#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ২৩,২৪
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ২৩
পরদিন সকালে রিয়াদের মেসেজের রিপ্লাই দিলাম।
ও বললো, “মিট করে সামনাসামনি বলি সব?”
“আচ্ছা। তাহলে শাওনদেরসহ ডেকে নিই? মিট যখন করবো একসাথেই করি।”
রিয়াদ সোজা না করে দিলো। বললো,
“কাউকে ডাকার দরকার নেই। তোকে তেকেছি তুই একা আসবি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। কোথায় মিট করবি?”
“কলেজ ক্যাম্পাসে।”
বিকেল চারটার দিকে ও এসে আমায় ড্রপ করে নিলো। কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে বসলাম আমরা। রিয়াদকে দেখার পর অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে একটা কথায় বেরুলো,
“তোর এই অবস্থা কেন?”
রিয়াদের চোখগুলো লাল হয়ে আছে। চোখ ফোলা ফোলা। কেঁদেছে নাকি সারারাত? উসকোখুসকো চুল। কতদিন চুলে হাত দেয়নি কে জানে!
“আমার ভীষণ দিশেহারা লাগছে।”
“কিন্তু কেন? কি এমন হয়েছে?”
“আমি একজনকে ভালোবাসি কিন্তু বলতে পারছি না। বলার আগেই সে বোধহয় হারিয়ে গেছে।”
এবার আমি দিশেহারা বোধ করতে লাগলাম। আমি নিজের সম্পর্কই ছিন্ন করে এলাম হারাম বলে। এখন আবার রিয়াদের হারাম রিলেশনে হেল্প করতে হবে নাকি?
“পুরো ঘটনা খুলে বল। তারপর নাহয় বুঝবো।”
রিয়াদ গলা খাঁকারি দিয়ে কাশলো। শার্টের টপ বোতামটা খুলে নিলো। চোখ-মুখ মুছে বলা শুরু করলো,
“আমি একজনকে ভালোবাসি৷ একতরফা! যেদিন ওকে প্রথম দেখি সেদিন থেকে কারণে অকারণে ওকে দেখতে মন চাইতো। দেখতে মন চাইলেই ওকে নিয়ে ঘুরতে চলে যেতাম।”
“এই না বললি তাকে ভালেবাসি বলিসনি? তো ঘুরতে নেওয়ার মানে কি?”
“আমাদের তো রোজই কথা হতো। তারপর একসময় ফাইনাল এক্সাম হয়ে যাওয়ার পর আমাদের দেখা হওয়া কমে যেতে থাকে। একপর্যায়ে পুরোপুরি থেমে যায়। ওকে না দেখতে পেয়ে আমার অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে থাকে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি হৃদি। রাতের পর রাত আমার ঘুম হয় না। আমি মরে যাচ্ছি। প্লিজ আমাকে বাঁচা।”
রিয়াদ নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। আমার ভীষণ অবাক লাগলো। ভালেবাসা মানুষকে এত অসহায় করে তোলে কেন? রিয়াদের সাথে পরিচয়ের পর থেকে ওকে আমি কক্ষনো কাঁদতে দেখিনি। কাঁদা তো দূর আমাদের মধ্যে সর্বদা হাসিমুখে থাকা মানুষটা ও।
“মেয়েটা কে দোস্ত? মনে তো হচ্ছে আমাদের ভার্সিটির কেউ।”
“আমাদের ক্লাসেরই।”
“আমাদের ক্লাসের? কে? নাম বল?”
“তুই…” বলে সামনে কাউকে দেখে থেমে গেল রিয়াদ।
আমিও ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে সেদিকে তাকালাম। আমাদের ক্লাসমেট সোহা দু’প্যাকেট ঝালমুড়ি নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। ওর সাথে আগে কখনো তেমন কথা হয়নি৷ টুকটাক পড়াশোনার ব্যাপারে কিংবা দেখা হলে কুশলাদি পর্যন্তই।
সোহা এসে আমার পাশে বসে মিষ্টি করে হাসলো। রিয়াদকে দেখলাম সোহাকে দেখার পর থেকে ও কেমন চুপসে গেছে। সোহা আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললো,
“ভাবলাম কারো সাথে শেয়ার করে খাবো। বাট তোমরা তো দুজন বসেই আছো। চেনা কাউকে একা পেলাম না।”
“তুমি হঠাৎ কলেজে?”
“এমনিই ঘুরতে এলাম।”
আমি রিয়াদের দিকে তাকালাম। ওর দৃষ্টি, নড়াচড়া সব এলোমেলো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, সোহাকে দেখে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে ও। একটু আগেও তো ঠিক ছিল। ও যাকে ভালোবাসে মেয়েটা কোনোভাবে সোহা নয়তো? ‘তুই’ বলে থেমে গিয়েছিল কেন তখন? নাকি ‘তুই’ বলার পর থেকে অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। মেয়েটা কি…? না থাক, আগ বাড়িয়ে ভেবে লাভ নেই। বরং একটা পরীক্ষা করা যাক।
আমার ঝালমুড়ির প্যাকেটটা রিয়াদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “তুই খা। নিকাব করে আছি তো খুলে খেতে পারবো না।”
সোহা ‘না, না ’ বলে একপ্রকার জোর করেই প্যাকেটটা রিয়াদকে দিতে দিলো না৷ বললো,
“আমারটা থেকে বরং ও খাক। আমার সাথে শেয়ার করবে রিয়াদ?”
রিয়াদ সোহার দিকে একপলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। তারপর নিজ থেকে খেলো সোহার প্যাকেট থেকে। না দেখে খেতে গিয়ে জিহ্বায় মরিচ লেগে যায় ওর। হু হা করে মুহুর্তেই চোখ ভিজিয়ে একাকার করে ফেলে। সোহা ব্যতিব্যস্ত হয়ে মাথা চাপড়ে দেয়। আমি আঁড়চোখে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে আছি। ওর অভিনয়টা ভালোই ধরতে পেরেছি। বোকা সোহাটা ওর অতি কেয়ারিংয়ের দরুণ ধরতে পারেনি।
আমি বললাম, “সোহা, ওর বোধহয় আইসক্রিম খেলে ভালো লাগবে।”
আমার বলতে দেরী হলো কিন্তু সোহার যেতে দেরী হলো না। ও ছুটে বেরিয়ে গেল। আইসক্রিমের দোকান থেকে ঘুরে আসতে কমপক্ষে পনেরো মিনিট লাগবেই৷ সোহা যেতেই রিয়াদকে বললাম,
“বল বল, তোর পরের কাহিনি বল? মেয়েটা কে ছিল?”
রিয়াদ হু হা করতে করতে আমার দিকে তাকালো।
“আমার এত ঝাল লেগেছে আর তুই কাহিনী শুনতে চাইছিস?”
“অভিনয় ওর সাথে করিস, আমার সাথে না। এটা প্যাকেট ঝালমুড়ি। এখানে কোনো কাঁচা মরিচ থাকার কথাই না। ঝালে একদম মরে যাচ্ছিস যেন।”
রিয়াদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আমাদের সামনের বাসায় থাকতো মেয়েটা। রোজ আমরা একসাথে ভার্সিটি আসতাম, যেতাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমাদের দেখা হওয়া কমে গেল। বারান্দায় যা-ও একটু দেখা হতো সেটাও একসময় বন্ধ হয়ে গেল। ওরা বাসা বদলে আরেক জায়গায় চলে গেল। এরপর শুধু ফোনে কথা হলো অনেকদিন। এখন সেটাও বন্ধ হওয়ার যোগাড়। ওকে অনবরত পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে আর আমি এখনো “ভালোবাসি” বলতেই পারলাম না।
“মেয়েটা কে সেটা তুই আমাকে পরে বলবি। আগে আমার সাজেশন শোন৷ তোর বাবা মা তো তোর পছন্দকে জীবনেও না বলবে না। তুই সরাসরি ঐ মেয়ের বাসায় প্রস্তাব পাঠাবি৷ তার আগে বাবা-মাকে কিভাবে মানাবি বলি৷ তুই বলবি, আমি নিজের নফসকে হারাম থেকে দূরে রাখতে, অবৈধ সম্পর্কে না জড়িয়ে বৈধ সম্পর্কে নিজেকে জড়াতে চাইছি৷ যাতে আমার দৃষ্টির যথাযথ হেফাজত আমি করতে পারি। বুঝলি?”
“সত্যি এটা বলবো?”
“তো কি বলবি আর? এটার জন্যই তো বিয়ে করতে চাইছিস। তাছাড়া মেয়েটার বাবাও তোকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না কোনোমতেই। তোর তো কোনো দিকে কমতি নেই তাই না?”
“জানি না কি হবে। তবে আমি জানতাম তুই কোনো না কোনো সলিউশন দিবিই দিবি৷ এজন্যই হন্য হয়ে তোকে খুঁজছিলাম। থ্যাংক ইউ দোস্ত। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”
“মোস্ট ওয়েলকাম। আচ্ছা শোন, তোকে আমি হালাল রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি এরপর একটা হারাম রাস্তা তোর নিজ হাতে বন্ধ করে দিতে হবে।”
“কি সেটা?”
“আজই তোর সাথে আমার শেষ কথা। আর কখনো আমি তোর সামনে এসে দাঁড়াতে পারবো না, তোর সাথে কথাও বলতে পারবো না।”
রিয়াদ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। একপর্যায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“মানে?”
“আমি তোর সাথে কথা বলছি এতে আমার যেমন গুনাহ হচ্ছে, তোরও হচ্ছে। আমাদের উচিত বন্ধুত্বের নামে অবৈধ মেলামেশা থামিয়ে দেওয়া। শোন রিয়াদ, তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস আমি তোর সাথে শত্রুতা করে কিংবা তোর প্রতি কোনো কারণে বিরক্ত হয়ে কথা থামিয়ে দিচ্ছি এমনটা কিন্তু না। শুধুমাত্র গুনাহ, আর আল্লাহর ভয়ে।”
রিয়াদ হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ওকে আরও ভালোভাবে বোঝাতে বললাম,
“তোদেরকে বলেছিলাম না আমার বয়ফ্রেন্ডের কথা। যাকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি৷ গতরাতে তার সাথে শুধুমাত্র গুনাহের কারণে সব সম্পর্কের ইতি টেনেছি৷ যদি বৈধভাবে ও আমার কাছে আসতে পারে তো আসবে নাহয় আমাদের আর কখনো কথাও হবে না, দেখাও হবে না৷ সব যোগাযোগ চিরতরে বন্ধ থাকবে।”
রিয়াদ অনেকক্ষণ পর বললো, “তোর এত পরিবর্তন কিভাবে হলো? যদিও এটা খুব ভালো দিক আমি বুঝতে পারছি।”
“হেদায়েত দোস্ত, হেদায়েত। হেদায়েতের সৌভাগ্য সবাই পায় না। আমি বড়ই ভাগ্যবতী৷ আল্লাহ আমাকে সেই সৌভাগ্য দিয়েছেন। আমি চাই না হেলায় ফেলায় হেদায়েত হারাতে।”
রিয়াদ মাথা নাড়লো। আমি বললাম, “নিজের নফস ও দৃষ্টিকে হেফাজতে রাখিস। আর হ্যাঁ এবার বলতো, মেয়েটা কে?”
“সোহা…” বলে আবার সামনে তাকিয়ে থেমে গেল ও।
সোহা হন্তদন্ত হয়ে এসে রিয়াদকে আইসক্রিম দিলো। রিয়াদ আইসক্রিমটা নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সোহা, বাসায় যাও। আমার ঝাল চলে গেছে।”
“মানে?”
সোহা বোধহয় এটা আশা করেনি। এতদূর থেকে কষ্ট করে আইসক্রিম আনার পর রিয়াদের ব্যবহারটা ওর সহ্য হলো না৷ আমি নিজেই হতবাক মুহুর্তেই ওর পরিবর্তন দেখে।
রিয়াদ বললো, “যেতে বলেছি যাও। বিয়ের প্রস্তুতি নাও।”
সোহা কি বুঝলো কে জানে। খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে চলে গেল ও।
আমি রিয়াদকে আস্তে করে বললাম,
“বিয়ের পর ঠিক এরকম একটা আইসক্রিম নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আজকের দিনের জন্য স্যরি বলে দিবি। ব্যস! রাগ উবে যাবে।”
রিয়াদ আমার দিকে না তাকিয়েই মুচকি হাসলো। খানিকটা আমার দিকে ফিরে বললো,
“তোকে বিয়েতে দাওয়াতও দিতে পারবো না?”
“দরকার নেই তো। তোরা সুখে থাকলেই হলো। আমি নাহয় তোদেরকে দোয়ায় রাখবো। আর দাওয়াতের চেয়ে তুইও বরং আমায় দোয়ায় রাখিস।”
“অবশ্যই। আচ্ছা, বিয়ে হয়ে গেছে এমন একটা মেসেজ তো অন্তত দিতে পারি?”
“আচ্ছা ঠিক আছ মেসেজ দিস। আমি সিন করবো বাট রিপ্লাই পাবি না কিন্তু। এটার জন্য আবার মন খারাপ করতে পারবি না।”
“আরে না, এটুকুতেই আমি খুশি।”
“যাই তাহলে?”
“হুম।”
চলে আসছিলাম। পেছনে ফিরে তাকাতে গিয়েও তাকালাম না। আমি জানি রিয়াদও আমার দিকে তাকিয়ে নেই। আমার এক কথায় ও মুহুর্তেই দৃষ্টির হেফাজত করতে শুরু করে দিয়েছে। আমার চেয়ে ভালো কে জানে, রিয়াদ আমার কত ভালো বন্ধু ছিল? সবসময় সব কাজে সাপোর্ট দিতো আমাকে। আজ অবৈধ বলে ওকে ত্যাগ করতে হচ্ছে আমাকে। আমার এক কথাতেই সব মেনে নিলো ও। এমন বন্ধু পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। মনে মনে এটা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম যে,
“যাক! আরও একটা হারাম সম্পর্কের ইতি ঘটলো।”
বাসায় এসে আবার দু’রাকাত তওবার নামাজ পড়লাম। অতীতের গুনাহের সমাপ্তি টানলাম। হারাম সম্পর্কের বোঝা পুরোপুরি নেমে গেছে কাঁধ থেকে আলহামদুলিল্লাহ।
#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️
#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ২৪
রমজান মাস শেষ হয়। এই পুরোটা মাস আমার কেটেছে ইবাদতে। পুরোদমে মিশে গিয়েছিলাম নামাজ-দোয়ার সাথে। ঘর থেকে বেরুনোও বন্ধ করে দিলাম৷ বেরুলেও হাত মোজা, পা মোজাসহ বোরখা-নিকাবে আবৃত্ত হয়ে বেরোই। একদিন কিছু বই কিনতে বাবার সাথে বাইরে গিয়েছিলাম। সেদিন বৃষ্টি ছিল খুব। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম গাড়ির অপেক্ষায়। যাত্রী ছাউনিতে অপেক্ষা করছিলাম। তুমুল বৃষ্টি হওয়ায় একটাও গাড়ি রাস্তায় দেখা যাচ্ছিলো না। যা-ও এক-দুটো আসছিলো সেগুলোও চোখের পলকে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখলাম কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় বসে কি যেন খাচ্ছে। খাবারের প্যাকেটটা শার্টের নিচে ঢুকিয়ে রেখেছে যাতে খাবার ভিজে না যায়। আমার বেশ অবাক লাগলো। বাবাকে বললাম,
“ওরা তো চাইলেই ছাউনির নিচে এসে খাবারটা খেতে পারতো তাই না বাবা?”
“প্যাকেটটা যখন হাতে পেয়েছে তখন হয়তো এতদূর আসার তর সয়নি ওদের। কয়দিনের অভুক্ত কে জানে?”
বাবাকে বেশ আশাহত দেখালো।
আমি বললাম, “বাবা, ওদের দায়িত্ব যদি আমি নিই তুমি কি বাঁধা দিবে?”
বাবা অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। পরক্ষনেই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তুই দায়িত্ব নিবি কেন?”
“কারণ ওদের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই।”
“ওরা ওদের মতো ভালো আছে। আর তোর যদি বেশি ইচ্ছে হয় হাতে কয়েকশো টাকা দিয়ে দে। আরও বেশি ইচ্ছে হলে একবেলা রেষ্টুরেন্ট থেকে খাইয়েও আনতে পারিস।”
“না বাবা, ওরকম না। আমি ওদেরকে বাসায় নিয়ে যেতে চাই।”
“কিহ? পাগল নাকি? ওদের মধ্যে অনেকেই আছে যাদের অভ্যাস হচ্ছে চুরি করা। তুই ঘরে নিয়ে গেলি আদর করে পরদিন দেখা গেল মূল্যবান জিনিস নিয়ে ওরা পগারপার।”
“বাবা, ওরা অভাবে পড়ে চুরি করে। অভাব না থাকলে তো চুরি করবে না।”
“অভাব থাকবে না? মানুষের আবার চাহিদার শেষ আছে নাকি? অভাবে পড়ে ওদের স্বভাবই নষ্ট হয়ে যায়। শোন, এসব টোকাই ছেলেগুলো গল্প-উপন্যাসেই ভালো হয়৷ বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। তুই যদি এখন আমার কথাগুলো বইয়ের পাতায় পড়তি তাহলে আমাকে তোর ভিলেন মনে হতো বুঝলি?”
“বাবা প্লিজ, সব বুঝলাম তো। আচ্ছা শোনো না, আমি ওদেরকে ঐ যে আমাদের বাইরের ঘরটা আছে না ওখানে রাখবো। পরে ওদের জন্য অন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করবো।”
বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তোর অত সামর্থ্য আছে?”
“বাবা, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে নিজের অল্প সামর্থ্যের মধ্যে থেকে আল্লাহর রাস্তায় দান করে সেই সর্বোত্তম। ধরো, তোমার কাছে অঢেল সম্পদ আছে। তার থেকে তুমি অনেক কিছু দান করলে। দান করার পর তুমি যে সওয়াবটুকু পাবে তারচেয়ে বেশি পাবে যখন তোমার কাছে দুই দিরহাম রয়েছে কিন্তু তার থেকে এক দিরহাম তুমি দান করে দিলে। সেটাই আল্লাহর কাছে অধিক গ্রহনযোগ্য হবে।”
“আচ্ছা রে মা বুঝলাম। তোর মাকে রাজি করাতে পারলে তবেই…”
আমি খুশি হয়ে সামনে তাকাতেই দেখি ছেলেগুলো নেই। হতাশ হতে গিয়েও হতাশ হলাম না৷ কারণ মুমীনরা কখনো হতাশ হয় না, সবসময় সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে। আমিও ভরসা রাখলাম।
বাসায় এসে মাকে জানাতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে মা রাজি হয়ে গেলেন৷ গরীব-দুঃখীদের প্রতি স্বভাবতই মায়ের অনেক টান। পরদিন গিয়ে অনেক খোঁজার পর ছেলেগুলোকে খুঁজে পাই আমি। প্রথমে ওরা আসতে কিছুতেই রাজি হয় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমরা কোথায় থাকো?”
“আকাশের নিচে, মাটির উপরে।” পাঁচবছর বয়সী একটা ছেলে জবাব দিলো।
আমি মুচকি হেসে বললাম, “সে তো আমিও থাকি। আবাসস্থল মানে বাড়ি কই তোমাদের?”
“আমাদের তিনকূলে কেউ নেই, বাড়ি কোত্থেকে আসবে?” আটবছর বয়সী ছেলেটা কথা বললো।
আমি ওদেরকে নিয়ে গিয়ে গাছতলায় বসলাম। সাথে করে খাবার নিয়ে এসেছি। ওদেরকে খেতে দিয়েছি। মোট সাতজনের ছোট্ট একটা দল। দুজন মেয়ে বাকীসব ছেলে। আমি প্রথমে সবার চেয়ে বড় মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমার নাম কি?”
“কুলসুম।” খাওয়া থামিয়ে বললো মেয়েটি।
“বাহ! খুব সুন্দর নাম। কে রেখেছে নামটা?”
“জানিনা। কেডায় জানি রাখছিলো।”
“খুব সুন্দর আর অর্থবহ তোমার নামটা৷ আমাদের প্রিয় নবীজীর মেয়ের নামও কুলসুম, জানো?”
মেয়েটা দু’পাশে মাথা নাড়লো। আমি বললাম,
“আমাকে কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে?”
“ইচ্ছা তো করতাছে বিশ্বাস করি কিন্তু বারবার তো ঠকতে মন চায় না আপা।”
আহারে! ছোট্ট এই জীবনে কতবার যে ছোট্ট শিশুগুলোকে ঠকতে হয়েছে। পৃথিবীর মানুষগুলো এত নিষ্ঠুর কেন?
আমি বললাম, “তুমি নিশ্চিন্তে আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি তোমাদেরকে ঠকাবো না, কথা দিলাম। যাবে আমার সাথে?”
কুলসুম কিছু বলার আগেই আট বছর বয়সী ছেলেটা এসে বললো,
“আপা, ছবি তুলবেন না?”
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “কিসের ছবি?”
“খাবার দিলেন যে আমাদের? খাবারশুদ্বা ছবি তুলে নিবেন না?”
আমার মনটা তাৎক্ষণিক বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেল। সত্যিই পৃথিবীর মানুষগুলো স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। একটু শো-অফ করবে বলে কত কিই না করে। অথচ এগুলো যদি আল্লাহর জন্য করতো কতশত সওয়াব যে আমলনামায় যুক্ত হতো!
আমি ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
“না বাবু, আমি কোনো ছবি তুলতে আসিনি। তোমাদেরকে দেখে ক্ষুদার্থ মনে হয়েছে তাই খাবার দিতে এসেছি।”
সবাই বেশ অবাক হলো মনে হলো। হয়তো আগে কেউ এভাবে বলেনি। ওদের ক্ষুধা হয়তো কারো চোখে পড়েনি৷ আমি বললাম, “তোমাদেরকে কিছু কথা বলবো?”
সবাই উৎসুক হয়ে আমার দিকে তাকালো।
আমি বললাম, “পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। তাই ক্ষুধার্ত, দরিদ্র ব্যক্তিকে খাবার দানের মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী বান্দা হিসেবে গণ্য হতে পারি। ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের খাবার দানকারী ব্যক্তি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ পাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে আমরা তোমাদের খাবার দান করি, তোমাদের নিকট এর কোনো প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও কামনা করি না।’ (সুরা দাহর, আয়াত : ৯)।
সেদিন বৃষ্টির সময় দেখলাম তোমরা খোলা আকাশের নিচে বসে কি যেন খাচ্ছো। দেখে আমার এত খারাপ লাগলো ইচ্ছে করলো তখনই আমার বাসায় নিয়ে গিয়ে তোমাদের খাওয়াই। আমি তোমাদেরকে খাওয়ানোর বদলে তোমাদের কাছে কিচ্ছু চাই না৷ তোমাদেরকে ক্ষুদার্ত দেখেছি বলে খাইয়েছি এর বেশি কিছু না।”
কুলসুম বললো, “আপা, আপনে কিছু মনে কইরেন না। আমরা তো জন্ম থেকেই ঠকতে ঠকতে আসছি এজন্য এখন আর কাউরে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু আমরা আপনেরে বিশ্বাস করছি আপা। বিশ্বাস করেন।”
কুলসুমের গালে হাত রেখে বললাম,
“আমি কিছু মনে করিনি কুলসুম। আচ্ছা তুমি যেহেতু বলছো আমাকে বিশ্বাস করেছো তাহলে আমার একটা কথা রাখবে?”
“বলেন আপা।”
“তোমরা আমার সাথে আমার বাসায় যাবে?”
ওরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। আমি বললাম,
“আমি তোমাদেরকে স্কুলেও ভর্তি করে দিবো। তোমাদেরকে আর কষ্ট করে খেঁটে খেতে হবে না।”
ওরা নিজেরা কিছুক্ষণ আলোচনা করে বললো,
“আপনার সাথে যাওয়াই যায়। আপনের মতো করে কেউ আমাদেরকে ভালোবেসে খাওয়ায়নি আপা। আমরা যাবো আপনার সাথে।”
আমার এত খুশি লাগলো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ছোট একটা ছেলে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় আমাকে বললো,
“আপা, তুমি বললা না ঐদিন বৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখছো, আসলে সেদিন বস্তি থেকে আমাদেরকে বাইর কইরা দিছিলো। কই থাকবো বুঝতাছিলাম না৷ আল্লাহ ছাড়া কেউ আছিল না আমাদের। আল্লাহই তোমারে পাঠাইছে আমাদের কাছে। তুমি অনেক ভালা।”
আমি ওদের সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। একরাশ আনন্দ নিয়ে ওদের সাথে বাড়ি ফিরছি। ভালোবাসা যে কতরকমের হয় আজ বুঝতে পারছি৷
হঠাৎ একটা হাদীস মনে পড়লো আমার৷
মহানবী (সাঃ) বলেন, ‘দয়াশীলদের ওপর দয়াময় আল্লাহ দয়া করে থাকেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর দয়া করো, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯২৪; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৪১)
বাসায় আসতে আসতে ওদের সবার পরিচয় জেনে নিলাম। সবার বড় কুলসুম। ওর বয়স দশ। এরপর যথাক্রমে মাহফুজ, রায়হান, আবরার, আবির, ফাহিম ও ঝিলি। ওদের বয়স যথাক্রমে আট, সাত, নয়, পাঁচ, ছয় ও চার। ঝিলি বয়সে সবার চেয়ে ছোট। একদম কিউট একটা ফুটফুটে মেয়ে।
বাসায় এসে মা, বাবা ও নাকীবকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মা সবচেয়ে বেশি আদর করলেন ওদের৷ দুপুরে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ালেন। ঝিলিকে তো নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন। বাবা-মা দুজন একসাথে গিয়ে ওদের জন্য চার সেট করে কাপড় কিনে নিয়ে এলেন, জুতো, স্যান্ডেল থেকে শুরু করে চিরুণি পর্যন্ত সব কিনে আনলেন। প্রায় পাঁচ হাজার টাকার শপিং করে তবেই ফিরলেন দুজনে। বাবা তো বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে ঝিলি ছাড়া সবাইকে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থাও করে ফেললেন। তবে কুলসুম ও মাহফুজের ভর্তি হতে একটু বেগ পোহাতে হবে। ওদের বয়স একটু বেশি বলে। সেটাও বাবা নিজে গিয়ে ম্যানেজ করবেন বলে জানিয়েছেন।
আমি ছোটফুফিকে ব্যাপারটা জানালাম। শুনে খুব খুশি হলেন ফুফি। আমি ওদের ভরনপোষণের জন্য কিছু একটা কাজ করতে চাই বলার পর ফুফি বললেন,
“আল্লাহর কাছে চাও। আল্লাহর তো দিতে বাঁধা নেই তোমার চাইতে এত আপত্তি কেন? বিশাল বিশাল চাওয়া তুমি মানুষের কাছে না চেয়ে আল্লাহর কাছে চাও। অন্তর লাগিয়ে দোআ করো। কবুল না হয়ে যাবে কোথায়? শুধু কবুলই না অতি শীগ্রই তোমার চাওয়া-ও পূরণ হবে ইন শা আল্লাহ। সুতরাং আল্লাহকে ডাকো।”
#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️