#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২২
#Esrat_Ety
গাঁয়ের ওপর দুই তিনটা শাড়ি ধরে রেখে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে উর্বী। সে বুঝতে পারছে না কোনটাতে তাকে মানাবে। গোলাপী নাকি লাল? কোনটা যাবে তার সাথে আজ!
তহুরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলেও থ’ম’কে যায়, উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কি? রেডি হোসনি? ওদিকে রাওনাফ ভাই তা’ড়া দিচ্ছে!”
উর্বী তহুরার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। কিশোরীদের মতো উচ্ছসিত ভঙ্গিতে বলে,”কোনটা পরবো ভাবী? একটু বলে দাও না।”
তহুরা হাসে,উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”লাল টা পর।”
লাল শাড়ি গাঁয়ে জরিয়ে উর্বী নিজেকে দেখে আয়নায়। তহুরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে উর্বীকে। উর্বী বলে ওঠে,”আমাকে কেমন লাগছে ভাবী?”
_ভালো লাগছে।
_বৌয়ের মতো লাগছে?
তহুরা মাথা নাড়িয়ে বলে,”না।”
উর্বী কিছুটা অবাক হয়ে বলে,”কেনো?”
তহুরা কাছে এসে উর্বীর মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বলে,”এটা দিসনি বলে।”
উর্বী বলে ওঠে,”ঘোমটা? আমি ওনার সামনে কখনো ঘোমটা দিইনি!”
কথাটি বলে উর্বী ঘোমটা নামিয়ে দিতে চায় তহুরা উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে পুনরায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বলে,”আজ দে!”
***
রাওনাফ অবাক হয়ে নিজের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তার গাড়িটাকে ছোটখাটো একটা মালবাহী ট্রাক মনে হচ্ছে তার কাছে এখন, খাবারদাবার থেকে শুরু করে উর্বীদের বাড়ির গাছের নারকেল। সবকিছু দিয়ে বোঝাই করে দিয়েছে পুরো গাড়ি। শুধু সামনের সিট দু’টো ফাকা। উর্বীর মা তো তিনটা জ্যান্ত রাজহাঁসই দিতে চেয়েছিলেন তার বেয়ান আর রাওনাফের তিন ছানার জন্য। রেজাউল বাজারে গিয়ে রাজহাঁস তিনটা জবাই,প্রসেসিং, ফ্রিজিং করিয়ে প্যাক করে দেয়। পিঠা, রান্নাকরা বিভিন্ন আইটেম, গাছের ফল, ফ্রিজিং করে রাখা পুকুরের চিংড়ি,চিতল,কোড়াল, এক টিন ভর্তি খই ভাজা কি নেই সেখানে। রাওনাফ এতো নিষেধ করছে, কে শুনছে কার কথা! যে যা পারছে গাড়িতে ঠেসেঠুসে রেখে যাচ্ছে।
অবশেষে হার মেনে রাওনাফ চুপচাপ দেখতে থাকে।
সবচেয়ে অবাক হয়ে যেটা দেখছে রাওনাফ, সেটা হলো খাবারদাবারের সাথে একটা খাঁচা সহ ময়না পাখিও দেওয়া হয়েছে গাড়িতে, এটা নাকি উর্বীর পাখি।
উর্বী ধীরপায়ে হেঁটে রেজাউল কবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রেজাউল তাকিয়ে দেখতে থাকে তার বোনকে। উর্বী ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,”আসছি।”
_আবার আসবি।
_কবে?
_ঈদে। তবে দাওয়াত দিলে তবেই আসবি,স্বামীকে নিয়ে। হুট হাট করে আসবি না।
উর্বী তাকিয়ে আছে তার ভাইয়ের দিকে। রেজাউল কবিরের চোখে পানি। উর্বী বলে,”ছিহ! পুরুষ মানুষ কাঁদে?”
রেজাউল কবির মাথা নাড়ায়। নিচু গলায় বলে,”ভাইয়েরা কাঁদে।”
উর্বী সাথে সাথে ভাইকে জরিয়ে ধরে। রেজাউল কবির বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”যা বলেছি মনে রাখবি। এলে স্বামীকে নিয়েই আসবি!”
উর্বী কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দেয়,”আচ্ছা।”
***
ড্রাইভ করতে করতে রাওনাফ একপলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”ঘোমটা দিয়েছো কেনো?”
উর্বী সাথে সাথে টেনে ঘোমটা নামিয়ে দেয়। নিচুগলায় বলে,”রোদের জন্য।”
রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে পেছনের সিটের দিকে একপলক তাকিয়ে উর্বীকে আবারও বলে,”এটা তোমার পাখি?”
_হ্যা।
_কথা বলতে পারে?
_দুয়েকটা শব্দ। আর আমার নাম।
_নিয়ে যাওনি কেন সাথে করে?
_ইচ্ছে হয়নি।
_এখন কেন নিয়ে যাচ্ছো?
_একজনের মান ভাঙাতে।
_শর্মী?
_হু।
রাওনাফ হাসে। তারপর বলে,”ও তোমাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে।”
_আমিও।
উর্বী জবাব দেয়।
রাওনাফ বলতে থাকে,”তোমার এই পাখি এতো চুপচাপ হয়ে আছে কেনো? কিছুই তো বলছে না। কেমন মনমরা।”
_মন খারাপ হয়তো ওর। নয়তো কিছু বলতো!
রাওনাফ হাসে, হাসতে হাসতেই বলে,”ডিপ্রেসড? কেনো ওরও কি কোনো পাস্ট আছে? যে ডিপ্রেসড থাকে! সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে?”
উর্বী হেসে ফেলে, রাওনাফ তার দিকে তাকায়। উর্বী চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”শর্মীর পাপা!”
রাওনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে ব্রেক কষে দেয়। একটা কুকুর এসে পরেছিলো তাদের গাড়ির সামনে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছে কুকুরটা।
মৃদু আর্তনাদের আওয়াজ হয়। উর্বী কপালে হাত চেপে কা’তরাচ্ছে। সিটবেল্ট পরেনি বিধায় হুট করে ব্রেক কষে দেওয়ায় আঘাত পেয়েছে কপালে।
রাওনাফ হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উর্বীর কপাল থেকে হাত সরিয়ে চ’ম’কে ওঠে। কে’টে গিয়েছে কিছুটা। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”সিট বেল্ট বাঁধতে বললাম তখন!”
_কিচ্ছু হয়নি। সামান্য কেটে গিয়েছে।
কোকিয়ে উঠে জবাব দেয় উর্বী।
***
রওশান আরা লিভিং রুমের সোফাতেই বসে ছিলো। রাওনাফ ঘরে ঢোকে, উর্বী তার পিছু পিছু ঘরে ঢোকে। রাওনাফ আবদুলকে ডেকে বলে গাড়ি থেকে মালামাল নামাতে।
উর্বীকে দেখে রওশান আরা দাঁড়িয়ে যায়। সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে থাকে উর্বীর দিকে। রওশান আরা প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলে,”বৌমার কপালে কি হয়েছে?”
উর্বীর কপালে ব্যান্ডেজ। উর্বী শাশুড়িকে শান্ত করতে কিছু বলতে যাবে তার আগে সামিউল বলে ওঠে,”ভাইয়া, মা তোমাকে ভাবীকে নিয়ে আসতে বলেছে বলে মা’রধোর করে নিয়ে এসেছো নাকি! না মানে,তুমি তো খুব মা ভক্ত তাই!”
রওশান আরা ক’ট’ম’ট দৃষ্টি দিয়ে সামিউলের দিকে তাকায়। সামিউল ঘা’ব’ড়ে গিয়ে বলে,”হেহে! যাস্ট কিডিং মা! ক্ষেপছো কেনো!”
অন্তরা কনুই দিয়ে সামিউলকে খোঁচা মেরে ফিসফিসিয়ে বলে,”একটু চুপ করো না! মায়ের ধ’ম’ক না শুনলে তোমার ভাত হজম হয়না নাকি?”
উর্বী হাঁসি চাপিয়ে রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলে,”পরে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। সামান্য চো’ট।”
রাওনাফ রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে,”হয়েছে এখন?”
রওশান আরা মাথা নাড়ায়। তারপর রাওনাফ রুমা আর আজমেরীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোদের হয়েছে?”
তারা দুজনেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,”হয়েছে।”
রাওনাফ দোতলায় চলে যায়। উর্বী দাঁড়িয়ে থাকে।
বাড়ির সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার চোখে মুখে চাপা আনন্দ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সবাই ভান করছে যেনো উর্বী এলো কি না এলো তাতে তাদের অতো মাথা ব্যাথা নেই।
রওশান আরা উর্বীকে বলে,”এসেছো! হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যাও। দেখো রাতে কি রাঁধবে। তোমার ননদাই রা খাবে।”
উর্বী তার ননদদের দিকে তাকায়। আজমেরী,রুমা দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী বলে,
“আপনারা কেমন আছেন আপা?”
_জি ভালো নতুন বড় ভাবী, আপনি কেমন আছেন?
দুজনেই একসাথে, হাসিমুখে বলে।
উর্বী লজ্জা পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। ওদের তিন ভাইবোনকে দেখা যাচ্ছে না। আর কেউ না থাকলেও শর্মীর তো থাকার কথা এখানে।
আজমেরী বলে,”কাকে খুজছো? শর্মীকে? সে তার রুমে। ভুলেও যেও না সেখানে। গিয়ে লাভ নেই। ডাক্তার রাওনাফ করিম খানের ছোটো মেয়ে, রেগে আছে প্রচুর তোমার ওপরে। নিজে থেকে রাগ না কমলে তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। শুধু শুধু গিয়ে কাজ নেই।”
উর্বী হেসে বলে,”আচ্ছা তাই! দেখি পারি কি না।”
উর্বী সিঁড়ির দিকে যেতে নিলে আমীরুনের সামনে পরে। আমীরুন মুচকি হাসি দিয়ে বলে,”শইলডা ভালা ভাবি?”
উর্বী ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”তোমাকে আমি পরে দেখে নেবো আমীরুন আপা। ওয়াদা করে সেটা ভঙ্গ করলে। তোমার পাপ হয়েছে তুমি জানো?”
আমীরুন দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, “জে না। সব ওয়াদা না রাখলে পাপ হয় না। কিছু কিছু ওয়াদা ভাঙলে বিরাট সওয়াব হয় ভাবী।”
উর্বী বলে,”তোমাকে পরে দেখে নিচ্ছি। আগে শর্মীর সাথে দেখা করে আসি।”
পেছন থেকে রওশান আরা গম্ভীর কন্ঠে বলে,”দেখাদেখি হয়ে গেলে শাড়ী পাল্টে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে এসো।”
_আচ্ছা মা।
উর্বী দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। রুমা আজমেরী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে।
রুমা বলে,”মা তোমার দজ্জাল শাশুড়ির অভিনয়টা একেবারে নিখুঁত হচ্ছে। তুমি চালিয়ে যাও।”
রওশান আরা মুচকি হেসে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। আজ বহুদিন পরে সে রান্নাঘরে ঢুকেছে। একটু পায়েস রান্না করছে বাড়ির সবার জন্য।
***
শর্মী বেলকোনীতে দাঁড়িয়ে আছে।
উর্বী গিয়ে পেছন থেকে শর্মীর চোখ চেপে ধরে। শর্মী কিছু বলে না। চুপ করে আছে।
উর্বী চোখ ছেড়ে দিয়ে শর্মীর সামনে দাঁড়ায়।
দুহাত দিয়ে গাল দুটো টিপে দিয়ে বলে,”খুব রাগ করেছে আমার উপর তাই না?”
শর্মী কথা বলে না। উর্বীকে সরিয়ে দিয়ে রুমে ঢুকে বিছানায় বসে। উর্বী পিছু পিছু যায়।
শর্মীর হাত দুটো ধরে বলে,”কথা বলবে না? ”
শর্মী অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
উর্বী বলে, “আচ্ছা আমি কি করলে শর্মীর রা’গ পরে যাবে জানতে পারি? কানে ধরবো?”
শর্মী চুপ। উর্বী চুপ করে শর্মীর পাশে বসে থাকে, কিছুক্ষণ পরে বলে “আমি যদি এই কাজ আর দ্বিতীয় বার কখনো করি,তুমি আর আমার সাথে কথা বোলো না কিন্তু এবারের মতো মাফ করে দাও!”
অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলে উর্বী।
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে শর্মী!”
কিছুক্ষণ থেমে বলে ওঠে উর্বী।
শর্মী মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“বুঝেছি। নিজের মা নই তাই তুমি এভাবে কথা না বলে থাকতে পারছো শর্মী তাইনা?”
উর্বীর কথায় শর্মী মুখ তুলে তাকায়। তারপর নরম গলায় বলে ওঠে,”আমিও তোমার নিজের মেয়ে নই তাই এভাবে আমাকে অবহেলা করতে পেরেছো তাই না আন্টি?”
উর্বী করুণ দৃষ্টিতে বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটা প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে তার আচরণে। তার নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।
সে শর্মীকে টেনে নিজের কাছে নেয়।
শর্মী বলে,”তুমি চলে যাও আন্টি।”
_আচ্ছা যাবো। তার আগে একটা জিনিস দেখবে?
_কি?
_তোমার জন্য সারপ্রাইজ।
_আমার কোনো সারপ্রাইজ চাই না।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে শর্মী।
উর্বী জোর করে শর্মীর চোখ চেপে ধরে আবারও।
_কি কোরছো, কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়!
শর্মী বলে।
_আগে চলোই না। শর্মীকে এনে দোতলার খোলা বারান্দায় দাড় করায় উর্বী। তারপর তার চোখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়।
শর্মী তাকিয়ে আছে। তার সামনে একটা ময়না পাখি। খাঁচায় রাখা। সেবার উর্বীদের বাড়িতে গিয়ে এটা পছন্দ করে ফেলেছিলো শর্মী।
শর্মীর চোখ চকচক করছে খুশিতে।
উর্বী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”এটা নেবে না?”
শর্মী চেঁচিয়ে ওঠে।
“আন্টি এটা তুমি আমাকে দিচ্ছো? সত্যিই?”
_হ্যা। তিন সত্যি।
শর্মী খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। সে বলে,” আন্টি এটা আমি আমার ঘরে নিয়ে যাই?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। শর্মী একটুও দেড়ি করে না। খাচাটা ছো মেরে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যায়।
উর্বী দাঁড়িয়ে আছে। রুমা পেছন থেকে বলে,”এতো তাড়াতাড়ি রাগ ভেঙ্গে গেলো? তোমার তো এলেম আছে ভাবি।”
উর্বী ম্লান হেসে বলে,”বয়সের তুলনায় ও যে বড্ড সরল।”
কথাটা বলে উর্বী সেখান থেকে চলে যায়। তাকে রান্নাঘরে যেতে হবে। হাতে রাজ্যর কাজ।
****
উর্বীকে দেখে আজমেরী মুচকি হাসে। রওশান আরার মুখ গম্ভীর।
উর্বী নিচুস্বরে তার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে,”মা কি কি রাধবো? দুলাভাইরা কি খাবেন?”
রওশান আরা বলে,”সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে?”
উর্বী কিচেনের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। টেবিলের ওপর অনেকগুলো ঢেকে রাখা বাটি। সে ঢাকনা উঠিয়ে দেখে নানা রকমের রান্না। উর্বী আজমেরীর দিকে তাকায়। আজমেরী হো হো করে হাসতে থাকে,বলে,
“তুমি কি ভেবেছিলে আমরা সত্যিই তোমাকে দিয়ে রান্না করাবো আজ? রান্না তো তোমাকে আজীবন করতে হবে এ সংসারের। আজ না হয় একটু আরাম করো।”
উর্বী তার শাশুড়ির দিকে তাকায়। রওশান আরা বলে,”বোকার মতো তাকিয়ে আছো কেনো? দুটো বাটি আর দুটো চামচ বের করো।”
উর্বী তাই করে।
“এবার টেবিলের ওপর পায়েশ রাখা আছে। বাটি গুলোতে পরিবেশন করো।”
উর্বী পায়েশ বাটিতে পরিবেশন করে তার শাশুড়িকে বলে,”কাকে দেবো মা?”
_নিয়ে আমার বড়ছেলের কাছে যাও। দুজনে খাও। তারপর ওর জামাকাপড় গুছিয়ে দাও। ও রাজশাহী যাবে।
উর্বীর দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। আমীরুন, আজমেরী, রুমা। সবার মুখে চাপা হাসি।
উর্বী যেনো পালিয়ে গেলে বাঁচে।
***
শেফালী ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একপলক উঁকি দিয়ে চলে যেতে নিলেও দাঁড়িয়ে পরে। খুব ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পরে স্বামীর আরাম কেদারার পেছনে।
শাখাওয়াত চৌধুরী বুঝতে পেরে অত্যন্ত নরম গলায় বলে,”কিছু বলবে!”
শেফালী অবাক হয় স্বামীর এহেন নরম রূপ দেখে। শাখাওয়াত চৌধুরী বলতে থাকে,”মন খারাপ কেনো প্রশ্ন করবে? উত্তর তো তুমি জানো।”
শেফালী চুপ থাকে। শাখাওয়াত বলতে থাকে,”আমি অনেক কঠিন, খারাপ হতে পারি। কিন্তু আমি একজন বাবা শেফালী। ছেলের জন্য কষ্ট আমারও হয়। কিসের অভাব ছিলো ওর বলো তো?”
_সব দোষ ঐ মেয়েটার। রূপ দেখিয়ে ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছিলো। ছাড়বে যখন সম্পর্কে জরিয়েছিলো কেনো?
_একদম বাইরের মেয়েকে দোষ দেবেনা শেফালী। তোমার ছেলে কারো জীবন সঙ্গী হবার যোগ্য ছিলো? আর ঐ মা’র্ডার দুটো? ঐ মেয়েটা বলেছিলো মা’র্ডার দু’টো করতে?
_নেশার ঘোরে ছিলো, আর করেছে তো ঐ মেয়েটার জন্য। বাবুর বন্ধুরা ঐ মেয়েকে নিয়ে বাজে কথা না বললে তো রাগের মাথায় বাবু এহেন কান্ড ঘটাতো না। তুমি মানো বা না মানো ঐ মেয়ে আমার ছেলের জীবনের অভিশাপ। এখন আবার যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তার জীবনটা ঠিক থাকলে হয়।
_ঠিক থাকবে, যদি তোমার গুনধর ছেলে নাক না গলায়। আগে বাঁধা দিতাম। এখন আমিই অনুমতি দিলাম তোমায়। ছেলেটাকে ফোন করে একটু একটু বোঝাও শেফালী। আমি আমার ছেলেটাকে আর হারাতে চাই না।
***
পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। বাড়িতে এখন তারা তিনজন। উর্বী, নাবিল এবং শর্মী।
রওশান আরাকে নিয়ে আজমেরী আর রুমা রুমার শশুর বাড়িতে গিয়েছে, রুমার শাশুড়ি হুট করে অসুস্থ হয়ে পরেছেন। আমীরুন গিয়েছে দেশের বাড়িতে। সামিউল অন্তরা সিলেট। শায়মী তার খালামনিদের বাড়িতে। রাওনাফ হসপিটালে। তার রাজশাহী যাওয়া ক্যানসেল হয়েছে। হসপিটালে পরপর চারটা অপারেশন করতে হবে। রাত দুইটা-তিনটার আগে ফিরবে না।
নাবিল নিচতলায় নিজের ঘরে। শর্মীও নিজের ঘরে বসে পড়ছে। উর্বী শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে ঘর গোছাতে ব্যস্ত। তার ঘর। প্রত্যেকটা জিনিস ধরতে গিয়ে উর্বী টের পাচ্ছে তার মনে একটা অদ্ভুত জোর চলে এসেছে। অদ্ভুত ভালোলাগা ঘিরে ধরছে তাকে।
রাওনাফের জামাকাপড়, নিজের পোশাক খুব যত্ন করে গুছিয়ে রাখছে আলমারিতে। রাওনাফের গাছ গুলোর পরিচর্যা করে,পোষা কবুতর গুলোকে খাবার দিয়ে, রাওনাফের যত মেডিকেলের বই সবকিছু গুছিয়ে বেড সাইডের টেবিলের কাছে আসতেই সে দাঁড়িয়ে যায়।
টেবিলের ওপর শিমালার ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে কিছুক্ষণ। হাত বাড়িয়ে শিমালার ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে ছবিটা মুছে দিয়ে আবারও যায়গামতো রেখে দেয়।
ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে উর্বীর অন্যমনস্ক ভাব কেটে যায়। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই ফোনের স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে সে থ’ম’কে যায়।
দুবার রিং হয়। কেউ ধরছে না। তৃতীয় বারের বার উর্বী ফোন ধরে, ভীত কন্ঠে বলে।
“হ্যালো কে?”
উচ্ছাস চোখ বন্ধ করে উর্বীর গলার আওয়াজ শোনে।
“হ্যালো!!”
দ্বিতীয়বার বলে উর্বী।
“তোমার গলার আওয়াজ টা আমাকে যা শান্তি দেয় পাখি! তুমি কিছুক্ষণ এভাবেই হ্যালো হ্যালো করতে থাকো।”
উর্বীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়।
“তুমি? তুমি কেনো ফোন দিয়েছো আমায়? কি চাচ্ছো তুমি?কেনো পিছু ছাড়ছো না আমার?
_আমি মরলেও তোমার পিছু ছাড়বো না পাখি।
উচ্ছাস হাসছে। তার কথা জরিয়ে যাচ্ছে। সে আজ নেশা করেছে।
উর্বী বলে,”লজ্জা করে না তোমার? একটা খু’নী হয়ে এখনোও একটুও অনুশোচনা নেই তোমার? তোমার ভাগ্য ভালো আমি সেদিন পুলিশ কে কিছু বলি নি। আমার জীবনে আমি আর কন্ট্রোভার্সি চাচ্ছি না তাই বলিনি। প্লিজ এবার নিজেকে শোধরাও উচ্ছাস। প্লিজ।”
উচ্ছাস হাসে,”তার মানে বুঝতে পারছো এখনো তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো? আমার কোনো ক্ষতি হোক তুমি চাওনা উর্বী। কেনো এখনো চলে আসছো না উর্বী আমার কাছে?”
বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী গলায় বলে উচ্ছাস।
উর্বী ধমকে ওঠে,”বাসিনা। বাসিনা ভালো তোমায় উচ্ছাস। তুমি আমার অতীত। আমাকে তুমি প্লিজ বাঁচতে দাও। উচ্ছাস লাইফ তোমাকে যেমন সেকেন্ড চান্স দিয়েছে। আমাকেও দিয়েছে। আমি আরেকটি বার শুরু করেছি সব। কেউ আমাকে আগলে নিয়েছে, আরেকটি বার স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করছে!
_চোপ!! কে অতীত? তোর অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ সব আমিই। এটা তুই মাথায় ঢুকিয়ে নে।
_তুমিও মাথায় ঢুকিয়ে নাও। আমি বিবাহিতা। আমি অন্য কারো স্ত্রী। এবং তার সাথেই আমি বাকি জীবন টা কাটাবো।
উচ্ছাসের রাগ উঠে যায়,সে উর্বীকে কুতসিত একটা গালি দেয়।
উর্বী চুপ করে থাকে। উচ্ছাস বলতে থাকে,
“তোর সংসার করা একেবারে ঘুচিয়ে দেবো। তোর স্বামীর ফোন নাম্বার কিন্তু আমার কাছে আছে। তাকে ফোন দিয়ে বলবো তোর নাভীর নিচেই একটা তিল আছে? বলবো?
বেশি ফরফরাচ্ছিস তুই। বলে দেই?”
ঘৃণায় উর্বীর চোখ বেয়ে পানি পরে।
উচ্ছাস বলতে থাকে,”ভয় পাস না। তোর স্বামীকে আমি মারবো না। আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছি। তিন বাচ্চার বাপকে মেরে বাচ্চা তিনটাকে এতিম করবো আমি? আমি এতোটাও খারাপ নই। তোকে আদায় করার অন্য কৌশল আমার জানা আছে।”
কথাটি বলেই উচ্ছাস কথার সুর পাল্টে ফেলে। আবার নরম গলায় বলে ওঠে,”এই দেখো পাখি। আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করে ফেললাম। কত খারাপ আমি। তুমি প্লিজ রাগ করো না। আচ্ছা শোনো তুমি আমার গান শুনতে চাও না বলো? আমি গান গাইবো। তুমি আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবে।”
উর্বী ফোন কে’টে দিতে চায়। উচ্ছাস বলে,”ফোন কাটবি না ছলনাময়ী।”
উর্বী থামে। উচ্ছাস হেসে ফেলে বলে,”এই দেখো। আবার তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেললাম। সরি পাখি। আচ্ছা শোনো। আর কখনও আমি এমন করবো না, আমি এ্যাংগার ম্যানেজমেন্ট ক্লাসে যাবো প্রমিজ। ধ’ম’কাবো না তোমায়, গালি দেবো না।”
“উচ্ছাস আমাকে বাঁচতে দাও।”
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে উর্বী। উচ্ছাস আবারও চেঁ’চি’য়ে ওঠে,” তুই কেনো বুঝতে পারিস না আমি তোকে ভালোবাসি। গোল্ড ডিগার বি’চ। নতুন পুরুষ পেয়ে একেবারে…..”
ফোন কাটার শব্দ হয়। উর্বী ফোন কে’টে দু’চোখ ভর্তি পানি নিয়ে বসে থাকে।
উচ্ছাস দুলতে থাকে। নেশার ঘোরে সে উর্বীকে কি বলেছে সে নিজেই জানে না।
একটা ও.টি. সামলে এসে সার্জিক্যাল ক্যাপ খুলে এই মাত্র বসেছে সে। এ্যাসিস্ট্যান্ট এসে এক কাপ কড়া ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায়।
নার্স এসে দরজার বাইরে থেকে ডাকে,”স্যার!”
_হ্যা রুপা। রিপোর্ট এসেছে?
_জি স্যার। ইম্প্রেশন নরমাল ফাইন্ডিংস।
_ওহ ওকে। রিপোর্ট টা পাঠিয়ে দাও। আর সাজিয়া নামের রোগীর বাড়ির লোককে বলো লামিয়া আসছে। টেনশন না করতে।
নার্স রুপা মাথা নেড়ে চলে যায়।
রাওনাফের ফোন বেজে ওঠে। উর্বী ফোন দিয়েছে। ম্লান হেসে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে উর্বীর বিষন্ন কন্ঠস্বর।
“কি করছেন?”
_কিছু না? তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ?
_না।
_মন?
_না।
_মেজাজ?
উর্বী হেসে ফেলে। রাওনাফ বলে,”কপালের ব্যাথা কমেছে?”
“হু”
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে উর্বী।
রাওনাফ বলতে থাকে,”আক্তারুজ্জামানের এ্যাসিসট্যান্ট তোমাকে ফোনে না পেয়ে আমাকে ফোন দিয়েছে। আজ নাকি তোমার এ্যাপয়েনমেন্ট ছিলো!”
_জানি। আর বোধ হয় ওখানে যাওয়া হবে না আমার।
রাওনাফ অবাক হয়ে বলে,”কেনো?”
_একসাথে দুজন সাইক্রিয়াটিস্টকে এফোর্ড করতে পারবো না আমি।
_দুজন সাইক্রিয়াটিস্ট মানে?
_আরেকজন পেয়ে গিয়েছি আমি। ভাবছি তাকেই দেখাবো এখন থেকে।
_চেইঞ্জ করেছো! আক্তারুজ্জামান তো ভালো ছিলো। সাইক্রিয়াটিস্টের নাম কি? কোথায় বসেন?
উর্বী কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থাকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে।
_নাম ডক্টর রাওনাফ করীম খান।
চলমান……..
[ আজ গল্প আসার কথা ছিলো না। কিভাবে কিভাবে যেনো লিখে ফেললাম। কাল পাবেন কি না জানি না]