#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৬০
মুবিন কল ধরে চোখ উল্টে বলল, “আবার কি?”
কড়ি বলল, “আপনার সাথে একটা পরামর্শ করতে চাই।”
“আমি কোনো অ্যাজেন্সি না।” মুবিন মুখের উপর বলল।
কড়ি বলল, “আমি ইমাদকে হাতেনাতে ধরব। ওকে আমি ছাড়ব না।”
মুবিন বলল, “হোয়াটএভার।”
কড়ি একটু কঠিন হয়ে বলল, “মুবিন সাহেব, আপনি প্রমাণ দিতে পারবেন কিনা সেটা বলুন।”
মুবিন আরো কঠিন হয়ে বলল, “কেন আমি প্রমাণ দিব?”
কড়ি এবার মোলায়েম হয়ে গেল। বলল, “ইটস ওকে মুবিন সাহেব। আই টোট্যালি আন্ডারস্ট্যান্ড। আপনি আসলে ইমাদের সাথে পেরে উঠবেন না। সে ধুরন্ধর। সারাক্ষণ এত চুপচাপ থেকে সে কি করে জানেন? বসে বসে বুদ্ধি বের করে। মাথার ভেতর শুধু শয়তানী বুদ্ধি।”
মুবিন কর্কশ কণ্ঠে বলল, “আপনি কি সোজা কথা বুঝেন না?”
কড়ি মিষ্টি করে বলল, “স্যরি। আমি বুঝিনি।”
মুবিন রেগে গিয়ে বলল, “কেন আমি আপনাকে প্রমাণ বের করে দিব? প্রয়োজনটা কি আমার? আমার এত সময় নেই।”
কড়ি বলল, “রেগে যাচ্ছেন কেন? রাগ করবেন না।”
মুবিন বলল, “ন্যাকামো বন্ধ করুন। মেয়েরা এত ন্যাকা হয় কি করে?”
কড়ি সুযোগ পেয়ে বলে বসল, “আপনার গার্লফ্রেন্ডও ন্যাকা?”
মুবিন শক্ত গলায় বলল, “আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”
“উমা! কি বলেন! কেন নেই?” কড়ি যেন ভীষণ অবাক।
মুবিন বলল, “আমার আপনাদের ভালো লাগে না। তাই নেই।”
“কেন? আমরা মেয়েরা কি করি? স্বাধীনতায় বাধা দিই? বন্ধুদের সাথে ফূর্তি করতে সময় দিই না?”
মুবিন বলল, “আমি একাই এনাফ। আমার কোনো বন্ধুর প্রয়োজন নেই ”
কড়ির মুবিনের জন্য হঠাৎ এত মায়া হলো! আহারে ওর কোনো বন্ধুও নেই। এই বয়সেই তার বন্ধু নেই! অথচ, খাঁটি বন্ধু পাওয়ার বয়স চলে যাচ্ছে। যত বড় হতে থাকবে, তারপর যাদের সাথে দেখা হবে সবাই হবে স্বার্থপর। বন্ধু আর ভরসার জায়গা বড় হয়ে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। বড় হলে মানুষ দুনিয়াদারি শিখে যায়। তখন আর কাউকে বিশ্বাস করা মুশকিল। হয় আশেপাশের মানুষকে ব্যবহার করতে হয় নতুবা, তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে হয়। কমবয়সের লেনদেন ভালো। সে আফসোস ঢেকে রেখে বলল, “পারবেন না বললেই হয়। আমার ব্যবস্থা আমিই করব। আমার কাছে সাহসী ছেলেপেলের অভাব নেই।”
মুবিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “করুন ব্যবস্থা।”
তারপর কল কেটে দিলো। কড়িও মুবিনকে সময় দিলো। টিনএজারদের উপর কিছু চাপিয়ে দিতে নেই। তাদের ভাবতে সময় দিতে হয়। মুবিনকে সময় দেয়া হলো।
.
শিল্পী অফিস থেকে ফেরার সময় খাবার কিনে নিয়ে এল। আজকাল রান্না করতে ইচ্ছে করে না আর। প্যাকেট খুলে যে খাবে সেটা করতেও রাজ্যের অলসতা। নিঃশব্দে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। খেতে হবে না। এক রাত না খেলে মরবে না সে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল মুবিন মিলা সাথে থাকলে নিশ্চয়ই সে আজ রাঁধত। কি রাঁধত? কি কি খাবার রাতের জন্য রান্না করার সম্ভাবনা ছিল সেগুলো ভাবতে ভাবতেই তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল। গালে মশা নামের যন্ত্রণাটা এসে বসতেই ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে এলোমেলো চুলগুলোতে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে উঠল সে। অন্ধকার হাতড়ে বাতি জ্বালল। খাবারের প্যাকেট ফ্রিজে রেখে কয়েল ধরাল। কয়েল খাটের পাশে রেখে বসবার কয়েক মুহূর্ত কাটতেই সে ঝুঁকে কয়েলটা ফের হাতে নিলো৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কয়েলটা মেঝেতে চেপে ধরে নিভিয়ে দিলো। মশা না যাক। একা ঘরগুলোতে পর্দা নেচে উঠতেই সে নিঃসঙ্গতায় ডুবে মরে। অন্তত মশারা থাকুক। দমবন্ধ না লাগুক। বুজের ভেতর শূণ্যগা নিয়ে ব্যাগ থেকে জুয়েল সাহেবের দেয়া নাম্বারটা বের করল। দ্বিধাহীনভাবে কত রাত হয়েছে সে পরোয়া না করে কল করল। যাকারিয়া কল ধরলেন। শিল্পী বলল, “আসসালামু আলাইকুম। যাকারিয়া সাহেবকে চাইছিলাম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। যাকারিয়া বলছি।”
“শিল্পী বলছিলাম। জুয়েল সাহেবের কাছ থেকে নাম্বার সংগ্রহ করেছি।”
“জি জুয়েল আমাকে বলেছে।”
“এত রাতে কল করবার জন্যে দুঃখিত।”
“সমস্যা নেই। সারাদিন হয়তো ব্যস্ত থাকেন।”
“ধন্যবাদ৷ আমি আপনার কাছে আমার ছেলের ব্যবহারের জন্য খুবই স্যরি। আচমকা এসে আমাদের একসাথে দেখে রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছে।”
“ছোট মানুষ। আমি কিছু মনে করিনি।”
“ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।” শিল্পী মোবাইল রেখে দিচ্ছিল। যাকারিয়া বললেন, “আমাদের বিষয়টা ভেবে দেখবেন।”
শিল্পী হেসে বলল, “আমার কাছে আমাদের বলতে এখন শুধু আমি আর আমার ছেলেমেয়ে। আমরা তিনজন’ই আমাদের।”
“পরে খুব একা লাগবে। আমি আগে ভাবতাম বিয়ে না করলে কি হবে? এখন বুঝি, একা লাগে।”
“আপনার ছেলেমেয়ে নেই তাই একা লাগে। আমি মা। আমি একা না।”
“তবু একবার ভেবে দেখবেন। ছেলেমেয়ে বড় হলে ঠিকই বুঝবে। এখন হয়তো সাময়িকভাবে অভিমান করতে পারে।”
“ওদের চাওয়া তো পরের কথা। আমি’ই চাই না। আমি কল করেছি আমার ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইতে৷ আর কিছু না। ভালো থাকবেন।”
“জি আপনিও।”
শিল্পী মোবাইল রেখে বাতি নেভাল। এই একাকিত্বের কিছু একটা করতে হবে৷ এভাবে আর হবে না।
.
কাদের সাহেব টিভিতে সংবাদ শুনছিলেন। কায়েস পাশে বসে বলল, “বাবা খেলা চলে।”
কাদের সাহেব কায়েসের হাতে রিমোট দিয়ে উঠে যেতে যেতে বললেন, “দেখ।”
কায়েস বলল, “যাচ্ছ কোথায়? বাংলাদেশের খেলা চলে। দেখবে না?”
কাদের সাহেব বললেন, “না তুই দেখ।”
“শরীর খারাপ নাকি?”
“না বাসাটা খালি খালি। রিমা সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকে। তোরা তো বাসায়ই থাকিস না।”
কায়েস বলল, “মেজো ভাবিকে কল করে বলি চলে আসতে?”
“না, না। কতদিন পর মায়ের কাছে গেল। কাদিন বলল রাতে মাকে মনে পড়ায় রাতেই চলে গেছে। ইচ্ছেমতো মায়ের কাছে থেকে আসুক।”
“ওকে।” কায়েস হাত দিয়ে থামস আপ দেখাল। কাদের সাহেব নিজের ঘরের দিকে গিয়েও আবার ফিরে এসে কাদিনের ঘরে গেলেন। কাদিন কিছু ফাইলপত্র নিয়ে বসেছিল। কাদের সাহেব দরজায় নক করতেই সে বিছানা থেকে বিনয়ী হয়ে উঠে দাঁড়াল। ফাইলপত্র বিছানা থেকে সরিয়ে বাবার জন্য বসবার জায়গা করে দিতে দিতে হেসে বলল, “বসো বাবা।”
কাদের সাহেব বললেন, “না বসব না। দীপার সাথে ভিডিয়ো কলে কথা বলবার ব্যবস্থা করে দে তো। কথা বলি।”
“এখনি দিচ্ছি।”
কাদের সাহেব এসে বসলেন। কাদিন ল্যাপটপ অন করল। কাদের সাহেব হেসে বললেন, “মেয়েটা একটা বাবু। ও থাকলে মনে হয় বাসায় একটা না, কয়েকটা বাচ্চা আছে।”
কাদিনও হাসল। দীপার সাথে বাবাকে ভিডিয়ো কলে বসিয়ে দিয়ে সে ফাইলপত্র নিয়ে অন্য ঘরে চলে এল। সেখানে বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে লাগল। দীর্ঘদিন দীপার সঙ্গে থেকে সেও দীপার মত শিশুসুলভ আচরণ শুরু করেছিল। কথায় কথায় ঝগড়া করা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই ছিল তার বোকামো৷ দীর্ঘদিন একসঙ্গে থেকে সেও দীপার মত হয়ে যাচ্ছিল৷ সে ভেবেছিল দীপাকে রেখে এসে তার একা থাকতে কষ্ট হবে। কোনো কষ্টই হচ্ছে না। সবসময় সে যেমন থাকে তেমনি আছে। কোনো ফারাক নেই। মুদ্রার উল্টোপিঠে দীপা কেঁদেকেটে ইতোমধ্যে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শোকাহত, মর্মাহত৷ সারাদিন কাঁদে, সারাদিন। কাদিনের কি ওকে একটু মনেও পড়ে না?
চলবে…
অটোগ্রাফসহ আমার পাঠকদের বহুল প্রতীক্ষিত উপন্যাস, আমার তৃতীয় বই “একটুখানি” এর প্রি- অর্ডার চলছে।
★প্রি- অর্ডার লিঙ্কঃ
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1127224604700136&id=100022378217757