‘মনসায়রী’
১০.
প্রকৃতি কখনো নির্মল, স্নিগ্ধ, শান্ত। তো কখনো ভীষণ ধ্বংসাত্মক। এই ধ্বংস প্রকৃতি সর্বদা বয়ে আনেনা। কিন্তু,কখনো বয়ে আনলে, সবটা কেড়ে নিয়ে যায়। কাজল, মিহা, রিয়াদ,আকাশ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাজল আর মিহার চোখ ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেছে। একটু পর ফুঁপানোর শব্দ করে মুখ চেপে ধরছে। মিহা আর রিয়াদ শহরে বড় হয়েছে। দু’জনের কেউই সাঁতার জানেনা।
খুব বেশি পানি হয়তো নেই। কিন্তু, যারা সাঁতার পারেনা তাদের জন্য এটা ভয়ংকর। কাজল গ্রামে বড় হওয়ায় সাঁতার জানলেও, দুপুরকে ভেতর থেকে খুঁজে আনার মতো শক্তিশালী সে নয়। পাটখড়ির মতো শুঁকনো হওয়ায় নিজেও নামতে পারছেনা। একবার দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েছিলো, রিয়াদ আর আকাশ এসে ওকে চুপ করিয়ে বসিয়ে দিলো। দিহান একটু আধটু সাঁতার জানে। দুপুর পানিতে পড়েছে মিনিট খানেক হয়েছে। দিহান দ্রুতগতিতে প্যান্ট উঁচু করে ঝাপ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবার চিৎকার চেঁচামেচিতে মোটামুটি বেশ ভালো ভিড় জমা হয়েছে। সেই ভিড় ঠেলে কয়েক জন ছেলেমেয়ে হাজির হলো। নিপা বেশ বিরক্ত হলো। ফাহাদ আর সায়রের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে। উচ্চতায় অনেকটাই লম্বা। সবার পিছনে দাঁড়িয়ে ভর্তা হওয়ার উপক্রম ইশিকার। নিপাকে টেনেটুনে ধরে সামনে আসলো। খাটো হওয়ার জ্বালা হারে হারে টের পাচ্ছে। নিপা ইশিকার পিঠে কিল দিয়ে বলল,
‘ছাগলনী,চল আমরা এখান থেকে চলে যাই। আজকে আর ঘোরার দরকার নেই। ‘
ফাহাদ আর সায়রকেও ধাক্কা দিয়ে একই কথা বললো। কেউই খুব একটা ধ্যান দিলো না যখন, তখন মুখ বাঁকিয়ে চুপ করে রইলো। সায়র তীক্ষ্ণ চোখে কী যেনো দেখছে। ফাহাদ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ইশিকা কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফাহাদের আর নিপার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এই কে যেনো পানিতে পড়েছে। ওনারা বলাবলি করছে, সে নাকি সাতার জানেনা। তোরা একটু গিয়ে সাহায্য কর না! ‘
সায়র আগের মতোই পকেটে হাত রেখে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে। নিপা ধমক দিয়ে বলল,
‘চুপ কর তুই! আমরা কেউ কী সাঁতার পারি নাকি! সায়ু পারে একমাত্র। আর আমাদের দরকার কী এই ঝামেলায় যাওয়ার। ওখানে আরো লোকজন আছে। ‘
নিপা এই কথা বলে সামনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে চেঁচিয়ে বলল,
‘এই সায়ু! ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?’
ইশিকা ফাহাদ দু’জনেই অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। সায়র একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ইশিকা খুশি হলেও, নিপা হায় হায় করছে। দিহান মাত্রই ঝাপিয়ে পড়ছিলো। আরেকটা ছেলেকে নামতে দেখে অবাক হলেও, মাথা না ঘামিয়ে বলল,
‘আপনি ওইপাশে খুঁজুন। আমি এই সাইডে খুঁজে দেখি। ‘
সায়র কোনো কথাই বলল না। এমনকি দিহানের দেখানো সাইডেও গেলোনা। সে আরো সামনে এগিয়ে মাঝখানে দিকে গিয়ে ডুব দিলো। দিহান চিন্তার মাঝেও বিরক্ত হলো। ছেলেটা মাঝে গেলো কী কারণে! শুধু শুধু মহান সাজতেই নেমেছে বুঝি।
দিহান সাইডে আরো অনেক পাশেই ডুব দিয়ে দেখলো। তারপর হতাশ হয়ে ভেসে উঠলো। সবাই এগিয়ে আসলো ওকে উঠতে দেখে। দিহান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,দুপুরকে পাচ্ছে না। কিছুটা দম নিয়ে আবারো পিছনে ঘুরে ডুব দিতে গিয়ে চমকে উঠলো।
লেকের চারপাশে ঘেরা লোকজন চিৎকার দিলো। সায়র ধীরে ধীরে কিনারায় চলে আসছে। নিপা, ইশিকা দৌড়ে পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে হা করে দেখলো, সায়রের বুকের সাথে লেপ্টে আছে একটা মেয়ে। পেছনের সাইডটা দেখা যাচ্ছে। থৈ থৈ জলে ভেসে থাকা দুটো সিক্ত নরনারীকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দেখতে। মনেই হচ্ছে না, কিছুক্ষণ আগেও সবাই আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার চেচামেচি করছিলো। সায়র আলগোছে কোলে তুলে দুপুরকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসলো। দুপুরকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে নিজের চোখের চশমাটা খুলে পাশে রাখলো।
অতঃপর গায়ের ভেজা শার্টটাই দুপুরের গায়ে জড়িয়ে দিলো। কাজগুলো সে এতো নির্লিপ্ততার সঙ্গে করলো, কেউ এসে ওকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে দিলো। এমন চিন্তার মুহুর্তে কেউ কীভাবে এতোটা শান্ত থাকতে পারে। সায়র মুখ তুলে কাউকে খুঁজলো। তারপর উৎসুক মুখে তাকিয়ে থাকা মিহাকে হাতের ইশারায় এদিকে বসতে বললো। মিহা দ্রুত এসে বসলো। সায়র মিহাকে বলল,
‘আপনি আপনার হাতটা দিন ৷ ‘
ভড়কে গিয়ে মিহা নিজের হাতটা চেপে ধরলো। সায়র শান্তকন্ঠে আবারো একই কথাটা বললে, মিহা এগিয়ে দিলো নিজের হাতদুটো। সায়র নিজের হাতটা নিজের পায়ের উপর রেখে বারকয়েক চাপ দিয়ে মিহার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘যেভাবে আমি করলাম, সেভাবে আপনার হাতটা ওনার পেটের উপর রেখে প্রেস করুন। ‘
ভারী কন্ঠে কেঁপে উঠলো মিহা। তারপর একইভাবে দুপুরের উপর হাত রেখে চাপ প্রয়োগ করলো। দেখা গেলো, তিন বারের সময় দুপুরের মুখ থেকে পানি বের হচ্ছে। এভাবে অনেকক্ষণ করার পর জ্ঞান ফিরে আসলো আধো আধো। পেট চেপে কেঁশে উঠলো দুপুর।
মিনিট দশেক পর জ্ঞান ফিরে চোখ খুলে তাকালো দুপুর। নিজেকে মাটিতে শোয়া অবস্থায় দেখে যতটা না অবাক হলো, তার চেয়ে বেশি ভয় পেলো একটা ছেলে অবয়বকে মুখের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে। ছেলেটা তার গায়ে কী যেনো পড়িয়ে দিচ্ছে। ঘাবড়ে গিয়ে শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠলো দুপুর। ভেজা শরীরে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে সে। ছেলেটার চেহারা ভালো মতো দেখতে না পেরে বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। সায়র পাথরের মতো শক্তমুখ করে এক হাত পেছনে সরে গেলো। তার পড়নে সাদা সেন্ডো গেঞ্জিটা ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। দুপুর পিটপিট চোখে তাকিয়ে আছে। অজ্ঞান থাকা অবস্থায় কেনো জানি মনে হচ্ছিল পেটে কেউ চাপ দিচ্ছে। দুপুর সন্দেহবাতিক চোখে সায়রের দিকে তাকালো। এই ছেলেটা এখানে কী করছে! তাঁকে হেনস্তা করতে এতদূরেও চলে এসেছে! আবার তার পেটে চাপও দিচ্ছিলো! সর্বনাশ! বড়বড় চোখ করে ঢোক গিললো দুপুর। সায়র মুচকি হাসলো। হাসি দেখে আরেকবার অবাক হলো। সায়র দূরত্ব ঘুচিয়ে দুপুরের মুখের সামনে মুখ আনলো। গভীর কালো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ঘোরে চলে গেলো দুপুর। কথা বলতে ভুলে গেলো। সায়র দুপুরের পাশ থেকে চশমাটা তুলে নিতে নিতে দুপুরের কানের পাশে অত্যন্ত নিচু স্বরে বলল,
‘আমি অনুমতি ব্যতিত আপনাকে কখনো স্পর্শ করবো না দুপুর।’
বলেই সরে আসলো সায়র। কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে চশমাটা চোখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কেউ বিন্দু পরিমাণ বুঝতে পারলো না এর মধ্যে সায়র কথা বলে নিয়েছে। দুপুর হতভম্ব দৃষ্টি দিয়ে মাটিতে বসে আছে। সায়রের শার্টটা এখনো দুপুরের শরীর আবৃত করে আছে। সায়র একবার দুপুরের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। দুপুরের অস্বস্তিতে গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। আশপাশে তাকিয়ে দেখলো, ওদের বন্ধুবান্ধব সবাই অদ্ভুত চোখে সবকিছু লক্ষ্য করে দেখছে। সায়র তবুও চোখ সরালো না৷ হাতের ভেজা ঘড়িটা খুলে পকেটে রাখতে রাখতে দিহান আর আকাশের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আপনাদের খেয়াল রাখা উচিত ছিলো। ‘
দিহান আর আকাশ নিজেদের মুখ দেখাদেখি করলো। কীসের খেয়াল রাখা উচিত! দিহান ভ্রু কুঞ্চন করে বলল,
‘কার খেয়াল রাখা উচিত ছিলো? ‘
সায়র প্রতিত্তোরে হা না কিছুই বলল না। বাইকের চাবিটা হাতে ঝুলিয়ে গমগমে পায়ে প্রস্থান করলো ৷ কাজল পেছন থেকে সায়রকে ডেকে বলল,
‘এক্সকিউজ মি, আপনার নামটা?আর কীসে পড়ছেন?’
সায়র যেতে যেতে নমনীয় স্বরে বলল,
‘সায়র দেওয়ান। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। ‘
বলে নিরব মুখে সামনে চলল। তাঁর পেছনে ছুটে গেলো নিপা, ইশিকা আর ফাহাদ। পুরো ঘটনাটা দেখলো সবাই। অবাক না হয়ে পারলোনা, সায়রকে দেখে ওরা নিজেদের সমবয়সী মনে করছিলো। আবার একই সাথে খুব কৃতজ্ঞও হলো। ঐ ছেলেটা না আসলে তো দুপুরকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো না। দিহান বিব্রতবোধ করলো ভেতরে ভেতরে। বয়সে ছোট একজন ছেলের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। দুপুর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। কাজল আর মিহা ওকে টেনে উঠালো। ভেজা কাপড়ে বেশি সময় থাকতে পারবেনা। দিহান নিজের প্রাইভেট গাড়ি এনেছিলো। রিয়াদ নিজের বাইক এনেছিলো। সে ওটাতেই চলে গেলো। দিহান, কাজল, আকাশ, মিহা ওরা দুপুরকে ধরে গাড়িতে উঠলো।
দুপুর উইন্ডোর বাহিরে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে। নিজের গায়ের সাদা শার্টটার দিকে তাকিয়ে গাল লাল হয়ে আসলো। যখন সায়র কানের পাশে ফিসফিস করে কথা বলছিলো, তখন গা শিউরে ঝিমঝিম করে উঠেছিলো। তার উষ্ণ নিশ্বাসের উত্থান পতন অনুভব করেই থম মেরে বসেছিলো সে। টু শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি। সায়রের ঐ গভীর চোখদুটো বুকে তীরের বেগে ছুটে এসেছিলো। দুপুর ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। হাসফাস লাগলো ভেতরটা। বয়সে ছোট একটা ছেলেকে নিয়ে মনে এসব উদ্ভটতম ভাবনার উদয় হওয়া অনেক লজ্জাজনক। বুকেরপাটায় কে যেনো হাতুড়ির আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলো মুহুর্তে। চোখ বুজে সিটে সব ভার ছেড়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। সেখানেও ব্যাঘাত ঘটিয়ে অর্ধঘুমন্ত অবস্থায় মস্তিষ্কের সচল পাতায় দুটো চোখ ভেসে উঠলো। অদ্ভুত চিরচেনা সুঘ্রাণ নাসিকাপথে অনুভব হলো। পড়নের শার্ট থেকে পরিচিত ঘ্রাণ ভেসে আসছে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। তবুও মনে হলো, কানের কাছে কেউ ঝিম ধরানো মোহনীয় কন্ঠে ফিসফিস করে বলছে,
‘আমি অনুমতি ব্যতিত আপনাকে কখনো স্পর্শ করবো না দুপুর।’
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।
(দুদিন যাবত লিখছি। ততবারই মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটছিলো। গতকাল রাতেই দিতাম। বানানে কিছু হেরফের ছিলো। সকালে উঠে এগুলো সুধরে নিলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।)