তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ৪৩ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৪৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

শীত সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশিই আলসেমি লাগে। ঠান্ডায় হাত পা কাঁপাকাপি অবস্থা। তারমধ্যে সকাল বেলায় উঠা বিরক্তির কারণ। ভোঁরে বেলা নামাজ পড়ার জন্য এলার্ম দিয়ে রাখে মীরা। যেন নামাজটা সে পড়তে পারে। নিজের সাথে আহানকেও উঠিয়ে মসজিদে পাঠায় সে। নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে যায় ওরা৷ সকাল আটটা কি সাড়ে আটটার দিকে উঠে সবাই। এরমধ্যে নাশতা রেড়ি করতে হয়। কারণ নয়টা বাজার আগেই আহান থানায় চলে যায়। তবে আজ একটু দেরি করেই উঠেছে মীরা। ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে হাতমুখ ধুঁয়ে নেয় সে। আহানকে না ডেকে রান্নাঘরে চলে গেল। মীরা সবার জন্য চা বানাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে মীরার শাশুড়ীও এলেন। দুজন মিলে সকালের নাশতা তৈরি করল। ডাইনিং টেবিলে সব সাজিয়ে সবাইকে ডাকলেন। সবার আগে আহান উঠে গেল। সে ঘুমুঘুমু চোখে নিচে নেমে মীরাকে ধমক দিয়ে বলল, “কয়টা বাজে মীরা। তোমায় বললাম না আজ সকালে আমাদের বেরোতে হবে। তুমি উঠেছ আমায় ডাকোনি কেন?”
আহানের কথায় মীরার মনে পড়ল আজ তাদের বান্দরবান যাওয়ার কথা। মীরার মাথায়ই ছিল না। আহানের সৎ মা বললেন, “কোথায় যাবে তোমরা?”
“বান্দরবান।”
“বেড়াতে যাচ্ছ?”
“জি।”
“বেশ ভালো। আমরাও চাই তোমরা একটু ঘুরে আসো। বাহিরের হাওয়া লাগুক। মেয়েটা সারাদিন বাসায় বসে থাকে। দেখতে ভালো লাগেনা।”
“সেজন্যই যাবো।”
“আচ্ছা, তোমার বাবাকে বলেছ?”
“খেতে আসুক, বলব সব।”
“কয়টার দিকে বের হবে?”
“দশটার দিকে।”
“বসে পড়ো, খেয়ে নাও দু’জন। দেরি হয়ে যাবে।”
আহান তার সৎ মায়ের ব্যবহারে মুগ্ধ হলো। আগে কত অবহেলা করত তাকে। কত বাজে কথা বলত। তাকে নিয়ে, তার মা’কে নিয়ে৷ আর এখন। ওদের নিয়ে ভাবছে। আহানের ভালো লাগল। কিন্তু প্রকাশ করল না। সব ভালো লাগা প্রকাশ করতে নেই।

ডাইনিং টেবিলে সবাই বসে নাশতা খাচ্ছেন। আহান তার বাবাকে বলল তারা ঘুরতে যাচ্ছে। সবার ভালো লাগলেও আহানের ফুপির মোটেও ভালো লাগেনি। উনি রাগে ফোসফাস করছেন। আহান ও মীরা দুজন খেয়ে তাদের রুমে চলে গেল। দুজনে একসাথে রেড়ি হলো। তারপর ব্যাগ নিয়ে সবাইকে বলে বাসা থেকে চলেও গেল।
বাসা থেকে বের হয়েছে একটা সিএনজি নিয়ে। মহিপাল বাস স্টেশনে যেতে হবে তাদের। সিএনজিতে বসে মীরা চারপাশের পরিবেশ দেখছে। কিন্তু কয়েক জায়গায় বেশ দুর্গন্ধে মীরার বমি আসার উপক্রম। আহান মীরার অবস্থা দেখে তাকে এক হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয়। মীরার মাথাটা চেপে ধরে নিজের বুকে। বলে, “আর কিছুক্ষণ। সহ্য করো।”
মীরা চুপচাপ আহানের বুকে মাথা রেখে ওর এক হাত জড়িয়ে রাখে। আহানের কেয়ার মীরার খুব পছন্দ। মহিপাল ফ্লাইওভার এর নিচ দিয়ে সিএনজি চলে গেল রাস্তার ওপারে। সব বাস এখানে থামে। মীরারা সিএনজি থেকে মেনে বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে রইলো। বাস এখনো আসেনি। অথচ দশটা বেজে গেছে। কাউন্টারে জিগ্যেস করে জানলো আরও দশ মিনিট লেইট হবে। এদিকে মীরার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। আহান তা দেখে মীরাকে একটা চেয়ারে বসায়। জিগ্যেস করে, “কিছু খাবে? এনে দিব?”
“বমি বমি পাচ্ছে।”
“আচ্ছা, তুমি বসো আমি কিছু কিনে নিয়ে আসছি।”
কাউন্টারের পাশেই অনেকগুলো দোকান আছে। আহান একটা দোকানে গিয়ে জুস, চিপ্স, আচার, চকলেট, কেক, ডাল ভাজা এসব নিল। টাকা দিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে মীরার কাছে এলো সে। মীরা দেখলো আহানের হাতে বড়ো এক পলিথিন খাবারের জিনিস। মীরা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “এতো জিনিস কে খাবে?”
“কোথায় এতো দেখছ? তোমার জন্য নিয়ে এসেছি, তুমি খাবে।”
“আমি এতো কিছু খেতে পারব না।”
“যেতে যেতে সব খাওয়া হয়ে যাবে।”
আহান পলিথিন থেকে জুসটা বের করে তার ক্যাপটা খুলে মীরাকে দিল। “এটা খাও। ভালো লাগবে।”
মীরা খুশিমনে আহানের কাছ থেকে জুসটা নিয়ে খেতে লাগলো। একটু পরেই বাস এসে গেল। আহান মীরাকে নিয়ে বাসে উঠল। লাগেজটা বক্সে দিল। মীরার হাতে তার হ্যান্ডব্যাগটি। আহানের হাতে শুধু খাবারের পলিথিনটা। এক এক করে যাত্রী উঠলে বাস ছেড়ে দেওয়া হলো। বাস চলছে, মীরা আশেপাশের সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। নিজের শহর ছেড়ে আবারও সে অন্য শহরে যাচ্ছে। যতই অন্য কোথাও যাকনা কেন, নিজের শহরের জন্য মন টানবেই। আহান এতক্ষণে নিজের মাথাটা বাসের সিটে হেলিয়ে রেখেছে৷ চোখ বুঝে আছে সে। মীরা তার এক হাত দিয়ে আহানের মাথায় হাত বুলে দিল। এক ধ্যানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মীরা। আহানের এক হাত জড়িয়ে ধরে আহানের কাঁধে নিজের মাথাটা রাখল। মীরা বলল, “ইন্সপেক্টর সাহেব! আপনাকে কিছু কথা বলা হয়নি।”
আহান চোখ বুজে জবাব দিল,
“কি?”
“আপনি জেগে আছেন?”
“হুম। বলো, শুনছি।”
“এই যে আমি আপনার কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকি; হাতে হাত রাখি, কাঁধে মাথা রেখে আপনাকে জড়িয়ে ধরি; এসব আমাকে মানসিক শান্তি দেয়। প্রচন্ড শান্তি দেয়। আপনি আমার মানসিক শান্তি ইন্সপেক্টর সাহেব! আপনাকে ভালোবাসি, কারণে অকারণে।”
আহান চোখ খুলে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রপোজ! তাও বাসে?”
“ভালোবাসি বলার জন্য বিশেষ স্থান বা বিশেষ মুহুর্তের প্রয়োজন হয়না। আপনার সাথে থাকলেই ওটা আমার কাছে বিশেষ মুহুর্তই। আর কে বলল আমি আপনাকে প্রপোজ করেছি? আপনার মতো নিরামিষকে কেউ প্রপোজ করবে নাকি!”
ভাব দেখিয়ে বলল মীরা। ক্ষেপে গেল আহান।
“আবার নিরামিষ বললে? নিরামিষ কে সেটা দু’দিন পরেই বুঝবে।”
“কেন? দু’দিন পর কি হবে?”
“বলবো না।”
“বলুন।”
“সিক্রেট।”
“নিরামিষ।”
“যত খুশি বলে নাও। দেখবে এরপর নিরামিষ বলার সুযোগই তোমায় দিব না।”
“হুহ্।”
ভেংচি কাটে মীরা। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে।


কলেজে এসে বসে আছে দিবা। সামনে তার ফাইনাল পরিক্ষা। পরিক্ষা নিয়ে ভাবার বদলে সে অন্য কিছুর কথা ভেবে মন খারাপ করে বসে আছে। সকালবেলা আয়ানের নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কতগুলো মেসেজ এসেছিল দিবার কাছে। ও ভাবতেও পারেনি আয়ান ওকে ধরে ফেলবে। ওর কিছু কথার এমন রিয়েক্ট করবে। কড়া ভাষায় জবাব দিবে। দিবাকে হাজারটা কথা শুনিয়েছে আয়ান। দিবা আয়ানের কথায় কষ্ট পেয়েছে প্রচুর। আয়ান বলেছে, যখন সে আয়ানকে পছন্দই করে না তাহলে কেন ওকে মেসেজ দিয়ে এসব পাঠালো। ওর সাথে যে-ই থাকুক, তাতে দিবার এতো সমস্যা কেন? মানুষ তো তখনই জেলাস ফিল করে যখন সে দেখে তার প্রিয় মানুষটির সাথে অন্যকেউ আছে। কিন্তু দিবার তো জেলাস ফিল করার কথা নয়। তাহলে শুধু শুধু এসব বলে নিজেকে নিচে নামানোর কি প্রয়োজন ছিল তার। যদি পছন্দ করে থাকে তাহলে সরাসরিই বলুক। তা না করে উল্টো পালটা কথা বলে নিজেকে ছোট করার কোনো কারণ ছিল না। আয়ান যার সাথেই থাকুক, যার সাথেই ছবি তুলে আপ দিক তাতে দিবার মাথা ঘামানোর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা সে।
এসব কথায় দিবা আর উত্তর দেওয়ার সাহস পায়না। তার কাজে সে নিজেই লজ্জিত। শুধু শুধু আয়ানকে ওসব মেসেজ দিতে গেল ও। আয়ান যা খুশি তা করুক, তাতে দিবার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাহলে কেন সে এসব করলো? দিবা নিজেও বুঝে উঠতে পারিনি সে এ কাজটি কেন করলো। প্রিতির সাথে আয়ানকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না যেন। কিন্তু কেন তার এতো বিরক্ত লাগলো সে নিজেও জানেনা। এখন সে বসে বসে কাঁদছে। আয়ানের এমন ব্যবহার সে মেনে নিতে পারেনি। আয়ান তাকে ব্লকও করে দিয়েছে। এই জিনিসটা খুবই খারাপ লাগলো দিবার।
দিবার বন্ধবীরা এসে দিবাকে কত কিছু জিগ্যেস করছে, দিবা চুপ করে শুধু চোখের পানি ফেলছে। ক্লাসেও তার মন বসছে না।


বিকেল তিনটার দিকে মীরারা বামন্দরবানে ঢুকলো। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যখন বাস যাচ্ছিল মীরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। চারদিকে সারি সারি পাহাড়, আঁকাবাকা রাস্তা, গাছগাছালি দেখে মীরার মন ভরে গেল।।প্রকৃতি এতো সুন্দর হয়! কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটি বান্দরবান সদরে এসে থামলো। আহান মীরাকে নিয়ে বাস থেকে৷ নেমে পড়ল। বক্সে রাখা তাদের লাগেজটি বুঝে নিল। স্টেশনের সামনেই অনেকগুলো সিএনজি দাড় করানো আছে। আহান একটা সিএনজি ডেকে তাকে ঠিকানা দেখিয়ে বলল যাবে কিনা। সিএনজি ড্রাইভার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। আহান মীরাকে বলে সিএনজিতে উঠে বসতে। লাগেজটি সিএনজিতে রেখে আহান চলে গেল মিষ্টির দোকানে। ওখান থেকে মিষ্টি নিয়ে কিছু ফল নিল। তারপর দাম মিটিয়ে আবারও সিএনজিতে ব্যাক করল। মীরার পাশে বসে জিনিসগুলো পিছনে রেখে দিল। সিএনজি করে বন্ধুর বাসায় চলে গেল।

বান্দরবান সদরে আহানের এক বন্ধু থাকে পরিবার নিয়ে৷ আসলে ঠিক বন্ধুও না, তার সাথে চট্রগ্রাম থানায় ছিল। তার সহকর্মী। আহানের বদলির পর সেও বান্দরবান এ বদলি হয়ে এসেছে। সে যখন থেকে শুনেছে আহান বিয়ে করেছে, তখন মীরাকে নিয়ে তাদের বাসায় আসার জন্য অনেকবার রিকুয়েষ্ট করেছে আহানকে। আহান আসব আসবে বলেও আসা হয়নি। এখন ভাবল মীরাকে নিয়ে ঘুরে আসা যাক। তাই আসা।
বাসায় আসতেই হৈচৈ পড়ে যায়। ছোট ছোট বাচ্চা দুটো তাদের দেখে খুশিতে নাচানাচি করতে থাকে৷ জোরে জোরে বলতে থাকে আংকেল এসেছে, আন্টি এসেছে। বাসায় আহানের বন্ধু তার স্ত্রী ও মা’কে নিয়ে থাকেন। আর দুটো বাচ্চা তারই। আহান সবার সাথে পরিচিত হয়ে কথা বলল। মীরাকেও সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তাদের একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। মীরা বোরকা খুলে লাগেজ থেকে একটা শাড়ি নিয়ে আহানকে বলে, “ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আহান বলে, “যাও। শরীর হালকা হবে।”
মীরা চলে যায় ওয়াশরুমে। আহান নিজের শার্ট পেন্ট লাগেজ থেকে বের করে। পরনের শার্ট খুলে নেয়। অনেক গরম লাগছে। এতক্ষন বাসের মধ্যে ছিল, বেশ গরম লেগেছে। ফ্যানটা চালু করে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। লং জার্নি হয়েছে আজ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here