#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_৩৬,৩৭
#আফিয়া_আফরিন
৩৬
যতই দিন যাচ্ছে, বাচ্চাটা আর বড় হচ্ছে ততই মা হওয়ার অনুভূতিটা জোরালো হচ্ছে। মায়া এখন স্পষ্ট ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে, তার ভিতরে আরেকটা প্রাণ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। তার ছোট ছোট হাত পা বেড়ে উঠছে। খুব ইচ্ছে করছে একবার চোখের দেখা দেখতে। কিন্তু সেটা তো আর এখন সম্ভব নয়, তাই মন প্রাণ খুলে উপলব্ধি করে নিচ্ছে অনুভূতিটাকে।
একটা মেয়ের কাছে এই মা হওয়ার প্রাপ্তি টা অনেক বড়, অনেক সম্মানের। এটা অনেক বড় অর্জন।
ইমনের দিকে তাকালে মনে হয়, সে কি দেখতে ইমনের মতো হবে নাকি তার মতো হবে? কাকে বেশি ভালবাসবে? বাবাকে নাকি মাকে?
নিজের ভালোবাসার মানুষের ছোট্ট একটা অংশ ধীরে ধীরে তার গর্ভে পালিত হচ্ছে, ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠে। একটা মেয়ে নারী হিসেবে পরিপূর্ণতা লাভ করে বিয়ের মাধ্যমে, আর পুরোপুরি পরিপূর্ণতা লাভ করে মাতৃত্বের মাধ্যমে।
তাদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে ইমনের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। বাবুকে নিয়ে এই করবে, সেই করবে। এমন কি বড় হলে কোন স্কুলে ভর্তি করাবে সেটা পর্যন্ত ঠিক করে রাখছে! কি একটা অবস্থা?
মায়া মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সে বাবা হবে বলে এসব পাগলামির সত্যি কোন মানে আছে? অবশ্য ইমনের এসব পাগলামিতে মায়া নিজেই মনে মনে হাসে। নিজেকে তখন বড্ড সৌভাগ্যবতী মনে হয়!
সেদিন সকাল বেলা জাহানারা ফোন করলো মায়াকে।
“কিরে গতকাল যে চেকআপ করালি, রিপোর্ট কি আসছে?”
“সবকিছু নরমাল মা। টেনশন করো না।”
“না। টেনশন এর কি আর তুমি বাকি রেখেছো? তা তুই নাকি আসবি না?”
“এতটা পথ জার্নি করে আসতে চাচ্ছি না মা। আমি ঠিক আছি তো এখানে। তুমি যদি মনে কর এখানে আমার খেয়াল রাখা হচ্ছে না, তাহলে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা মা। সবাই তো পারলে ২৪ ঘন্টাই আমার সাথে লেপটে থাকে।”
“নারে আমি সে কথা বলিনি? আমি তো জানি ওখানে তোর কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু এখানে আসলে আমি একটু শান্তি পাইতাম।”
“বুঝছি মা। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার যাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে না। এখানে থাকতে থাকতে এই পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন কি আর যেতে মন চাইবে বলো?”
“আচ্ছা থাক। আমি আর তোর বাবা না হয় যাব কিছুদিনের জন্য।”
মায়া লাফিয়ে উঠে বলল, “সত্যি? কবে আসবে তোমরা?”
“আসবো। হয়তো সপ্তাহখানেক এর মধ্যেই। আর তুই এই অবস্থায় বেশি লাফালাফি করিস না, মা। খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো হচ্ছে তো?”
“একদমই খেতে ইচ্ছা করে না মা।”
“হ্যাঁ করবে নাই তো। নিজের জন্য না হোক, বাচ্চাটার কথা ভাবতে হবে। খবরদার খালি পেটে থাকবি না।”
“যথা আজ্ঞা। মেনে নিলাম।”
“ঠিকমতো ওষুধ পানি খাবি। নিয়ম মেনে চলবি।”
“আচ্ছা মা। তুমি একদমই টেনশন করো না। এখানে আমার নিয়মের কোন হেরফের হচ্ছে না।”
.
.
.
সন্ধ্যার পর ইমন বাড়ি ফিরলো। ইমন বাড়ি ফিরে আগে মায়ার কপালে একটা পেটে একটা চুমু খাবে। কপালের একটা মায়ার জন্য, আর পেটেরটা বাবুর জন্য। এখন এটা নিত্য দিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মায়া ইমনের এসব কর্মকাণ্ডে না হেসে কুল পায় না। একটা মানুষ বাবা হওয়ার আনন্দে কতটা ডেস্পারেট হয়ে যায়? কিনা কি করে নিজেও জানে না!
ইমন বাড়ি ফিরলে মায়ার মাথায় একটা ফাজলামি বুদ্ধি আসলো। ইমনের সাথে একটু মজা করবে বলে ওর সামনে গিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে দাঁড়ালো।
ইমন মায়ার এমন মুখশ্রী দেখি অস্থির চিত্র জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে? কোন সমস্যা হচ্ছে? পেটে ব্যথা করছে?”
“না।”
“তাহলে কি হইছে? ওরকম মুখ করে রেখেছিস কেন?”
“আমাকে চলে যেতে হবে।”
ইমন অবাক হল। বলল, “কোথায়?”
“বাসায়। আমার নিজের বাসায়।”
“কেন?”
“মা আজকে ফোন করে যেতে বলেছে। বলেছে মেয়েদের ফাস্ট ডেলিভারি বাপের বাড়িতে হয়।”
এমন কিছু বলল না। শুধুমাত্র শক্ত করে মায়া কে জড়িয়ে ধরল। ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বললো, “আমি তোকে কোথাও যেতে দিচ্ছি না। তুই আমার কাছেই থাকবি।”
মায়া হাসলো। ইমনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি চলে গেলে কি হবে?”
“আমি থাকতে পারবো না তোকে ছাড়া।”
মায়া পর মুহূর্তে কিছু একটা ভাবলো। মলিন কণ্ঠে বললো, “আচ্ছা বাচ্চাটা ডেলিভারি হওয়ার সময় যদি আমি চিরদিনের জন্য পর দেশে পাড়ি জমাই? কি করবে তুমি তখন?”
মায়ার কথাটা শুনে ইমনের মেজাজ সপ্ত সীমানায় পৌঁছালো।
মায়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “কসম করে বলছি, আজ যদি এই অবস্থায় না থাকতে তুই; স্রেফ খু’ন করে ফেলতাম তোকে আমি। আর যেন মরার কথা মুখেও আনিস না। আমার থেকে খারাপ কিন্তু কেউ হবে না। তুই আমার কাছেই থাকবি। থাকতে বাধ্য তুই আমার কাছে।”
বলেই ইমন রেগে মেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আচমকা ইমনের এই আচরণে হতবাক হয়ে গেল মায়া। সেতো ভুল কিছু বলে নাই। হ্যাঁ, হতেও তো পারে এমন কিছু!
ইমন খুব সহজে রাগে না। একবার রেগে গেলে তার মাথা ঠিক থাকে না। এবারও তাই হইছে। মায়ার বলা কথাটা একদম বুকের মধ্যে গিয়ে লাগছে। সত্যি কথা বলতে, ওর উপর যত টা না রাগ হচ্ছে; তার চেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে। সত্যি যদি এমন কিছু একটা হয়ে যায়? কি হবে তখন?
এখন মনে হচ্ছে বাচ্চাটা না হয় ভালো। সারা শরীর দর দর করে ঘামছে। অজানা আশঙ্কায় বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। আল্লাহর কাছে বারবার প্রার্থনা করছে, “আল্লাহ আমার ভালোবাসা আমার থেকে কোনভাবেই কেড়ে নিও না!”
হঠাৎই চোখ দুটো ভিজে আসছে। বুকের মধ্যে অদ্ভুতভাবে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। মায়া কেন তার মনে এই আশঙ্কা তৈরি করে দিল? এতদিন তো এই আশঙ্কা ঘুণাক্ষরে ও টের পায়নি।
ইমন সাদেই ছিল।
বেশ রাত হয়ে গেছে। ইমন বাড়ি ফিরছে না দেখে মায়া ওকে মেসেজ দিল, “কোথায় তুমি?”
ইমন মেসেজ পেয়ে সময় দেখে নিল। সাড়ে বারোটা পার হতে চলল। মায়া এখনো, এত রাত পর্যন্ত জেগে আছে? সে ‘আসছি’রিপ্লাই করে নিচে নামলো।
মায়া ওকে দেখা মাত্রই কানে ধরে বলল, “সরি।”
“বলে ফেলা কথা কখনো সরি বলে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।”
বলেই ইমন চুপচাপ শুয়ে পড়ল। মায়া ও পাশে শুয়ে পড়ল। বুঝল যে, ইমন এখনো রাগ করেই আছে। মায়া নানান ভাবে ইমনের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
ইমন বললো, “এসব বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়। কাল সম্ভবত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। চেকআপের জন্য।”
“তোমার বুকে ঘুমাবো!”
“আয়!”
বলেই ইমন মায়াকে এক হাতে জড়িয়ে বুকের উপর শুয়ে দিয়ে, চুলে বিলে কেটে দিতে লাগলো। এক সময় ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো দুজন।
.
.
সকালবেলায় ইমন মায়াকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। মায়া রেডি হয়ে বসে আছে। ইমন কোন কথাই বলছে না। মায়ায় গিয়ে পেছন থেকে ইমনের চুল টেনে দিয়ে বলল, “কি হলো? কিছু বলছ না কেন? আমার সাথে কথা বলছো না কেন? রাগ পড়ে নাই এখনও?”
“রাগ করি নাই, তো রাগ পড়ার কথা আসছে কোথা থেকে? আমার তো রাগ করতে মানা।”
“তাহলে একটু হাসো প্লিজ।”
“আমি হাসতে পারি না।”
মায়া ভেংচি কেটে বললো, “রামগরুড়ের ছানা, এদের হাসি থাকা মানা!”
ইমন ভুরু কুঁচকে তাকালো কিন্তু কিছু বলল না।
মায়া পুনরায় বলল, “শোনো, এমন রাগ করে থাকলে কিন্তু আমি আজ ই মাকে ফোন করে বলবো আমাকে যেন এখান থেকে এসে নিয়ে যায়।”
এমন একটু এগিয়ে এসে আলতো করে ওকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলল, “সামান্য রাগ করে থাকার সুযোগটাও দিবি না তাই না?”
মায়া হেসে উঠলো খিলখিল করে।
মায়ার হাসি দেখে ইমন ও হেসে ফেলল। সামান্য একটুখানি রাগ মূহুর্তে উড়ে গেল।
.
.
.
হাসপাতালে গিয়ে কয়েকটা টেস্ট করালো। সবই ঠিকঠাক নরমাল। বাচ্চা এবং মা দুজনই সুস্থ আছে। ইমন আর মায়া যখন বাড়ি ফিরছিল, মায়া তখন ইমনের হাত থেকে রিপোর্টগুলো নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল। ইমনও ফাজলামি করেই দিচ্ছিলো না।
মায়া বলল, “সিরিয়াস কিছু?”
“বলবো না।”
“বলোনা প্লিজ। সিরিয়াস কিছু কি হইছে আমার?”
“বাসায় চল তারপর বলতেছি।”
বাসায় গিয়ে এমন ফাইল থেকে কাগজপত্র গুলো বের করে বারান্দায় চলে গেল। যাওয়ার আগে একটা এক্সট্রা কাগজ আর কলম নিতে ভুললো না।
মিনিট দশেক পর মায়ার সামনে এসে হাজির হলো। চিরকুট একটা হাতে দিয়ে বলল, “এইনে রিপোর্ট!”
মায়া কাগজটা নিয়ে পড়া শুরু করল,
‘এই যে মাই ডিয়ার মাম্মাম’
কি শুনলাম হ্যাঁ? তুমি নাকি আমার বাবাকে খুব জ্বালাচ্ছো? উল্টোপাল্টা কথা বলে নাকি হাই প্রেসার বাড়িয়ে দিচ্ছো? এসব কি শুনছি আমি? আর এমন করো না প্লিজ। আমি কিছুদিন পর এলে কিন্তু তোমার কাছে একদম থাকবো না। সব সময় আমার বাবার কাছে থাকবো।
তোমরা একদমই ঝগড়া করবে না। ঝগড়া করলে কিন্তু আমি আর আসবো না।
ইতি,
তোমাদের আদরের বাবু!’
চিঠিটা পড়ে মায়া ইমন এর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে দিল। চোখ থেকে আপনা আপনি পানি পড়ছে। কথাগুলো বোধহয় বাস্তবেই তাকে বললো। একদম বুকের মধ্যেখানে কথাগুলো গেঁথে রইলো।
#পর্ব_৩৭
.
.
.
যতই দিন যাচ্ছে, ‘অতিরিক্ত কেয়ারিং’ নামের অত্যাচারটা ক্রমে ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। মায়াকে কেউ কোন কাজে হাত লাগাতে দেয় না। এমনি নিজে যে এক গ্লাস পানি নিয়ে খাবে, মিমোর জন্য তাও করতে পারছে না।
এখন প্রেগনেন্সির পাঁচ মাস চলতেছে।
সেদিন সকাল-সকাল ইমন এসে মায়াকে বলল, “ঘুরতে যাবা?”
“কোথায় যাব?”
“এমনিতেই পাশের মাঠে।”
“এত সকালে?”
“হ্যাঁ। এটাই তো হাঁটার সময়। চলো হেঁটে আসি। রিফ্রেশ দরকার।”
“হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিকই বলেছ। আসলেই একটু রিফ্রেশ দরকার। ঘরের মধ্যে সারাদিন বসে থাকতে থাকতে আমি একেবারে পাগল ই হয়ে যাব। উঠলে বসতে দাও না, আর বসলে উঠতে দাও না।”
ইমন হাসলো। মায়ের হাত ধরে ড্রয়িং রুম পার হতে সুহাদা পেছন থেকে ডাক দিলেন, “কোথায় যাচ্ছিস এত সকালে তোরা?”
ইমন উত্তর দিল, “মা এই পাশের মাঠ থেকে একটু ঘুরে আসি। মায়া তো সারাদিন বাসায় বসে থাকে, ঘুরে আসুক ভালো লাগবে।”
তিনি একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর মায়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “যাচ্ছিস যা। কিন্তু সাবধানে যাবি। ইমনের সাথে সাথেই থাকবি।”
মায়া আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তোমরা সবাই এমন ভাব করছো যেন আমি সর্বপ্রথম পৃথিবীতে মা হতে যাচ্ছি? আমার আগে যেন কেউ কখনো মা হয় নাই? এবার কিন্তু তোমরা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছো।”
সুহাদা বললেন, “তুই প্রথমবার মা হচ্ছিস না, এ কথা যেমন ঠিক; তেমনি ও আমি প্রথম দাদু হচ্ছি এই কথা ও ঠিক।”
ইমনও মায়ের তালে তাল মিলিয়ে বলল, “আমিও প্রথম বাবা হচ্ছি।”
তৎক্ষণাৎ মিমো ও দৌড়ে এসে বলল, “আমিও প্রথমবার ফুপি হচ্ছি। আমাদের এক্সাইটমেন্ট তো একটু বেশি থাকবেই। একবার বাবুটাকে শুধু আসতে দাও না কেন, তারপর দেখো। আমি তো আমার কাছ থেকে তাকে ছাড়বোই না। ইশশ, আল্লাহ আল্লাহ করে এই পাঁচটা মাস যেন খুব তাড়াতাড়ি কেটে যায়।”
মায়া মাথায় হাত দিয়ে ধপাশ করে সোফায় বসে পড়ল। ইমন বললো, “আবার বসলে কেন? চলো।”
মায়া আর কথা বাড়ালো না। একেকজনের অবস্থা দেখে আর কিছুই বলার নেই। এতগুলো মানুষের বিশ্বাস ভরসা, যত্নআত্তি, ভালবাসার দাম সে দিতে পারবে তো?
.
.
.
ভোরের শিশির গুলো ঘাস ছুঁয়ে দিয়েছিল। সেই ভেজা ঘাসের উপর পা ফেলে হাঁটছে মায়া। মাঠের একপাশে ছোট কয়েকটা বাচ্চা ফুটবল খেলছে।
মায়া আর ইমন যে অন্য পাশে ভাঙ্গা গাছের গুড়ির উপর বসলো।
মায়া ও চুপচাপ বসলো। ইদানিং শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল লাগে। একটুতেই হাঁপিয়ে উঠে। তবে এখন আগেরকার থেকে মাতৃত্বের অনুভূতিটা বেশ দৃঢ় হয়েছে। তার ভিতরে বসবাসকারী জীবন তো পুতুলের হৃদস্পন্দন এখন স্পষ্ট পাওয়া যায়।
ইমন বললো, “এখন কি বাসায় যাবা? নাকি আরো কিছুক্ষণ থাকবা?”
“থাকি আমি। খারাপ লাগছে না তো। তোমার যদি জরুরী কাজ থাকে তাহলে যেতে পারো। আমি কিছুক্ষণ বসি।”
“না আমার আবার জরুরী কাজ কোথায়? তোমার সমস্যা হচ্ছে কিনা, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
মায়া হঠাৎ করে খেয়াল করলো ইমন তাকে তুমি তুমি করে ডাকছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে তুমি করে ডাকে। কিন্তু সেটা ক্ষণস্থায়ী।
তবে এইবার বেশ কিছুদিন ধরেই ইমন তাকে তুমি করে ডাকছে। ব্যাপারটা এতদিন নজরে আসে নাই। আজকেই খেয়াল হলো।
মায়া ইমনের দিকে ফিরে সোজা হয়ে বসে বলল, “আমাকে হঠাৎ তুমি তুমি করে বলছ কেন? কি হয়েছে?”
“কিছু হয় নাই। কেন তুমি করে বলা যাবে না!”
“যাবে, কিন্তু?”
“এর মাঝে আবার কিন্তু কিসের? বাচ্চাকাচ্চা হলে যদি দেখে বাবা তার মাকে তুই তুই করে ডাকছে, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখায়?”
“ও আচ্ছা! এতদূর পর্যন্ত ভাবনা শেষ। আচ্ছা শোনো, বাবু হলে বাবুর সামনে তুমি তুমি করে বলবা। এমনিতে যেরকম ডাকো সেভাবেই ডাকবে। তুমি করে ডাকলে কেমন লাগে? বহু দিনের পুরাতন ডাকটা কেমন অচেনা অচেনা লাগে!”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
“কিন্তু একটা কথা?”
“কি কথা?”
“তুমি যেহেতু এতো দূর পর্যন্ত ভেবে রেখেছো, তবে একটা ব্যাপারে কিন্তু এখনো কিছু ভাবো নাই।”
“কোন ব্যাপার?”
“বাবু হলে বাবুর নাম কি রাখবে? দুটো করে ঠিক করে রাখো।”
“নামধামের দরকার নেই আলাদা করে। বাবু হলে বাবুই নাম থাকবে। ছেলে হলেও বাবু, মেয়ে হলেও বাবু।”
“ধ্যাত! মেয়েদের নাম কখনো বাবু হয় শুনেছ?”
“কিন্তু বাবু ডাক শোনাটা তো তাদের অধিকার তাই না?”
“তা তো ঠিক। কিন্তু আজকালকার যুগের কিছু আপু মনিরা/ভাইজানেরা ছোট্ট ছোট্ট বাবুদের অধিকার খর্ব করে তাদের গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ডকে বাবু বলে ডাকে। বলোতো এটা কি ঠিক? ঘোর তোর অন্যায়!”
“আসলেই একদম অন্যায়। তারা কিভাবে বাবু হয়? বাবুদের মত কি তাদের ছোট ছোট হাত-পা থাকে? দাঁত বিহীন মারি বের করা হাসি থাকে?”
মায়া হেসে বলল, “এখন বসে নাম ঠিক কর।”
ইমন বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আমার নামের অক্ষরেই তো তাদের নাম হওয়া উচিত তাই না?”
“কেন? শুধু তুমি কেন? আমাকে বাদ দিচ্ছ কেন?” মায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।
“আরে না তোকে বাদ দেবো কেন? দাঁড়া, আমাকে ভাব তে দে।”
“আচ্ছা তাড়াতাড়ি।”
ইমন ভাবতে ভাবতে নামও পেয়ে গেল। মনের মত। মায়া এবং ইমন দুজনের নামের সাথেই মিলে যায়।
ইমন হেসে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “ছেলে হলে নাম হবে ইমাদ, মেয়ে হলে ইমা!”
মায়া পাল্টা একগাল হিসেবে বলল, “কনফার্ম!”
.
.
সন্ধ্যেবেলা সবাই একসাথে চা আড্ডায় বসেছে। মিমো টিভি দেখছে, মায়া একটা গল্পের বই হাতে নিয়ে বসে আছে, আর ইমন ফোন স্ক্রল করছে।
সুহাদা বললেন, “এই না একটু আগে বললি, অনেকদিন গল্প করা হয় না। আজ সবাই মিলে একটু আড্ডা দেই। কি তার নমুনা?”
ইমন বললো, “তোমরা কথা বলো। আমি নীরব দর্শক হয়ে শুনে যাচ্ছি।”
সুহাদা ইমন আর মিমো দুজনকে ধমক দিয়ে বললেন, “মিমো টিভি অফ কর আর ইমন তুই ফোন রাখ।”
ইমন বললো, “আচ্ছা মা তোমরা থাকো না। আমি ছেলেমানুষ, আমাকে তোমাদের মধ্যে থেকে বাদ দাও।”
“তোর কানের নিচে দুটো থাপড়ায় তারপর বাদ দিব। ফাজিল ছেলে কোথাকার!”
মিমো আর মায়া দুজনেই নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে সুহাদার পাশে এসে বসলো।
মিমো বলল, “মা ভাইয়া এত বড় হয়ে গেছে তাও তুমি বকো কেনো?”
মায়া বলল, “মায়েদের কাছে সন্তানরা কখনো বড় হয় না। তার মধ্যে ইমন এখন ও যে ফাজলামি গিরি করে, তাতে তো মা শুধু বকাই দেয়। আমি হলে তো পিটায়া পিঠের চামড়া তুলে দিতাম।”
ইমন ওর দিকে তাকালো। মিমো হাসতে হাসতে বলল, “তোমার বাবু হলে কি সে দুষ্টামি করলেও তুমি এমন করবে?”
“আমার বাবু শান্তশিষ্ট ভদ্র হবে। ওর মত নাকি?”
“বাবুর বাবাটা কিন্তু ভাইয়াই। তো ভাইয়ার মত হওয়াটা অস্বাভাবিক না। দোয়া করি, তোমাদের যাতে একটা মেয়ে বাবু হয়। বড় হলে আমি তারে চুল বেঁধে দিব। এত বড় বড় চুল হবে। পরি সাজিয়ে দিব।”
মায়া হাসলো। সুহাদা বললেন, “বাচ্চা একটা হলেই হল। খুশি হয়ে যেটা দেয়।”
মিমো এইবার হাতে তুড়ি বাজিয়ে বললো, “আপু রেডি হও এখন থেকেই। কেঁদে কেঁদে সারাদিন ওয়া ওয়া করে তোমার কলিজা ঝাঝড়া করে দেওয়ার জন্য সে আসছে। রাতের বেলা তোমার নাইট ডিউটি ফরজ করে ছাড়বে।”
মায়া হেসে বলল, “হ্যাঁ সারাদিন শুধু ভ্যা ভ্যা!”
ইমন এসে ওর পাশে ধপাশ করে বসে বলল, “ভ্যা ভ্যা!”
“কি? তুমি কেন ভ্যা ভ্যা করছো? বাচ্চা নাকি?”
“ভ্যা ভ্যা ভ্যা!”
“আরে কি মুশকিল।”
“ভ্যা ভ্যা!”
“মা তুমি ওর কানটা টেনে দাও তো।”
“ভ্যা ভ্যা!”
ইমনের কর্মকাণ্ডে হেসে ফেললো সবাই।
এক কথায় সুখী পরিবার। সুখ হলো বিচ্ছিন্ন কিছু অনুভূতির নাম। নিজের সুখটা নিজেদের মধ্যে থেকে এমনি করেই নিতে হয়। এটা কেউ কাউকে দিতে পারে না। টাকা দিয়েও তো কখনো কেনা যায় না।
.
.
.
সময়টা এভাবেই হেসে খেলে পার হচ্ছিলো। কিন্তু অঘটন টা ঘটল দুইদিন পর।
মায়া বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো ছিল। এমন সময় বেলকনি থেকে দেখতে পেল রিয়াদকে। নিচে এটা ইটের স্তূপ আছে। খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে এবং রক্ত বের হচ্ছে। ছোট বাচ্চা, অঝরে কেমন কাঁদছে। ওর কান্নার আওয়াজ বোধহয় ওপর পর্যন্ত, ওর মায়ের কানে যাচ্ছেনা। মায়া নিজেই নিচে নেমে এলো।
রিয়াদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে বাবা?”
“পায়ে ব্যথা পাইছি আন্টি।” রিয়াদ কাঁদতে কাঁদতে বলল।
“আচ্ছা বাসায় আসো। পা থেকে রক্ত বের হচ্ছে ড্রেসিং করে দেই।”
“আমি আম্মুর কাছে যাব আন্টি।”
“আচ্ছা চলো। নিয়ে যাই।”
রিয়াদ উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু হাঁটতে পারছে না। মায়া ওকে কোলে তুলে নিল। কোলে নিয়েই হেঁটে হেঁটে পাঁচতলা পর্যন্ত উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে গেছে। রিয়াদকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওর মায়ের সাথে গল্প করে তারপর বাড়ি ফিরল।
বাড়ি আসতেই শরীর প্রচন্ড দুর্বল লাগছিল। গিয়ে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ কেমন যেন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
এমন সময় মিমো এসে পাশে বসলো। মায়ার ঘর্মান্ত চোখ মুখ দেখে প্রশ্ন করল, “কি হইছে আপু? শরীর খারাপ করছে? মাকে ডাকবো কি?”
“আরে না। এমন কিছুই না। এই সময় এমন হয় স্বাভাবিক ব্যাপার। তুই আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিতে পারিস?”
“তুমি বসো। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”
মিমো পানি নিয়ে এসে মায়াকে দিতেই মায়া বলল, “তোকে কিছু না মনে করলে একটা কথা বলবো?”
“হ্যাঁ বলো। এভাবে বলার কি আছে?”
“আমি কিছুক্ষণ একা থাকি!”
মিমো অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ থাকো। এতে কিছু মনে করার কি আছে? সম্ভবত তোমার শরীরটা খারাপ লাগতেছে। কিছুক্ষণ বসে রেস্ট নাও। দরকার পড়লে অবশ্যই ডেকো।”
“আচ্ছা।”
মিমো চলে গেল।
কিন্তু একি? মাথাটা হঠাৎ এমন ঝিমঝিম করছে কেন? সবকিছু চোখের সামনে ঝাপসা হতে শুরু করেছে। মায়া বালিশ টেনে নিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, হাত পা কেমন যেন আটকে আসছে। অবশ হয়ে যাচ্ছে।
অব্যক্ত যন্ত্রণায় দেহের প্রতিটি হার অসাড় হয়ে যাচ্ছে। মাংসপেশিগুলো যেন চড়চড় করে ছিঁড়ে ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কলিজাটাও বুঝি ছিড়ে যাচ্ছে! কিন্তু এমন কেন হচ্ছে? হৃদপিণ্ড টা বোধ হয় শেষবারের মতো নিজেকে প্রবল ভাবে প্রকম্পিত করে নিচ্ছে! অজানা আশঙ্কায় বুকের মধ্যে ধুক পুক করছে। মায়ার এই মুহূর্তে কাউকে ডাকা উচিত। কিন্তু সে নিঃশ্বাসই নিতে পারছে না, সেখানে কাউকে ডাকবে কি করে?
রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এত রক্ত কি থাকে মানুষের শরীরে?
এমন সময় দরজার বাইরে থেকে ইমনের কণ্ঠ শোনা গেলো। ইমন এসেছে। হ্যাঁ, ইমনই তো!
মায়া শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে, চাপা গোঙ্গানির মতো শব্দ করে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো, “ইমন!”
.
.
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]