You are my property,Part 41,42
M Sonali
Part-41
কাপড় চোপড়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে গাল ফুলিয়ে চুপ করে সোফার উপর বসে আছি আমি। আমাকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাকি সবাই। আব্বু আম্মু ভীষণ রেগে আছে আমার উপর। আমার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে রাজ। সে কি করবে হয়তো ভেবে পাচ্ছেনা এখন। ভাইয়াও পাশে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আর রাই বেচারি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সকলের দিকে লক্ষ্য রাখছে। পুরো রুম জুড়ে ছড়িয়ে আছে নিরব নিস্তব্ধতা। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই যে আমার উপর বেশ রেগে আছে এটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছি আমি। তার কারণটাও একমাত্র আমি’ই। কারণ রাত প্রায় 10 টার উপরে বাজতে চললো কিন্তু আমি এখনই এ বাসা ছেড়ে ওই বাসায় যাব বলে উঠে পড়ে লেগেছি। যদিও এই সময় কেউ আমাদের যেতে দিতে চাইছে না। তবে কে শোনে কার কথা, আমি যখন জেদ ধরছি তখন তো গিয়েই ছাড়বো। রাজকে যে শিক্ষা দিতে হবে আমায়। হঠাৎ নীরবতা কাটিয়ে সামনে থেকে আব্বু রাগি গলায় বলে উঠল,
— রাহি অনেক পাগলামো সহ্য করেছি আমরা তোমার? কি হয়েছে বলোতো তোমার? বিয়ের পর থেকেই দেখছি তুমি সব সময় কেমন জেদ নিয়ে চলো। তুমি যখন যেটা জেদ ধরো তখন সেটাই করে ছাড়ো। এতো ছেলেমানুষীর মানে কি? এখন কি বাসা ছেড়ে যাওয়ার সময়? কালকে সকালে গেলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে শুনি? আর কি এমন হয়েছে যে তুমি এ সময় যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ?
আব্বুর কথার উত্তরে আমি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে আম্মু আমার পাশে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— রাহি মা, বলতো আমায় তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে? হঠাৎ করে এভাবে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলে তুমি? এ কদিন তো জোর করে ও রাজ তোমাকে নিয়ে যেতে পারছিল না। তাহলে আজ কেন যাবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছো? আর এভাবে বসে আছো কেন? আমাদের কথার উত্তর দাও মা! তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? নাকি তোমাকে কেউ কিছু বলেছে বলো মা?
আম্মুর কথার উত্তরে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বেশ কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলাম আমি,
–আম্মু ভাইয়ার বিয়ের দিন তুমি’ই আমাকে বলেছিলে মেয়েদের বিয়ের পর তাদের আসল ঠিকানা হয় শ্বশুরবাড়ি। তাহলে আজ কেন আমাকে এভাবে যেতে দিচ্ছো না তোমরা? আর তাছাড়া এখানে এসেছি আমি 10 দিনের বেশী হলো। তাহলে এখন কি আমার নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়া উচিত নয়? বিয়ে হয়েছে তো বেশিদিনও হয়নি। যদি সারাক্ষণ শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়িতেই পড়ে থাকি, তাহলে আশেপাশের মানুষ কি বলবে বলো তো? পরে আমার স্বামীর বদনাম হবে। আর আমি সেটা চাইনা। তাই আমাকে তোমরা বাধা দিও না প্লিজ। আমাকে যেতে দাও আমি এখনি ও বাড়িতে যাব, মানে এক্ষুনি যাব। আর কারো কোন কথা শুনতে চাই না। রাজ আপনি কি আমাকে নিয়ে এখন যাবেন? নাকি আমি নিজে নিজেই চলে যাব?
আমার কথা শুনে আব্বু কিছু না বলে রেগে গিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। আম্মু কি বলবে হয়তো বুঝতে পারছে না। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এবার ভাইয়া বেশ রাগী গলায় আমার কাছে এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
— আচ্ছা সত্যি করে বলতো পুচকি তোকে কি কেউ কিছু বলেছে? তুই হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিস কেন? আজকে সন্ধ্যা অব্দি তো সব ঠিক ছিল, তাহলে হঠাৎ কী হলো তোর?
ভাইয়ার কথার উত্তরে আমি ভাইয়ার দিকে না তাকিয়ে রাজের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বললাম,
— আপনাকে আমি কিছু বলছি, আপনি কি কানে শুনতে পান না? নাকি বিয়ে করার পর বউকে শ্বশুর বাড়িতে ফেলে রাখার ইচ্ছা আছে? এমনটা হলে বলে দিন আমি কালকেই উকিল নিয়ে এসে আপনার আশা পূরণ করে দেব।
আমার কথার উত্তরে রাজ দ্রুত এসে আমার হাত থেকে কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে বললো,
— তুমি এস আমি গাড়িতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। বলেই সকলের থেকে বিদায় নিয়ে সে বাইরে বের হয়ে গেল। তাকে এভাবে ভয় পেতে দেখে এবার বেশ হাসি পেল আমার। কিন্তু হাসিটা চেপে গিয়ে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম বাসা থেকে। তারপর গাড়িতে গিয়ে রাজের পাশের সিটে চুপ করে বসে পড়লাম।
রাজ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল। গাড়ি চালাতে চালাতে একটু পর পর আমার দিকে বারবার ফিরে তাকাচ্ছে ও। এভাবে অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর আমি ওর দিকে তাকিয়ে জোরে করে বলে উঠলাম,
–গাড়ি থামান, আমি বলছি গাড়িটা থামান।
আমার কথা শুনে গাড়ি ব্রেক করলো উনি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
— আবার কি হলো?
আমি রাগী চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলে উঠলাম,
— আপনার সমস্যাটা কি হ্যা? গাড়ি চালাবেন নাকি আমাকে দেখবেন? যদি আমাকে দেখতে হয় তাহলে গাড়ি থামিয়ে রেখে দেন। আমি আপনার সামনেই বসে আছি মন ভরে দেখে নেন। তারপর সামনে দেখে গাড়ি চালান। এভাবে গাড়ি চালিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে মেরে ফেলতে চান নাকি আমাকে?
আমার কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললেন উনি। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। এবার আর একটিবারের জন্যেও আমার দিকে ফিরে তাকাননি উনি। কেন জানি না খুব দ্রুতই রাগ উঠে যায় আমার। আর সেই রাগটা কন্ট্রোল করতে পারি না সোজাসুজি ঝেড়ে ফেলি সামনের মানুষটির উপর।বিয়ের পর এই কিছুদিনে রাজ বেশ ভালোভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছে আমার রাগের কারনে। তবে ও কখনো রাগ দেখায় নি আমায়। বরং সব সময় নিজের ভালবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে।
————————–
রাতের সব প্রয়োজনীয় কাজগুলো শেষ করে শুয়ে পড়েছে রাই আর রাকিব। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলে নিরবতা কাটিয়ে রাকিব কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো রাই,
— তোমার বোনটা আমার ভাইয়াকে একদম নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো। আজকে ভাইয়ার অবস্থাটা দেখেছিলে একবার?
— হুমম দেখেছি রাজের অবস্থাটা। কিন্তু আমি একটা জিনিস’ই বুঝতে পারিনা, রাজ এত রাগী একজন মানুষ হয়েও কিভাবে আমার বোনকে দেখে এত ভয় পায়? আরে বউ কি কোন ভয় পাওয়ার জিনিস হল নাকি? আমি রাজকে দেখে সত্যিই অবাক হই। এত রাগি আর হ্যানসাম একটি ছেলে হয়ে নিজের বউকে দেখে এতটা ভয় পায় ও।
রাকিবের কথা শুনে পাশ থেকে ভাব নিয়ে বলে উঠল রাই,
— শুধু ভাইয়ার কথা কেন বলছ? তুমিও তো আমাকে দেখে কম ভয় পাও না? একচুয়ালি দুনিয়ার সব পুরুষই তার বউকে দেখে ভয় পায়। তারা সারা দুনিয়ার কাছে সাহসী হলেও ঘরের বউ এর কাছে তারা একদম হুলো বিড়াল বুঝলে?
রাই এর কথা শুনে বুক ফুলিয়ে বলে উঠলো রাকিব,
— কে বলেছে আমি তোমাকে দেখে ভয় পাই? হ্যা কে বলেছে? আরে বউ কি কোনো ভয় পাওয়ার জিনিস হলো নাকি হুহহ? আমি তোমাকে দেখে একটুও ভয় পাইনা।
রাকিবের কথা শুনতেই চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে উঠলাম রাই,
— কি বললে তুমি? তুমি আমাকে দেখে ভয় পাও না?
রাইয়ের চোখ রাঙ্গানো দেখে এবার শুকনো ঢোক গিলে রাইকে বুকে আগলে নিয়ে বলে উঠল রাকিব,
— ইয়ে মানে আসলে, হয়েছে কি জানো? পৃথিবীতে যে পুরুষই তার বউকে অনেক বেশি ভালবাসে! তারাই বউকে দেখে একটু হলেও ভয় পায়। আসলে এটা ভয় পাওয়া নয়, বরং ভালোবাসার টানে তারা এরকম করে। যেমন আমিও তোমাকে দেখে ভয় পাই। কারন তোমাকে অনেক ভালোবাসি যে তাই।
রাকিবের কথা শুনে মুচকি হেসে ওর বুকে মাথা লুকালো রাই। তারপর দুজম মিলে ভালোবাসা রাজ্যে পারি জমালো।
—————————
বাসার সামনে এসে গাড়ি থামতেই গাড়ির দরজা খুলে একাই বেরিয়ে পরলো রাহি। তারপর রাজের অপেক্ষা না করে দ্রুত গিয়ে বাসার মধ্যে ঢুকে পড়ল। রাজও আর দেরি না করে গাড়ি থেকে নেমে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাসার ভিতর দিকে রওনা দিলো। দুজন মিলে বাসার মধ্যে ঢুকতেই দেখতে পেল সোফার উপর বসে থেকে মোবাইলে কিছু একটা করছে আরিশা। আরিশাকে দেখে দুজনেই বেশ অবাক হয়ে গেল। আরিশা পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সামনে তাকিয়ে রাহি এবং রাজকে দেখে বেশ চমকে উঠলো। তারপর তখন’ই নিজেকে আবার সামলে নিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— তোমরা তাহলে এসে গেছো? আমি সেই কখন থেকে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি এখানে। ভেবেছিলাম এয়ারপোর্ট থেকে ডাইরেক্ট এখানে এসে তোমাদের সারপ্রাইজ করে দেবো। কিন্তু দেখো উল্টো নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম। সেই কখন থেকে একা একা বসে রয়েছি তোমাদের অপেক্ষায়। এক্ষুনি ভাবছিলাম রাজ কে ফোন করবো। আর তোমরা এসেছ।
আরিশার কথা শুনে দুজনেই হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। তারপরে ওর হাত ধরে বলে উঠলাম আমি,
— খুব ভালো করেছো আরিশা। তোমাকে অনেক মিস করেছি জানো। কতদিন হল দেখি না তোমায়। তা হঠাৎ এভাবে চলে আসার মানে কি বলতো?
আরিশা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার রাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
— মানেটা আর কিছুই নয়, তোমাদেরকে অনেক বেশি মিস করছিলাম তাই আর থাকতে না পেরে চলে আসলাম তোমাদের মাঝে। আসলে তোমাদের জীবনের সাথে তো আমার জীবনটাও গাঁথা। মানে বন্ধুত্ব বলতে পারো, তোমার বন্ধু রাজের বন্ধু। তাই তোমাদের ছেড়ে কি থাকতে পারি বিদেশে একা? তাই ভাবলাম বিদেশে না থেকে দেশেই থাকি তোমাদের সাথে। নিজের ভালো সময়ও কাটবে সাথে আর মিস করাটাও হবে না।
আরিশার কথা শুনে রাজ মুচকি হেসে বলল,
— খুব ভালো করেছো আরিশা , আমরাও তোমায় অনেক মিস করতাম। যাও তুমি তোমার ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে গিয়ে গেস্ট রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমরাও রুমে যাই।
— তা তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে শুনি? রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে গিয়েছিলে বুঝি?
— আরে না তেমন কিছুই নয়। আসলে রাই এর বেবি হবে তো সেই খুশিতে আমি এ কয়দিন বাবার বাড়িতে ছিলাম। আর রাজও আমার সাথে সেখানেই ছিলো। কিন্তু অনেকদিন হল ওখানে রয়েছি বলে এখন চলে আসলাম।
আমার কথা শুনে বেশ কিছুটা অবাক হয়ে বলে উঠল আরিশা,
— ওয়াও জাস্ট এ সারপ্রাইজ। রাই প্রেগনেন্ট? শুনে অনেক ভালো লাগলো। আমি তো জানতামই না কিছু। তো তোমরা হঠাৎ এই সময় কেনো বাবার বাড়ি থেকে আসলে? এত রাতে না এসে সকালবেলা ও তো আসতে পারতে?
আরিশার কথার উত্তরে আমি কিছু বলার আগেই রাজ বলে উঠলো,
— আসলে আমার সকালবেলা অনেক কাজ থাকে অফিসে। ইদানীং অনেক পেশার কাজের। তাই আমি ওকে নিয়ে এলাম সকাল বেলার ঝামেলা যাতে নয় হয়। তাই রাতে নিয়ে আসাই ভালো মনে হলো। এখন কথা না বাড়িয়ে যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি রহিমাকে বলছি তোমাকে খাবার দিয়ে দিতে। খেয়ে শুয়ে পড়ো।
আর আমরাও খুব টায়ার্ড, তাই আমরাও এখনই শুয়ে পড়বো।ও বাসা থেকে ডিনার করে এসেছি।
কথাটি বলে আরিশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমার হাত ধরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো রাজ। আমিও আর কিছু বললাম না রাজের সাথে রুমের দিকে চলে আসতে লাগলাম। হঠাৎ থেমে গিয়ে রহিমাকে ডেকে আরিশাকে ডিনার রেডি করে দিতে বললো রাজ। তারপর আমায় নিয়ে আবারও রুমের দিকে পা বাড়ালো।
(রহিমা আমাদের নতুন কাজের মেয়ে। বয়স ২৪ থেকে ২৫ বছর হবে হয়তো। মেয়েটি অনেক মিষ্টি আর ভোলাভালা টাইপের। কাজেও বেশ পারদর্শী। বাসার সব কাজ একা হাতেই সামলে নেয় সে। পৃথিবীতে ওর আপন বলে কেউ নেই।)
রুমে এসে হাতের ব্যাগ টা পাশে রেখে দরজা লাগিয়ে দিল রাজ। তারপর শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ওকে এভাবে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে এবার বেশ ভয় করতে লাগল আমার। তাই একপা একপা করে পিছন দিকে পেছাতে পেছাতে বলতে লাগলাম,
— ক কি কি হয়েছে আপনার? এভাবে আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন?
উনি কোন উত্তর না দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে ভয় পেতে দেখে হাসতে হাসতে ওয়াশ রুমে চলে গেল। আর একটু হলেতো প্রাণটাই বেরিয়ে যেত আমার। এভাবে কেউ ভয় দেখায় নাকি? ভীষণ রাগ উঠে গেল আমার। মনে মনে বললাম, “একবার ওয়াশরুম থেকে বের হও চান্দু তারপর মজা দেখাবো তোমায়।”
চলবে,,,,,,,
You are my property
Part 42
M Sonali
আকাশে আজ বিশাল বড় একটি থালার মত চাঁদ উঠেছে। আর ঐ চাঁদের মিষ্টি জ্যোৎস্না আলোকিত করে তুলেছে সারা পৃথিবীকে। সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের রুমের মাঝেও। বেলকুনির জানালা ভেদ করে আলো এসে পড়েছে রুমের মাঝে। আমি রুমের মধ্যের লাইট অফ করে দিয়ে রুমের মাঝে পায়চারি করে চলেছি রাজের অপেক্ষায়। সেই আধ ঘন্টা আগে ওয়াশরুমে ঢুকেছে উনি। এখনো যেন বের হওয়ার নামই নেই তার। আমি যে তাকে মজা দেখাতে চাই সেটা কি উনি জেনে গেছে নাকি? কথাটা ভাবতেই মাথার মধ্যে ঘুরে উঠলো আমার। তাই আর দেরি না করে সোজা চলে গেলাম উনার ওয়াশ রুমের দরজার সামনে। তারপর দরজায় বেশ কয়েকবার টোকা দিলাম কিন্তু না, ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এবার অনেক বেশি বিরক্ত ফিল করতে লাগলাম আমি। ধুর আর ভালো লাগেনা। কথাটি ভাবতেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন উনি। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বললেন “কি হয়েছে, আমি কেনো এভাবে ডাকছি”। ওনার ইশারাতে কি বলবো বুঝতে পারছিনা আমি। তাই আমিও ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম “কিছু না এমনি”। তারপর সোজা ওনাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে ওয়াশরুমের মাঝে ঢুকে পড়লাম। কেন জানি না ওনাকে হঠাৎ করে এভাবে সামনে দেখে আর কিছু বলার মত সাহস হলো না আমার। তাই ওয়াশরুমে আসলাম সাহস যোগাতে। ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে সাহস দিতে লাগলাম বেশ কিছুক্ষণ। এখন হবে মজা মিস্টার রাজ চৌধুরী। আপনাকে আজকে আমি দেখাবো মজা কাকে বলে।
মনে সাহস সঞ্চয় করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম উনি সোফার উপর বসে ল্যাপটপ নিয়ে কি যেনো কাজ করছেন। আমি গুটি গুটি পায়ে ওনার সামনে এগিয়ে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে ওনার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে এভাবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে এক নজর তাঁকিয়ে, তারপর আবারো ভাবলেশহীন ভাবে ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ দিলেন। ওনার এমন ভাবলেসহীনপনা দেখে এবার অসম্ভব রাগ হতে লাগলো আমার। এই মুহূর্তে ল্যাপটপটা কে নিজের চরম শত্রু বলে মনে হচ্ছে আমার। যেন মনে হচ্ছে উনার কাছে আমার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই ল্যাপটপটা। মনে হচ্ছে এই ল্যাপটপটাই যেন আমার সতীন। রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে আমার। তাই আমি আর একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে এবার শব্দ করে কাশি দিয়ে উঠলাম। কিন্তু না এতেও কোন কাজ হলোনা। উনি সেই একি ভাবে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কাজ করে চলেছেন। বড্ড বেশি রাগ হচ্ছে এবার আমার। তাই গিয়ে ধপ করে উনার পাশে সোফায় বসে পরলাম আমি। আমাকে এভাবে পাশে বসতে দেখে একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন উনি। তারপরে আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আবারো ল্যাপটপে মনোযোগ দিলেন। এই মুহূর্তে ইচ্ছা করছে উনার মাথার চুলগুলো সব একটা একটা করে টেনে টেনে ছিঁড়ি আমি। এতটা রাগ হচ্ছে আমার। কিন্তু না সেটা তো সম্ভব নয়। তাই এবার আরো জোরে শব্দ করে কাশি দিয়ে উঠলাম আমি। তার পরেও উনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। তাই এবার রাগ দেখিয়ে ওনার হাত থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে ঠাস করে বন্ধ করে সোফার উপর রাখলাম। তারপর ওনার সামনে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে কর্কশ গলায় বললাম,
— সমস্যা কি আপনার?
আমার প্রশ্নের উত্তরে উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
— আমার সমস্যা কি মানে? তোমার সমস্যা কি তুমি কেন এমন করছো রাহি? এনি প্রবলেম?
— হ্যাঁ প্রবলেম, অনেক অনেক বড় প্রবলেম। আপনি মানুষটাই একটা প্রবলেম। বুঝলেন? আমি যে সেই কখন থেকে আপনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি। সেদিকে আপনার কোনো খেয়াল আছে? তা না আপনি তো সেই ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে আছেন। বলি ল্যাপটপের মাঝে পেয়েছেন কি হ্যা? কি পেয়েছেন আপনি? আমার থেকে ল্যাপটপ টাই আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই না? আমার কথা শোনার কোন টাইম নেই আপনার কাছে? তাহলে বলে দিন আমি এক্ষুনি চলে যাব আমার বাবার বাড়ি। আর কখনো আসবো না আপনার কাছে। আমি সেই কখন থেকে আপনার সাথে কথা বলার ট্রাই করে চলেছি। আর আপনি ভাবলেশহীনভাবে অন্যদিকে গুরুত্ব দিয়ে রয়েছেন। এটা আমি মানবো না। কিছুতেই মানবোনা। কি পেয়েছেন কি আপনি হ্যা, কি পেয়েছেন।
এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে তারপর থামলাম আমি। তারপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম। উনি চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছেন। ওনার মাঝে কোন রকম ফিলিংস দেখতে পাচ্ছি না আমি। উনার মনে কি চলছে কিছুই যেন বুঝতে পারছি না। ওনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরো বেশি রাগ উঠে গেল আমার। আমার কথার উত্তর না দিয়ে উনি কেন এভাবে হামলার মতো তাকিয়ে আছে আমার দিকে? আজব তো! আমি আবারও রাগী গলায় উনাকে কিছু বলতে যাবো, তার আগেই উনি আমার হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে নিলেন। তারপর আমার চুলের মাঝে হাত গুজে দিয়ে ঘোর লাগানো কন্ঠে বললেন,
— এখন বল কি বলতে চাও। আমি সব শুনতে চাই।
আচমকা ওনার এমন কান্ডে শক খাওয়ার মত চুপ করে গেলাম আমি। এখন কি বলবো কিছুই যেন মাথায় আসছে না আমার। কথাগুলো যেন পেটের মধ্যেই আটকে গেল। মুখ পর্যন্ত আর পৌঁছালো না কিছুতেই। তাহলে কি উনি এভাবে আমাকে সায়েস্তা করতে চান? আমার আর কোন কিছু বলা সম্ভব হবে না। আমি মনে মনে সাহস সঞ্চয় করতে লাগলাম এভাবে চুপ করে থাকলে তো হবে না। আমার আগে রাই কেন মা হতে চলেছে? ওর আগে বিয়ে হয়েছে আমার, তাহলে কেন ও আমার আগে মা হবে? এটা তো আমাকে বলতেই হবে ওনাকে। কিন্তু কিভাবে বলবো আমি? উনি আমাকে যেভাবে আকড়ে ধরে বসে মাথায় হাত গুজে রেখেছেন। এভাবে তো কোন কথাই আমার পেট থেকে মুখ পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষমতা নেই। আমাকে চুপ করে ভাবতে দেখে উনি আবার ও ঘোর লাগানো গলায় বলে উঠলেন,
— কি হলো কি যেনো বলবে আমায় বলছিলে? তাহলে এভাবে চুপ করে আছো কেন? বল কি বলবে? আর শোনো তোমার চাইতে ইম্পর্টেন্ট পৃথিবীতে আমার কাছে দ্বিতীয় আর কোন কিছুই নেই। তোমার জায়গায় অন্য কেউ নিতে পারবে না। আর ল্যাপটপ তো দূরের কথা। এখন বল কি বলতে চাও আমি সারারাত ধরে তোমার সব কথা শুনতে চাই।
ওনার এইটুকু কথাতেই যেন আমার সব রাগ পানি হয়ে গেল। কি বলব কি করব কোন কিছুই মাথায় আসছে না আমার। আর কোন কিছু বলার উপায় নেই। এভাবে কথা বললে কি কিছু বলা যায় না কি। আমি ওনার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলাম,
— আ আ আমাকে ছাড়ুন। ক কা কাজ আছে আমার।
আমার কথা শুনে উনি আমার কোমর আরো শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলেন,
— ছাড়বো কেন, আগে বল কি বলতে চাও আমায়? আর এত রেগে আছো কেন তুমি? ও বাড়ি থেকে এভাবে নিয়ে এলে কেন হঠাৎ? বাবা-মা রাকিব ভাইয়া কি মনে করলো বলতো?
ও বাড়ির কথা শুনতেই রাই এর বলা কথাটা মনে পড়ে গেল আমার। আমি এক ঝটকায় উনার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর কোমরে হাত দিয়ে রাগী গলায় বলে উঠলাম,
— নিয়ে এসেছি বেশ করেছি। আপনার বিচার করবো বলে নিয়ে এসেছি আমি। আপনি বলুন ভাইয়া আর রাই এর তো আমাদের পরে বিয়ে হয়েছে তাই না? আমাদের বিয়ে তো ওদের বিয়ের অনেক আগে হয়েছে তাই না? তাহলে রাই কেনো আমার আগে মা হতে চলেছে? আমি কেন হলাম না? আমাদেরও তো এতদিনে একটা বেবি হওয়ার কথা তাই না? তাহলে আমি কেন মা হচ্ছি না? বলুন আমাকে, এটা আমি মানতে পারছি না। মানতে পারব না। আপনাকে বলতে হবে জবাব দিতে হবে কেন হল এমন?
আমার কথা শুনে উনি ভূত দেখার মত করে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। উনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ অসস্তি বোধ হতে লাগলো আমার। আমি ওনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,
— কি হয়েছে? আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন আমার দিকে? উত্তর দিন আমার কথার?
উনি কোন উত্তর না দিয়ে এবার আমার সামনে উঠে দাঁড়ালো। উনাকে দাড়াতে দেখে আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম। উনি আমার দিকে গুটি গুটি পায়ে এগোতে লাগলেন। আমিও ধীরে ধীরে পেছনে যেতে লাগলাম। এভাবে যেতে যেতে একসময় আমি দেয়ালের সাথে গিয়ে আটকে গেলাম। উনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে দুদিকে হাত রেখে আমাকে মাঝখানে আটকে দিয়ে বলে উঠলেন,
— লাইক সিরিয়াসলি রাহি? তুমি এজন্য রাগ দেখিয়ে ও বাসা থেকে চলে এলে এত রাতে?
— ত তা নয়তো কি হ্যা, তা নয়তো কি? রাই কেনো আমার আগে মা হবে? আমার কেনো বেবি হবে না?
আমার কথা শুনে উনি স্থির দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর হঠাৎ করেই জোরে শব্দ করে হাসিতে হাসতে বিছানার উপর গিয়ে পড়ে গেল। ওনাকে এভাবে হাসতে দেখে মেজাজ টা যেন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল আমার। ইচ্ছে করছে উনাকে খুন করে ফেলতে। আমি দ্রুত ওনার কাছে এগিয়ে গিয়ে ওনাকে কিল ঘুষি মারতে লাগলাম। রাগে যেন শরীর জ্বলছে আমার। আমার এত সিরিয়াস মুডের সময় উনি কিনা হাসছেন? কেমন লোক উনি? আমাকে এভাবে মারতে দেখে উনি আমার দুই হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে আমাকে উনার বুকের উপর ফেলে দিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠলেন,
— তাহলে চলো তোমার কোলে বেবি আনার জন্য মিশন শুরু করা যাক।
ওনার এমন কথায় ড্যাবড্যাব করে উনার দিকে তাকালাম আমি। ওনার কথাটা বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল আমার। কিন্তু যতক্ষণে বুঝতে পারব তার আগেই উনি আমাকে আঁকড়ে ধরলেন নিজের বাহুডোরে।
——————————–
সকাল সাতটা। রাজ ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে এক কাপ কফি খেতে খেতে রহিমাকে ডেকে বললো ব্রেকফাস্ট রেডি করতে। আজ অফিসে একটি জরুরি মিটিং আছে। তাই সকাল সকালেই অফিসে যেতে হবে তাকে। রহিমাকে কথাগুলো বলে কফি মগ হাতে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল রাজ। তারপর পাশে পড়ে থাকা একটি ম্যাগাজিন নিয়ে পড়তে লাগল। সাথে কফি খেতে লাগল। তখনই গেস্ট রুম থেকে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলো আরিশা। ওকে ব্যাগ হাতে বেড়িয়ে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো রাজ। তারপর বলে উঠলো,
— কি হয়েছে আরিশা? এত সকাল-সকাল ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো তুমি?
ওর প্রশ্নের উত্তরে আরিশা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
— আসলে আমি নিজের বাসায় চলে যাচ্ছি আরিয়ান। শুধু শুধু তোমার এখানে থেকে কি করবো বলো। আর তাছাড়া আবারও আমি মেডিকাল কলেজে জয়েন করবো ভাবছি। বিদেশে তো আর করা হলো না। তাই দেশে থেকেই করবো।
— সেটা তো খুব ভালো কথা আরিশা। কিন্তু তুমি এখান থেকে কেন চলে যাচ্ছো? আর তাছাড়া আন্টিও তো এখন দেশে নেই। সে কবে ফিরবে সেটাও তুমি জানো না। তাহলে তুমি এখানেই থেকে যাচ্ছো না কেন? আর তাছাড়া তোমার মেডিকেল কলেজ টা ও তো এখান থেকে কাছে হবে। তোমার বাসা থেকে তো বেশ দূরে হয়ে যায়। এই বাসাতে শুধু আমরা একাই থাকি। তুমি থাকলে তেমন একটা সমস্যা হবে না। এখানেই থেকে যাও। তুমি থাকলে রাহিরও আর একা ফিল হবে না। সারাদিন ও একা একাই থাকবে, তুমি থাকলে তাও দুজন সময় কাটাতে পারবে একসাথে।
— কিন্তু আরিয়ান এভাবে তোমাদের এখানে থাকলে তোমাদের আবার যদি অসুবিধা হয়?
— আরে কিসের অসুবিধা হবে, কিছুই হবে না। তুমি এখানেই থেকে যাও সবার ভালো সময় কাটবে।
রাজের কথা শুনে চোখ মুখ খুশিতে চকচক করে উঠলো আরিশার। ও যেন রাজের মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার অপেক্ষাই করছিল। খুশিতে যেন মনটা লাফিয়ে উঠলো ওর। ও দ্রুত ব্যাগ নিয়ে আবার নিজের রুমে ফিরে গেল।ওকে ফিরে যেতে দেখে রাজ মুচকি হেসে ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেলো। তারপর রহিমাকে বললো রাহি উঠলে ওকে খাবার দিতে। আর ও অফিসে গেছে তা বলতে। তারপর ব্রেকফাস্ট শেষ করে অফিসের জন্যে বেরিয়ে পরলো রাজ। যাওয়ার আগে রুমে গিয়ে ঘুমন্ত রাহির কপালে ছোট করে ভালবাসার পরশ একে দিলো সে।
চলবে,,,,,,,,,,