#জুনিয়র_পদ্ম
পর্ব-০২,০৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
০২
নয়নতারা,টগর,পর্তুলিগ,গন্ধরাজ ফুল গাছ বারান্দায় টবে লাগানো।এর মধ্যে নয়নতারা আর গন্ধরাজ ফুল ফুটে আছে। নয়নতারা ফুলের মধ্যে একটা প্রজাপতি বসে আছে,পদ্মর ইচ্ছে করছে এই সুন্দর দৃশ্য টা ক্যামেরা বন্দি করে রাখতে কিন্তু কোথাও একটা বাধা কাজ করছে। মনের শান্তি টাই আসল,মনে অশান্তি সৃষ্টি হলে কিছুই ভালো লাগে না,তাই প্রজাপতির থেকে চোখ সরিয়ে বেখেয়ালি ভাবে দূরের রাস্তায় গাড়ি চলাচল দেখছে পদ্ম। দু-একটি রিকশা চলাচল করছে আর কয়েকজন মহিলা এবং পুরুষদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে, হয়তো সকালের এক্সারসাইজ করার জন্য বের হয়েছে। আবার কেউ দূরের পথ পারি দিতে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে।
পিছনে জায়ান এসে দাঁড়ায়,পদ্ম বুঝতে পারে কিন্তু কোন ভাবান্তর প্রকাশ করে না।জায়ান ক্ষীণ স্বরে বলে,
–“আজকের সকালটা স্বপ্ন ছিল একদিন আজকে সেটা পূরণ হলো”আলহামদুলিল্লাহ”। আপনি আমার পাশে থাকলে অন্য সব কিছু যেন তুচ্ছ মনে হয়!
–“কেন করলেন এরকম? আপনি খুব ভালো করে জানেন আমার পরিবার সম্পর্কে। তবুও এভাবে ঠকালেন ?
জায়ান অনুযোগের স্বরে বললো,
–“ইনশা আল্লাহ আমি আপনার পরিবারের যোগ্য জামাই হবো একদিন। শুধু আপনি আমাকে একটু সাপোর্ট দিলেই হবে।
–“আপনি খুব ভালো করে জানেন কিছুদিন পর পর আমার বিয়ের ঘর আসে! তখন আমি কি জবাব দিব?
–“কয়েকটা বছর ম্যানেজ করে নিতে পারবেন না? আপনি পড়াশোনায় ভালো করে মনোযোগ নিবেশ করেন তাহলে আর আপনাকে বিয়ের জন্য জোর করবে না।
পদ্ম’র খুব রাগ ওঠে, কারণ জায়ান খুব ভালো করেই জানে পদ্ম পড়াশোনা করতে চায় না! গতবছর করোনা পরিস্থিতির কারণে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটো পাশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রী। সেই বছর পদ্ম ও অটোপাশ করে, এরপর ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে থাকবে বলে ঠিক করে পদ্ম কিন্তু তেমন ভাবে পড়াশোনা করার ইচ্ছা নেই! ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনা সবচেয়ে বড় শত্রু পদ্ম’র। নিজের বাবার ভয়ে এই পর্যন্ত পড়াশোনা করে এসেছে। এখন বিভিন্ন স্থান থেকে বিয়ের ঘর আসছে,আর বিয়েই একমাত্র পদ্ম’র স্বপ্ন পূরণের পথ! তাই বিয়ে করে নিবে বলে ঠিক করে। কিন্তু যেখান থেকেই বিয়ের ঘর আসে না কেন, পাত্র’র থেকে পাত্র’র পরিবার কে পছন্দ হয় পদ্ম’র! একজন পাত্র কেও পছন্দ হয় না।
–“কি হলো পারবেন না আমার জন্য পড়াশোনায় মনোযোগ নিবেশ করতে?
জায়ানের কথায় ভাবনার সুতা কাটে পদ্ম’র। রাস্তায় চোখ নিবদ্ধ করেই বললো,
–“আমার সবচেয়ে কঠিন কাজ টাই আপনি করতে বলছেন!যেটা আমি কখনোই করতে পারবো না।
থমথমে মুখে বারান্দার গ্রিলে হাত রাখে জায়ান।এ বাড়ির দক্ষিণ কোনায় একটা নিম গাছ আছে,যার একটা ছোট ডালে বসে আছে দুটো জোড়া বুলবুল পাখি। পাখি দুটোর মধ্যে গভীর মনোনিবেশ করে জায়ান।জায়ানের মনে হচ্ছে পাখি দুটো খুব সুখী দাম্পত্য, ভালো জীবন কাটাচ্ছে!একে অপরের সাথে খুব নিভির আলাপে মগ্ন হয়ে আছে।এরা দিনের পরিকল্পনা করে তাই এরা সুখি, এদের মতো আমরা মানুষরা যদি সারা জীবনের পরিকল্পনা না করে, দিনের পরিকল্পনা করতাম তাহলে আমরা ও হয়তো সুখি হতে পারতাম।
বুলবুল পাখি দুটোর মধ্যে নেই কোন তৃতীয়জন,সে আর পদ্ম যদি পাখি হতো তাহলে তো এদের মতো সুখি জীবন কাটাতে পারতো। ইচ্ছে মত এই নীলাভ আকাশে উড়ে বেড়াতো।কতোই না সুন্দর হতো।
পাশে কান্নার শব্দ শুনে ধ্যান ভাঙ্গে জায়ানের! পদ্ম কাঁদছে, জায়ান ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পদ্ম কে ঘুরে দার করায়। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
–“প্লিজ এভাবে কাঁদবেন না, আপনি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।
পদ্ম’র কান্না যেন হুরমুর করে বেরেই চলে।অধর দুটো কামড়ে ধরে,তাও নিজেকে আটকাতে পারে না পদ্ম।কান্না মিশ্রিত কন্ঠেই বলে,
–“কেন করলেন জায়ান? আমি কিভাবে মুখ দেখাবো আব্বু কে?
জায়ান কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। আসলে কোন কোন সময় আমরা জীবন কে যতটা সহজ মনে করি, জীবন টা কিন্তু ততোটা ও সহজ নয়, আবার জটিল ও নয়! এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থান।
_______
জান্নাত অনেক বুঝানোর পর পদ্ম মুখে খাবার নেয়, কিন্তু চোখের পানি মুছতে মুছতে খাচ্ছে এদিকে অর্পিতা টিস্যু পেপার এগিয়ে দিচ্ছে! এভাবেই কেঁদে কেটে খাওয়া শেষ করে পদ্ম। খুব ভোরেই চলে যেতে চায় পদ্ম কিন্তু এরশাদ আর জান্নাত যেতে দেয়নি। আজকে বসন্তের প্রথম দিন তাই সবার সাথে আনন্দ করলে পদ্মর মন ভালো হবে বলে কেউ চায়নি পদ্ম চলে যাক,তা ছাড়া জায়ানের বোন অর্পিতা,অনিতা আর কাজিন মুশফিক আর ইরা মিলে জায়ানের বিয়ে উপলক্ষে ট্রিট হিসেবে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্লান করেছে।বড় রা বলে,শুধু তোমরা একা বেড়াতে যাবে তা তো হবে না আমরাও ট্রিট যাই জায়ানের থেকে! কারণ জায়ানের বিয়ের সব ক্রেডিট কিন্তু আমাদের বড়দের।জায়ান ও খুশি মনে সম্মতি দিয়েছে, এই উসিলায় পদ্ম’র সাথে ও কিছু মূহূর্ত কাটাতে পারবে।
অবশ্য এই পরিকল্পনা এক সপ্তাহ আগে করা হয়েছে! বিয়ে এবং বসন্তের শপিং তাই আগেই করা আছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই তৈরি হয়ে নেয় বসন্তের পোশাকে।জায়ানের আম্মু,বড় আম্মু এবং বোনেরা শাড়ি পরেছে হলুদের সাথে লাল সবুজ রঙের পার আর পদ্ম’র জন্য জায়ান নিজে পছন্দ করে কাঁচা হলুদ রঙের গাউন এনেছে। পদ্ম’র গাউন খুব পছন্দের যদিও শাড়িও পছন্দ তবে বাহিরে শাড়ি কমফোর্টেবল ফিল করে না তাই। সাথে ফুলের গহনা চুরি সব কিছু মিলিয়ে বসন্তের ছোঁয়া।
পদ্ম কে তৈরি করতে গিয়ে অনিতা আর ইরার ঘাম ঝরার অবস্থা! পদ্ম কিছুতেই বোরকা ছাড়া বাহিরে বের হবে না বলে জেদ ধরে বসে আছে।ইরা বোঝাচ্ছে যে তারা সবাই তো সাথে থাকবে কিছু হবে না। পদ্ম বললো,
–“প্লিজ আমাকে জোর করো না আমি বোরকা ছাড়া বাহিরে বের হইনা কখনো।
অনিতা আর ইরা ব্যার্থ হয়ে, রুমের বাহিরে আসে।অনিতা বিরক্ত মাখা মুখশ্রী করে জান্নাতের কাছে এসে বললো,
–“আম্মু দেখনা ভাবীমনি কিছুতেই তৈরি হচ্ছে না। আমরা কখন বের হবো বলো তো? তুমি একটু বুঝাও না।
–“দারা আমি দেখছি। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নেই।
পদ্ম ফোন হাতে নিয়ে দেখে,মামি কল করেছিল গতকাল।কি জবাব দিবে সে? মামির ফোনে ডায়াল করবে তখন খুব পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পায় পদ্ম! ফোন রেখে কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে যায় রুমের বাহিরে।যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই যেন শরীর আসার হয়ে আসছে। কাছাকাছি গিয়ে দেখে,অসমি জান্নাতের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। পদ্ম কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
–“আমি তুমি কি আব্বু আম্মু কে সব বলে দিয়েছো?মামি বিশ্বাস করো আমি এমনটা করতে চাইনি। আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি,ইনফেক্ট আমি এসব কিছুই জানতাম না।
–“আরে শ্বাশুড়ি কি বলেন আমি কি বলবো আপনার আব্বু আম্মু কে?
পদ্ম’র মামি পদ্ম কে মজা করে মাঝে মাঝে শ্বাশুড়ি বলে ডাকে। পদ্ম’র মামি কিছুই বুঝতে পারলো না পদ্ম কি এমন করেছে যার জন্য এভাবে বলছে। তাই আবার বললো,
–“পদ্ম তুমি কিসের কথা বলছো বলোতো?
পদ্ম কে বলতে না দিয়ে জান্নাত বললো,
–“আপা পদ্ম আপনাকে না বলে আমাদের বাসায় যে এসেছে, সেই কথাই বলছে।তাই না পদ্ম?
পদ্ম বুঝতে পারলো, তার মামি বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানেনা। তাই নিজেকে ধাতস্থ করে মাথা ঝাঁকায়।অসমি বলে,
–“অহ এই কথা। ঠিক আছে আর কান্না করতে হবে না। তবে পদ্ম আমাকে এভাবে না বলে আসা উচিৎ হয়নি তোমার। কতোটা দুশ্চিন্তা করেছি জানো? আল্লাহ না করুক তোমার কিছু হলে তোমার আব্বু আম্মু কে কি জবাব দিব আমি?তারা তো তখন সব দোষ আমাকেই দিবেন।
–“এরকম ভুল আর হবে না মামি, তুমি আব্বু কে কিছু বলো না।
অসমি পদ্ম’র বাবা কে কথা টা না জানালেও পদ্ম’র মামাকে ঠিক জানাবে সাথে আরো তেল মসলা মিশিয়ে বলবে!সব সময় এরকম টাই করে অসমি। পাঁচ কে দশ করে ইনিয়ে বিনিয়ে বিদেশে স্বামীর কান ভাড়ি করে।যার দরুন পদ্ম কে ভুল বুঝে তার মামা!
–“আপু তুমি যে এখনো অবধি তৈরি হওনি, কখন যাবো আমরা?
পদ্ম’র মামাতো বোন ফারিহা বললো পদ্ম কে। পদ্ম এতোক্ষণে খেয়াল করে, তার মামি মামাতো ভাই বোন ও বসন্তের পোশাকে নিজেদের রাঙিয়ে তুলেছে। তখন অসমি ও বললো,
–“সেকি পদ্ম!আমরা বাসা থেকে তৈরি হয়ে এসে গেছি অথচ তুমি এখনো তৈরি হওনি?আর তোমার বান্ধবী কোথায় ওর কথা তো এতদিন বললে না!
পদ্ম কিছুতেই বুঝতে পারছে না তার মামি কোন বান্ধবীর কথা বলছে! তখন ইরা এসে বললো,
–“আসসালামু আলাইকুম।
মামি কেমন আছেন? আমি পদ্ম’র বান্ধবী ইরা।
ছোট ছোট চোখ গুলো কে খানিকটা বড় করে তাকায় পদ্ম!এসব কি বলছে এই মেয়ে?
#চলবে,, ইনশা আল্লাহ।
#জুনিয়র_পদ্ম
পর্ব-০৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
জল ও জঙ্গলের কাব্য বা পাইলট বাড়ি রিসোর্টটি গাজীপুর জেলাস্থ টঙ্গীর পোবাইলে নব্বই বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই রিসোর্ট টি প্রকৃতিকে প্রায় অবিকৃত রেখে বাঁশ ও পাঠখরি দিয়ে সুনিপুণ ডিজাইনের মাধ্যমে সাজানো হয়েছে। রাজধানী ঢাকার কাছেই খুব অল্প সময়েই একটি মোহনীয় দিন কাটানোর জন্য “জল ও জঙ্গলের কাব্য” একটি চমৎকার স্থান।ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা যায়।জায়ানরা অবশ্য একদিন এক রাত থাকবে। শহরের আবদ্ধ স্থানে থেকে, কখনো সখনো এরকম গ্রামিন পরিবেশের ছোঁয়া মন্দ হয় না। সবাই খুব খুশী এখানে এসে। পদ্ম’র মন খুব ফুরফুরে হয়ে আছে এখানে আসার পর থেকে, নিজেকে মুক্ত পাখির মতো মনে হচ্ছে। সাথে নিজের ছোট্ট গ্রামের কথা মনের কোণে ভাসছে।
বাঁশ,পাঠখরির বেরা,ছনের ছাউনি,দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি এখানে জন্ম দিয়েছে পরিছন্ন গ্রামিন ছোঁয়া। অনাবিল সবুজ আর বিলের শান্ত জলে বরশি হাতে একটি দুপুর নিবৃতচারী মনের স্বপ্ন স্বাদ পূরনের জন্য যথেষ্ট।পদ্ম বৈঠা হাতে বিলের নৌকায় চড়ে বসে।জায়ান পদ্ম কে জিজ্ঞাসা না করেই সেও নৌকায় ওঠে! অনেক সাহস সঞ্চয় করে তাকে নৌকায় উঠতে হয়েছে কারণ জায়ান সাঁতার জানে না! এদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অসমি! কিছু বলতে যাবে তার আগেই জান্নাত আর অর্পিতা বললো,
–“চলুন আমরা ওদিকটায় যাই, খুব সুন্দর ছনের ছাউনি আছে।
অসমি এখান থেকে মনোযোগ সরিয়ে, তাদের সাথে যায়।জায়ান প্রশান্তির হাসি হাসে।
_______
জায়ানদের বাসায় অসমির আসার কারণ ছিল জান্নাত! পদ্ম’র এ বাসায় থাকা নিয়ে অসমি ঝামেলা করবে ভেবে,অসমি এবং তার ছেলে মেয়ের জন্য বসন্তের পোশাক পাঠানো হয় এবং জান্নাত’দের সাথে বেরাতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করা হয়।অসমির তখন খুশি আকাশ ছোঁয়া। নতুন পোশাক তার উপর বেরাতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ খুবই খুশি হয়, তাইতো তৈরি হয়ে ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে আসে আর মনে মনে ধন্যবাদ দেয় পদ্ম কে।আর অনিতা আর ইরা প্লান করে অসমি কে জানায় যে ইরা পদ্ম’র বন্ধু! পদ্ম প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়,যেখানে রাহি কে গতকাল প্রথমবারের মতো দেখেছে পদ্ম! তাছাড়া রাহি পদ্মর থেকে সিনিয়র।
অসমি যখন জানতে পারে পদ্ম বোরকা পরে যেতে চায় তখন সে ই পদ্ম’কে রাজি করিয়ে, তৈরি করে নিয়ে আসে। তারপর গাজিপুর জল ও জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে রওনা হয়ে আসে।
_______
পদ্ম নৌকা খানিকটা দূরে নিয়ে বিল থেকে পদ্ম ফুল তুলে নেয়।পদ্ম কে এই মূহুর্তে ইউলোকুইন লাগছে, হলুদ রঙের গাউন এর সাথে হলুদ রঙের ফুলের গহনা, মাথায় ফুলের ক্রাউন। গায়ের রঙের সাথে একদম মিলে মিশে একাকার।
আর জায়ান বাচ্চাদের মত নৌকার মাঝ খানটায় বসে নিজের ফোনে পদ্ম’র এই নির্মল হাসি আর দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করে।
পদ্ম রাগি মুখশ্রী করে বলে,
–“কি করছেন আপনি?
–“একটা “ইউলোকুইনের” ছবি তুলছি!
–“আমি বলছি আপনাকে ছবি তুলতে?
–“আমার বউ এর ছবি আমি তুলবো, এতে আমি অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে নাকি?
“আমার বউ”
সামান্য একটা সাইন করে,বউ হয়ে গেলাম কি আজব দুনিয়া!
পদ্ম হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়ায়, জায়ান জিজ্ঞাসা করলো,
–“কিছু বলছেন না যে?
পদ্ম কোন জবাব না দিয়ে নৌকা তীরে নিয়ে এসে, নেমে আসে নৌকা থেকে।জায়ান ধীরে ধীরে নৌকা থেকে নেমে এসে, দুপুরের খাবার নিয়ে ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে যায়।
পদ্ম নৌকা ভ্রমণ শেষ করে মামাতো বোন ফারিহা আর মামাতো ভাই ফারুক কে নিয়ে,বড় একটা আম গাছে দোলনা তৈরি করে! ফারুক গাছে চড়ে রসি লাগিয়ে দেয়। নিজেদের তৈরি করা এই দোলনার দোল খেতে খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের ছেলে মেয়েরা এই পদ্ধতিতে দোলনা তৈরি করে। প্রথমে ফারিহা আর ফারুক ওঠে দোলনায়।ওরা বায়না করে ওদের বিশ বার দোল দিতে হবে। পদ্ম মেনে নেয়, ওদের বিশ বার করে দেওয়া হলে পদ্ম ওঠে দোলনায়। কয়েকবার দোল দেওয়ার পর খুব জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে দোল দেওয়া হয় পদ্ম কে যার দরুন পদ্ম’র জান যায়যায় অবস্থা। এরকম একের পর এক দিতে দিতে পদ্ম ভয়ে চুপসে যায় যার দরুন হাত ফসকে দোলনা থেকে খানিক দূরে ছিটকে পড়ে!পদ্ম’র শেষ কথা শুনা যায় আব্বুওওওওও!
জায়ান রিসোর্টের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে, পদ্ম কে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে ছনের ছাউনীর কাছে আসে কিন্তু এখানেও পদ্ম নেই। তারপর জান্নাতের কাছে যায়,জান্নাত আর এরশাদ হোসেন পানিতে পা ডুবিয়ে বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যাস্ত।জায়ান দূর থেকে জানান দেয় তার উপস্থিতি। জান্নাত আর এরশাদ হোসেন ছেলের চিন্তিত মুখ দেখে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?
–“আম্মু পদ্ম কোথায় দেখেছো?
জান্নাত আর এরশাদ বিগলিত হাসে ছেলের এই বেহায়াপনা দেখে।জায়ান বুঝতে পেরে বললো,
–“প্লিজ এভাবে হেসো না বলো না দেখেছো কিনা?
জান্নাত হাসির রেশ কাটিয়ে বললো,
–“দেখ হয়তো ওর মামির সাথে আছে।
–“আচ্ছা দেখছি।
জায়ান চলে যাওয়ার পর, এরশাদ বললো,
–“আমার ছেলে ঠিক আমার মতোই হয়েছে।
জান্নাত খানিক ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচু করে বললো,
–“কি রকম?
এরশাদ গর্বের সাথে বললো,
–“প্রেমিক পুরুষ!
–“আসছে আমার প্রেমিক পুরুষ।
–“তুমি কি অস্বিকার করছো জানু? মনে নেই তোমার বাবার সামনে থেকে তোমাকে কিভাবে তুলে নিয়ে এসেছিলাম!
–“সে আর বলতে, কি পাগলামী টাই না করেছিলে।বাবা তো তোমাকে জেলে ও দিতে চেয়েছিলেন! সেদিন মায়ের জন্য বেঁচে গিয়েছিলে।
–“হুম, শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তা’আলা ওনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন আমিন।
–“সুম্মা আমিন।
–“দেখতে পঁচিশ টা বছর কেটে গেল তাই না? সময় যে কখন চলে যায় বলা যায় না।
________
জায়ান কিছুটা হেঁটে গিয়ে দেখে, অসমি ভিডিও কলে কাউকে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখাচ্ছে। হয়তো তার প্রবাসি স্বামী কে দেখাচ্ছে।জায়ান এক পা এগিয়ে আবার দু পা পিছিয়ে গেল, ভাবলো অসমি কে পদ্ম’র কথা জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না। উল্টো পাল্টা চিন্তা ভাবনা করলে, পদ্ম কে কথা শুনতে হবে।তাই এখান থেকে প্রস্থান করে।
অনিতার ফোনে কল দেয়, সাথে সাথে রিসিভ করে অনিতা।বললো,
–“ভাইয়া বল?
–“কোথায় তুই?
–“এই তো পুকুর পাড়ে,বাঁশের খুঁটির এখানে। কেন বলোতো?
–“পদ্ম কোথায়?
–“আমি তো জানি না,ভাবীমনি তো আমাদের সাথে নেই।
জায়ান আর কিছু না বলে কল কেটে দেয়। তখন দেখতে পায় ফারিহা আর ফারুক কি যেন নিয়ে দৌড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে ফারুক কিছু নিয়েছে আর ফারিহা তা উদ্ধার করার মিশনে নেমেছে!জায়ানও ওদের পিছনে দৌড়ায় এক পর্যায়ে দুজনের নাগাল পায়।
–“তোমরা তোমাদের আপু কে দেখেছো?
জায়ানের প্রশ্ন শুনে দুজনেই সচকিত হয়ে বললো,
–“,আপু খুঁজছেন কেন আপনি?
জায়ান নিজেকে ধাতস্থ করে নরম গলায় বললো,
–“আচ্ছা তোমরা কি নিয়ে দৌড়াচ্ছিলে?
ফারিহা অভিযোগের স্বরে বললো,
–“এই বেয়াদব টায় আমার চকলেট নিয়ে গেছে,
ফারিহার কথা শেষ না হতেই ফারুক বললো,
–“তুমি যে আমার নামে বাবার কাছে বিচার দিসো সেটার কি হবে? আমিও তোমাকে চকলেট দিব না।
ব্যাস আবার দুই ভাই বোনের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়!
ফারিহা এবার সপ্তম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে আর ফারুক পঞ্চম শ্রেণীতে। এখনো এদের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক! একজন আরেকজনের ছায়া ও যেন সহ্য করতে পারে না।
জায়ান দু’জনের ঝগড়া থামিয়ে বললো,
–“আমি তোমাদের অনেক চকলেট কিনে দিব,তোমরা শুধু বলো পদ্ম আই মিন তোমাদের আপু কোথায়?
ফারিহা আর ফারুক খুশি হয়ে বললো,
–“আপু ঐখানের একটা গাছে বসে দোল খাচ্ছে।
–“আমাকে নিয়ে চল দুজনে।
তারপর ওদের সাথে জায়ান সেই গাছের কাছে যায়। কাছাকাছি গিয়েই দেখতে পায় পদ্ম জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে! এই দিকটায় মানুষের আনাগোনা না থাকায় কেউ দেখতে পায়নি পদ্ম কে।জায়ান মাটিতে বসে পদ্ম’র মাথা কোলে রাখে, কপালের কিছু অংশ কেটে রক্ত ঝরছে,ঘ্রাণেন্দ্রিয় রক্ত জমাট হয়ে আছে। পদ্ম’র এরকম অবস্থা দেখে জায়ানের ভিতরটা যেন পুরে যাচ্ছে। ফারিহা আর ফারুক বোনের এই অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়ায়!জায়ান কোন রকমে কোলে তুলে নেয় পদ্ম কে।
এর ঘন্টা খানেক পর পদ্মর জ্ঞান ফিরলো।ডাক্তার ক্ষত স্থান ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন।সবাই নানান প্রশ্ন করছে কিভাবে কি হলো? পদ্ম বলতে পারলো না হঠাৎ কি হয়েছিল। তাই সবাই ভেবে নিল দোলনা থেকে বেকায়দায় পড়ে গেছে হয়তো।
জল ও জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে নিজস্ব জমিতে চাষ করা শাকসবজি,ধান এবং বিলের ধরা মাছ দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয়।জল ও জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে দেশিও খাবার ও পিঠা পরিবেশ করা হয়।
দুপুরে খাবার তালিকায়,ভাত,মুরগির গোশত,চালতা দিয়ে ডাল, তেঁতুল দিয়ে কচু মুখি,রুই মাছ, আলুর ভর্তা,ডাল ভর্তা, ছোট মাছ ইত্যাদি আরো বেশ কিছু মজাদার খাবার। সবাই খুব তৃপ্তি ভরে খাচ্ছে, আর জায়ান প্লেটের খাবার নারছে ও আর চোখে পদ্ম কে দেখছে।জায়ানের বাবা সবাই কে ভর্তা দিয়ে খাবার শুরু করতে বলেছেন,তো জায়ান পরেছে বিপদে!জায়ানের গোশত খুব পছন্দ, বিশেষ করে গরুর গোশত। সেখানে ভর্তা দেওয়া হয়েছে, বেচারা কিছু বলতে পারছে না। জান্নাত ব্যাপার টা বুঝতে পেরে, জায়ান কে মুরগির গোশত ভুনা দিল। এতে মায়াভরা চোখে তাকায় জায়ান, তার মায়ের থেকে বেশি কেউ তাকে এভাবে বুঝতে পারে না।
এদিকে পদ্ম খেতে চাচ্ছে না,অসমি অনেক জোর করে পদ্ম কে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। খাবার খেয়ে মেডিসিন নিতে হবে।
_________
দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ করে,কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে সবাই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। কথা ছিল আজকে এখানে থাকার কিন্তু পদ্ম’র কথা চিন্তা করে আর থাকলো না জায়ানের পরিবার।
রিসোর্ট থেকে ফিরে জায়ান এবং পদ্ম’র পথ আলাদা হয়ে যায়! দুজন দুজনের বাসায়। জান্নাত অসমি কে কল করে জেনে নেয় তারা ঠিক মতো বাসায় পৌঁছেছে কিনা?
এর এক সপ্তাহ পর,
জায়ান পদ্ম’র মামির বাসায় আসে! এসে তালা ঝুলানো দেখে বাসায়। এই এক সপ্তাহে পদ্ম কোন রকম যোগাযোগ রাখেনি জায়ানের সাথে।
একজন মহিলা বললো,
–“বাড়িওয়ালার ভাগ্নির বিয়ে!সে জন্য তারা সবাই গ্রামের বাড়ি গিয়েছে।
জায়ান আঙ্গুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
–“ভাগ্নির নাম কি আপনি জানেন?
–“জানবো না কেন?ও তো এখানেই ওর মামার বাসায় থাকতো!
#চলবে,, ইনশা আল্লাহ।