টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),০৩,০৪

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),০৩,০৪
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৩

ভোরের আলো যখন ফুটে, রিহান ঘর থেকে বের হয়ে হাই তুলে শরীরের আলস্য কাটায়। গত সন্ধ্যার অন্ধকারে চারপাশটা ভালো করে না দেখলেও ভোরের আলোতে এখন সব স্পষ্ট। সুফিয়াদের এই বাড়িটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল। বেড়ার চিহ্নটুকুও এখন আর নেই। হয়তো কারও বাসার চুলোয় কাজে লেগেছে। সামনে একটা টিনের গেইট ছিল, ওটাও নেই৷ সুফিয়াদের বাড়ি থেকে যখন জাকারিয়া সাহেবদের বাড়িতে চলে যেত রিহান, সে সময় সুফিয়া গেইট থেকে মাথাটা বের করে রিহানের গমনপথে চেয়ে থাকতো। পাশের বাড়ির দিকে নজর গেল রিহানের। শিউলির মা ছাই দিয়ে ডেকচি মাজছিল তখন। রিহানকে দেখে হা করে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর পানিতে হাত ধুয়ে হাত দুটো শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে রিহানের দিকে এগিয়ে এল। রিহান মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভয় কেটে গেছে?’

শিউলির মা ইতস্তত করে পালটা প্রশ্ন করলো, ‘সত্যি মিয়া আপ্নে ভূত না?’

‘আমি ভূত হবো কেন? আমি মানুষ, এই যে হাতটা ধরে দেখেন আমার…’ ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো রিহান। শিউলির মা লজ্জিত হয়ে বললো, ‘না, থাক। তয়, আপ্নে এহনও সেই আগের মতনই আছেন, কেমনে? ব্যাপারডা আমার মাথায় ঢুকতাছে না। সে যাকগে, আমারে চিনছেন আপ্নে? আমি খুশি। সুফিয়ার বান্ধবী, চিনছেন?’

‘বয়স তো বেড়েছে আপনার। চেনা যায় না। তবে, খুশি নামে সুফিয়ার একটা বান্ধবী ছিল, মনে আছে।’

‘হ, ওইডাই আমি৷ একলগে বিকাল হইলে খেলতাম আমরা। এই যে এই উডানে।’ সুফিয়াদের উঠানটা দেখালো খুশি। ‘আমরা খেলতাম, আপ্নে জাফর চাচার লগে ওই দাওয়াই বইসা আমাগো খেলা দ্যাখতেন, মনে আছে?’

‘হুমম, মনে আছে।’ হাসলো রিহান। খুশি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘দিনগুলা যে কীভাবে কাইটা গেল। আচ্ছা, রাতের ব্যাপারডা মনে রাইখা দ্যাননি তো? আপ্নেরে ভূত ভাবছিলাম। আসলে ওগো বাড়িডাতে কেউ থাহে না, হুট করে আপ্নে আইসা বাড়িডাতে উঠছেন, তার উপর আগের চেহারাডা এহনও রইয়া গ্যাছে আপ্নের, তাই ভুলডা হয়ছে। কিছু মনে নেননি তো?’

‘না, না, কিছু মনে করিনি আমি।’

‘রাতে তো কিছু খাননি আপ্নে। আহেন, আমাগো বাড়ি থেইকা খাবেন।’

‘না, না, আপনি কষ্ট করতে যাইয়েন না।’ ভদ্রতার খাতিরে কথাটা বললেও, রিহান সুযোগটা মিস করতে চাইলো না। খুশি তার কথাটা কানে না নিয়ে বললো, ‘লজ্জা পাইয়েন না মিয়া। আহেন তো, খাবার খাইয়া যান।’ বলেই ভেতরে মেয়ের উদ্দেশ্যে হাক ছাড়লো খুশি, ‘শিউলি, ভাই সাহেবের লাইগা ভাত বাড়তো।’

শিউলি বের হলো বাইরে। রিহানকে দেখে অবাক হয়ে মাকে বললো, ‘তুমি না কইছিলা লোকটা ভূত?’

‘আরে লজ্জা দিস না তো। যা ভাত বাড়।’

শিউলি ভাত বাড়তে ভেতরে গেল। খুশি রিহানকে বললো, ‘ওইডা আমার মাইয়া, শিউলি।’

‘হুমম। আমি যখন আপনাকে লাস্ট দেখেছিলাম, তখন মনে হয় বিয়ে হয়নি আপনার।’

‘হ, তহন কুমারি আছিলাম।’

‘এখন শ্বশুরবাড়িতে থাকেন না?’

‘নাহ্, বর মইরা গ্যাছে। হেরপর থেইকা এইহানে চলে মা মেয়ের সংসার।’ খুশির মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ, বুঝতে পেরে সে সম্পর্কে কথা বাড়ালো না আর রিহান।

ভাত বেড়ে শিউলি বলতে এলো বাইরে, ‘মা, ভাত বাড়ছি, উনারে লইয়া আহো।’

‘ঠিক আছে, ভাইসাব চলেন, গরিবের বাড়িত দুগা ডাইল ভাত খান।’ আবদারের সুরে বললো খুশি। রিহান টিউবওয়েল থেকে ফ্রেশ হয়ে ভেতরে এল। জানালা দিয়ে আলো ভেতরে ঢুকলেও, আঁধারটা পুরোপুরি কাটেনি। তাই একটা কুপি জ্বালিয়ে দিয়েছে শিউলি। নিচে একটা পাটি বিছিয়ে দিয়েছে। পাটিতে বসে হাত ধুয়ে মাটির বাসনে খেতে শুরু করলো রিহান। ডাল দিয়ে হলেও, এই মুহূর্তে পেটের খিদের কারণে এটাই মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার। খেতে খেতে রিহান খুশিকে সুফিয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা, সুফিয়া আসে না এখানে?’

‘না ভাইসাব। সুফিয়ারে দ্যাহি না অনেক বছর। ওরে শ্যাষ দেখছিলাম ব্রিটিশ গো আমলে। ব্রিটিশরা ওরে ধইরা লিয়া গেছিল একবার। হের বেশ কয়েক মাস পর ও একরাতে এইহানে ফিইরা আইছিল। ওরে জিগাইয়া জানছিলাম, ও হেইসময় জাপান সেনা গো মাইরা পলাইয়া আইছে। তারপর এইহানে বেশ কিছুদিন থাকছিল।’

‘এরপর আর যোগাযোগ হয়নি? কোথায় গেছে সে?’

‘তার দাদা না-কি বিরাট জমিদার। ওইহানে যাইবো কইছিল। একদিন বাড়িডাতে একডা বড়ো তালা ঝুলাইয়া হে চইলা গ্যাছে। আর এদিকডাতে আহেনি। এহন কই আছে, কীভাবে আছে হেইডা কইতে পারি না।’

‘আচ্ছা, ওই সময় সুফিয়াকে কেমন দেখছিলেন?’

‘দুঃখী একডা মাইয়া। চিন্তায় হুগাইয়া গ্যাছিলো। কী যেন চিন্তা করতো হারাদিন। আমি তারে জিগাইতাম, কী লিয়া তার এত চিন্তা। হে কিছু কইতো না। খালি কইতো, তার জন্মডা যদি এহন না হইয়া আরও পরে হইতো। আরও কীসব কথা হে কইতো। পাগলামি করতো।’

খাবারের চেয়ে এবার খুশির কথাগুলোকে অমৃত লাগলো রিহানের। ধীরে ধীরে খাবার চিবোতে চিবোতে খুশির কথা শুনতে আগ্রহী হয়ে উঠলো, ‘কী ধরনের পাগলামি করতো সে? কী বলতো?’

‘কী জানি বলতো, ভুইলা গেছি। এতদিনে কি মনে থাহে কন? তয়, ও কইতো ওর জন্ম যদি আরও সত্তর পঁচাত্তর বছর পরে হইতো, তাইলে ওর আর কিছু চাওয়ার থাকতো না। ও আমারে জিগাইতো, ভবিষ্যতে কেমনে যাওয়া যাইবো? কী করলে হে ২০১৭ সালে যাইতে পারবো? আমি তারে কইতাম ওসব পাগলামি না করতে। আচ্ছা, ভাইসাব আপনি কন তো, হেই সময় ১৯৪৩ সাল চলে, হে কেমনে ২০১৭ সালে যাইবো? পৃথিবী এতদিন টিকবো কি না তাও তো আমাগো অজানা। তাই না?’

‘হুমম…’ খাবারের শেষ গ্রাসটুকু মুখে পুরলো রিহান। খুশি পুনরায় বললো, ‘আমি তারে কী কইতাম জানেন? কইতাম, রিহান বাবুর লগে মিশে তোমার মাথাডাও গেছে। আপ্নেও হেই সময় উলডাপালডা কীসব কথা কইতেন, মনে আছে? কইতেন আপ্নে ভবিষ্যত থেইকা আইছেন। হেই রোগডাই ওরে পাইছিল। আপ্নের রোগডা। আপ্নেরে হে মনে মনে খুব ভালোবাসতো। আমারে কইতো।’

পানিতে চুমুক দিয়েছিল রিহান। খুশির শেষ কথাটা শুনে পানির পাত্রটা রেখে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বলতো?’

‘কইতো, আপ্নেরে তার ভালা লাগে। কেমন যেন সরল বোকা বোকা টাইপের আপ্নে।’

‘আমি সরল? বোকা বোকা টাইপের?’

‘ওই আপনি একটু উলডাপালডা কথা কইতেন তো? ও ভাবতো, আপ্নে সরল, একটু বোকা।’

‘আচ্ছা, কখনও সুফিয়ার সাথে দেখা হলে, আমি আপনার কথা ওকে বলবো।’

‘জমিদার বাড়িতে থাহে সে। আমাগো গরিবের কথা কি তার মনে থাকবো?’

‘হয়তো সে অনেক দুঃখে আছে। সবকিছু ভুলতে চায়, তাই হয়তো এদিকে আসে না। ওর সাথে দেখা হলে এখানে নিয়ে আসবো একদিন।’

‘কিন্তু, ওরে আপ্নে খুঁইজা পাইবেন কই?’

‘খুঁজে নিবো আমি। আমিও যে ওকে ভালোবাসি। মনের চোখ দিয়ে ঠিকই খুঁজে নেবো। দোয়া করবেন।’

কুপির সোনালি আলোতে দেখলো খুশির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠছে। ভিজে ওঠছে অশ্রুতে। হয়তো পুরনো কথা মনে করে, অথবা নিজের প্রয়াত স্বামীর কথা ভেবে।

‘আচ্ছা, আমি উঠি তবে আজ।’ বলেই উঠে দাঁড়ালো রিহান। বের হয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে খুশি বললো, ‘সুফিয়রে পাইলে এইহানে আনবেন কিন্তু।’

‘ঠিক আছে।’

নিজের ব্যাগটা নিয়ে রিহান বেরিয়ে এল। কোথায় যাবে এখন সে, ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো। তারপর একটা গরুর গাড়িতে উঠে পড়লো। গাড়োয়ান তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কই যাবেন?’

‘সামনে যাবো।’

‘দেইখা তো মনে হইতাছে না আপ্নের কাছে ভাড়া আছে। ভাড়া আছে তো?’

‘আছে, ভাড়া আছে আমার কাছে।’ বলার সময় গলা জড়িয়ে গেল রিহানের। রিহানের উপর কয়েকমুহূর্ত চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে ‘হঠ হঠ হেই’ বলে বেত দিয়ে আঘাত করলো গারোয়ান গরুর পিঠে। গরুর গাড়ি চলতে লাগলো সামনে। রিহান ভাবতে লাগলো কী করা যায়। গারোয়ান লোকটাকে সুবিধের মনে হলো না। ভাড়া বুঝে না পেলে সে নিশ্চয়ই রিহানের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বসবে। সেই মুহূর্তে রিহানের মনে পড়লো সুফিয়ার দেয়া একটা বাক্সের কথা। সুফিয়া অবশ্য নিজ হাতে বাক্সটা রিহানকে দেয়নি। তার মৃত্যুর পর ইউসুফ সাহেবের মাধ্যমে বাক্সটা সে পায়। বাক্সটা দেয়ার সময় ইউসুফ সাহেব সতর্ক করে দিয়েছিলেন, এটা খোলা যাবে শুধুমাত্র রিহান ভবিষ্যতে গেলে, এবং ভবিষ্যতে গিয়ে যদি সে বিপদে পড়ে, তখন। কারণ, সুফিয়া রিহানকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। সুফিয়ার দেয়া শেষ সারপ্রাইজ বাক্সটা রিহানের ব্যাগেই আছে। এখন যেহেতু একটা বিপদে পড়েছে সে, বাক্সটা খুলতে সমস্যা নেই। গারোয়ান সাহেব যদি একটু নরম মনের মানুষ হতো, তবে এটাকে সে বিপদ মনে করতো না। কিন্তু পয়সা না পেলে গারোয়ান হয়তো তার গায়ে হাতও তুলতে পারে। ব্যাগ থেকে বাক্সটা বের করলো রিহান। ধীরে ধীরে বাক্সটা খুললো সে। তারপর সত্যি সত্যিই সে সারপ্রাইজ হয়ে গেল। বিপদটাকে আর বিপদ মনে হলো না। হাসি ফুটে ওঠলো রিহানের মুখে। কারণ, বাক্সটার ভেতরে রয়েছে এই সময়ে চলার মতো বেশ কিছু পয়সা। সুফিয়া হয়তো তার জন্য জমিয়েছিল পয়সাগুলো। আচ্ছা, জমিয়েছিল? না-কি জমাবে? এখনকার সময়ের জন্য উক্তিটি হবে, ‘জমাবে’। ২০২২ সাল হলে বলতে পারতো ‘জমিয়েছিল’ কথাটা।

গারোয়ানের উদ্দেশ্যে নির্জড়িত কণ্ঠে রিহান বললো, ‘এই থামান, থামান, এখানেই নামিয়ে দিন আমাকে।’

গারোয়ান গাড়ি থামালে রিহান নেমে জিজ্ঞেস করলো, ‘কত ভাড়া হয়েছে বলুন?’

‘চার-পয়সা।’

‘এই নিন।’ বলেই বাক্স থেকে চার-পয়সা নিয়ে গারোয়ানের দিকে এগিয়ে দিলো রিহান। তারপর কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে চারদিকে তাকাতে লাগলো। নাহ্, জায়গাটা বদলায়নি খুব একটা। শুধু, আগের তুলনায় কয়েকটা ঘর আর দোকান বেড়েছে। জাকারিয়া সাহেবদের বাড়িটার পাশেও কয়েকটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, যেগুলো আগেরবার রিহান দেখেনি। ধীরে ধীরে জাকারিয়া সাহেবদের বাড়িটার দিকে হাঁটলো রিহান। মনে কিছুটা সংকোচ। তাকে দেখে বাড়ির লোকগুলো কী কী বলে কে জানে। ২০২২ সাল হলে কোনো সংকোচ থাকতো না, বাড়িটাতে যখন খুশি ঢুকতে পারতো, বের হতে পারতো। কারণ সেই অধিকারটা তার আছে, নিজের দাদা-বাড়ি এটা। কিন্তু, এই সময় তার সেই অধিকারটুকু নেই। অধিকারটুকু এখনও হয়ে উঠেনি। ভবিষ্যতে হবে, আরও অনেক পরে। ভাবতে ভাবতে প্রায় কাছে চলে এসেছে রিহান। তখন তার খেয়াল হলো, সে ছাড়াও আরও অনেক লোক বাড়িটার দিকে যাচ্ছে। কী ব্যাপার? কোনো উৎসব চলছে না-কি বাড়িটাতে? আরও কাছে গিয়ে রিহানের ভুল ভাঙলো। উৎসব নয়। কেউ একজন মারা গেছে এই বাড়িতে। তাই লোকজন দেখতে আসছে। কে মারা গেল? উঠানে খাটিয়াতে রাখা ছিল লাশটা, কাফন পরানো। দেখেই চিনতে পারলো রিহান। জাকারিয়া সাহেবের লাশ। বার্ধক্যের কারণে মারা গেছেন। রিহান ভেবেছিল হয়তো আরও আগে তিনি মারা গেছেন, কিন্তু এই দিনেই যে তিনি মারা যাবেন, সেটা রিহান ভাবতে পারেনি। কিছুটা কষ্ট হলো তার। সে-ই হয়তো প্রথম কোনো ব্যক্তি, যে তার জন্মের আগে মারা যাওয়া কোনো পূর্বপুরুষের লাশের পাশে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একটা সাতাশ-আটাশ বছরের যুবকের দিকে রিহানের চোখ আটকে গেল। এটা হয়তো তার দাদা ইউসুফ। দাদির কাছে শুনেছে সে, দাদা দীর্ঘদেহী ছিল। কাঁধ পর্যন্ত চুল থাকতো সবসময়। আরেকটু নিশ্চিত হতে সে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো। পরে একটা লোক ইউসুফের নাম ধরে ডাক দিলে, রিহান নিশ্চিত হয় ওটাই তার দাদা ইউসুফ। ভেতর থেকে বেশ কয়েকজন মেয়েলোকের কান্নার আওয়াজ আসছে। লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে, তাই ওদের কান্না বেড়ে গেল। কয়েকজন বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিয়ে কান্না করছে। ওদের মাঝে হয়তো রিহানের দাদিও একজন।

[[চলবে…]]

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৪

বেশ কিছুক্ষণ ভেতরে কান্নারত মেয়েলোকগুলোর উপর নজর রেখেও রিহান চিনতে পারলো না তার দাদি কোনটা। ওদিকে লোকজন জাকারিয়া সাহেবের লাশটা তুলে নিলো কাঁধে, জানাজা পরাতে নিয়ে যাচ্ছে কালেমা শাহাদাত পাঠ করতে করতে। লাশের খাটিয়াটা যখন চারজন মিলে কাঁধে তুলে নিলে, ভেতর মেয়ে লোকগুলোর কান্নার আওয়াজ বেড়ে গেল। পুরুষদের কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ তেমন কানে আসছে না। পুরুষরা নীতিগতভাবেই একটু কঠোর। সহজে কাঁদে না। যা কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে নারী আর শিশুদের। সবাই যখন লাশ নিয়ে চলে যাচ্ছিল, রিহানও চললো সাথে সাথে। জানাজাটা অন্তত পড়া যেতে পারে। ভেবে কিছুটা রোমাঞ্চিত হচ্ছে সে, তার দাদারও দাদা এই জাকারিয়া সাহেব, আর সে কয়েক যুগ পেছনে এসে তাঁর জানাজা পড়তে যাচ্ছে।

জানাজা পড়ে রিহান সিদ্ধান্ত নিলো জমিদার বাড়িতে যাবে। সুফিয়ার দাদা বাড়ি। এখানে নিজের দাদাবাড়িতে থাকার আর উপায় নেই৷ বাড়িটা এখন মৃতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েকদিন জাকারিয়া সাহেবের জন্য শোক পালিত হবে ওখানে। তাই ওখানে গিয়ে রিহান আর ঝামেলা বাড়াতে চাইলো না। একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লো সে। কোথায় যেতে হবে বলে দিলো ড্রাইভারকে।

জমিদার বাড়িতে এসে যখন পৌঁছালো রিহান দেখলো সব আগের মতনই আছে। শুধু গেইট ধরে যে ছোটো পথটা ভেতরে গেছে, তার দুপাশে ছোটো ছোটো গাছের চারা ছিল। গাছগুলো বড়ো হয়ে শাখা ছড়িয়েছে। গেইটে আগের মতোই দুজন পাহারাদার। একজনকে চিনতে পারলো৷ আগেও ছিলেন তিনি। বয়স বেড়ে গেছে। চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে। তিনিও রিহানকে চিনতে পেরে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপ্নে, রিহান স্যার না?’

‘জি চাচা, চিনতে পারছেন আমাকে?’

‘চিনবার তো পারছি। কই ছিলেন স্যার আপ্নে এত্তগুলা দিন?’

‘সে অনেক কথা। সুফিয়া কোথায়? ও আছে?’

‘আপ্নে স্যার এতদিন পর মাইয়াডার খোঁজ করতাছেন? আহ্ বেচারি, কত যে দুঃখ সইয় গ্যাছে।’

‘আমাকে কি দয়া করে বলবেন সুফিয়া কোথায়?’

‘ভেতরে যান, গিয়া কথা কন।’

‘জমিদার সলিমুদ্দিন আছেন?’

‘উনি কি আর এত বছর বেঁচে থাকবো কন? উনার ছেলে এহন জমিদারি দ্যাহাশোনা করে।’

‘বখতিয়ার আংকেল?’

‘হ, উনিই এহন জমিদার।’

‘আছেন উনি এখন?’

‘জি, ভেতরে আছেন।’

রিহান ধীরপায়ে ভেতরে গেল। জমিদার বখতিয়ার উদ্দিন সেই সময় বের হচ্ছিলেন। রিহানকে দেখে অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। তারপর নিজের বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘রিহান, তুমি এতদিন পর!’

‘জি চাচা।’

‘তোমাকে তো জাপানিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর কীভাবে বেঁচে ফিরলে এতদিন পর?’

‘জাপানিরা ধরে নিয়ে গেছে!’ বিড়বিড় করলো রিহান। তারমানে সুফিয়া এদেরকে আসল সত্যটা বলেনি। সে হয়তো ভেবেছিল রিহান আর কখনও ফিরবে না, তাই সবাইকে মিথ্যে বলেছে রিহানকে জাপানিরা ধরে নিয়ে গেছে। সত্যটা যদি বলতো, রিহান ভবিষ্যতের লোক ভবিষ্যতে চলে গেছে, তবে কথাটা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারতো না সে। উলটো সবাই তাকে পাগল ভাবতো। তাই হয়তো এমনটা বলেছে সে।

‘কী ভাবছো, চুপ করে আছো যে?’ বখতিয়ার উদ্দীন পুনরায় বলে উঠলেন রিহানকে চুপ দেখে। রিহান আমতা-আমতা করে বললো, ‘জি আংকেল, আমি পালিয়ে এসেছি। জাপানে আটকে ছিলাম এত বছর।’

‘আটকে ছিলে? পালিয়ে এসেছ? তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না ওরা তোমাকে খাটিয়েছে? আগে যেমন ছিলে তেমনই আছে। ওরা কি তোমাকে সুখে রাখছিল?’

সরাসরি বখতিয়ার উদ্দিনের চোখের দিকে তাকালো রিহান। উনি হয়তো তাকে সন্দেহ করছে, বা এরকম কিছু একটা। উনার কথার কী জবাব দেবে হুট করে মাথায় কিছু এলো না। কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ‘বয়স বাড়েনি, তাতে আমি কী করতে পারি আংকেল, এখানে তো আমার হাত নেই। তাই না?’

‘ঠিক আছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে এখানে থাকো। কিছু খেয়েদেয়ে নাও। আমি একটু বের হচ্ছি।’

‘আংকেল, সুফি..য়া… সুফিয়া আছে?’

‘নাহ্, ও নেই। সে সম্পর্কে রাতে কথা বলবো তোমার সাথে।’

‘ঠিক আছে আংকেল।’ মাথা নেড়ে সায় দিলো রিহান। বখতিয়ার উদ্দিন রিহানকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কেন জানি মনে হলো, রিহানকে দেখে তিনি অসন্তুষ্ট। নয়তো এতদিন পর তাকে দেখে উনার আনন্দিত হওয়ার কথা। গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে তার সাথে সময় কাটানোর কথা। সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ-ই দেখাননি উনি।

তবে, রাতে রিহানের সাথে ঠিকই কথা বলতে এলেন বখতিয়ার উদ্দিন। রিহান বিছানায় শুয়েছিল, উনাকে দেখে শোয়া থেকে উঠে পা দুইটা নামিয়ে বসলো। জমিদার সাহেব একটা কাঠের চেয়ার টেনে বসলেন তার মুখোমুখি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাতে ঠিকমতো খেয়েছ?’

‘জি আংকেল।’

‘শুনো, তোমাকে কীভাবে যে বলি কথাটা। এত বছর পর এলে, হয়তো অনেক আশা নিয়েই এসেছ, সুফিয়াকে দেখবে, ওর সাথে নতুন করে সংসার করবে। কিন্তু, যে কথাটা তোমাকে বলতে যাচ্ছি, সেটা শুনে হয়তো তুমি ভেঙে পড়তে পারো, তাই মনটাকে শক্ত করো।’

‘জি আংকেল, আপনি নির্দ্বিধায় বলুন।’

‘দেখো, তোমাকে যখন জাপানিরা ধরে নিয়ে যায়, তখন আমার মেয়েটা মানে সুফিয়া মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়ে। অনেক বছর সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। পরে এক রাতে…’ দম নিলেন জমিদার সাহেব।

‘এক রাতে…?’ রিহানের যেন তর সইছে না আর।

‘তুমি মনটা শক্ত করছো তো? তুমিও ওকে অনেক বেশি ভালোবাসো আমি জানি।’

‘আমি শক্ত আছি, বলুন আপনি।’

‘এক রাতে সুফিয়া গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে?’

‘হোয়াট! আত্মহত্যা করে?’

‘হ্যাঁ, কথাটা তোমাকে এখনই বলতে চাইনি। কিন্তু তুমি এত বছর পর ফিরেছ, একদিন তো তোমাকে বলতেই হতো কথাটা।’

রিহান মনে মনে ভাবলো, জমিদার সাহেব মিথ্যে বলছেন কেন? সুফিয়া যে মরেনি তা সে খুব ভালো করেই জানে। সুফিয়ার মৃত্যু কবে হবে, কীভাবে হবে সেটাও সে জানে। কিন্তু, জমিদার সাহেবের উদ্দেশ্য কী? কেন তিনি এতবড়ো মিথ্যাটা তার সামনে এভাবে উপস্থাপন করছেন?’

‘কষ্ট পেয়ো না রিহান। নিয়তিকে মেনে নাও।’ রিহানের মাথায় হাত বুলালেন জমিদার সাহেব। রিহান নিজেকে সামলিয়ে বললো, ‘আমি ঠিক আছি আংকেল। কিন্তু, ও আত্মহত্যা করলো কেন?’

‘হয়তো তোমার শোকে।’

‘আর ওর পেটে যে বাচ্চাটা ছিল?’

‘বাচ্চাটা জন্মের সময়-ই মারা গেছে। তোমাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার নেই। এতবছর পর ফিরলে, কিন্তু স্ত্রী সন্তান কারও মুখটা দেখতে পেলে না। আপাতত কিছুদিন এখানে থাকো। নিজ বাড়িঘর কিছু আছে এখানে তোমার?’

রিহান বুঝলো, জমিদার সাহেব তাকে ইন্ডাইরেক্টলি চলে যেতে বলছেন। তাছাড়া সুফিয়া যেহেতু এখানে নেই, তারও এখানে থাকার প্রশ্নই আসে না। সুফিয়াকে খুঁজতে যেতে হবে তার। কিন্তু কোথায় খুঁজবে। তার চাচা তো সরাসরি বলে দিলেন যে সুফিয়া আত্মহত্যা করেছে। এরপর আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগই রাখেননি। ভাবতে ভাবতে রিহান বললো, ‘কয়েকদিন থাকবো না আংকেল, সুফিয়া যেহেতু নেই, আমিও কাল চলে যাবো।’

‘তা কী করে হয়? কয়েকদিন এখানে থাকো, তারপর না হয় চলে যেয়ো।’ কথাটা যে জমিদার সাহেব মন থেকে বলেনি তা রিহান বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে। তিনি চান রিহান কালকেই চলে যাক। রিহানও তাঁকে খুশি করে বললো, ‘না আংকেল, আমাকে কালকেই যেতে হবে।’

‘বেশ! তবে যেয়ো।’ রাতটা সুন্দরভাবে ঘুমিয়ে কাটাও তবে।’ বলেই জমিদার সাহেব বেরিয়ে গেলেন। রিহান বসে বসে সুফিয়ার কথা ভাবতে লাগলো। কোথায় পাওয়া যেতে পারে তাকে। ২০১০ সালে যে সুফিয়ার সাথে রিহানের সাক্ষাৎ হয়েছিল, সে সময় সুফিয়া বলেছিল, শ্রীপুর থেকে তারা ঢাকায় গেছে। তারমানে এখন নিশ্চয়ই শ্রীপুরেই আছে সে। ওখানে খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু, শ্রীপুর তো আর ছোটোখাটো কোনো জায়গা না। ওখানে কোথায় খুঁজবে সে তাকে? গেইটের ওই চাচার কাছে জিজ্ঞেস করলে হয়তো কোনো তথ্য পাওয়া যেতে পারে। তাই রিহান আরেকটু
দেরি করে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়লো তখন ধীরপায়ে বের হয়ে ওই চাচার সাথে দেখা করতে এলো। গেইটের পাশে একটা ছোট্ট ঘরে উনি থাকতেন আগে। এখনও হয়তো সেই ঘরেই থাকেন। রিহান গিয়ে দরজায় টোকা দিলো। একটু পর বের হলেন সেই চাচা।

‘স্যার, আপ্নে এই সময়!’ অবাক হলেন তিনি।

‘আমাকে কি বলবেন দয়া করে, সুফিয়া কোথায়? জমিদার আংকেল বলছেন সুফিয়া আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আমি জানি, সুফিয়া এখনও বেঁচে আছে। আর আমি এটাও জানি ওর সাথে আমার দেখা হবে শীঘ্রই। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে জানি না। আপনি কি তার কোনো খোঁজ জানেন?’

‘না স্যার, আমি খোঁজ জানি না। সলিমুদ্দিন স্যার যে সময়ডাতে মইরা গ্যালেন, হেরপর উনিও বাড়িডা ছাইড়া চইলা যান উনার দশ বছরের বাচ্চাডারে সাথে লিয়া।’

‘দশ বছরের বাচ্চা! মানে ইউসুফ?’

‘বাচ্চার নাম ইউসুফ আপ্নে ক্যামনে জানলেন?’

‘আমি জানি, কারণ বাচ্চা হওয়ার আগেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাচ্চা হলে ওই নামটাই রাখবো। মানে ছেলে হলে।’ তাৎক্ষণিক জবাবটা মাথায় এসে যাওয়ায় হাফ ছেড়ে বাঁচলো রিহান।

‘ও আচ্ছা। হ, ইউসুফকে লইয়াই চইলা যান উনি। জমিজমা লইয়া একটু সমস্যা হইয়াছিল তার চাচার লগে। সলিমুদ্দিন স্যার মরার আগে বেশকিছু জমি সুফিয়া ম্যাডামের নামে লেইখা গ্যাছিলেন, এইডা বখতিয়ার স্যারের পছন্দ হয়নাই। আমি যে আপ্নেরে কথাগুলো কইতাছি, কাউরে কইবেন না কিন্তু। বখতিয়ার স্যারের কানে গ্যালে আমার এতদিনের চাকরিডা আর থাকবো না।’

‘নাহ্, আমি কাউকে বলবো না। আপনি বলুন।’ রিহান এতক্ষণে বুঝলো বখতিয়ার আংকেল তার সাথে তখন ওভাবে কথা বলেছিলেন কেন? কেন তার আগমনে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি৷ সম্পত্তির ব্যাপার-স্যাপার৷

‘হেরপর জমি লিয়া চাচা-ভাতিজির মাঝে ঝগড়াঝাঁটি হয়। একদিন সুফিয়া ম্যাডাম চইলা যায়।’

‘কোথায় যায় জানেন?’

‘হেইডা কইতে পারি না৷’

‘আচ্ছা, শ্রীপুর সম্পর্কে কিছু জানেন? শ্রীপুরে যেতে পারে?’

‘হ, ওইহানে ম্যাডামের নামে অনেকগুলো জমি আছে। ওইহানেও যাইবার পারেন।’

‘চিনেন আপনি জমিগুলো কোথায়?’

‘চিনি তো। ওইহানে ফাউগান নামে একটা গ্রাম আছে, গ্রামডার বেশিরভাগ জমি ম্যাডামের।’

‘আচ্ছা, অসংখ্য ধন্যবাদ চাচা উপকারটা করার জন্য।’

‘ঠিক আছে। তয় আমি আপ্নেরে এসব কইছি হেইডা যেন কেউ জানবার না পারে।’

‘চিন্তা করবেন না চাচা, আমি কাউকে জানাবো না।’ বলেই শুতে চলে এলো রিহান। পরদিনই সে শ্রীপুরের ফাউগান গ্রামে যাবে। ওখানে নিশ্চয়ই সুফিয়া আছে।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here