#গল্প১৩৮
#সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৯)
১.
পারিজাত স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে, বিশ্বাসই হচ্ছে না। হুমায়ুন নামের লোকটা ওর মেসেজের উত্তর দিয়েছে। আজ সকাল থেকেই মনটা খারাপ ছিল।কলেজে এসে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের পড়ানোর সময় অল্পতেই রেগে গিয়েছিল। কেন জানি ইদানীং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সূর্যের খোঁজটা পেতে পেতেও সেটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে খুব অসহায় লাগছিল। কিন্তু আজ যখন ক্লাশ শেষে একটু এসে বসেছে ঠিক তখনই মেসেজটা আসে, ‘সূর্য কাশিমপুর কারাগারেই আছে, এখানে এলেই দেখা পাবেন। ভুলেও আমাকে চেনেন এটা বলা যাবে না। শুধু আসার আগে আমাকে একবার জানিয়ে রাখবেন, আমি ব্যবস্থা করে রাখব।’
পারিজাতের মনে হলো ওর মেঘে ঢেকে থাকা আকাশে আজ বহুদিন পর যেন সূর্য উঠল, মনের স্যাঁতসেঁতে আঙিনায় রোদ পড়ল। বুকের ভেতর একটা আকুলতা টের পায়, সূর্যের কাছে যাবার, একটু দেখার।
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই পারিজাত থমকে যায়, আচ্ছা, সূর্য কী ওর উপর রেগে আছে? ওর জন্যই তো সূর্যের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল। মায়ের জন্য ওর কিছু করার কথা ছিল, সেটা হলো না। শুধুমাত্র ওকে বাঁচাতে গিয়েই তো সূর্যের জীবন আজ এলোমেলো। সূর্য কী ওর পরিণতির জন্য ওকেই দোষী মনে করে? পারিজাত কী সূর্যের মনের কোণে সেই আবেগের জায়গাটাতেই আছে নাকি অনেকখানি দূরে সরে গেছে?
আরেকটা ভয়ংকর কথা মনে হতেই পারিজাত মনে মনে আরো বেশি কুঁকড়ে যায়। সেদিনের সেই ঘটনার পর সূর্য ওকে কী আগের মতোই পরিশুদ্ধ ভাবে? নাকি ওই ছেলেটা ওকে যখন টেনে হিঁচড়ে কাশফুলে বনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন ওর গায়ে নোংরা ছোঁয়াটা টের পাচ্ছিল। সূর্য কী পারিজাতকে ঘৃণা করে? গল্পের তৃতীয় পর্ব পড়ে সেটা বোঝা যায়নি, কিন্তু একটা অজানা আশংকায় পারিজাতের বুকটা ভারী হয়ে আসতে থাকে। ও দেখা করতে যেয়ে যদি সূর্যের চোখে সেই মায়াটা না দেখে? ওর এমন অধীর হয়ে অপেক্ষা করে থাকাটা যদি মিছে হয়ে যায়?
ভাবনাটা ভাবতেই একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এসে ওকে ঘিরে ধরে। সূর্যের সাথে কী দেখা করবে? একটু ভাবে, তারপর সিদ্ধান্ত নেয় যে গল্পটার পরের পর্বের জন্য ও অপেক্ষা করবে। তার আগে হুমায়ুন নামের লোকটাকে বিশেষ করে অনুরোধ করতে হবে পরের পর্বটা যেন উনি পোস্ট করেন।
সেদিনের পর থেকে পারিজাতের অপেক্ষার প্রহর শুরু হয়, আরেক ধরনের অপেক্ষা। সত্যটা ওর জানা দরকার। কিন্তু সপ্তাহ পেরিয়ে যায়, ওদিক থেকে নতুন কোনো পোস্ট আসে না। এর মাঝে পারিজাত আবার অনুরোধ করে মেসেজ পাঠিয়েছে। একটা জিনিস ও বোঝে যে এই হুমায়ুন নামের লোকটা অতটা খারাপ না। ওদের ভালোবাসা ওনাকে ঠিক ছুঁয়ে গেছে, তা না হলে উনি সূর্যের কারাগারের নামটা বলত না।
ঠিক সতের দিনের মাথায় গল্পের নতুন পর্বটা পোস্ট হয়। পারিজাত নিশ্বাস বন্ধ করে পড়তে থাকে। গল্পের প্রথমে কারাগারের কষ্টের দিনের কথা, ক্ষেতে কাজ করার কথা। মায়ের জন্য ওর উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা। এরপর গল্পটার একটা অংশে এসে ওর চোখটা থেমে যায়, ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে ওঠে। জেলখানায় একটা মান্দার গাছ আছে, যেটার সামনে এসে দাঁড়াতেই পারিজাতের কথা মনে হয়ে সূর্যের মুখটা কোমল হয়ে গিয়েছিল। এরপরের লাইনগুলোতে শুধুই পারিজাতের কথা। শুধু পারিজাতের মুখটা মনে করেই যে সব কষ্ট ভুলে থাকা তার কথা লেখা। কারাগারের অন্ধকারের দিনগুলোতে পারিজাতই যে তার বাতিঘর!
পারিজাত চোখটা মুছে, বিষাদ চোখে তাকিয়ে ভাবে, একটা মানুষ জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে এখনো ওকে ভেবেই বেঁচে আছে। অথচ ও কীসব উল্টোপাল্টা ভাবছিল। ও যাবে, আর কোনো দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই।
কিন্তু একা একা কী করে যায়? অন্য কাউকে যে নেওয়া যাবে না। হঠাৎ ধ্রুবর কথা মনে হয়, এই ক’দিনে যতটুকু চিনেছে এই মানুষটা আলাদা। পারিজাতের ব্যাপারে একটু হলেও কেয়ারিং।
সেদিন ক্যাম্পাসে একটু একা পেতেই পারিজাত ধ্রুবকে বলে, ‘আগামী সপ্তাহে আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে পারবেন?’
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে, ‘এ যে মেঘ না চাইতেই ঝড়, বৃষ্টি। আপনি যেখানেই নিয়ে যাবেন আমি সেখানেই যাব, সেটা আন্দামানে হলেও।’
পারিজাত চোখ তুলে তাকায়, তারপর শান্ত গলায় বলে, ‘জায়গাটা আন্দামান দ্বীপের মতোই।’
ধ্রুব পারিজাতের গলায় একটা বিষাদের হাওয়া টের পায়, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই পারিজাত বলে, ‘আপনি না সেদিন আমার কথা জানতে চেয়েছিলেন? আমি বলেছিলাম সময় হলেই বলব। সেই সময়টা এসেছে এবার। তার আগে আমাকে একটু আপনার গাড়িতে করে একটা জায়গায় যেতে হবে।’
ধ্রুব বুঝতে পারে, কোনো একটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি ও হতে যাচ্ছে। ও মাথা নেড়ে বলে, ‘কোনো সমস্যা নেই পারিজাত। আগামী সপ্তাহে কবে যাবেন বলবেন, আমি ছুটি নিয়ে রাখব।’
২.
সূর্য দুপুরের খাবার খেয়ে ভাবছিল আজ আর লিখবে না। একটু ভাববে, গল্পটা গুছিয়ে নিতে হবে। আকাশের দিকে তাকাতেই নীল আকাশটা দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়। শরতের নীল আকাশ, সাথে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভাসছে। এই মেঘের ভেলায় চড়ে যদি পারিজাতের কাছে চলে যেতে পারত।
এমন যখন ভাবছে ঠিক তখন একজন কলিং রাইটার ওকে এসে ডাক দেয়, বলে, ‘ওস্তাদ, একটা সুন্দর মতো মাইয়া দেখা করতে আইছে।’
সূর্য কম্পিউটার সেকশনে কাজ করার পর থেকে ওকে সবাই সমীহ করেই চলে। জেলার সাহেবও ওকে নামে চেনেন। ওনার অনেক ইংরেজি চিঠি ও লিখে দেয়। ওর লেখার হাতে উনি দারুণ মুগ্ধ। তাই সবাই ওকে সমীহই করে।
কলিং রাইটারের কথায় ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, ওর কাছে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে? একটা অসম্ভব ভাবনা মনে খেলে যায়, পারিজাত না তো? এতদিন পর ও আসবেই বা কেন? পারিজাতের নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে গেছে। তাহলে কে?
মনের ভেতর একটা উত্তেজনা নিয়ে ও দর্শনার্থীদের নির্ধারিত জায়গায় যায়। দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে একটা মুখের উপর এসে স্থির হয়, সেইসাথে সময়টা স্থির হয়ে যায়, পাখিরা তাদের কোলাহল থামিয়ে দেয়, আকাশের ভেসে বেড়ানো মেঘেরাও বুঝি থমকে দাঁড়ায়, পারিজাত!!! শাড়ি পরে এসেছে পারিজাত, মুখটা কী বিষন্ন! মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য ভাঙা গলায় আকুল হয়ে ডাক দেয়, ‘পারিজাত’।
পারিজাত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, ও ভেবে পাচ্ছে না এত মানুষের মাঝে আর এত দূর থেকে ও কী করে সূর্যের সাথে কথা বলবে। আর সূর্যকে ও চিনতে পারবে তো? উদ্বিগ্ন চোখে ও বার বার ওপাশের বন্দিদের দেখছিল, কিন্তু সূর্য নেই। মনটা খারাপ করে মাথা নিচু করে একটু ভাবছিল, ঠিক এমন সময় একটা ডাক ও শুনতে পায়, কেউ আকুল হয়ে ওর নাম ধরে ডাকছে। পারিজাত মুখটা তুলে তাকাতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, বুকের ভেতর একটা ভাংচুরের শব্দ পায়। ওর প্রিয় মানুষ, প্রিয় মুখচ্ছবি, সূর্য! আবেগে গলাটা বুজে আসে, ভাঙা গলায় ডাকে, সূর্য!
দু’জন যেন কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চল হয়ে যায়, কারো মুখে কথা নেই, শুধুই তাকিয়ে থাকা। কত কথা যে হয়ে যায় ওই নীরব চোখের ভাষায়। পারিজাত সূর্যের চোখে সেই মায়াটা দেখতে পায়, যেটুকুর জন্য ও বেঁচে থাকে। আর সূর্য অপলক চেয়ে ভাবে, একটা মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে এত সুখ কেন?
সূর্য শুধু বারবার জানতে চায় পারিজাত কেমন আছে, ভালো আছে তো? পারিজাত বলার চেষ্টা করে ও ভালো নেই কিন্তু এখানে এমন চিৎকার করে এই কথাগুলো বলা হয়ে ওঠে না।
শুধু আসার সময় একটা কথাই বলে, ‘সূর্য, আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য।’
ধ্রুব গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ দেখতে পায় পারিজাত মাথা নিচু করে হেঁটে ওর দিকেই আসছে। কী বিষাদময় হয়ে আছে মুখটা, যেন বাসি ফুলের মতো। এখানে আসার পথে পারিজাত ওর আর সূর্যের কথা পুরোটাই বলেছে। শুনতে শুনতে ধ্রুব কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ও নিজেও একজনকে ভালোবাসত, নিলীমাকে। অনার্স শেষ হবার সাথে সাথেই ওর বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে, ধ্রুব তখন বেকার। মাস্টার্সের পাশাপাশি নানা জায়গায় চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু নীলিমা অপেক্ষা করেনি, ভালো পাত্র, বিসিএস চাকুরে পেয়ে ঠিক বিয়েটা করে ফেলেছিল। অথচ পারিজাত জীবনের সুখের হাতছানি উপেক্ষা করে দুঃখকে আলিঙ্গন করেছে, সূর্যের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। মনে মনে সূর্যকে হিংসে হয় ধ্রুবর।
পারিজাত গাড়িতে উঠতেই ও গাড়িটা ছেড়ে দেয়। আলতো করে জিজ্ঞেস করে, ‘সূর্যের দেখা পেয়েছেন?’
পারিজাত অস্ফুটে বলে, ‘হ্যাঁ, পেয়েছি।’
ধ্রুব আর কথা বাড়ায় না, মূল রাস্তায় গাড়িটা পড়তেই পারিজাত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে কোথাও উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইশ, সূর্য কেমন শুকিয়ে গেছে। আসার সময় ওর মায়ের ঠিকানাটা শুনে এসেছে। পারিজাত যাবে দেখা করতে।
৩.
মেহেরুন্নেসা চিন্তিত মুখে ব্যারিস্টার তৌফিক এলাহীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সূর্যের সাজা কমানোর যে আপিল করা হয়েছে তা কবে নাগাদ শেষ হতে পারে তাই জানতে চেয়েছিলেন।
ব্যারিস্টার তৌফিক বলেন,’দেখুন, এই কেসগুলো সংবেদনশীল। এগুলোর আপিল শুনানি শেষ হয়ে নতুন রায় হতে কম করে হলেও দুই তিন বছর লাগবে। অনেকক্ষেত্রে পাঁচ বছরও লেগে যায়। তবে আমি আশাবাদী যে আপনার ছেলের শাস্তির মেয়াদ কমবে।’
শেষের কথাটায় মেহেরুন্নেসা একটু ভরসা পান। ছেলেটা কয়েকটা বছর আগেও যদি জেল থেকে মুক্তি পেত!
সেদিন বাসায় ফিরতেই ফাতেমা উৎসুক গলায় জানতে চায় উকিল কী বলল। এই মেয়েটাকে কয়েক মাস হলো গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন। একা একা থাকা খুব কষ্টের। কাছের আত্মীয় স্বজনরা তো সেই খুনের ঘটনার পর থেকে ভয়ে কাছেই আসে না। নিজের আপন মানুষেরা কেউ এগিয়ে আসেনি, যদি পুলিশ ওদের জড়িয়ে মামলা দেয়। ফাতেমার অবশ্য সেই ভয়টা নেই, তিনকূলে ওর কেউ নেই। বাচ্চা হয় না বলে অনেক আগেই বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল। এখন এই শেষ বয়সে মেহেরুন্নেসার কাছে এসে তাও একটা স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে।
মেহেরুন্নেসা খেতে খেতে সব খুলে বলেন। ফাতেমা আফসোস করে বলে, ‘আমাগো সূর্য বাবা এত ভালো একটা পোলা, তার কি না এই অবস্থা হইল। তুমি বুবু চিন্তা কইরো না, আল্লাহ নিশ্চয়ই সাজা কমাই দিব।’
মেহেরুন্নেসা ভাবেন, যে সাজা উনি ইতিমধ্যেই পেয়েছেন তার কী হবে?
খাওয়া শেষ করে একটু ঘুমোতে যেতেই কেউ দরজায় কড়া নাড়ে। ফাতেমা দরজা খুলে দেখে একটা সুন্দর মতো মেয়ে, ওকে জিজ্ঞেস করে, ‘মেহেরুন্নেসা ম্যাডাম কী এখানে থাকেন?’
ফাতেমা মাথা নাড়ে। এদিকে মেহেরুন্নেসা পাশের ঘর থেকে নিজের নাম শুনে উঠে এসেছেন। চেনা চেনা লাগে মেয়েটাকে, কোথায় যেন দেখেছেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, ‘তোমাকে তো চিনলাম না?’
মেয়েটা মাথা নিচু করে বলে, ‘আমি পারিজাত।’
এবার মনে পড়ে, এই সেই মেয়ে যাকে আদালতে কয়েকবার উনি দেখেছেন। এর জন্যই তো ওর সূর্যের আজ এই অবস্থা। ভীষণ রাগ উঠে যায়, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, কড়া কথা বলতে গিয়েও হঠাৎ করেই মনে হয়, সূর্য মেয়েটাকে ভালোবাসত। পারিজাত যে সূর্যেরই একটা অংশ ছিল!
কাছে এসে জড়িয়ে ধরতেই পারিজাত ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। বহুদিন পর একটা মায়ার আশ্রয় যেন ও পেল। কান্নার দমকে পিঠটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। মেহেরুন্নেসাও চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না।
দু’জন সর্বহারা মানুষ বহুদিন পর মনের আগল খুলে দিয়ে কাঁদে, সূর্যকে হারানোর দুঃখটা ভাগ করে নেয়।
৪.
পারিজাত আনমনে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে আছে, সূর্যের সাজার তিন বছর শেষ হতে চলল। এদিকে আপিলের শুনানি হতেও সময় নিচ্ছে। পারিজাত এখন সময় পেলেই সূর্যের মায়ের কাছে যায়, চুপ করে বসে থাকে। পৃথিবীর এই একটা মানুষ ওর কষ্টটা বোঝে। দু’জনের কষ্টটা যে একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু যত দিন গড়াচ্ছে মা ততোই ওর বিয়ে নিয়ে অস্থির হয়ে ওঠছেন। প্রায়ই নতুন নতুন ছেলের খোঁজ নিয়ে আসেন, তারিখ করেন। পারিজাত কোনো না কোনো ছুতোয় ঠিক এড়িয়ে যায়। এই যেমন আজকেও বিকেলে পাত্রপক্ষ আসার কথা ছিল কিন্তু ও আগেই কৌশলে পাত্রের ফোন নাম্বার যোগাড় করে ওর জীবনের কিছু কথা শেয়ার করেছে। ও যে একটা খুনের মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া একজন আসামি সেটা জানতেই এরা আজকের আসাটা বাতিল করেছে। উলটো কথাও শুনিয়েছে। পারিজাত এখন অপেক্ষা করছে মা কখন এসে ওর উপর রাগ ঝাড়বেন।
এই যখন ভাবছে ঠিক তখন নিলুফার বেগম মেয়ের রুমে ঢোকেন, এক দৃষ্টিতে পারিজাতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর রাগে ফেটে পড়ে বলেন, ‘তুই ওই খুনী ছেলেটার জন্য নিজের বিয়েটা ইচ্ছে করে ভেঙে দিবি?’
পারিজাত খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ‘মা, বিয়েটা তো আমি ভাঙছি না, পাত্র পক্ষেই তো ভয়ে চলে যাচ্ছে।’
নিলুফার হতাশ গলায় বলেন, ‘তুই ওই মামলার কথাটা কেন বললি? না বললেই পারতি। তোর বাবা খুব রাগ করেছে।’
পারিজাত এবার উঠে এসে মায়ের হাতটা ধরে বিছানায় বসায়, তারপর গভীর গলায় বলে, ‘মা, একটা কথা বলো তো, আমি যাকে বিয়ে করব সে যদি আমার সব মেনে না নেয়? এই ছেলে তো শুধু আমার মামলার কথাটা শুনেছে। কিন্তু যখন জানবে আমাকে রেপ করার চেষ্টা করা হয়েছিল তখন কী আর মন থেকে কেউ মেনে নেবে? কেউ কী আমাকে ভালোবাসবে? তোমরা তো অনেক চেষ্টা করলে, কিন্তু দেখলে তো কেউ এগিয়ে আসেনি। তুমি কী চাও আমি সারাজীবন মাথা নিচু করে, আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে বাঁচব? আর সূর্যকে তো আমি ভালোবাসি, ওর জন্য আমি অপেক্ষা করব। এই পৃথিবীতে একমাত্র সূর্যই আমাকে অকৃত্রিম ভালোবাসে।’
লিলুফার সত্যিটা অনুভব করতে পারেন, আসলেই তো পারিজাতের ওই ঘটনার আগে অনেক সমন্ধ আসত। তখন পড়াশোনা শেষ হয়নি তাই বিয়ের চিন্তা করেননি। কিন্তু এখন সেই পরিচিত মুখগুলো যারা একসময় অনেক আগ্রহ করে পারিজাতকে বিয়ে করতে চাইত তারা সবাই পিছুটান দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে সূর্যকে কিছুতেই মন মেনে নিতে চায় না। নিলুফার গম্ভীরমুখে বলেন, ‘সূর্যের সাজা খেটে বের হতে অনেক সময় লাগবে, আর জেল থেকে বের হয়ে ও কী করবে? ওকে কেউ না দেবে চাকরি আর ওর না আছে কোনো ব্যবসা করার টাকাপয়সা। সারাজীবন তুই সুর্যকে চাকরি করে খাওয়াবি? একটা জিনিস জানিস তো পুরুষ মানুষ যদি নিজে রোজগার না করে তাহলে কিন্তু সে হীনমন্যতায় ভোগে। আর সূর্য তো শিক্ষিত ছেলে, ও কী এমন জীবন মেনে নেবে? তখন দেখবি ইগো নিয়ে সমস্যা। তুই সুখী হবার কথা ভাবছিস সেটা কিন্তু এত সহজ না।’
কথাগুলো বলতে পেরে নিলুফার বেগম বেশ স্বস্তি বোধ করেন। পারিজাতকে বাস্তবতার আরেকটা দিক আজ দেখাতে পেরেছেন।
পারিজাত ঠোঁট কামড়ে ভাবে, মায়ের কথাগুলো একদম ঠিক। সত্যি বলতে কী পারিজাত নিজেও খুব ভাবে ইদানীং, সূর্য জেল থেকে বের হয়ে সম্মানজনক কিছু যদি না করতে পারে তাহলে আবার হতাশার ভেতর ডুবে যাবে। নিজে কিছু না করার অক্ষমতা ওকে কুড়ে কুড়ে খাবে। পারিজাত গভীরভাবে ভাবতে বসে, একটা উত্তরণের পথ খুঁজে পাবার আশায়।
৫.
মেহেরুন্নেসা আজ ফজরের নামাজ শেষে সুরা ইয়াসিনটা পড়েন। তারপর চোখটা বন্ধ করে গভীর আবেগে দুই হাত তুলে মোনাজাতে বসেন। মোনাজাত শেষে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন। আজকের দিনটা অন্যরকম হোক, আজ সূর্যের আপিলের রায় হবে। চারটা বছর হয়ে গেছে সূর্য কারাগারে। হে আল্লাহ, সূর্যের সাজাটা যেন কমে যায়।
মেহেরুন্নেসা আজ আগেই আদালত প্রাঙ্গণে চলে এসেছেন। পারিজাত আসার কথা। মেয়েটা সেদিনের পর থেকে প্রতি মাসে একবার করে হলেও এসেছে, পুরোটা দিন থেকে গেছে। আর প্রতিদিন ফোন করে খবর নিত। মেহেরুন্নেসা একটা শান্তি অন্তত পান, তার ছেলের জন্য এই পৃথিবীতে একজন ভাবার মানুষ আছে। খুব ভয় হতো, উনি মরে গেলে এই ছেলেকে কে এমন দেখেশুনে রাখবে?
এজলাশে মাননীয় বিচারক বসতেই মেহেরুন্নেসার বুকে ড্রাম বাজতে থাকে। পারিজাত এখনো এসে পৌঁছুতে পারেনি। ফোনে জানিয়েছে রাস্তায় জ্যাম, তবে আধা ঘন্টার মাঝেই চলে আসবে। কিন্তু এখনই তো রায় ঘোষণা হবে, মেহেরুন্নেসার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
পারিজাতের নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে, আজকেই এমন বিপত্তি হলো? বাসা থেকে বের হতে যেতেই স্যান্ডেলটা ছিঁড়ে গেল। তখনই মনে কু ডাক দিয়েছে। তারপর যে সিএনজিটা নিল সেটাও মাঝপথে বিগড়ে গেল। ইশ, ধ্রুবকে একবার বলা উচিত ছিল, তাহলে ঠিক সময়মতো পৌঁছে যেত। ইচ্ছে করেই আজ বাসার গাড়িটা এড়িয়ে গেছে ও।
পারিজাত যখন আদালতে পৌঁছে তখন নির্ধারিত সময় থেকে এক ঘন্টা পার হয়ে গেছে। রায় কী হয়ে গেল? পারিজাতের অস্থির চোখ মেহেরুন্নেসাকে খুঁজে বেড়ায়। হঠাৎ করেই নজর পড়ে, এক কোণে মানুষটা বসে আছে, শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। পারিজাতের বুকটা ধক করে ওঠে, তাহলে কী সূর্যের সাজাটা কমেনি?
পারিজাত শংকিত মুখে মেহেরুন্নেসার কাছে গিয়ে বসে হাতটা ধরে। মেহেরুন্নেসা চোখ তুলে তাকিয়ে পারিজাতকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন, ভাঙা গলায় বলেন, ‘মাগো, আমার সূর্যের সাজা কমেছে। আল্লাহ আমার মোনাজাত কবুল করেছে। আমার সূর্য, আমার জীবনের আলো। আদালত ওকে দশ বছর সাজা মওকুফের আদেশ দিয়েছে।’
পারিজাতের বুকের ভেতরে জমে থাকা কষ্টের হিমবাহটা যেন গলতে থাকে, মাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আজ চোখে আনন্দ আশ্রু।
আসার সময় ওরা দু’জনে ব্যারিস্টার তৌফিক এলাহীকে অনেক ধন্যবাদ জানান। নিশ্চিত হতে ওনাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ওর তো সাজার চারটা বছর পার হয়ে গেছে, আর ছয় বছর পর মুক্তি পাবে, তাই তো?’
তৌফিক এলাহী একটু ভাবেন, কড় গোনে একটা হিসেব করে বলেন, ‘ছয় বছর না, আর সাড়ে তিন বছর পরেই আপনার ছেলে মুক্তি পাবে?’
পারিজাতের সাথে সাথে মেহেরুন্নেসার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়, সামনের টেবিলটা খামচে ধরে বলে, ‘মানে? এত দ্রুত মুক্তি পাবে?’
তৌফিক এলাহী হাসেন, বলেন, ‘জেলখানায় ন’মাসে বছর। ক্যালেন্ডারের সময় হিসেবে আপনার ছেলের সাজা হয়েছে সাড়ে সাত বছর। ও তো চার বছর সাজা খেটেছে, তাহলে আর সাড়ে তিনবছর বাকি থাকে।’
মেহেরুন্নেসা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। এত এত খুশির খবর আজ ছিল!?
পারিজাত সেদিন মেহেরুন্নেসাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। ফেরার পথে একটা ভালো লাগা ওকে ঘিরে ধরে, সূর্য আসছে। কিন্তু সাথে সাথে একটা ভাবনা ওকে দিশেহারা করে ফেলে, সূর্যের জন্য একটা কিছু ওর অবশ্যই করে রাখা দরকার। যাতে ও এই কয়েকটা বছরে পিছিয়ে পড়া জীবনটা কিছুটা হলেও যেন এগিয়ে শুরু করতে পারে। কিন্তু, সেটা কী?
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৮/০২/২০২২