শূন্য_অনুভূতি পার্ট:”দশ”

শূন্য_অনুভূতি পার্ট:”দশ”
#রোকসানা_ইয়াসমিন

সাহিত্য বেশ কিছুক্ষণ ধরে বেলকণি তে দাঁড়িয়ে আছেন।উনাকে এভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি ধীরে ধীরে উনার পিছনে গিয়ে দাড়ালাম।আমার উপস্থিতি উনি টের পেয়েছেন।কিন্তু তবু নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
“আচ্ছা,আপনার কী মনে হয় না বাবা সবার সামনে নিজেকে যতটা হাসি খুশি দেখাতে চান উনি ভেতরে ততটাও সুখী নন।আপনার কী মনে হয় না উনার একটা নতুন জীবনের প্রয়োজন উনার সুখে থাকা প্রয়োজন।”
আমার কথায় মনে হলো উনার কোনো পরিবর্তন ঘটেছে বলে মনে হলো ন। উনি এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন।তা দেখে আমি উনার পাশে গিয়ে দাড়ালাম।
“কী হলো কিছু বলছেন না যে।আপনার কষ্ট হয় না বাবাকে এভাবে একা থাকতে দেখে।”
এবার উনি আমার দিকে এক পলক শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে যেতে চাইলে আমি উনার পথ আটকে ধরে চেঁচিয়ে উঠি,
“কিছু বলছেন না কেন আপনি?কষ্ট হয়না আপনার বাবার জন্য?”
আমার কথায় উনি এবার একটু বেশি ই রেগে গেলেন।চোখ মুখ লাল করে হঠাৎ করেই আমার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলেন,
“না.না কষ্ট হয় না আমার।শুনতে পেয়েছ তুমি।”
“কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে।”
আমার এমন কথায় উনি কিছুটা ভড়কে গেলেন।আমি অসহায় অসহায় ভাব নিয়ে বলে উঠলাম,
“আপনি সবসময় আমাকে শুধু কষ্ট দিয়েই কথা বলেন।কেন,একটু ভালোবেসে কথা বললে কী হয়?”
কথাটা বলতে বলতেই আমি উনার দুই হাত আমার বাহু থেকে সরিয়ে আমার কোমরে জড়িয়ে দিলাম।মূহুর্তেই উনার চোখের দৃষ্টি শান্ত হয়ে গেল।আমি হাল্কা হেসে দুই হাতে উনার গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম,
“হুম এবার বলুন।”
“হা…!”
কথাটা এমন ভাবে বলে উঠলেন যেন উনি সম্মিহিত হয়ে রয়েছেন।তাই আমি আবার বলে উঠলাম,
“বলুন,আপনার সত্যিই কষ্ট হয় না।”
এবার যেন উনার ধ্যান ভাঙল।আমার কোমর থেকে হাত সরিয়ে আমার আবার একই জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
“না কষ্ট হয় না আমার।”
ওনার কথায় আমি কিছুটা রেগে গিয়েই ওনার পাশে গিয়ে দাড়ালাম।
“কষ্ট হয় না?কষ্ট হয় না আপনার?তাহলে আমায় কেন বিয়ে করেছিলেন?এজন্যই তো কারণ আপনার বাবা আমায় পছন্দ করতেন।উনার মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য আপনি একটা অপরিচিত অজানা মেয়ে কে বিয়ে করেছিলেন যাকে আপনি ভালো পর্যন্ত বাসেন না।এতো সব কিছু কিসের জন্য তাহলে।যদি কষ্ট নাই হয় আপনার।”
আমার এমন কথায় উনি দম ধরে আমার দিকে তাকালেন।আমি আমার চোখে হাজার প্রশ্ন নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।কিছুক্ষণ পরই উনি আমার দিক থেকে নজর সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“মম যখন এক্সিডেন্টে মারা যায় তখন আমি খুব ছোট ছিলাম।মমের মৃত্যুর পর ফ্যামিলির সবাই ডেড কে দ্বিতীয় বার বিয়ের জন্য প্রেসারাইজ করতে থাকে।কিন্তু ডেড আর বিয়ে করবে না বলে ফ্যামিলির সকল কে ছেড়ে আমায় নিয়ে অনেক দূরে চলে আসে।তখন বুঝতে পারিনি আমাদের কেন নিজেদের পরিবারের থেকে দূরে চলে আসতে হলো।ধীরে ধীরে যখন বয়স বাড়তে লাগল তখন বুঝলাম ভালোবাসা কী?ভালোবাসা একটা যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু ই নয়।প্রতিদিনের ন্যায় হাসি খুশি ডেডকে যখন মধ্যরাতে মমের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে কাঁদতে দেখলাম।তখন বুঝতে পারলাম পরিবারের সবাই কেন ডেড কে দ্বিতীয় বার বিয়ের জন্য জোড় করছিল।একাকিত্বে থাকা যে বড়ই যন্ত্রণা দায়ক।তখন আমিও মনে প্রাণে চাইতে লাগলাম যেন ডেড আবার নতুন করে জীবন শুরু করে।কিন্তু আমি তার জীবনে থাকতে কখনোই এটা সম্ভব হবে না ভেবে আমি ধীরে ধীরে ডেডের সাথে নিজের দূরত্ব বাড়ালাম।কথায় কথায় কথা কাটাকাটি হতে লাগল। আমাদের মাঝের দূরত্ব বাড়তে লাগল।ভেবেছিলাম আমার উপর অতিষ্ঠ হয়ে হলেও ডেড আবার নিজের জীবনের কথা ভাবতে শুরু করবে।কিন্তু এমনটা হয়নি।উনি একা বাচতে শিখে গেলেন।এখন তো আমি উনার থেকে এতোটাই দূরে চলে এসেছি যে উনার কাছে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ ই আমার নেই।উনার চোখে চোখ মেলানোর সাহস টাও নেই।”
আমি উনার কথা শুনে অবাক চোখে উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“আপনি কী জানেন আপনি যেমন আপনার ভাবনা গুলোও ঠিক তেমনি।”
আমার কথায় উনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন।
“একবার ভাবুন যেই লোকটা চাইলেই নিজের জীবন নতুন করে শুরু করতে পারতেন সে শুধু মাত্র আপনাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে।তার জীবনে অন্য কারো নয় আপনার প্রয়োজন।আর বাবার কাছে যেতে হলে কোনো সাহসের প্রয়োজন হয় না।শুধু ছোট্টবেলার মতো বাবার পায়ে পা মিলিয়ে চলতে হয়।”
উনি আমার দিকে এক মুঠো আশাভরা চোখে তাকিয়ে রইলেন।আমি ধীরে ধীরে উনার কাছে গিয়ে উনাকে মৃদু জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম,
“বাবাকে একমাত্র আপনিই নতুন জীবন দিতে পারেন।দয়া করে পিছিয়ে আসবেন না।”
_____________________________________
আজ শুক্রবার।বাবা মাত্রই গোসল সেড়ে সাদা পাঞ্জাবী সাদা টুপি মাথায় দিয়ে নামাজের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ি তে বসলেন।বাড়ি থেকে মসজিদ অনেকটা দূরে হওয়ায় উনাকে গাড়ি করেই মসজিদ অবধি যেতে হয়।কিন্তু আজ উনার এই যাত্রা কিছু টা ভিন্ন হতে চলেছে।উনি গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট করতে যেতেই ওনার পাশের দরজা খুলে সাহিত্য গিয়ে উনার পাশে বসে পরলেন।উনি সাহিত্য কে এভাবে দেখে কিছুক্ষণ এর জন্য থমকে গেলেন। তারপর চট করেই গাড়ির জানালা ভেদ করে উনরে বেলকণির দিকে তাকালেন।আমি বেলকণিতে মৃদু হেসে দাঁড়িয়ে রয়েছি।আজ সত্যি বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তির অনুভব হতে লাগল।বাবা মৃদু হেসে আমার দিক থেকে নজর সরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করতে লাগলেন।আমি জানি এখন উনার বুকের ভেতরে কতটা তোলপাড় চলছে।উনারা যেতেই আমি লাঞ্চের সব কিছু টেবিলে সাজিয়ে রেখে আমি নিজেও নামায আদায় করে নিলাম।এরই মাঝে উনারা চলে এসেছেন।আমি নামায শেষ করে বসার ঘরে এসে দেখি দুই বাবা ছেলে একই সাথে টেবিলে বসে খেতে শুরু করে দিয়েছে।বাবা এটা ওটা ওর পাতে তুলে দিচ্ছেন।আর উনি খুব ভালোভাবেই তা অনুভব করছেন।আজ বাবা কে দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃত সুখী মানুষ।
চলবে❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here