একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ২৬

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৬
কড়ি আজ যে শাড়িটা পরেছে সেটি ওর মায়ের। বার্গান্ডি রঙের জামদানি। কড়ির কানে, গলায় মুক্তোর দুল আর মালা। রামিম বলতো এই শাড়িটায় কড়িকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়। এত সুন্দর দেখায় যে বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। এ কারণেই শাড়িটা আজ পরা। গতরাতে কড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। রিমা দরজা ধাক্কে তুলে বলল, “আজ তোর সাথে থাকি।”
ঘুমে আড়ষ্ট কড়ি বলল, “থাকলে থাকো, আমার যেমন দাদীর ঘর, তোমারও দাদীর ঘর। তোমার আবার একইসাথে দাদী শাশুড়িও।”
রিমা হেসে দরজা আটকাল। কড়ির পাশে কনুইয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে বলল, “অ্যাই শোন না, তোর সাথে কথা আছে।”
“কি বলবে?”
রিমা নিজের গলার চেইনটা আঙুল দিয়ে খুটতে খুটতে বলল, “তোর কোনো পছন্দ টছন্দ আছে?
কড়ি দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, “উহুঁ।”
“তাহলে আমরা তোর জন্য বিয়ে দেখি?” খুশিতে রিমার চোখ চকচক করে উঠল।
কড়ি বলল, “এখনি বিয়ে দিয়ে দিবে?”
“সমস্যা কি? তোর কি কেউ আছে?”
“না, তা নেই।”
“তাহলে আর বাধা দিস না।”
কড়ি চুপ করে রইল। রিমা বলল, “নাসিমা ফুপুকে চিনিস?”
“হ্যাঁ।”
“নাসিমা ফুপুর ভাসুরের ছেলের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। ফুপুই চাচ্চুর কাছে প্রস্তাব দিলেন। চাচ্চুর কাছে মন্দ মনে হয়নি। চেনাজানার মাঝে হলেই ত ভালো। তাই আমাকে পাঠালেন তোর দ্বিতীয় কোনো মত আছে কিনা জেনে নিতে।”
“ওহ্।”
“ছেলে পুলিশ অফিসার। খুব অনেস্ট নাকি। কাল বৌভাতের অনুষ্ঠানে তো আসবেই। তখন দেখতে পারবি। কথা বলতে চাইলে সে ব্যবস্থাও করে দিতে পারব।”
“কথা বলতে হবে না। বাবা যা বলবেন তাই।”
“কী সোনালক্ষী বোন আমার!” রিমা কড়িকে আদর করে দিলো।
কড়ি মনে মনে তীব্র অপরাধবোধে মরে গিয়ে বলল, “স্বর্ণ পুড়ে যেমন খাঁটি হয় তোমার বোনও পুড়েই সোনালক্ষী বোন হয়েছে। নয়তো সে তোমাদের মুখে চুনকালি মাখবার সব ব্যবস্থাই সুন্দরমত করে ফেলেছিল।”
রিমা বলল, “কি ভাবছিস?”
“কই ভাবছি?”
“কাল কিন্তু সুন্দর করে সাজিস।”
এজন্যই কড়ি আজ এত সুন্দর করে সেজেছে। রামিম যে শাড়িতে তাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত সেটা পরেই সে পাত্রপক্ষের সামনে যাবে। নিজের পরিবারের পছন্দে বিয়ে করে পরিবারকে খুশি করবে। এতে যদি খানিক প্রায়শ্চিত্ত হয় তার! এতকাল একটা চোরের জন্য সেজে এসেছে। আজ পুলিশের জন্য সাজবে। তার জীবনে, মরণে, মনে,মস্তিষ্কে কোথাও সেই চোরের জন্য কোনোপ্রকার জায়গা রাখবে না। কড়ি আঙুলে রামিমের মায়ের ফিরিয়ে দেয়া সেই আংটিখানাও পরল।
.
মুবিন এক কান ফুঁড়িয়েছে। কানে দুলও পরেছে। আয়নায় নিজেকে দেখে মুবিন প্রসন্ন। কানে দুল পরার বহুদিনের শখ ছিল তার। বাবার ভয়ে কান ফুঁড়াতে পারছিল না। আজ রাগে শেষ পর্যন্ত ফুঁড়িয়েই ফেলেছে। হাতে পরার জন্য একটা ব্রেসলেটও কিনে এনেছে। ব্রেসলেটটা পরে মায়ের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে মা আঁতকে উঠবেন। মুবিন সেটাই চায়। বাঁকা হাসল সে। কানে দুল, হাতে ব্রেসলেট পরে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েই সে লিভিং রমের টিভিটা চালু করে আরাম করে বসল। পাশেই বাবা পত্রিকা পড়ছেন। এখনি নিশ্চয়ই গম্ভীর গলায় বলে উঠবেন, “টিভি বন্ধ করো, মুবিন। দেখছ না পত্রিকা পড়ছি?”
মঈন এখনও কিছু বলছে না। মনোযোগ সহকারে পত্রিকা পড়ে যাচ্ছে। মুবিন কপাল কুঁচকে বাবার দিকে তাকাল। কি ব্যাপার? কিছু বলছেন না কেন? মুবিন ঘাড় কাত করে বাবাকে দেখতে দেখতে টিভির ভলিয়্যুম আরো বাড়িয়ে দিলো। চ্যানেল পাল্টে গানের চ্যানেল দিলো। ধুম ধারাক্কা হিন্দি গান বেজে উঠতেই মঈন বিরক্ত হয়ে উঠল, “আহা মুবিন, তোমার মায়ের ঘরে যাও। সেখানে গিয়ে টিভি দেখো।”
মুবিন শয়তানি হাসি হাসল। না সে উঠল, না চ্যানেল বদলাল আর না সে বন্ধ করল টিভি। মঈন মুখের সামনে থেকে পত্রিকা সরাতেই মুবিন চট করে ঠোঁট থেকে হাসি মুছে ফেলল। বাবার চেহারা থেকে চোখ সরিয়ে টিভিতে চোখ রাখল। মঈন ধমকে উঠে বলল, “টিভি বন্ধ করো, মুবিন।”
মুবিন মনে মনে বলল, “কানের দুলটা দেখে না কেন?”
মঈনের দৃষ্টি দুলে আটকাতে মুবিন কান চুলকে বলল, “পারব না।”
মঈন রাগে থমথম করে উঠল। চোখ বড় বড় করে তাকাতেই মুবিনের কানে চোখ চলে গেল। সাথে সাথে বলল, “হোয়াট ইজ দিস, মুবিন?”
মুবিন অলস ভঙ্গিতে রিমোট রেখে উঠে দাঁড়াল। মঈন কঠোর গলায় বলল, “কখন করেছ এসব?”
মুবিন জবাব দিলো না। মঈন দ্বিগুণ ধমকে বলল, “এখনি খুলো।”
“না।”
মঈন উঠে এসে মুবিনের কানে হাত দিলো, “দেখি, আমি খুলে দিচ্ছি। এই বয়সে এসব পরতে নেই।”
মুবিন বাবার হাত সরিয়ে পিছিয়ে গেল, “বললাম না খুলব না।”
মঈন রেগে গেল। মুবিনও একগুঁয়ে, কোনোভাবেই খুলবে না। বাপ ছেলের চেঁচামেচি শুনে শিল্পী এদিকটায় এল। মুবিনের কানে দুল, হাতে ব্রেসলেট দেখে চট করে মেজাজ বিগড়ে গেলেও চুপ করে রইল। মঈন ওকে দেখে বিচার দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “এসব করার বয়স তোমার ছেলের এখন হয়েছে?”
শিল্পী কাটাকাটা গলায় বলল, “কোন বয়সে কি করতে হয় তা তোমার কাছ থেকে আমার ছেলের শিখতে হবে না।”
মঈন বলল, “কি বললে?”
শিল্পী বলল, “তোমারোতো এই বয়সে প্রেম করার কথা না। তুমি যেহেতু করতে পেরেছ, তোমার ছেলেও বয়স মানবার কথা না, তাইনা?”
মুবিন এই ফাঁকে দৌড়ে পালাল। বর্তমানে শিল্পীর কাছে ছেলের সুশিক্ষার চাইতে ছেলের বাপকে অপদস্ত করাই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
.
কড়িকে দেখে দীপা প্রায় চিৎকার করে উঠল, “আরে তোমাকে দেখি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।”
“মোটেও না।”
দীপা বলল, “সত্যি বলছি, কড়ি।”
কড়ি দীপার পাশে বসে কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল, “যে কোনো ছেলে দেখলেই কি পছন্দ করে ফেলবার মতন সুন্দর দেখাচ্ছে?”
দীপা ঘন ঘন চোখের পাপড়ি ফেলে, মাথা নেড়ে জোর দিয়ে বলল, “জি ম্যাডাম। যে কোনো ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতন সুন্দর দেখাচ্ছে। তোমার আঙটিটাও খুব সুন্দর। রামিমের মা এটাই ফিরিয়ে দিতে এসেছিলেন, তাইনা?”
“হ্যাঁ।”
“যাক মায়ের আংটিটা অন্তত পেয়েছ। শান্তি লাগছে আমার।”
কড়ি নিজের হাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, উঁহু এটা তো ওর মায়ের না। রামিমের মা আসলে রামিম থেকে কোনো গয়নাই উদ্ধার করতে পারেননি। তিনি হয়তো ওর মোবাইলে ছবিটবি দেখে এটা বানিয়েছেন। বানিয়ে তাকে মিছেমিছি সান্ত্বনা দিতেই এটা দিয়ে গেছেন। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি। পুরোপুরি মায়ের আংটির প্রতিচ্ছবি এটি। আংটিটা ফেরত পেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়ে গিয়েছিল। মায়ের একই যে আংটিটা ছিল সেটা ওর অনামিকা আঙুলে হতো না। মধ্যমা আঙুলে পরতে হতো। খানিক বড় ছিল। পরে ট্রেনে উঠে আঙুলে দিতেই এই আংটিটা মধ্যমায় লাগেনি, লেগেছে অনামিকায়। একদম খাপে খাপ। তখন বুঝল এটা মায়ের না। এজন্যই ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে রামিমের মাকে জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হয়েছে। মানুষটা বড় ভালো আর অসহায়। উনার সাধ্যে থাকলে সম্ভবত সবগুলোই উনি নতুন করে গড়ে দিতেন। কিন্তু যত টাকাই থাকুক অত গয়না একসঙ্গে গড়ে দেওয়া অসম্ভব। আর টাকা তো উনার না, রামিমের বাবার। রামিমের বাবা কঠিন মানুষ। রামিমের পিছনে বহু টাকা খুইয়েছেন তিনি। ছেলে তার সহায়সম্পত্তি কম নষ্ট করেনি! আর বোধহয় খোয়াতে চাইবেন না। কড়ির ধারণা রামিমের মা নিজের জমানো আধুলি থেকেই কড়িকে এই আংটিখানা দিয়ে গেছেন। কড়ি যে বুঝতে পেরেছে এটি সেই আংটি না, তা সে দিব্যি চেপে গেছে। কি দরকার একজন মায়ের স্বস্তি নষ্ট করবার? থাকুক নাহয় এই আংটিখানা আরেক মায়ের আশীর্বাদ হয়ে।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here