You are my property,Part_8,9
M Sonali
Part-8
সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিট
নিজের রুমের বেলকুনিতে চেয়ার পেতে বসে চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। কাউকে বুঝাতে পারছি না আমার মনের কষ্ট গুলোর কথা। এই দুদিনে আমার জীবনটা হঠাৎ করে কেমন হয়ে গেল কিছুই যেন বুঝতে পারলাম না আমি। হঠাৎ কোনো এক কালবৈশাখী ঝড়ের মত জীবনে সব কিছু ঘটে গেলো। আমার সবকিছু তছনছ করে দিলো সকল স্বপ্নকে শেষ করে দিলো। জানিনা আদৌ আমি এই বাস্তবটাকে মেনে নিতে পারবো কিনা। নাকি সারা জীবন এভাবে কাঁদতে হবে আমায়।
হঠাৎ কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে ধ্যান ভাঙ্গলো আমার। আমি আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ভাইয়া আমার দিকে এক পলকে তাকিয়ে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়াকে দেখে দ্রুত নিজের চোখের জল গুলো মুছে ফেললাম। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
— কিছু বলবে ভাইয়া?
আমার প্রশ্নের উত্তরে ভাইয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরেকটি চেয়ার নিয়ে এসে আমার পাশে বসলো। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলো,
— সব সময় মানুষ যেটা দেখে সেটা কখনোই ঠিক হয়না। হয়তো তার পিছনে অনেক বড় কোন কিছু কারণ থাকে। জীবনে চলতে গেলে এমন কিছু জিনিসের সম্মুখীন হতে হয় সেটার কথা আমরা কখনও কল্পনাও করিনি। কিন্তু সেটাই আমাদের জীবনে এক অদ্ভুত সময় হয়ে চলে আসে। আমাদের মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয় তখন। কিন্তু সেই সময় টা আমরা ঠিকই পার হয়ে যাই। তবে সেই সময়কার কিছু দাগ রয়ে যায় আমাদের মনে। তাই সে সময় টাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে শিখতে হয়। কে জানে সেই সময়ের সেই অভিজ্ঞতার আড়ালে হয়তো অন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তাই ভেঙে না পড়ে পরিস্থিতি মেনে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আমি ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। কেমন রহস্যের মত করে কথাগুলো বলল ভাইয়া। ভাইয়ার কথা গুলো বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা এখন আমার মাঝে নেই। তাই সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে আবারও আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। এখন যেন এই আকাশ টাকেই চিরসাথী মনে হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ নেই আমার। আমি যেন বড্ড একা যেভাবে একাই এসেছিলাম পৃথিবীর বুকে ঠিক তেমন। ভাবতেই একটি বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে।
——————————
গভীররাত চারদিকে নিরব নিস্তব্ধ অন্ধকারে ঢাকা। কোন দিকে কোন পাখিরও শব্দ নেই। সবাই যেন ঘুমে বিভোর হয়ে রয়েছে। সবার মত আমিও ঘুমাচ্ছি বিভোরে। কিন্তু হঠাৎ কেন জানি না ঘুমের ঘোরে আমার মনে হচ্ছে আমাকে যেন খুব কাছ থেকে কেউ পর্যবেক্ষণ করছে। আমাকে দেখছে অনেকক্ষণ হলো এক নজরে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আমার ঘুমের মাঝেই। অস্বস্তিটা কোনমতোই কাটিয়ে উঠতে পারছিনা আমি। ঘুমটাও যেন ভাঙতে চাইছে না। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি আমি যে আমার পাশে কেউ আছে আর আমাকে সে এক নজরে তাকিয়ে থেকে মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর অসম্ভব রকমের বিরক্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ঘুম ভাঙতেই লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম তেমন কেউ নেই রুমে। আমি একাই রয়েছি। তবে আমার পায়ের দিকের জানালাটা খোলা। আমি বিরক্তি নিয়ে উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। তারপরে হাই তুলতে তুলতে এসে আবার শুয়ে পরলাম।
সকালে আম্মুর আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার। আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখেই আম্মু ব্রেকফাস্ট করার কথা বলে চলে গেলো। আমি আরমোরা ভেঙে উঠে বসলাম। তারপর দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমার চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। সকাল দশটা বেজে গেছে। আমি তো এত বেলা অব্দি কখনো ঘুমায়নি? তখনই মনে পড়ে গেল কাল রাতে ঘটে যাওয়া সেই অস্বস্তিকর কথাগুলো। তাই আর কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে কলেজের জন্য একদম রেডি হয়েই রুম থেকে বের হলাম। তারপর আম্মুর কাছে গিয়ে টেবিলে বসতেই আম্মু আমার জন্য খাবার দিয়ে বলে উঠলেন,
— আজকে প্রথম নতুন কলেজে যাচ্ছো এত লেট করলে চলে! সেই কখন থেকে ডাকছি তোমায় আমি। কিন্তু তোমার এত ঘুম কিসের বলোতো?
আম্মুর কথায় অবাক চোখে আম্মুর দিকে তাকালাম আমি। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলাম,
— কি বলছো তুমি আম্মু? নতুন কলেজ মানে? আমি তো এই কলেজে প্রায় দুই বছর হলো পড়াশোনা করছি? তাহলে তুমি নতুন কলেজ বলছ কেন আম্মু?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে একটা কাজের জন্য তাড়াতাড়ি চলে গেলেন আম্মু রান্নাঘরে। তখনই ভাইয়া এসে আমার পাশে বসে আমার প্লেট থেকে খাবার নিয়ে খেতে খেতে বলে উঠলো,
— দু’বছর আগে তুই একটি কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিলি মনে আছে তোর পুচকি? সে কলেজের খরচ বেশি বলে আব্বু চাওয়া সত্যেও তোকে ভর্তি করতে পারেনি। সে জন্য অবশ্য তুই সহ বাসার সবারই মন খারাপ ছিল। তবে পরবর্তীতে তুই আর সে মন খারাপ মনে রাখিস নি। আজ থেকে তুই সেই কলেজেই পড়বি। আর তাই আম্মু বলছিল তোকে নতুন কলেজের কথা। এখন দেরি না করে তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে নে তোকে নিয়ে আমি কলেজে যাব।
ভাইয়ার কথায় যেন কিছুই বুঝলাম না আমি। আমাকে যে কলেজে দু’বছর আগে ভর্তি হতে দেয়নি টাকা খরচ বেশি বলে, তাহলে এখন কেন সেই কলেজে পড়তে যাবো আমি? কথাগুলো মনের মধ্যে আসতেই ভাইয়ার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম,
— কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ভাইয়া? দুই বছর আগে যখন আমি সেই কলেজে পড়তে চেয়েছিলাম তখন খরচ বেশি বলে আব্বু সেই কলেজে আমায় ভর্তি করতে পারেনি। তাহলে এখন আমি কি করে সেই কলেজে পড়বো? আর তাছাড়া আমাদের অবস্থাও তো ততটা ভালো নয়! ঐ কলেজের খরচা টানা আব্বুর জন্য অনেক কষ্টের হয়ে যাবে। আমার ওই কলেজে পড়তে হবে না। তুমি আব্বুকে বলে দেও আমি বরং আমার আগের কলেজেই পড়বো!
আমার কথা শুনে ভাইয়া আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
— এত ঢং করতে হবেনা এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বাইরে আয় আমি তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি কলেজে পৌঁছাতে হবে তোকে অনেক লেট হয়ে গেলো।আর সেখানে তোর এডমিশন কনফার্ম হয়ে গেছে। তাই আর কথা বাড়াস না জলদি আয়।
কথাটি বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে চলে গেল ভাইয়া। মনের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্ন আসলেও এখন আর ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করার মত ইচ্ছা হল না আমার। আর তাছাড়া ওই কলেজে পড়ার স্বপ্ন আমার প্রায় দুই বছর হলো। যদিও স্বপ্নটাকে মনের মাঝে পুতে রেখেছিলাম সত্যি হবে না জেনে। তবে এতদিন পর যেহুতু স্বপ্নটা পূরণ হতে যাচ্ছে তাই ভীষণ ভালো লাগছে। কোনো মতে খেয়েদেয়ে ছুটে চলে আসলাম বাইরে। আসার আগে আম্মুকে শুধু একবার ডেকে বলে এসেছি কলেজে যাওয়ার কথা। বাইরে আসতেই দেখতে পেলাম ভাইয়া একটি রিকশা নিয়ে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গিয়ে ভাইয়ার পাশে বসে পড়লাম। ভাইয়া আমাকে নিয়ে কলেজ এর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মনের মাঝে ভীষণ আনন্দ লাগছে আমার। আজকে স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে, যে কলেজে পড়ার স্বপ্ন আমি অনেক আগে থেকেই দেখে এসেছি। বেশ কিছুক্ষণ পরেই কলেজের সামনে পৌঁছে গেলাম আমরা। ভাইয়া ভাড়া মিটিয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে কলেজের দিকে এগিয়ে গেল। কলেজের দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছি ততো যেন বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে আমার। একেই বুঝি বলে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আনন্দ। এটাতো কোনো ভয় বা অন্য কিছুর ধুকপুকানি নয়। শুধুমাত্র স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আনন্দে এমন হচ্ছে আমার।
কলেজের গেটের কাছে পৌঁছাতেই একটি মেয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে লাগলো। মেয়েটাকে দেখে আমার আর চিনতে অসুবিধা হলো না। এটা আমার ননদিনী রাই। রাই দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বলে উঠলো,
— ভাবি তুমি এসেছ? আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আর তুমি কিনা এত দেরিতে আসলে? প্রথম দিনেই এত দেরী করলে চলে বুঝি?
আমি ওর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,
— আমি যে এই কলেজে আসছিলাম তুমি আগে থেকে জানতে? আর তুমি এখানে কি করছ রাই?
— আমি তো এই কলেজেই পড়ি। আর তাছাড়া কালকে যখন আঙ্কেল তোমার এখানে এডমিশনের জন্য এসেছিল তখন আঙ্কেলের সাথে দেখা হয়ে এসব জেনে গিয়েছিলাম আমি। তাই জানতাম তুমি আজকে আসবে। এখন বলো কেমন আছো তুমি?
— হুমম ভালো আছি। তুমি?
— তুমি চলে এসেছো এখন আমি বিন্দাস আছি।
আমরা দুজন যখন কথা বলায় ব্যস্ত তখন ভাইয়া বিরক্তি নিয়ে আমাকে বলে উঠল,
— আচ্ছা পুচকি তুই তাহলে থাক আমি চলে যাচ্ছি। আবার কলেজ টাইম শেষ হলে নিতে আসবো কেমন।
ভাইয়া কথাটি বলতেই রাই চট করে বলে উঠলো,
— আরে বিয়াই সাব আপনার কথা তো আমি ভুলেই গেছি। আসসালামু আলাইকুম বিয়াই সাব। কেমন আছেন আপনি?
রাইয়ের কথায় যেন কেঁপে উঠল ভাইয়া। ভাইয়া যেনো এতক্ষণ এটারই ভয় পাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারিনা ভাইয়া সব মেয়েদের কে দেখে এত বিরক্তি বোধ কেন করে। রাই এর কথা শুনে মনের মাঝে বিরক্তি নিয়ে মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে ভাইয়া বলে উঠলো,
— ওয়ালাই কুমুসসালাম, এইতো ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
ভাইয়ার মুখে কথাটি শুনে রাই যেন এবার খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো। ভাইয়ার একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— বিয়াই সাপ আপনাকে দেখার পরে তো আরো বেশি বিন্দাস আছি আমি। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটি কথা বলতে পারি, ঠিক কথা নয় একটি রিকোয়েস্ট করতে পারি?
রাইয়ের কথা শুনে ভাইয়া যেনো এবার বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। ভাইয়া মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— কি রিকোয়েস্ট?
ভাইয়ার উত্তরের অপেক্ষায় যেন এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল রাই। রাই হুট করে বলে উঠল,
— সেটা এখন বলব না কলেজ টাইম শেষে দেখা করবেন তখন বলবো। আপনার সাথে একটু কথা আছে এখন বলা যাবেনা। আচ্ছা এখন আপনি যান আমি ভাবীকে নিয়ে যাচ্ছি।
যাওয়ার কথা শুনে যেন ভাইয়া হাপ ছেড়ে বাঁচল। দ্রুত গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো। আমাকে একবার বললও না। ভাইয়া এভাবে চলে যাওয়া দেখে হিহি করে হেসে দিল রাই। আমি রাই এর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রাই হাসি থামিয়ে বলে উঠলো,
— আচ্ছা ভাবী তোমার ভাইটা এত আনরোমান্টিক কেন? মনের মাঝে কোন ফিলিংস নেই? এত সুন্দরী একটা বিয়াইনসাব সামনে রয়েছে, তার সাথে কোথায় একটু ইয়ার্কি ঠাট্টা করবে! তা নয় উনি মুখ গোমরা করে যেন পালিয়ে বাঁচলো। তোমার ভাইয়াকে না দেখলে জানতামই না কোনো মানুষ এমন গোমরা মুখোও হয়।
রাই এর দিকে রাগি চোখে তাকালাম আমি। আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে রাই নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নিল। আমি তখন হেসে দিয়ে বলে উঠলাম,
— চিন্তা করো না, তোমার মত রোমান্টিক একটি বিয়ানসাব যখন পেয়েছে আমার ভাইয়া। তখন দেখবে সেও একদিন রোমান্টিক হয়ে যাবে। এখন চলো কলেজে যাওয়া যাক।
কথাটি বলেই রাইকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে নিয়ে কলেজের মধ্যে প্রবেশ করলাম আমরা। কলেজের মাঝে আসার সাথে সাথে চোখটা শীতল হয়ে এল আমার। অসম্ভব সুন্দর একটি কলেজ এটা। কলেজের সামনে বিশাল বড় মাঠ, আর মাঠের মাঝে রয়েছে বিশাল বড় বড় অনেকগুলো গাছ। সেই গাছের নিচে অনেকখানি করে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। কলেজের একপাশে নানা রকম রং-বেরংয়ের ফুলের বাগানের মত অনেক ফুল গাছ লাগানো। অসম্ভব সুন্দর কলেজটি। মাঠের বড় গাছগুলোর বাঁধানো জায়গা গুলোতে বসে আছে অনেক ছাত্র-ছাত্রী। সবাই নিজেদের মাঝে কথাপোকথনে ব্যস্ত। আমাদের দুজনকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু আমি একটা জিনিস বেশ ভালো করে লক্ষ্য করলাম, কলেজে যেসব ছেলেরা আমাদের আশেপাশে দিয়েই বসে ছিল, তারা আমাকে কলেজে আসতে দেখে সবাই কেমন দূরে সরে যাচ্ছে। এমনকি একনজর তাকিয়ে সবাই মাথা নিচের দিকে করে ফেলছে। আমি এদের এমন আচরণের কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্নের সৃষ্টি হল। “আচ্ছা আমাকে কি খুব খারাপ দেখতে নাকি? আমাকে দেখে কি ওরা ভয় পাচ্ছে? এভাবে চোখ সরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করছে কেন সবাই?”
কথাটাকে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম আমি। হয়তো আজ প্রথম কলেজে এসেছি বলে অপরিচিত মেয়ে দেখে কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না। এটাই নিজের মনকে বোঝালাম আমি। তারপরে আর চিন্তাভাবনা না করে রাই কে সাথে নিয়ে ক্লাসের দিকে রওনা হলাম।
চলবে,,,,,,,,
You are my property
Part_9
M Sonali
বেলকুনিতে রকিং চেয়ারের ওপর রাহির একটি ছবি নিয়ে বসে আছে রাজ। ছবিতে থাকা রাহি অনেক মিষ্টি করে হাসি মুখে রয়েছে। রাহির এই হাসিটা যেন রাজের বুকটা ক্ষতবিক্ষত করতে যথেষ্ট। রাজ যে তার এই হাসিতেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে পারবে সারাটি জীবন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকার পর রাজ আনমনেই বলে উঠলো,
— জানি না রাহি কি আছে তোমার মাঝে? আমি কেনই বা এতটা পাগলের মত ভালবাসতে শুরু করলাম তোমায়? যে রাজ কখনো কোন মেয়ের নাম অব্দি সহ্য করতে পারত না, কোনো মেয়েকে দেখলে রাগে ফায়ার হয়ে যেত, আশেপাশে কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারত না। আজকে সেই রাজ দেখো তোমার প্রতি মুগ্ধ হয়ে যেন এক পলকের জন্য তোমাকে আড়াল হতে দিতে ইচ্ছে করে না। আমার শুধু মনে হয় তোমাকে আমার চোখের আড়াল করলেই হয়তো তোমায় হারিয়ে ফেলবো আমি। জানিনা এতটা পাগল তুমি আমায় কি করে করে ফেললে! তবে এই পাগলামির ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে।
কথাগুলো আনমনে বলে একটি হাসি দিল রাজ। তারপর রাহির ছবিতে ছোট্ট করে একটি চুমু এঁকে দিয়ে রকিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠে নিজে ড্রাইভ করে একটি শপিংমলে পৌঁছাল রাজ। তারপর সেখান থেকে কিছু একটা কিনে নিয়ে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো কলেজের উদ্যেশে।
কলেজ টাইম শেষের সময় হয়ে যাওয়ায় কলেজের সামনে রাকিব এসে দাঁড়িয়ে আছে রাহিকে নিয়ে যাবে বলে। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠল, ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো সে। ওই পাশ থেকে কেউ একজন কিছু বলে উঠলে মুচকি হাসল রাকিব। তারপর ফোনটা কেটে পকেটে রেখে বাসার দিকে হাঁটা দিল। বাসাতে চলে যাওয়ার জন্য। তখন ই পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
— এই যে মিষ্টার বিয়াই সাব কই পালান আপনি?
রাইয়ের কথা শুনে অনেকটা বিরক্তি নিয়েই ফিরে তাকাল রাকিব। তারপর পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল রাই এবং রাহি একসাথে হাসতে হাসতে কলেজ থেকে বের হচ্ছে। আর রাকিব ফিরে তাকাতেই রাই ওকে চোখ টিপ মেরে দিল। এটা দেখে রাকিব কাশতে শুরু করলো। রাকিব এর এমন অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে শেষ রাই। কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে রাহি কিছুই বুঝতে পারছেনা। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রাকিবের দিকে এগিয়ে দিল রাই। তারপর হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
— কি ব্যাপার বিয়াই সাব কি এমন দেখলেন, যে এভাবে কাশি উঠে গেল আপনার? আর আপনি এতো ভীতু কেন বলুন তো? আপনি এখন কোথায় পালাচ্ছিলেন? আপনি কি ভুলে গেছেন আপনাকে আমি সকালে কি বলেছিলাম?
একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করে থামলো রাই। ওর প্রশ্নে যেন এবার প্রান যায় যায় অবস্থা হল রাকিবের। ওদের দুজনের অবস্থা দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো রাহি। তারপর ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবারো রাই বলে উঠলো,
— ভাবি তুমি একা একাই একটু বাসায় চলে যাও। আমার বিয়াই সাব এর সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে। যদি কিছু না মনে করো তাহলে আমি বিয়াই সাবকে সাথে নিয়ে একটু কফি খেতে যেতে পারি!
রাই এর কথায় রাকিব কিছু বলবে তার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো রাহি,
— ঠিক আছে রাই আমার কোন আপত্তি নেই। তুমি ভাইয়াকে নিয়ে যেতে পারো। আমি একাই বাসায় চলে যেতে পারব। তোমরা যাও আমি বাসায় যাচ্ছি।
কথাটি বলতেই কাউকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রাকিবের হাত ধরে একপ্রকার দৌড়ে সেখান থেকে নিয়ে গেল রাই। বেচারা রাকিব অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে এক প্রকার জোর করে রাই এর পিছু পিছু যেতে লাগল। বেশ কিছুটা দূরে যেতেই রাকিবের হাত ছেড়ে বলে উঠলো রাই,
— এই যে মিষ্টার আপনার কি আক্কেল বলতে কিছু নাই? আমি আপনাকে নিয়ে ওখান থেকে কেন কেটে পরলাম বুঝতে পারছেন না? ভাইয়া কি আপনাকে ফোন করে কিছু বলেনি? আর আপনি সেখানে হাবলার মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেনো? কোথায় নিজেই বলবেন যে আমি আপনাকে সকালে কেন আমার সাথে যেতে বললাম, তা না উল্টো আমাকে এসব বলে নিয়ে আসতে হলো আপনাকে। বলি মেয়েদেরকে দেখে আপনি এত ভয় পান কেন হুহহ? মেয়েরা কি বাঘ না ভাল্লুক যে আপনাকে গিলে খাবে?
রাগী গলায় একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে থামল রাই। ওর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো রাকিব। তারপর মাথা নিচু করে বলল,
— ইয়ে মানে আসলে আমি মেয়েদের সাথে তেমন একটা কথা বলি না। তাদেরকে এড়িয়ে চলতে ভালোবাসি, তাই আরকি। আপনি কিছু মনে করবেন না। সরি,,,
— It’s ok no problem, কিন্তু একটা কথা বলেন তো! মেয়েরা আপনার এমন কি ক্ষতি করেছে যে আপনি মেয়েদের এড়িয়ে চলেন? নাকি কেউ ছ্যাঁকা ট্যাকা দিয়ে পালিয়ে গেছে আপনাকে, কোনটা?
— আমরা কি রাস্তায় দাঁড়িয়েই গল্প করবো! নাকি কফি খেতেও যাবো বিয়াইন সাব?
হঠাৎ রাকিবের এমন করে বিয়াইন সাব ডাক শুনে যেন বুকটা কেঁপে ওঠলো রাইয়ের। ও আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে বলল,
— সরি,
ওকে সরি বলতে দেখে এবার মুচকি হাসল রাকিব। তারপর দুজনে একসাথে কফি শপের দিকে রওনা হলো।
——————————-
ভাইয়া আর রাই চলে যাওয়ার পর সেই তখন থেকে কলেজের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছি আমি। একটা রিক্সার জন্য। কিন্তু কোন রিক্সার চিহ্নটুকুও নেই আশেপাশে। অসম্ভব বিরক্ত লাগছে আমার। কেন জানিনা কলেজের মাঝের সব ছেলেগুলো আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ আমার দিকে ভুল করেও তাকাচ্ছে না। বুঝতে পারছি না সবাই আমাকে এত এড়িয়ে যাচ্ছে কেন? কিন্তু এখন সে দিকে খেয়াল করার মতো কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমাকে এখন যে করেই হোক রিক্সা নিয়ে বাসায় পৌঁছাতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখলাম কালো রঙের একটি বিশাল গাড়ি এগিয়ে আসছে আমার দিকে। গাড়িটা দেখে কেন যেন ভয় হতে লাগল আমার। এমন এক অচেনা ফাঁকা রাস্তায় আমি একা একটা মেয়ে আমার ভয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়ে পিছু সরে দাঁড়ালাম আমি। তখনই আশ্চর্য জনক ভাবে গাড়িটা এসে ঠিক আমার সামনে দাঁড়ালো। গাড়িটাকে সামনে দাঁড়াতে দেখে যেন এবার আরো বেশি বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে গেল আমার। তখনই গাড়ির জানালার কাঁচটা নিচে নেমে গেল। আর এর মধ্য থেকে একটি চেনা হাস্যজ্জল মুখ আমার দিকে তাকিয়ে নিজের চোখের চশমা খুলে ফেলল। আমি তাকে দেখে আঁতকে উঠলাম। যেন বুকের মাঝে একটি তীর বিদ্ধ হল আমার। জানিনা এটা ভাললাগার তীর নাকি ভয়ের? তার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করলাম আমি। ইতিমধ্যে সে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বুকের সাথে দুই হাত বেঁধে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অসম্ভব সুন্দর দেখতে লাগছে তাকে। তাকে দেখে যেন চোখ ফেরাতে পারছিনা আমি। এর আগে হয়তো এভাবে কখনো তাকে লক্ষ্য করিনি। তাই বুঝতে পারিনি সে কতটা কিউট।
রাজ সাদা শার্ট এর ওপর কালো রঙের কোট ও প্যান্ট পড়েছে।সাথে চোখে সানগ্লাস, হাতে দামী ঘড়ি, চুলগুলো জেল দিয়ে স্টাইল করা।পায়ে দামী শু সাথে মুখে বাকা হাসি আর মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে যেনো একদম কিলার লুক ওনার।
আমাকে এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বলে উঠলো,
— হয়েছে?
আমি ওনার কথায় অবাক হয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে বললাম,
— কি?
তখন উনি হেসে দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে হালকা আমার দিকে ঝুঁকে বলে উঠলেন,
— আমাকে দেখা হয়েছে? মন ভরে দেখেছ, নাকি আরো দেখতে চাও?
ওনার কথা শুনে অসম্ভব লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছে আমার। আমাকে লজ্জা পেতে দেখে উনি নিজের বুকের বা পাশে হাত ঘষতে ঘষতে বলে উঠলেন,
— ইশশ আমাকে কি মেরে ফেলার প্যান করেছো নাকি রাহি বেবি? এমন লজ্জা মাখা লুক দেখিয়ে আমার এইখানটায় ঘায়েল করো না প্লিজ। আমি এমনিতেই তোমার প্রেমে আর্ধেক মরে আছি। এমন করলে তো পুরোটাই মরে যাবো।
ওনার কথায় যেন লজ্জায় এবার মরে যাওয়ার মত অবস্থা আমার। আমি এখন কি বলব বা কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। তাই দ্রুত ওনাকে পাশ কাটিয়ে অন্য দিকে যেতে যেতে বলে উঠলাম,
— আমি বাসায় যাব অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আম্মু আমার জন্যে টেনশন করবেন।
কথাটি বলেই সামনের দিকে রওনা হলাম আমি। তখনই উনি ছুটে এসে আমার হাত ধরে আমাকে এক টানে নিজের কাছে নিয়ে বলে উঠলেন,
— কেউ টেনশন করবে না। সবাই জানে তুমি এখন তোমার বরের সাথে আছো। আমি ফোন করে বলে দিয়েছি সবাইকে।
উনার কথার উত্তরে আমি কিছু বলবো তার আগেই উনি আমাকে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই কোলে তুলে নিলেন। এমন আকস্মিকভাবে কোলে তুলে নেওয়ায় অনেকটাই ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম আমি। তাই খিঁচে চোখ বন্ধ করে নিয়ে ওনার গলা জরিয়ে ধরলাম। উনি আমায় কোলে নিয়ে মুচকি হেসে আমাকে নিয়ে সোজা গাড়িতে বসিয়ে দিলেন। তারপর তিনি পাশের সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ভয় নেই আমি তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছি না। আমি কিন্তু তোমারি বর মনে রেখো রাহি বেবি।
চলবে,,,,,,,,,,,