You are my property,Part_35,36
M Sonali
Part-35
রাই এবং ভাইয়ার সকল কথা শুনে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইলাম আমি। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে যার যার জায়গায়। কেউ কোনো কথা বলছে না। পুরো রুমজুড়ে এখন স্তব্ধতা বিরাজমান। আমি বেশ কিছুক্ষণ একইভাবে বসে থাকার পর এবার মাথা তুলে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে উঠলাম,
— তোমাদের কথা সব কিছু বুঝলাম ভাইয়া। বুঝলাম তোমরা এ কারণে আমাকে বিয়ে দিয়েছো। কিন্তু সেটার জন্য তো আমি কোন কিছুই বলিনি। আমি জানতে চাই তোমরা এই এতদিন আমার সাথে মিথ্যা অভিনয় করলে কেন? কেন সবাই মিলে বললে যে আমার এখনো বিয়ে হয়নি? রাজ বা রাই বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই? সবই আমার মনের ভুল? তোমরা আমার সাথে কেনো এমন নাটক করলে ভাইয়া? তার উত্তর দাও আমায়!
আমার কথার উত্তরে ভাইয়া কিছু বলার আগেই আরিশা আমার পাশে এগিয়ে এসে আমার সামনে বসে বলতে লাগলো,
— তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি রাহি। কেন তোমাকে এতটা কষ্ট সহ্য করতে হলো সবার থেকে, কেনই বা তোমার প্রিয় মানুষেরা তোমার সাথে নাটক করলো! আমি জানি এটা নিয়ে তুমি অনেক চিন্তিত! কিন্তু তুমি কি জানো তোমার সাথে এমন আচরনের কারনে তোমার চাইতেও বেশী কষ্ট পায় তারা! যারা তোমার সাথে এমন টা করেছে? বিশেষ করে আরিয়ান যে প্রতিটা মুহুর্তে তোমাকে এমন কষ্ট দিয়ে নিজে ধুঁকে ধুঁকে মরছে সেটা কি তুমি জানো? তা হয়তো জানো না। তাহলে শোনো কেন এমন করেছে তোমার সাথে সবাই।” মনে আছে সেদিনের কথা? যেদিন তোমাকে আরিয়ান প্রপোজ করেছিল। যেদিন রাই এর সাথে তোমার ভাইয়ের বিয়ে ছিল। আর সেদিন তোমাকে বধু সাজে সাজিয়ে বাসর করার স্বপ্ন দেখেছিল আরিয়ান?
— হুমম!
— তোমার আচরণ ব্যবহারে আরিয়ান ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিল তুমি আরিয়ানের প্রতি অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছো। ওকে ভালবাসতে শুরু করেছো। তাই সেদিন ও তোমাকে স্ত্রী রূপে কাছে পাওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল। তোমার মা কিন্তু তোমার উপর রাগ করে তোমাকে সেখানে থাকতে বলেননি। বরং সেখানে তোমাকে থাকতে বলেছিল এই ভেবে যেন তুমি সংসারী হয়ে ওঠো। যতই হোক মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে স্বামী’ই হয় তার সবচাইতে আপন। বাবার বাড়ির সবাই তখন পর হয়ে যায়। এটা তোমার মা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিল। তাই বলে তোমার প্রতি তাদের ভালবাসা কিন্তু বিন্দু পরিমানও কমেনি। কিন্তু সেদিন তুমি ভুল বুঝে ছিলে। উল্টা বুঝেছিলে তুমি সব। আরিয়ানের সাথে যখন উল্টোপাল্টা কথা নিয়ে রাগারাগি করছিলে। আরিয়ানকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে তখন আরিয়ান তোমার ওপর রেগে যায়। এমনকি হাত তোলার জন্য হাত উঁচু করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিন্তু আরিয়ান তোমাকে মারেনি। বরং তুমি নিজেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাও। তোমার এই রোগটাই ছিলো তার কারণ। তুমি কি জানো তুমি জ্ঞান হারানোর পর আরিয়ান কেমন করেছিল? তোমার জন্য এক কথায় বলতে গেলে ও পাগল হয়ে গিয়েছিল। ও তখনই নিজেকে নিজে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো। আরিয়ান ভেবেছিল তুমি হয়তো ওর কারনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছো এত কষ্ট পেয়েছো। নিজেকে নিজে শেষ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল সেদিন আরিয়ান। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি আর আম্মু সেখানে গিয়ে পৌঁছাই। আর সেজন্যই আরিয়ানকে থামাতে পারি আমরা। তুমি জানো তোমার সাথে সবাই কেন এমন আচরণ করেছে? কেন সবাই তোমার থেকে নাটক করে দূরে সরে থেকেছে? সেদিন যখন তুমি জ্ঞান হারিয়ে পরে যাও! তখন তোমাকে নিয়ে আমরা সবাই মিলে আম্মুর হসপিটালে যাই। আরিয়ানকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করি। হসপিটালে দীর্ঘ ২ ঘন্টা আম্মু তোমাকে চেকআপের পরে আমাদের জানায় তুমি এক নতুন রোগে আক্রান্ত। আর সেই রোগের চিকিৎসা না করায় তোমার ওপর তার উল্টা প্রভাব পরছে। যেমন তুমি নিজের ফিলিংস গুলো বোঝাতে পারছো না। বরং উল্টা রিয়েক্ট করছো।
এতোটুকু একনাগাড়ে বলে থামল আরিশা। ওকে থামতে দেখে আমি প্রশ্ন করে উঠলাম,
— কি সেই রোগ যার কারণে আমি এমন হয়েছিলাম?
আমার কথার উত্তরে আরিশা জিব্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল,
— তোমার এই রোগটার নাম অ্যাসপারগার বা অ্যাসপারজার বলা চলে। তবে এই রোগটির নাম যে শুধু অ্যাসপারগার তা নয়। তোমার শরীরে যে রোগটা আছে সেটা ভীষণ অদ্ভুত একটি রোগ। তবে এটার সাথে অ্যাসপারগারের বেশ কিছুটা মিল রয়েছে বলেই এটাকে অ্যাসপারগার বলা হয়েছে। আম্মু তোমাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কেননা তোমার ব্যাপারে সব টা জানার পর আর তোমাকে চেকআপ করার পর অবাক করা বিষয় বেরিয়ে এসেছিল। আর সেটা হলো তুমি দিনে দিনে যত চুপচাপ থাকতে, যত কোনকিছুর প্রতিবাদ না করতে, ততো প্রতিবন্ধীর দিকে চলে যেতে। এমনকি একসময় হয়ত নিজে একটা প্রতিবন্ধী তে পরিণত হতে। কথায় কথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে। আর এভাবেই তোমার মৃত্যু ঘটতো। তুমি জীবনেও নিজের ফিলিংস গুলো প্রকাশ করতে পারতে না।
অ্যাসপারগারের লক্ষণসমূহ বা অ্যাসপারজারের লক্ষণসমূহ বলতে এক প্রকার অটিজম বোঝায়। যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শৈশব এবং জীবনব্যাপী বিকাশ প্রক্রিয়ায় এক প্রকার ত্রুটি বা পার্থক্য ঘটে। যার ফলে ব্যক্তির সামাজিক আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। এই লক্ষণসমূহের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি অলিখিত সামাজিক নিয়মাবলী বুঝতে পারেন না। এবং মুখের ভাব-ভঙ্গির মাধ্যমে এবং শরীরী ভাষায় বোঝানো নির্দেশ বুঝতে পারেন না। এরা সাধারণত প্রবল উদ্দীপকের অনুভূতি সহ্য করতে পারে না এবং প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। তোমার রোগ টা ও ঠিক এইরকমই। তবে তুমি আরেকটু গুরুতর হয়ে পড়েছিলে। যে কারণে দিন দিন তোমার মাঝে বেশি অবনতি লক্ষ করা যাচ্ছিল। তুমি দিনে দিনে হয়তো প্রতিবন্ধীত্বের রূপ নিতে বা পাগল হয়ে যেতে। নিজের ফিলিংস গুলো কখনো কারো সাথে শেয়ার করতে পারতে না। বা নিজের উপর হওয়া অন্যায় অপমানের কোন প্রতিবাদ করতে পারতে না। যেমনটা কখনো পারোনি তুমি। তখন তোমাকে ঠিক করার জন্য একটাই উপায় ছিল, আর সেটা হলো তোমাকে এমন কোন শক দেওয়া যেটাতে পরে তুমি চিন্তা করতে বাধ্য হও। এবং অতিত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করো। নিজের ফিলিংস গুলো কে ধীরেধীরে প্রকাশ করতে সক্ষম হও। সকলের কাছে নিজের মনের চিন্তা ভাবনা গুলো প্রকাশ করতে পারো। আর সেসবের কারণে তুমি নিজেকে ধীরে ধীরে বুঝতে পারো। অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়াতে পারো। এটার জন্যই সকলে তোমার সাথে অভিনয় করতে শুরু করে। কারণ তোমাকে শক দেওয়ার মতো তখন একটাই জিনিস ছিল সেটা হচ্ছে সকলের কাছ থেকে তোমার স্মৃতি মুছে ফেলার মত কথা বলতে শোনা। আর তোমার সাথে ঠিক সেটাই করা হয়েছে। সবাই অনেক কষ্ট করলেও তোমার থেকে দূরে সরে থেকেছে। এমন আচরণ করেছে যেনো তুমি সব ভুল বলছো তারাই সঠিক। আর তুমি যা বলছো সবই ভুল ও তোমার স্বপ্ন। বাস্তবে তার কোনো অসস্তি নেই। আর সবাই ঠিক সেটাই করলো, তোমার সাথে সবাই এমন আচারণ করতে শুরু করলো যেনো তুমি সব স্বপ্ন দেখেছো। রাজ বা রাই এরা কেউ নেই পৃথিবীতে। সবই তোমার কল্পনা ছিল। এমনকি তুমি বিবাহিতও নয়। যখন সবাই তোমার সাথে এমন আচরন করতে শুরু করল তখন তুমি মনে মনে পণ করলে তুমি সত্যিটা খুঁজে বের করবে। তুমি নিজের মাঝে রাগ ও কৌতুহলের সৃষ্টি করলে। এবং সেই কৌতুহলের বশে নিজেকে ধীরে ধীরে প্রকাশ করতে লাগলে। নিজের ফিলিংস গুলো প্রকাশ করতে লাগলে। আর এভাবেই এখন তুমি সুস্থ হয়ে গেছো রাহি। আর তোমাকে সুস্থ করে তোলার পিছনে সব চাইতে বেশি কষ্ট করেছে আরিয়ান। আমি নিজে চোখে দেখেছি তোমার প্রতি ওর পাগলের মতো ভালবাসাগুলো। তোমার সাথে অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে তিলে তিলে কষ্ট দেওয়াগুলো।
একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে থামল আরিশা। আমি ওর কথার উত্তরে কোন কিছু না বলে একদম চুপচাপ বসে রয়েছি। কারো মুখের দিকেও তাকাচ্ছি না। তবে বেশ ভালই বুঝতে পারছি সকলের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছে। শুধু আমি বাদে। আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরিশার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলাম,
— তাহলে রাজ যে আমার হাত কেটে নিজের নাম লিখে দিয়ে ছিলো। সেই হাত কাটার দাগ কোথায় গেল আরিশা? আর আজকে কেন আমার সাথে রাজ এতটা বাজে বিহেভ করল?
আমার কথার উত্তরে আরিশা মলিন হেসে আমার এক গালে নিজের হাত রেখে বলে উঠলো,
— আরে পাগলি তুমি এখনো বুঝলে না তোমার হাতের দাগ কোথায় গেল? তুমি যেনো কোন কিছু ধরতে না পারো সেই কারণেই তোমার হাতের নাম লেখাটা মুছে দেওয়া হয়েছে। আর সেটা করেছে আমার আম্মু। খুব সূক্ষ্মভাবে ছোট্ট একটি প্লাস্টিক সার্জারি অপারেশন করে তোমার হাত থেকে সেই লেখাটা মুছে দেওয়া হয়েছে। আর আজকে আরিয়ান তোমার সাথে যেটা করেছে সেটা শুধুমাত্র তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য। যে তুমি এখনও আগের মতো নিজের প্রতি অন্যায় হওয়াতে চুপ থাকো নাকি প্রতিবাদ করতে পারো। আর দেখো তুমি আজকে ঠিক নিজের রাগ অভিমানগুলো আরিয়ানের ওপর প্রয়োগ করতে পেরেছো। তুমি পুরপুরি সুস্থ হয়ে গেছো রাহি। You are perfectly healthy now.
আরিশার কথা শুনে আমি কোন কিছু বললাম না। সকলের সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা ভাইয়ার কাছে চলে গেলাম। তারপর ভাইয়ের হাত থেকে ওর ফোনটা ছো মেরে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। সবাই এসে আমার দরজা ধাক্কাতে লাগলো। হয়তো সবাই ভয় পেয়েছে আমি আগের মতো আবার অসুস্থ হয়ে গেলাম কিনা? নিজের অনুভূতিগুলো হয়তো বোঝাতে পারছি না। তাই আমি সকলকে অভয় দিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠলাম,
— আমার কিছু হয়নি আমি ঠিক আছি। আমাকে এখন কেউ বিরক্ত করো না প্লিজ। তোমরা যে যার কাজে চলে যাও।
কথাটি বলে ভাইয়ার ফোনটা নিয়ে সোজা আমার বিছানার উপর গিয়ে বসে পড়লাম। তারপর বালিশের পাশ থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিলাম। ভাইয়ার ফোন থেকে কল লিস্টে ঢুকে আরিয়ান এর নাম্বারটা নিজের ফোনে তুলে নিলাম। তারপরে কল দিলাম আরিয়ানের নাম্বারে। দুই তিনবার ফোন বাজতেই ওপাশ থেকে দ্রুত ফোন রিসিভ করলো আরিয়ান। তবে একদম চুপ করে রইলো সে। শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। আমি মুচকি হেসে অভিমানি গলায় বলে উঠলাম,
— হ্যালো মিষ্টার রাজ চৌধুরী, আমার সাথে কথা বলবেন না আপনি? বলি বৌ এর ওপর এত রাগ করলে চলে? যে বিয়ের পর থেকে একটানা বাবার বাড়িতে ফেলে রেখেছেন নিজের একমাত্র বউকে? নিজের কাছে বুঝি নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না আপনার? এই বুঝি বউ এর প্রতি আপনার ভালোবাসা? যে বিয়ে করে বউকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। এমন ভালোবাসা লাগবে না আমার বলে দিলাম। আগামি ১৫ মিনিটের মাঝে আপনাকে আমার সামনে চাই আমি। নয়তো আপনার সাথে কাট্টি। আর কখনো কোন কথা বলব না এই বলে দিলাম।
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ফোনটা কেটে দিলাম আমি। তারপর কিছু একটা ভেবে আলমারির কাছে চলে গেলাম।
চলবে,,,,,,
You are my property
Part_36
M Sonali
গত ১০ মিনিট হলো আলমারি খুলে তার মাঝে সুন্দর একটি কাপড় পছন্দ করার জন্য খুঁজে চলেছি আমি। যেটা আজকে পরে আরিয়ানকে চমকে দেবো। যেন উনি আমার দিক থেকে চোখ সরাতে না পারেন। কিন্তু কোনভাবে একটাও জামা পছন্দ করতে পারছি না আমি। আলমারির মাঝের সব কাপড়চোপড় প্রায় নিচে ছুড়ে ফেলেছি রাগ করে। কেন পছন্দ হচ্ছেনা তাই। এভাবে করতে করতে হঠাৎ চোখ পরল একটি প্যাকেট এর দিকে। আর তার দিকে চোখ পড়তেই খুশিতে গদগদ হয়ে গেলাম আমি।কেননা এই প্যাকেটটা সেটা যেটা আরিশার হাত দিয়ে আরিয়ান আমাকে কিনে দিয়েছিল নবীন বরণ উৎসব এর আগের দিন। প্যাকেটটা চোখে পড়তেই দ্রুত সেটা হাতে নিয়ে খাটের উপর চলে গেলাম আমি। তারপর প্যাকেটটা খুলতেই সেই নীল রঙের শাড়ি এবং জুয়েলারি গুলো বের হয়ে এলো। অসম্ভব খুশি লাগছে আমার এগুলো দেখে। কিন্তু এখন খুশি হয়ে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। তাড়াতাড়ি নিজেকে সাজাতে হবে আমায়। তাই দ্রুত নিচে পড়ে থাকা এলোমেলো কাপড়-চোপড় গুলো তুলে আলমারিতে রেখে কোনমতে আলমারিটা লাগিয়ে রাখলাম। তারপর ওয়াশ রুমে চলে গেলাম শাড়ি এবং প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে। একটু পর ফ্রেস হয়ে শাড়িটা পড়ে আসলাম ওয়াশরুম থেকে। বাইরে আসতেই শুনতে পেলাম আরিয়ানের কন্ঠ। আরিয়ান উত্তেজিত হয়ে সকলের কাছে জানতে চাইছে আমি কোথায়? আমি ঠিক আছি কিনা? ওর কন্ঠ শুনতেই যেন বুকের মধ্যখানে অনেকটাই ধুকপুকানি বেড়ে গেল আমার। তাই দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকবার টোকা দিয়ে বলে উঠলাম,
— এই যে মিস্টার আরিয়ান চৌধুরি, আমার সাথে দেখা করতে হলে আপনাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তাই উত্তেজিত না হয়ে চুপচাপ বসে থাকুন। আমি কিছুক্ষনের মাঝেই আসছি।
কথাটি বলেই মুচকি হেসে সেখান থেকে সরে আসলাম আমি। জানি এখন সকালের মাথার মধ্যে নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমায় নিয়ে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কারন আমি তো এখন তাদের সকলকে নতুন চমক দিতে চলেছি।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসলাম আমি। তারপর নিজেকে সাজাতে লাগলাম সুন্দর এক নতুন সাজে। আরিয়ানের দেওয়া শাড়ির সাথের সকল জুয়েলারি গুলো একে একে পরে নিলাম, হাতে কপালে গলায় এবং কানে। তারপর ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দিয়ে চোখে গাঢ় কাজল পরে নিলাম। চুলগুলো চিরুনি করে ঘারের পিঠে ছেড়ে দিলাম। এতটুকুই পার্ফেক্ট, এর চাইতে বেশি সাজগোছ পছন্দ নয় আমার। তারপর নিজেকে ভালোভাবে একবার আয়নায় দেখে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে আসলাম, দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার জন্য। দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন হার্টবিট দ্বিগুন বেড়ে গেল আমার। বুঝতে পারছি না এমন কেনো লাগছে আমার। অসম্ভব জোরে নিশ্বাস ফেলছি আমি। কেন জানিনা মন থেকে ভীষণ উত্তেজনা ফিল করছি। তবুও নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে বের হলাম। বাইরে বের হয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলাম সোফায় বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে আরিয়ান। বাকি সবাইও আশেপাশেই আছে। শুধু আব্বু আর আম্মু নেই। আমাকে এমন সাজে দেখামাত্র আরিয়ান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আর ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। তারপর মনে মনে দুষ্টু হেসে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম ওর সামনে। তারপর আরিয়ানের ঠিক সামনের সোফাটায় পায়ের উপর পা তুলে বসে পড়লাম আমি। ওর দিকে তাকিয়ে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে ওকে বসতে বললাম। ও বেচারা এখনো আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমার ইশারা পেয়ে চুপটি করে সোফায় বসে পড়ে একই ভাবে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি মুখ লুকিয়ে কিছুটা মুচকি হেসে নিয়ে আবার গম্ভীর মুখ করে বলে উঠলাম,
— তো বলুন মিস্টার আরিয়ান চৌধুরী, আপনি যে আমাকে দেখতে এসেছেন আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে?
আমার এমন কথা শুনে উপস্থিত সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হয়তো সবাই মনে মনে ভাবছে আমি পাগল হয়ে গেছি। কিন্তু তারা তো আর জানেনা, আমার মাথায় এখন কি দুষ্টুমি প্ল্যানিং চলছে। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি এবার রাই এর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— এই যে মিস রাই চৌধুরী। আপনি তো মনে হয় আপনার ভাইয়ার সাথে মানে আরিয়ান চৌধুরীর সাথে এসেছেন তাই না?তাহলে আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আপনি গিয়ে উনার পাশে বোসুন। আর ভাইয়া তুমি এসে আমার পাশে বসো। তোমার বোনকে দেখতে এসেছে আর তুমি কিনা ওখানে ক্যাবলাকান্তর মতো হা করে দাঁড়িয়ে আছো? এটা কেমন কথা বলতো? এখানে এসে আমার পাশে বসো।
আমার কথার উত্তরে কেউ কিছু না বলে যা বললাম তাই করে বসল ওরা। রাই গিয়ে সোজা আরিয়ানের পাশে বসলো। আর ভাইয়া এসে আমার পাসে। সবাই যেন বোঝার চেষ্টা করছে আমি কি করতে চাইছি। তবে সবাই যে অনেক বেশি কনফিউজড এটা আমি খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছি। হঠাৎ ভাইয়া আমায় কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই আমি ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম,
— প্লিজ ভাইয়া এখন কোন কথা বলো না। আমাকে প্রশ্ন করতে দাও। আফটার অল আমাকেও তো জানতে হবে যার সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে সে কেমন মানুষ। তার সম্পর্কে তো বিশ্লেষণ না জেনে তাকে আমি বিয়ে করতে পারি না তাই না? তুমি মিস্টার আরিয়ান চৌধুরি আপনি কি করেন?
আমার কথার উত্তরে আরিয়ান কি বলবে বুঝতে পারছেনা। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি আবার গলা খাখারি দিয়ে বলে উঠলাম,
— কি হলো আপনার কি কোন সমস্যা আছে? নাকি কথা বলতে পারেন না আপনি? আমি জিজ্ঞেস করছি আপনি কি করেন?
এবার আরিয়ান নড়েচড়ে বসে কেশে নিয়ে বলে উঠল,
— আমি, আমি চৌধুরী গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিক আরিয়ান চৌধুরি। এ ছাড়াও আমার দেশ বিদেশে বিজনেস আছে। আই এম এ বিজনেসম্যান।
— ওহ গুড। তা আমাকে দেখে আপনার কেমন লাগলো? মানে পাত্রী দেখতে এসেছেন বলে কথা? আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে?
আমার কথা শুনে এবার বেক্কলের মত তাকিয়ে রইল আরিয়ান আমার দিকে। আমি আবারো ওর সামনে হাতের আঙ্গুল দিয়ে চুটকি বাজিয়ে বলে উঠলাম,
— কি হলো বলুন তো? আপনাকে একটা প্রশ্ন একবার করলে কি বুঝতে পারেন না নাকি? আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে?
আরিয়ান দ্রুত বলে উঠলো,
— হ্যা হ্যা পছন্দ হয়েছে। অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে তোমাকে আমার।
— হুমম সেটা তো আগেই বুঝেছি। তো আপনি জানতে চাইবেন না, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে কিনা?
আমার কথার উত্তরে আরিয়ান কিছু বলার আগেই ভাইয়া পাশ থেকে রাগী গলায় বলে উঠল,
— কি হচ্ছে কি রাহি তখন থেকে? তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস নাকি? কি বলছিস এসব আবোল-তাবোল?
ভাইয়ার কথার উত্তরে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলব, তার আগেই আরিশা ভাইয়ার কাছে এগিয়ে এসে বলে উঠল,
— ভাইয়া আপনি চুপ থাকুন। রাহি যা করছে তা ওকে করতে দিন।
আমি আরিশার দিকে তাকিয়ে উড়ন্ত কিস ছুড়ে দিয়ে বলে উঠলাম,
— থ্যাঙ্ক ইউ সুইটহার্ট থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।
আমার এমন কান্ডে আরিশা সহ উপস্থিত সবাই বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবারও আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
— তা মিস্টার আরিয়ান আপনি হাতের কাজ কেমন জানেন? আই মিন রান্না-বান্না সব জানেন তো? আমি কিন্তু বিয়ের পর রান্না করে খাওয়াতে পারব না বরং আপনাকেই রান্না করে খাওয়াতে হবে আমায়।
আমার কথা শুনে ইয়া বড় বড় চোখ করে আরিয়ান তাকালো আমার দিকে। তারপর শুকনো ঢোক গিলে বলে উঠলো,
— রাহি তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? তুমি এসব কি শুরু করেছো বলোতো?
ওনার কথায় পাত্তা না দিয়ে আমি আবারও বললাম,
— দেখুন মিস্টার আরিয়ান আমি তেমন কিছুই শুরু করিনি। আসলে বিয়ের আগে ছেলেরা একরকম দেখায় আর বিয়ের পরে আরেকরকম, তাই বিয়ের আগে সবকিছু শিওর হয়ে নিতে চাইছি। আচ্ছা আপনি যদি কিছু না মনে করেন তাহলে আপনার সাথে আমি একটু আলাদা কথা বলতে চাই। সো আপনার কি সময় হবে?
আমার কথার উত্তরে এক লাফে উঠে দাঁড়ালো আরিয়ান। আর দ্রুত আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
— অবশ্যই হবে, চলো যাই।
ওর এমন কাণ্ড দেখে উপস্থিত সবাই বেক্কলের মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসতে শুরু করলো। আমার যে হাসি পাচ্ছে না তা কিন্তু নয়। কিন্তু যতটা সম্ভব নিজের হাসিটা কে লুকিয়ে যাচ্ছি আমি। আরিয়ানের এমন অদ্ভুত কান্ড সত্যিই অনেক হাস্যকর। সবার সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমি আরিয়ানকে নিয়ে আমার রুমে চলে আসলাম। তারপর ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বিছানার উপর গিয়ে বসে ওনাকে ইশারা করে আমার পাশে বসতে বললাম। উনি এসে আমার পাসে চুপচাপ বসে পরলেন। আমি আবার ওনার সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উনাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলাম। দেখে নিয়ে বললাম,
— আচ্ছা আপনি কি চুল চিরুনি করেন না? মানে আপনি এত অগোছালো কেন? চুলগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। শরীরের জামা কাপড়ও কেমন অগোছালো লাগছে। বলি আপনি কি পাগল? এত বড়লোক একটা মানুষ কিন্তু আপনার এই অবস্থা কেন?
উনি আমার কথার উত্তরে আমার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ছোট করে বলে উঠলো,
— তোমার জন্য!
ওনার এতোটুকু কথা’ই যেনো আমার বুকটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে যথেষ্ট। আমি আর ওনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। মনে মনে যতই দুষ্টুমি প্ল্যান করি না কেন ওনার সামনে এসে সবকিছুই কেমন গুলিয়ে ফেলেছি আমি। তাই ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
— দেখুন আরিয়ান আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই বিয়েতে আমার মত ছিল না। কিন্তু এখন আমিও আপনাকে বিয়ে করতে চাই। তবে সেটা নতুন করে। আগের বিয়েটা আমি মানি না, আপনি যদি আমাকে স্ত্রীরূপে পেতে চান তাহলে আমাকে নতুন করে বিয়ে করতে হবে আপনাকে। আর এতদিন আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে আমার জন্য।
আমার কথার উত্তরে উনি কিছু না বলে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুতগতিতে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমায় আচমকাই জড়িয়ে ধরলেন। উনার এমন আচরণে আমার কি করা উচিত আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। তাই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম আমার ঘারের কাছের শাড়ি অনেকটাই ভিজে যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম উনি হয়তো আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছেন। আমি কি করবো বুঝতে পারছিনা তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু উনি যেন আমাকে ছাড়ার নাম’ই করছেন না। সেই কখন থেকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে কান্না করে চলেছেন। এদিকে আমার অবস্থা বেহাল হয়ে যাচ্ছে। কেননা উনি আমাকে এতটাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে যে আমার মনে হচ্ছে আমার হাড়গোড় গুলো সব ভেঙে যাবে এখন। তাই আমি নিজের ডান হাতটা আলতো করে উনার পিঠে স্পর্শ করে বলে উঠলাম,
— আই এম সরি আরিয়ান। আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে, আমি না জেনে আপনাকে বড্ড বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন।
আমার কথার উত্তরে উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার দু গালে হাত রেখে কপালে আলতো করে একটি চুমু এঁকে দিয়ে বলে উঠলেন,
— তুমি একদম ছোট্ট শিশুর মত নিষ্পাপ রাহি। আর এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি। তোমার কোনো ভুল হয়নি। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো তোমার চাইতেও বেশি খারাপ আচরণ করতো আমার সাথে। তুমি সে তুলনায় কিছুই করোনি। আর আমি এতেই সার্থক যে তুমি স্বাভাবিক হয়ে গেছো। তোমার সব অসুখ সেরে গেছে। এটাই আমার কাছে যথেষ্ট। আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে নতুন করে বিয়ে করে আমার বাসায় নিয়ে যাব। আমার বউ করে। আর তোমার এই অগোছালো স্বামী তোমার কাছে গোছালো হয়ে ফিরবে আবার। প্রমিস
কথাগুলো বলেই উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালেন। তখনই আমি ওনার হাতটি ধরে ফেললাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে জানতে চাইলেন, “কি হয়েছে”। আমি এবার অভিমানী ফেস করে বলে উঠলাম,
— আমি যে আপনার জন্য এত সুন্দর করে সাজালাম! আপনারই দেওয়া শাড়ি পড়ে! আপনি তো কিছু বললেন না আমায় কেমন লাগছে?
আমার কথার উত্তরে উনি একবার আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভাল করে দেখে নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
— এখন কিছু বলবো না সময় হলে বলব! এখন বলতে গেলে সমস্যায় পড়ে যাব।
কথাটি বলেই মুচকি হেসে আমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন উনি। আর আমি বিছানায় বসে লজ্জা মাখা মুখ করে হাসতে লাগলাম আনমনেই।
চলবে,,,,,,