর পেছন পেছন ভার্সিটি অব্দি যাই।”

এটুকু পড়ে বিস্ময়ে আমার চোখজোড়া কোঠর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। ও আমার সাথে ভার্সিটি অব্দি যেত রোজ? অথচ আমি যাওয়ার পথে ওকে কত মিস করতাম। ভাবতাম, যদি ও থাকতো আমার সঙ্গে! এগুলো পাগলামি নয়? শুধু আমি বললেই পাগলামি হয়। আর উনি কাজে করে দেখালেও পাগলামি হয় না।

“আজ সকালে যখন ও বাসা থেকে বেরিয়েছিলো তখন আমি অন্যকাজে ব্যস্ত ছিলাম। ফলে ওকে ফলো করা হয়নি। আর আজই সে অন্য জায়গায় চলে গেল। নিশ্চয়ই ছেলেটার সাথে গিয়েছে। সেদিন ওর কোনো খোঁজ পেলাম না। বারবার ফোন করা সত্ত্বেও সে একটাবারও ফোন তুললো না। পরে জানতে পেরেছি সে তার বন্ধুদের সাথে পাহাড়ে গিয়েছিল। পাহাড়টার আশেপাশে পর্যন্ত কেউ যাওয়ার সাহস করে না। আর তারা সটান পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেল। নিশ্চয়ই তার সেই ছেলে বন্ধুটা নিয়ে গেছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা! আমি শিউর তারা কোনো না কোনো ডাকাতের কবলে পড়েছে। কারণ ঐ পাহাড়ে গিয়ে ডাকাতের মুখোমুখি না হয়ে আজ পর্যন্ত কেউ ফিরে আসেনি। ভালোমতো খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যারা ওর সাথে গিয়েছিল প্রত্যেকেই জ্বরের কবলে পড়েছে। সুতরাং, ভয়ানক কিছু ঘটেছে সেটা আমি নিশ্চিত। তবে তাকে এই ব্যাপারে আমি কোনো প্রশ্ন করিনি।

পরপর তিনদিন তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। তবে এমন একজনের সাথে যোগাযোগ আছে যে আমার প্রেয়সীর খবর প্রতিটা সেকেন্ডে পাই টু পাই আমাকে জানায়। তার কাছ থেকে জানলাম প্রিয়তমার নাকি ভীষণ জ্বর। জ্বর নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম তার জন্য। জ্বর নামলে সে নিজেই কল করলো আমাকে। কলেও বেশ রাগারাগি করলাম। অতঃপর পুনরায় সাক্ষাৎ হলো আমাদের। সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দেখি মহারাণী আগেভাগে কাশবনে এসে ক্রিকেট খেলছেন। জ্বর থেকে ভালো হয়ে উঠতে পারলো না আর লেগে পড়লো খেলায়৷ মেজাজ গেল চটে। ব্যাট হাতে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল সে। আমি হ্যাঁচকা টানে নিয়ে চললাম কাশবনের গহীনে৷ সে চেঁচাতে লাগলো, আশেপাশে বাকীরাও চেঁচাচ্ছে। হয়তো ম্যাচ জিতেছে ওরা। তাতে আমার কি! প্রেয়সী চেঁচাতেই থাকলো, ট্রফি নেওয়া হয়নি বলে। তার ভাই একচোখ টিপে বললো, ‘ট্রফিই তোমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।’ কথাটা শুনে কেমন যেন ভালো লাগায় মন ভরে গেল।”

আকাশ লাল নীলিমায় ছেয়ে গেছে। অনেক দূরে গাছের ফাঁক থেকে রক্তিম সূর্যটা দেখা যাচ্ছে। নিয়মমাফিক পশ্চিমাকাশে ডুবে যাচ্ছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে নীড়ে ফেরার পায়তারা করছে৷ গাছে গাছে পাখিদের সয়লাব কমে আসছে। রাস্তায় মানুষের ভীড়-ভাট্টা লেগেই আছে। কারো কারো হাঁটার গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। সবার বুঝি নীড়ে ফেরার তাড়া? খানিকবাদেই দূরের মসজিদ থেকে শোনা গেল মুয়াজ্জিনের সুরেলা কন্ঠের ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি। আকাশপানে চেয়ে আছি। আজ কেন যেন উঠতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, আজীবন যদি খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম? তা কি আর হয়? মানুষ তো কত কিছু চায়, সব কি পায়? ভাবতে ভাবতে আকাশটা অন্ধকারে ঢেকে যেতে থাকলো। একসময় হাজার হাজার গুনাহের অতল গহ্বরে, অন্ধকার থেকে তীব্র অন্ধকারের জগতে যেভাবে ঢেকে গিয়েছিল আমার হৃদয় সেভাবেই আকাশটা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারাতে থাকলো। অগত্যা আমিও উঠে পড়লাম। মাগরিবের আযান হয়ে গেছে বেশ খানিকক্ষণ হলো। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে নিচে নেমে এলাম। নামতে গিয়ে হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরে গেল। আমার প্রত্যেকটা খবর পাই টু পাই সেকেন্ডে সেকেন্ডে কে ওকে দিতো? কে জানে আমার এত খবর? আমি কখন কোথায় যাচ্ছি, কি করছি সব খবর জানে, কে সে? যে আমার খবর পাচার করতো ওর কাছে সে কি এখনও আমার খবর দেয় ওকে? কে হতে পারে সে? তারমানে কি রাফিন আজও আমার অবস্থান সম্পর্কে অবগত? অথচ আমি তো ওর কোনো খবরই রাখি না।

#Be_continued_In_Sha_Allah ❣️

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৩৪

মাগরিবের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে আছি। দোয়া-দরুদ পড়ছিলাম তখনই ফোনটা এলো। বাবার ফোন। রিসিভ করে কানে লাগাতেই বাবা বললেন,
“হৃদি রে, তোর মায়ের শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। তোকে খুঁজছে বারবার।”
আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে বললাম, “আমি এখনই আসছি বাবা।”

নাকীবকে সাথে নিয়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়লাম। সকালেও তো মা ঠিক ছিল৷ এরমধ্যেই শরীর খারাপ হয়ে গেল কি করে? অবশ্য শরীর খারাপ তো আর বলে কয়ে আসে না, হুটহাট হয়ে যায়। বর্তমানে চারিদিকে যে হারে ভেজাল খাদ্যের পরিমাণ বেড়েছে তাতে অসুস্থ হওয়াটা আশ্চর্যের না, বরং না হওয়াটাই আশ্চর্যের।

বাসায় এসে দেখি বাবা মায়ের মাথা টিপে দিচ্ছে। আমাদের দেখামাত্রই মায়ের কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে নিলেন বাবা৷ এরপর রুম থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। আমরা দুজন মায়ের দু’পাশে বসলাম। মায়ের হাত ধরতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো মা। চোখগুলো কোঠরে ঢুকে গেছে। আশ্চর্য! এটুকু সময়ের মধ্যে কি এমন হলো মায়ের? চেহারার এমন বেহাল দশা হলো কি করে? নাকি সকালেও এমন ছিল, আমরাই খেয়াল করিনি? যে মানুষটা আমাদের সবার খেয়াল রাখে তার খেয়াল রাখতে আমাদের একটুও মনে থাকে না। আশ্চর্যের বিষয় না?

আমি মৃদু কন্ঠে বললাম, “মা, কি হয়েছে তোমার?”
“তোরা দুটোতে মিলে সারাদিন কি করিস বলতো? একটু খোঁজ-খবরও রাখিস না আমাদের।” মায়ের অভিমানী কন্ঠস্বর।
“মা, সকালেও তো এখানেই ছিলাম। তখন তো তুমি একদম ঠিক ছিলে।”
“বেশি পটরপটর করবি না হৃদি। তোরা ছাড়া বাড়িটায় ভালো লাগে? সব ফাঁকা ফাঁকা। দুটো তো রাতে ঘরেও ফিরিস না প্রায়সময়। বৃদ্ধবয়সে একজন একা হয়েছে বলে তাকে সময় দিতে গিয়ে নিজের বৃদ্ধ বাবা-মাকে ফেলে রাখবি?”

আমি ও নাকীব বিস্ময়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। তারপর একসাথে বললাম, “তোমরা বৃদ্ধ?”
“তোদের জ্বালায় হচ্ছি আর কি!”

নাকীব বললো, “এখন তো আমরা পাশেই আছি তোমার। এবার উঠে বসো তো দেখি।”
“মাথার যন্ত্রণায় উঠতে পারছি না। হাত-পা সব অবশ হয়ে আসছে। তোরা কিছুতেই আর আমাদের একা রেখে যাবি না। যত কাজই থাকুক, করে আবার এখানেই ফিরে আসবি। শান্তি কুঠিরকে আসল ঠিকানা বানিয়ে বসে আছিস। নিজের বাড়িকে রেখেছিস অশান্তিতে। ক’দিন পর তো এমনিতেই চলে যাবি অন্য বাড়ি। যতদিন আছিস ততদিন তো সময় দিবি আমাদের।”

“তোমাদের সময় দিবো বলেই তো আমি ভাবছি যে খুব কাছে কোথাও বিয়ে করবো। যাতে রোজ তোমাদের সাথে দেখা হয়।”

মা কিছু বলার আগে নাকীব বললো, “ঐ যে কাশবনের ধারে নতুন শেইপের একটা বিল্ডিং উঠছে। সেটার মালিককে বিয়ে করে ফেলো। আমার খুব ইন্টারেস্ট ঐ বাড়ির প্রতি।”

মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমি পাশ থেকে মলম নিয়ে মায়ের কপালে লাগিয়ে টিপে দিতে লাগলাম। নাকীব মায়ের পা টিপে দিচ্ছে। মায়ের কপালে ভালোই মালিশ করছি৷ মা বললেন,
“তোকে এভাবে মালিশ করা কে শিখিয়েছে রে হৃদি?”
“বাবা শিখিয়েছিলো মা।”
“হুম, তাই তো বলি মনে হচ্ছে তোর বাবা টিপে দিচ্ছে।”
“আমার ছোটবেলায় একবার তোমার খুব মাথা ব্যাথা হয়েছিল। আমাকে বলেছিলে টিপে দিতে৷ কিন্তু আমার ছোট নরম হাতে আমি ঠিকঠাক টিপতে পারছিলাম না। তখন বাবা আসে আর ভালোভাবে টিপে দেয়। ইশারায় আমায় শেখায় ‘এভাবে টিপতে হয়’। তুমি বলে উঠলে, “এই তো এখন খুব ভালো টিপছিস তো। এতক্ষণ কি করছিলি?” তখন তোমার চোখ বন্ধ ছিল। সে-ই থেকে আমি বাবার মতো টিপতে পারি।”
“তোর প্রায় স্বভাবই তোর বাবার মতো। ছোটবেলায় বাবাকে নকল করতে খুব ভালোবাসতিস তুই। বাবা মসজিদ থেকে এলেই তার টুপি নিয়ে মাথায় পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যেতি। তখন তোকে হুবহু তোর বাবার মতো লাগতো। দিশা তো তখন হেসে কুটিকুটি হতো। দুষ্টুমি করে প্রায়ই তোর বাবার লুঙ্গি, গেঞ্জি সব পরাতো তোকে৷ আর তুইও খুশিতে বাকবাকুম।”

নাকীব মুখ গোমড়া করে বললো, “ও মা! আমার কোনো গল্প নেই? শুধু আপুরগুলো বলছো কেন?”
“তোর গল্প তো কত আছে।”
“বলো না।”
“তুই ছোটবেলায় খুব কেয়ারিং ছিলি। একবার দেশের বাইরে গিয়েছিলাম তোকে নিয়ে। তোর বাবা, আমি আর দিশা। হৃদিকে নিয়ে যাইনি তখন। দিশা তো বিদেশের খাবার মুখেই তুলতে পারছিলো না। তারপর ওর জন্য ভাতের ব্যবস্থা করা হলো। মোটা চালের ভাতগুলোও ওর মুখে রোচে না। তখন তুই জোর করে সেগুলো ওকে খাইয়েছিস৷ তখন তোর বয়স দেড় কি দুই বছর। দিশাকে সেদিন ভরপেট না খাইয়ে তুই ছাড়িসনি।”
“ছোটফুফিকে আমরা ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসতাম, তাই না মা?” নাকীব বললো।
“হুম। ও একেবারে অন্যধাচের একটা মানুষ। ওকে সবাই ভালোবাসে।”
“হুম।”

বাবা এলেন চার বাটি নুডলস নিয়ে। আমি দাঁড়িয়ে বললাম, “বাবা, এসবের মানে কি? আমরা থাকতে তুমি কেন?”
“আমি নাকি কোনো কাজ করি না, তোর মায়ের অভিযোগ।”
“ধুর বাবা! এসব ধরতে হয়? মা তো কতকিছুই বলে।” আমি বললাম।
“তাও বানালাম৷ দেখি খেয়ে বল কেমন হয়েছে?”

আমি ও নাকীব দ্রুত নুডলস মুখে দিলাম। খেতে খেতে বললাম, “অসাধারণ হয়েছে বাবা।”
বাবা মাকে বললেন, “তুমিও খেয়ে দেখবে নাকি?”
মা ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। বসতে বসতে বললেন,
“খেয়েই দেখি, তোমার হাতের রান্না।”

মায়ের দিকে একটা বাটি এগিয়ে দিলাম। বাবাও নিলেন একটা৷ বাটির দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন,
“আজ প্রথম খাচ্ছো নাকি আমার রান্না? আগে কত করেছি না!”
“তা তো বটেই। অনেকদিন পর আবার খাচ্ছি। ভালোই হয়েছে। এজন্য মাঝেমধ্যে রোগে পড়া ভালো। অচেনা স্বাদের রান্না খাওয়া যায়। নিজের হাতের রান্না খেতে খেতে মুখে বিতৃষ্ণা এসে গেল।”

মায়ের কথাটা শুনে কেন যেন খুব খারাপ লাগলো। বললাম,
“মা, আজ থেকে তাহলে সব রান্না আমিই করবো।”
”রোজ তো আর করতে পারবি না। তোর তো হাজারটা কাজ।”
“শ্বশুরবাড়িতে হলে কি করতে হতো না মা? শত কাজ থাকলেও তো আগে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির খাবার তৈরি করে দিতে হবে। অন্যের বাবা-মায়ের জন্য খাটতে পারলে নিজের বাবা-মায়ের জন্য খাটবো না কেন? পেলেপুষে বড় করবে তোমরা আর খাটবো অন্যের জন্য? এ বড় অন্যায় মা। আগে তোমাদের জন্য খাটবো পরে অন্যদের জন্য।”
“তুই অনেককিছু বুঝতে শিখে গেছিস হৃদি। এতদিন ভাবতাম, তুই কোনোকালেই আমার কষ্ট বুঝবি না। তোর বুদ্ধিশুদ্ধিও কোনোকালে হবে না। ছোটকাল থেকে তুই বড্ড একচোখা ছিলি। ন্যায়-অন্যায় সবকিছুতে তুই বাবার সাপোর্টে থাকতি। আমি ঠিক না ভুল তা জানারও চেষ্টা করতি না কখনো। ইদানিং তোকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে।”
“এতবছর তো কুরআন-হাদীস ধরিনি মা। তাই মায়ের মর্মটাও বুঝিনি। এখন পড়ছি, জানছি আর তাই মানছিও। আচ্ছা আমি এখন উঠলাম। রান্না বসাই। নাকীব কি যাবি আমার সাথে?”

নাকীব তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে বললো, “চলো যাই।”
এই হলো আমার মিষ্টি ভাই। ইচ্ছে করছে গালটা একটু টেনে দিই। মনে মনে একটা চুমু খেলাম ওর গোলাকার নরম গালটায়। উম্মাহ! এই যাহ! ব্যাপারটা ধরে ফেললো কিনা কে জানে? ও তো আবার আমার মনের কথা আগেই বুঝে যায়। আমি ওর দিকে তাকাতেই দেখি বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চট করে চোখ সরিয়ে নিলাম। ও বললো,
“গালটা টেনে দিলেই তো হয়৷ অশ্লীল চিন্তা করার কি আছে?”

গালে আস্তে একটা চড় মেরে বললাম,
“অশ্লীল চিন্তা কবে করলাম? যা সামনে সামনে হাঁট।”
ও ভেংচি দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।

আমি যা যা রান্না করবো তার সরঞ্জামগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলাম। নাকীব বললো, “আমার কাজ কি?”
“তোর কাজ হলো কাটাকুটি। তুই পেঁয়াজ, টমেটো, রসুন, মরিচ, ধনেপাতা এগুলো রেডি কর। আগে পেঁয়াজ, রসুন ছিলে ফেলবি। এরপর সব একসাথে ধুঁয়ে কাটাকুটি স্টার্ট… বুঝলি?”
“হুম বুঝলাম। বাট রান্না করবেটা কি?”
“বাবার পছন্দ হলো যেকোনো ধরণের সবজি আর ডাল। আর এখানে বাঁধাকপি দেখা যাচ্ছে। সো, বাঁধাকপির সবজি হবে। আর ভর্তা পছন্দ বাবার। ভর্তাও করা যাবে। বাট মায়ের পছন্দ কি?”
“মায়ের…? উমম! মা তো…”

আমরা অনেকক্ষণ ভেবেও মায়ের পছন্দের কোনো আইটেম পেলাম না। আশ্চর্যের ব্যাপার না! এতবছর একই ছাদের নিচে থেকে, একই সংসারে থেকে মায়ের কি পছন্দ সেটাই আমরা জানি না? বাধ্য হয়ে আমরা প্রথমে বাবার কাছে গেলাম। বাবাও জানে না মায়ের পছন্দের খাবার কি। কি আর করা? এরপর মায়ের কাছ থেকে জানতে গেলাম।
মা জানালো, “আমি সবই খাই, পছন্দ-অপছন্দ নেই আমার।”
“মা, এভাবে বললে তো হবে না। এক্সাক্ট খাবারের নাম বলতে হবে।”
“আহা! জানি না তো। বিরক্ত করিস না। তোর হাতের খাবারই আমার পছন্দের, যা।”

মন খারাপ করে চলে এলাম। মা ইচ্ছে করেই বলেনি। অভিমান করেছে আমাদের উপর। কেন আমরা তার পছন্দ জানি না এজন্য নাকি সংসারে অন্যদের পছন্দ দেখতে গিয়ে নিজের পছন্দ বিলীন হয়েছে এজন্য? নাকি আমাদের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ভাবতে ভাবতে মা নিজের পছন্দই ভুলে গেছে? যাইহোক, আমরা অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, মা ‘ডিমের ঝোল তরকারি’ খেতে পছন্দ করে। স্মৃতির পাতায় ভর করে অতীতের অহরহ ডাইনিং টেবিল থেকে ঘুরে এলাম। কোন্ খাবার দেখলে মা অতিরিক্ত ভাত খেতো, কোন্ খাবার রান্না হলে মায়ের চোখমুখ খুশিতে ভরে উঠতো? অবশেষে পেলাম একটা খাবার। সিদ্ধান্ত নিলাম সেটাই রান্না করার।

মায়েরা আমাদের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেয় বলে আমরা ভাবি তাদের কোনো পছন্দ নেই। ছোটবেলা থেকে মুরগীর সবচেয়ে বড় পিসটা আমাদের পাতে তুলে দেন বলে ভাবি, মা ওটা খায় না। সবচেয়ে ভালো তরকারিগুলো খেতে দেন বলে ভাবি, মায়ের বাসি তরকারি পছন্দ। অথচ আমরা একবারও তাদের সেক্রিফাইজটা বোঝার চেষ্টা করি না। জীবনের এই পর্যায়ে এসে মনে হলো, আমি মাকে অনেক ভুল বুঝেছি। এতদিন যাবৎ আমি ভুলের মধ্যে ছিলাম। আমার ধারণা ছিল, মা আমার চেয়েও বেশি নাকীবকে ভালোবাসে। আসলে তো তা না। সন্তান হলো দুটো চোখের মতো। একটাকে বেশি অন্যটাকে কম ভালোবাসা সম্ভব না। আমরা দুটি চোখকেই যেমন সমান ভালোবাসি তেমনই মায়েরাও সন্তানদেরকে সেই চোখজোড়ার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। পেপার পত্রিকায় কত পড়েছি, সন্তানের জন্য কিডনি দিতেও মা পিছপা হননা। সন্তানকে ভালো রাখতে নিজের কোনো অঙ্গ কাটতে হলেও মা’রাই এগিয়ে থাকেন। তাই তো ইসলামে মায়ের সম্মান এত বেশি৷
মা-বাবার অধিকার সম্পর্কে হাদিসে বহু জায়গায় বর্ণনা এসেছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! কে আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার বেশি হকদার? তিনি বলেন ‘তোমার মা।’ সে বলল, তারপর কে? তিনি বলেন, ‘তোমার মা।’ সে আবারও বলল, তারপর কে? তিনি বলেন, ‘তোমার মা।’ সে পুনরায় বলল, এরপর কে? তিনি বলেন, ‘তোমার বাবা।’ [১]

আমি রান্নার সরঞ্জাম গোছাতে ব্যস্ত তখনও। নাকীব দেখি ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম,
“কিরে ছেলে হয়েও কাঁদছিস তুই? কি বোকা!”

নাকীব রাগী চোখে তাকালো আমার দিকে। শব্দ করে ছুরিটা রাখলো কাটার বোর্ডে। আমি আবার হেসে ফেললাম।
“পেঁয়াজ বাদে বাকিগুলো কেটে দে। বাঁধাকপিটা কাট আগে।”
ও ঘনঘন চোখ মুছতে মুছতে বাঁধাকপি টেনে নিলো। ওর হাত ধরে আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম,
“বাইরে থেকে ঘুরে আয়, যা। চোখ জ্বালা কমলে তারপর আসিস।”
“আমি ঠিক আছি আপু।”

আমি ওড়না দিয়ে ওর চোখে ভাপ দিয়ে দিলাম। জ্বালা কিছুটা কমার পর ও চোখ কচলে বললো,
“আচ্ছা আপু, আমরা এত দ্রুত বড় হয়ে যাই কেন? এখন আর ইচ্ছে হলেও তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পারি না।”

কথাটা বলে একমুহূর্তও দাঁড়ালো না নাকীব। চোখ কচলাতে কচলাতে বাইরে চলে গেল। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবতে বসলাম ওর কথাটা। ছোটবেলায় যখনই দুঃখ পেয়েছে তখনই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আমি নিজের ওড়না দিয়ে সযত্নে ওর অশ্রু মুছিয়ে ওকে শান্ত করেছি। অথচ এখন লম্বায় ও আমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওর চোখ মুছে দিতে হলে ওকে আমার সামনে নিচু হতে হয়। এখন বরং আমার অশ্রুগুলোই ও ভালো মুছতে পারে। আমার দুঃখও লাঘব করে এই ছেলেটাই। ছোটবেলায় যে ছেলেটা একটা বিমান উড়ে গেলে সেটা দেখতে আমার কোলে লাফিয়ে উঠতো, বিমান না দেখতে পেলে আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসাতো সেই ছেলেটাকেই আজ চাইলে আর জড়িয়ে ধরতে পারি না। আসলেই তো আমরা এত তাড়াতাড়ি বড় হই কেন? কি ফায়দা আছে বড় হওয়ায়? কেবলই সম্পর্কগুলোর মাঝে দুরত্ব বেড়ে যায়। হুট করে আমারও খুব ইচ্ছে হলো ছোটবেলার মতো নাকীবকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ওর দুঃখ লাঘব করার, সাথে নিজেরও।

রেফারেন্স:
[১] সহীহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৭১

#Be_continued_In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here