##শেষ_বিকালের_আলো (পর্ব ১৫)
সাদিয়া আর রুদ্র বিয়ের শপিং শেষ করে যখন বাসায় আসলো তখন রাত বাজে ১০ টা।
বাসায় এসে দেখলো সবাই ড্রয়িং রুমে বসে বিয়ের আলাপ আলোচনা করছে। সাদিয়া তার রুমে চলে গেলো আর রুদ্র সবার সাথে বসলো।
আগামীকাল বাদ আসর বিয়ের সময় ঠিক করা হয়েছে। অরণ্য বলল,সবাই অনেক টায়ার্ড,এখন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ভালো হয়।
আগামীকাল ভোর বেলায় উঠে বিয়ের কাজ শুরু করতে হবে আবার….সবাই খাওয়া-দাওয়া করে যে যার মত চলে গেলো ঘুমানোর জন্য।
অরণ্য লিনসাকে নিয়ে শুয়ে পরলো। শুয়ে শুয়ে ভাবছে আগামীকাল এমন সময়ে অবনী আর লিনিয়া তার পাশে থাকবে উপরওয়ালা চাইলে!!!
সাদিয়া শুয়ে শুয়ে ভাবছিলো…সত্যিই তার জীবনে উপরওয়ালা এত ভালো কিছু লিখে রেখেছিলো! কত কষ্ট করে ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে। রুদ্রর মত এত ভালো ছেলে হাজব্যান্ড হিসেবে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।এসব চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো!!!
অবনী ভাবনায় পড়লো এখন কোথায় যাওয়া যায়!এখানে আর থাকা যাবেনা! আকাশের বাড়ি নাহলে এই ঝামেলাটা আর হতোনা। নিজের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করলেও অরণ্যের এমন অপমানের পরে আর অরণ্যের আশেপাশেও যেতে মন চাইছেনা।সে সবার আড়ালে থাকতে চায়… অনেক আড়ালে…..!!
একদম সকাল বেলায় উঠে রান্নাবান্না শুরু হয়ে গেলো অরণ্যদের বাড়িতে,আম্মা আর রাহেলা খালা রান্না করছে।সাদিয়া আর লিনসা মিলে ঘরের অন্য কাজ করছে …রুদ্র চলে গেলো সেলুনে…দুই বাবা বাইরে চলে গেলো কোন কাজে।
অরণ্য সাদিয়াকে ডেকে বলল…তুমি লিনসাকে নিয়ে বাসার আশেপাশে কোন একটা পার্লারে চলে যাও…তোমার ভাবী থাকলে অবশ্য আমাকে এটা বলতে হতোনা সেই কোন ভালো পারলার বুকিং দিয়ে নিয়ে যেতো। তুমি তো এখানে তেমন ভালো কিছু চেনোনা।লিনসা ওর মায়ের যাওয়া পারলার চেনে।ও তোমাকে দেখিয়ে দিবে।
সাদিয়া আচ্ছা বলে লিনসা কে নিয়ে চলে গেলো…অরণ্য ছাদে চলে গেলো…ছাদে গিয়ে বেঞ্চিতে বসে পরিচিত একজন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোককে ফোন দিলো সাদিয়া আর রুদ্রর রুম সাজানোর জন্য।
নিজের বাগান থেকে কিছু ফুল নিলো…গোলাপ আর রজনীগন্ধা…এই দেশী গোলাপ আর রজনীগন্ধা রাতে একটা মোহনীয় ঘ্রাণ ছড়ায়। অবনী খুব পছন্দ করে।
অরণ্য প্রায়ই এটা খেয়াল করেছে,অবনী কাঁচের ফুলদানিতে রুমের মধ্যে এই ফুলগুলো রাখতো। এক বার নেয়া ফুলেই কয়েকটা রাত সুঘ্রাণে ভরে থাকতো। দোলনচাঁপাও ঠিক এমন। কিন্তু দোলনচাঁপা এখন সে নিলোনা।
প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছে,অরণ্য নিচে নামলো…অরণ্য তার বেডরুম গুছালো পরিপাটি করে, ফুলদানীতে পানি ভরে একটু চিনি দিলো পানির মধ্যে, এতে নাকি ফুল অনেক দিন তাজা থাকে,অবনী বলেছিলো…তারপর ফুলদানিতে গোলাপ আর রজনীগন্ধা সাজালো।
রান্নাবান্না মনে হয় প্রায় শেষের দিকে…রান্নার সুঘ্রাণে ভরে গেছে ঘর। অরণ্যের মনে হচ্ছে অনেকদিন ভালোমন্দ খায়না সে।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ছেলেটা এসে গিয়েছে,অরণ্য রুম দেখিয়ে দিলো…তার কাজ সে শুরু করে দিলো।
রান্নাঘরের কাছে এসে রাহেলা খালাকে ডাক দিলো সে…অরণ্যের প্লান মত আসল কাজটা রাহেলা খালাকে দিয়েই সে করাতে চায়।
রাহেলা খালা…অরণ্য ডাকলো। রাহেলা খালা হাত শাড়ির আচঁলে মুছতে মুছতে এসে অরণ্যকে জিজ্ঞেস করলো…কিছু কইবেন ভাইজান?
অরণ্য: হুম বলবো…তোমার কাছে তোমার মোবাইল আছে এখন?
রাহেলা খালা: হ আছে…ভাইজান।
অরণ্য: টাকা আছে মোবাইলে?
রাহেলা খালা: মিস কলের টাকা আছে ভাইজান।
অরণ্য: আচ্ছা…মোবাইল নাম্বারটা বলো…আমি রিচার্জ করে দেই।
রাহেলা খালা: ক্যান ভাইজান,ট্যাহা দিয়া কি করমু এহন?
অরণ্য: আগে নাম্বারটা বলো…আমি সব বুঝিয়ে দিচ্ছি কি করবে!
রাহেলা খালা: ০১৯৩৪০…..
অরণ্য : শোনো খালা…রিচার্জ হয়ে গিয়েছে…তুমি এখন অবনীকে ফোন দিবে,ফোন দিয়ে আমি যা বলতে বলবো তাই বলবে…অবনীর নাম্বার তোমার মোবাইলে আছেতো!
রাহেলা খালা: হ আছে ভাইজান…
অরণ্য: শোনো…অবনী ফোন ধরলে তুমি যেমন কথা বলো তেমনই বলবে…কোন মিথ্যা বলতে হবেনা…আজ এই বাসায় যা ঘটছে তাই বলবে…শুধু কার সাথে কার বিয়ে হচ্ছে এটা বলবে না,বাকি সব বলতে পারো…তোমার আপা আসবে কখন সেটা জিজ্ঞেস করবে!তোমার আপাকে ছাড়া এই বাসায় কি কোন অনুষ্ঠান হতে পারে বলো!
রাহেলা খালা মনে মনে ভাবছিলো, যে কিছু একটা অইছে নাইলে অবনী আফায় নাই ক্যান! কিন্তু সে তা প্রকাশ করলোনা।
রাহেলা খালা: ঠিকই কইছেন ভাইজান…আমি তো এই কতাডাই অনেক্ষণ দইরা কইতে চাইতাছি।আফারে ছাড়া এই যোগার যন্ত ভাল্লাগতেছেনা।
অরণ্য: ঠিক আছে,তাহলে সময় নষ্ট করোনা…ফোন দাও
রাহেলা খালা অবনীকে ফোন দিচ্ছে…অরণ্যের হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।
অবনীর ফোনে রিং হওয়ার সাথে সাথে অরণ্য রাহেলা খালার ফোন স্পিকারে দিয়ে দিলো…
অবনী: হ্যালো…
রাহেলা খালা: আফা কেমুন আচেন? কতদিন আপনেরে দেহিনা!
অবনী : ভালো আছি খালা…তুমি কেমন আছো?(অবনীর কন্ঠ মন মরা কিন্তু দৃঢ়)
রাহেলা খালা: ভালো আছি আফা,আপনে আইবেন কহন বাসায়?
অবনী: কোন বাসায়? কেন আসবো? তোমাকে ফোন দিতে কে বলেছে খালা?(অবনীর কন্ঠ রাগান্বিত)
রাহেলা খালা: আফা আপনেরে তো আমি পত্যেকদিন কয়েকফির ফোনে টেরাই করি কিন্তু ফোন বন্দ পাই।এহন খোলা পাইলাম।
অবনী : একটু মনে হয় বিশ্বাস করলো তারপর কন্ঠ নরমাল করে বলল…আচ্ছা খালা কি বলবা বলো…
রাহেলা খালা: আফা কইছিলাম কি! বাসাত তো একটা বিয়া লাগছে,আপনে আইতেন না?
অবনী: এবার একটু উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো… তুমি এখন কই খালা? কি বলছো এসব!
রাহেলা খালা: আপনের বাসায় আফা…আপনে কি জানেন না বিয়ার কতা কিছু!
অবনী: নাতো….কিচ্ছু জানিনা…আমার বাসায় কার বিয়ে! কখন বিয়ে! কি হচ্ছে এসব!(এবার চিৎকার করে বলে উঠলো)
অরণ্য মনে মনে ইয়েস ইয়েস বলছিলো কিন্তু রাহেলা খালার সামনে তা প্রকাশ করলো না। তার প্লান কাজে দিচ্ছে মনে হয়। খালা ভালোই কথা বলছে এখন পর্যন্ত।
রাহেলা খালা: আফা আপনের বাসা,আপনে তো আইয়া দ্যাকতেই পারেন কার বিয়া হইতাছে, আর এই বাসায় এত্ত বড় অনুষ্ঠানে আপনে নাই,হেইডা ক্যামনে অয় কন!
অবনী: তোমাদের বিয়ে তোমরা খাও,আর নতুন আফারে নিয়া তুমিও ভালো থাকো,আর ফোন দিবানা আমাকে! অবনী রাহেলা খালাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দিলো।
ফোনের ওপাশে অবনী কাঁদছিলো অরণ্য তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো।কিন্তু অবনী কি তাহলে আসবেনা! অরণ্য এখন দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলো।
অরণ্যের মন খুব খারাপ হয়ে গেলো,তার প্লানটা ফেইল করলো মনে হয়! যাও আসতো,অরণ্য যে খারাপ ব্যবহার করে এসেছে তাতে বাকিটুকু আশাও মনে হয় শেষ।
রাহেলা খালার মনটাও খারাপ হয়ে গেলো। রান্নাঘরের দিকে যাবে এই সময়ে হঠাৎ তার হাতের ফোন বেজে উঠলো।
রাহেলা খালা আর অরণ্য দুজনেই ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে…অবনী কল করেছে।
অরণ্য ফোন ধরতে বলল রাহেলা খালাকে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে অবনী জিজ্ঞেস করলো…লিনসা কই? লিনসা কে দাও ফোন…আমি কথা বলবো লিনসার সাথে।
রাহেলা খালা বলল আফা লিনসা মামনী তো বউয়ের সাথে পারলারে গেছে। অবনী ওপাশ থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো, আমার মেয়ের মাথাটাও খেয়েছে দেখছি।
রাহেলা খালাকে অবনী বলল, লিনসা আসার সাথে সাথে আমাকে ফোন দিয়ে ধরিয়ে দিবে ওকে। মনে থাকবে খালা।রাহেলা খালা বলল, থাকবো আফা।
অবনী ফোনের লাইন খটাশ করে কেটে দিলো।
অরণ্য টেনশনে পড়ে গেলো,রাহেলা খালাতো বড় মানুষ কোনরকম কথা কাটিয়ে বলতে পেরেছে কিন্তু লিনসাকে কি জিজ্ঞেস করবে,কি উত্তর দিবে!!!
অরণ্য রাহেলা খালাকে বলল, তুমি কাজ করো তাহলে আমি লিনসাকে গিয়ে নিয়ে আসি।
রাহেলা খালা বলল আইচ্ছা ভাইজান।
অরণ্য সাদিয়াকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,আর কতক্ষণ লাগবে….সাদিয়া জানালো আরো ঘন্টা খানিক।
কোন পারলার শুনে নিয়ে অরণ্য বাইরে বের হলো।
অরণ্য পারলারের কাছে গিয়ে সাদিয়াকে ফোন দিয়ে বলল লিনসাকে পাঠিয়ে দিতে আর তার কাজ শেষ হলে যেন রুদ্রকে ফোন দেয় তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সাদিয়া বলল,ঠিক আছে ভাইয়া।
লিনসা বের হয়ে তার বাবার সাথে বাসায় যাচ্ছে,অরণ্য লিনসাকে বলল,মামনি তোমার আম্মু তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে।
লিনসা খুব খুশি হয়ে বলল, তাই বাবা! আম্মু কখন আসবে! অরণ্য বলল, জানিনা মা,তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো কখন আসবে তোমার আম্মু!
অরণ্যের একটুও ইচ্ছে করছেনা লিনসাকে কোন মিথ্যা বলা শেখাতে! যা হওয়ার হবে এই ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে আসলো!
এসেই রাহেলা খালাকে ডাকলো…অবনীকে ফোন দিতে বলল…অবনী মনে হয় ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলো।
ফোন দেয়ার সাথে সাথে ফোন রিসিভ করলো…এদিক থেকে লিনসা হ্যালো আম্মু বলতেই অবনী আবার কেঁদে ফেলল…অবনী জিজ্ঞেস করলো…মামনী তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
লিনসা: আম্মু আমি পারলারে গিয়েছিলাম।
অবনী: তুমি যার সাথে পারলারে গিয়েছিলে তার নাম কি মামনী?
লিনসা: আম্মু তার নাম সাদিয়া….নামটা শুনেই ওদিক থেকে অবনীর কথা বন্ধ হয়ে গেলো…লিনসা কয়েকবার ডাকলো আম্মু…আম্মু
অবনী বলল হুহ্…লিনসা বলতে লাগল জানো আম্মু আজ রুদ্র মামার সাথে সাদিয়া ফুপীর বিয়ে,তুমি কখন আসবে?
অরণ্য বলল…এই যাহ্ সেরেছে…এবার সব আশার বানী আরো গুবলেট পাকালো।
ফোনের ও পাশ থেকে কোন কথা আসছিলো না কিন্তু লিনসা কথা বলেই যাচ্ছে!
অরণ্য ফোন তার হাতে নিয়ে দেখলো….অবনী লাইনে নেই।
দ্রুত ব্যালেন্স দেখলো মোবাইলের…নাহ্ ব্যালেন্স শেষ হয়নি তার মানে অবনী লাইন কেটে দিয়েছে! ভাগ্যিস লিনসার বাকি কথাটুকু শোনেনি….!!!
দেখা যাক এখন কি হয়! এখন শুধু অপেক্ষার পালা!
রুদ্র এসে ঢুকল ঘরে…কিছুক্ষণ থেকেই সাদিয়ার ফোন পেয়ে ওকে আনতে চলে গেলো…
রান্না হয়ে গিয়েছে…এখন সবাই বাসায় ফিরলেই ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নিলে হয়…আসরের আযানের আর ঘন্টা তিনেক বাকি…
চলবে….
লেখনী: #নুসু