#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০২,০৩
লেখা: ShoheL Rana শামী
০২
‘এই আহেন আহেন, এহনি জাহাজ ছাইড়া দিবো। ঢাকার শেষ জাহাজ চইলা যাইবো। তাড়াতাড়ি আইয়া পড়েন।’
একসাথে কয়েকজন হাক ছাড়লো যাত্রীর উদ্দেশ্যে। ঢাকাগামী এটাই শেষ জাহাজ শুনে দ্রুত এগিয়ে গেল রিহান। জাহাজে উঠতে চাইলে একজন তার পথ আটকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘টিকেট নিছেন?’
‘টিকেট? না, নিইনি।’ হতাশার ছাপ ফুটে ওঠলো রিহানের চেহারায়।
‘তাইলে তো জাহাজে উঠবার পারবেন না। আগে টিকেট লন। ঐ যে টিকিট কাউন্টার।’ একদিকে ইশারা করলো লোকটা। রিহান ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। জানে সে, ওখানে গিয়ে ব্যর্থ হবে। ওখানে টিকেটের যে মূল্য চাইবে, তা তার কাছে নেই। রিহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা আবার বললো, ‘কী হইলো সাব? যান, টিকিট লইয়া আহেন। আর না গেলে সরেন। যাত্রী আইতে দ্যান।’
‘ভাই, আমার কাছে তো টিকেটের মূল্য নেই। আমাকে কি কোনোভাবে একটু ঢাকায় নিয়ে যাওয়া যাবে?’ খুব অসহায় শুনালো রিহানের কণ্ঠ।
‘না ভাই, হেইডা সম্ভব না।’
‘ভাই একটু কষ্ট করে নিয়ে যান না আমাকে? খুব বিপদে পড়েছি।’
লোকটা রিহানের কথা না শোনার ভান করে নিজের মতো করে যাত্রী ডাকতে লাগলো, ‘এই আহেন আহেন, আইজকার শেষ জাহাজ। আহেন আহেন…’
রিহানের পাশে এক মধ্যবয়সী লোক এসে দাঁড়ালেন। রিহান তার দিকে তাকাতেই লোকটা বললো, ‘ঢাকায় যাওয়ার পয়সা নেই? চলুন আমাদের সাথে, আমরা একটা কেবিন নিয়েছি।’
রিহান কী বলবে বুঝতে না পেরে একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটা পুনরায় তাগাদা দিলেন, ‘কী হলো, চলুন? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে যেতে পারবেন না। ওরা আপনাকে ফ্রিতে নিয়ে যাবে না৷ ব্রিটিশদের জাহাজ। বুঝলেন তো?’
লোকটাকে ভালো এবং ভদ্র মনে হলো রিহানের। হয়তো শিক্ষিতও। লোকটার পিছুপিছু চললো সে। এছাড়া উপায়ও নেই আর। চারপাশটা কোলাহলে ভরে ওঠেছে। কয়েকজন বাদাম বিক্রেতা ওঠেছে জাহাজে। যাত্রীদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বাদাম বিক্রি করছে। জাহাজের ডেকে বসে বেশ কয়েকজন খোশগল্প করতে ব্যস্ত। একটা শিশু জাহাজের রেলিং ধরে উঠতে চাইলে এক দম্পতি দৌড়ে যেতে লাগলো শিশুটার দিকে। ওরা পৌঁছার আগেই রিহান শিশুটাকে রেলিং থেকে নামিয়ে তার বাবা-মার হাতে তুলে দিলো। ঐ দম্পতি কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ করলো না। উল্টো এমনভাবে তাকালো যেন মানুষ সদৃশ কোনো চতুষ্পদ জন্তু দেখছে। রিহান নিজের মতো আবারও অনুসরণ করলো মধ্যবয়স্ক ঐ লোকটাকে। কেবিনের সামনে এসে দরজায় কড়া নাড়লেন তিনি। ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো একুশ-বাইশ বছরের এক যুবতী। ফুলহাতা ব্লাউজের সাথে ম্যাচিং করে খয়েরি রংয়ের শাড়ি পরে আছে সে। খোপা করা চুলে তার একটা লাল গোলাপ গুঁজানো। মেয়েটা হয়তো বেশ শৌখিন। মধ্যবয়স্ক লোকটার মেয়ে হবে হয়তো সে। বাবার সাথে অপরিচিত কাউকে দেখে মাথায় কাপড় টেনে দিলো।
‘আমার মেয়ে, সুফিয়া।’ পরিচয় করিয়ে দিলেন লোকটা।
‘হাই।’ আলতো করে হাত নাড়লো রিহান। মেয়েটার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। মনে হলো নতুন আপদটার কারণে কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু ওর বাবা যথেষ্ট বিনয়ের সাথে রিহানকে কেবিনের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালো। তখন সুফিয়া তার বাবার হাতটা ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা, তুমি কি এই লোকটাকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবে? একই কেবিনে?’
‘কী করবো মা? ছেলেটা বিপদগ্রস্ত।’ বাবার সদুত্তর।
‘কিন্তু বাবা, কেবিনে তোমার বিয়ের উপযুক্ত একটা মেয়েও আছে, সেটা কি ভুলে গেছো?
‘না, ভুলিনি। কিন্তু ছেলেটা অসৎ চরিত্রের কেউ মনে হলো না।’
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সুফিয়া। তখন ভেতর থেকে রিহান এসে বললো, ‘আপনাদের অসুবিধে হলে থাক… আমি চলে যাই।’
‘থাকুন আপনি, এসেই যখন পড়েছেন। তবে যে বিশ্বাসটা বাবা আপনাকে করেছে, তার মর্যাদা রাখার চেষ্টা করবেন।’
‘অবশ্যই।’ ভরসা দিলো রিহান। তার এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে অন্য কিছু মাথায় আসার প্রশ্নই আসে না। ভদ্র লোকটা যে তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন এটাই বেশ। রিহান নিজের পরিচয় দিলো, ‘আমি রিহান।’ নাম শোনার কোনো আগ্রহই দেখালো না সুফিয়া। জানালার পাশ ঘেঁষে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো নদীর জলের দিকে। তার এমন ব্যবহারের জন্য বাবা দুঃখ প্রকাশ করে বললো, ‘ওর ব্যবহারে কষ্ট পেয়ো না। আসলে মা ছাড়া বড়ো হয়েছে তো। তাই একটু একরোখা।’
‘মা নেই ওর?’
‘না, ওর বয়স যখন তিন বছর, তখন তার মা মারা যায় অসুখে।’
‘ওহ্!’ সমব্যথী দেখালো রিহানকে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে রিহান প্রশ্ন করলো, ‘আংকেল, আপনার নামটা জানতে পারি? ঢাকায় কি কোনো কাজে যাচ্ছেন?’
‘আমার নাম জাফর। এলাকার সবাই জাফর মাস্টার বলেই চেনে। আমার নিজ বাড়ি ঢাকাতেই। চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করতাম। শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে এখন চলে যাচ্ছি। গ্রামে জমি-জমা আছে, ওগুলো দেখাশোনা করবো।’
‘আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’
‘গফরগাঁও থানায়। গফরগাঁও চিনো?’
‘হ্যাঁ চিনি।’
‘তুমি ঢাকার কোথায় থাকো?’
চুপ করে রইলো রিহান। কোনো জবাব দিলো না। কী জবাব দেবে ভেবে পেল না সে। সেও গফরগাঁওয়ের ছেলে। কিন্তু এই সময়টাতে তার পরিচয় দেয়ার মতো কিছুই নেই। আশপাশের অবস্থা দেখে সে ইতোমধ্যে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে এখন ১৯৪২ সাল। সে তার সময় থেকে কয়েক যুগ অতীতে চলে এসেছে। এখন সে তার এলাকায় ফিরে গিয়ে হয়তো কিছুই পাবে না। তার আত্মীয়-স্বজন কাউকে না, তার পরিচিত পরিবেশটাও অপরিচিত হয়ে যাবে। রাস্তা-ঘাট, বাড়িঘর সবকিছু তো বদলে যাবে। তবে কীসের আশায় সে ফিরে যাচ্ছে?
‘কী হলো বাবা? তোমার কি যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই?’ জাফর মাস্টার পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন।
‘আংকেল, আসলে কীভাবে যে কথাটা বলি। আপনাকে বললেও হয়তো বিশ্বাস করবেন না। আমি আসলে আপনাদের সময়ের কেউ না।’
‘মানে?’ অবাক হলেন জাফর মাস্টার। সুফিয়াও মুখ ঘুরিয়ে আনলো রিহানের দিকে। মাথার কাপড় কিছুটা নেমে গেছে তার। জানালা দিয়ে ভারি বাতাস ঢুকে তার মাথার চুলগুলো নাড়াচ্ছে। রিহান তার দিকে বোকার মতো একবার চেয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো জাফর মাস্টারের দিকে। আমতা আমতা করে বললো, ‘আমি আসলে ভবিষ্যত থেকে এসেছি। আপনার এই সময়ের আরও ৪৮ বছর পর আমার জন্ম হয়েছে।’
এবার ফিক করে হেসে ওঠলো সুফিয়া। হাসিটা তার থামতেই চাইলো না আর। মুখে হাত চেপে ধরে হেসে চললো সে। তারপর রিহানের দিকে ইশারা করে বাবাকে বললো, ‘বাবা ও না-কি ভবিষ্যত থেকে এসেছে। বাবা… হি হি হি… তুমি এই লোকটাকে কোথা থেকে ধরে আনলে?’
বোকার মতো চেয়ে রইলো রিহান বাপ-মেয়ের দিকে। জাফর মাস্টার মেয়েকে কিছুটা ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘সুফিয়া, এটা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু। ছেলেটা হয়তো মানসিকভাবে একটু অসুস্থ। কারও অসুস্থতা নিয়ে এভাবে হাসতে হয়?’
‘ঠিক আছে বাবা, আর হাসবো না।’ কথাটি বললেও আরও অনেকক্ষণ হেসে চললো সুফিয়া। রিহান কিছুটা বিব্রতবোধ করলো। এরা ওকে মানসিক বিকারগ্রস্ত ভেবে নিয়েছে। এজন্যই সে কথাটি বলতে চাইনি প্রথমে।
কেবিনের দরজায় শব্দ হলো। জাফর মাস্টার উঠে দরজা খুলে দিলে এক হকার জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, পত্রিকা লাগবো?’
‘হ্যাঁ, দাও। একটা নবযুগ দাও, আরেকটা বেগম দাও।’
দু পয়সা দিয়ে দুটো পত্রিকা নিয়ে জাফর মাস্টার আবারও কেবিনে এসে বসলেন। তারপর পত্রিকায় মনোযোগ দিলেন। বাবার হাত থেকে নবযুগ পত্রিকাটা নিয়ে শিরোনামগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলো সুফিয়া। কী যেন খুঁজছে মনে হলো সে পত্রিকায়। পরে খুঁজে না পেয়ে আশাহত হয়ে রেখে দিলো পত্রিকাটা। রিহান তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো, ‘এটা কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত পত্রিকাটা না? শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত করেছেন?’
‘হুমম, অনেকদিন পত্রিকাটা বন্ধ করে রাখছিল। কিছুদিন হলো আবার চালু হয়েছে।’
‘হুমম। ২০০০ টাকা প্রদেয় জামানতের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি এই ব্যাপারে জানি দেখলেন তো?’ কথাটি বলে নিজেকে খুব পারদর্শী মনে হলো রিহানের। মৃদু হাসি ফুটে ওঠলো ঠোঁটের কোণায়। কিন্তু তার কথা শুনে অট্টহাসিতে মেতে ওঠলো সুফিয়া। হাসতে হাসতে সে বললো, ‘এটা তো সবাই জানে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নজরুল সাহেবের লেখাগুলো সবাই পছন্দ করে, তাই জনপ্রিয় একটি পত্রিকা এটি।’
রিহান চুপ হয়ে গেল সুফিয়ার ব্যঙ্গাত্মক হাসি দেখে। কয়েক মুহূর্ত পর আবারও বলে উঠলো, কিন্তু দু’বছর পর পত্রিকাটা আর থাকবে না। একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। এটা তো কেউ জানে না আমি ছাড়া।
সুফিয়ার হাসিটাও থেমে গেছিল। কিন্তু রিহানের এবারের কথাটা আরও বেশি রসাত্মক মনে হলো তার। পুনরায় হাসতে হাসতে বললো, ‘আপনি কি জ্যোতিষী না-কি? দুবছর পর কী হবে তা আগে থেকেই জানেন? বলুন তো আমার বিয়েটা কবে হবে?’
জাফর মাস্টার এবার পত্রিকা থেকে মুখ তুলে মেয়েকে নরম সুরে ধমক দিলেন, ‘আহ সুফিয়া কী হচ্ছে এসব? কারও সাথে এভাবে ব্যঙ্গ করতে নেই মা।’ তারপর মেয়ের কানে কানে বললেন, ‘ছেলেটার অসুস্থতা নিয়ে মজা করো না।’
মাথা নেড়ে শান্ত হয়ে গেল সুফিয়া। নবযুগ পত্রিকাটা বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বললো, ‘ধরো বাবা, নজরুল সাহেবের লেখা খুঁজছিলাম। কিন্তু আজ উনার কোনো লেখা আসেনি।’
‘আপনি নজরুলের লেখা পছন্দ করেন?’ সুফিয়াকে প্রশ্ন করে রিহান।
‘হ্যাঁ, খুব পছন্দ করি। তাঁর লেখা পড়লে মনে আশা জাগে। স্বপ্ন দেখি একদিন এই দেশ ব্রিটিশমুক্ত হবে।’
‘স্বপ্ন দেখাটা ভালো। আপনার স্বপ্নটা অবশ্যই পূরণ হবে। তবে আরও পাঁচ বছর আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।
‘মি. রিহান, আপনার এবারের কথায় আমি হাসছি না। কারণ, দেশ ব্রিটিশমুক্ত হবে শুনতে ভালো লাগছে। ব্রিটিশরা আমাদের শেষ করে দিচ্ছে।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুফিয়া। ‘আহ্, নজরুল সাহেব যদিও আরও বেশি করে লিখতেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে! উনার একটা লেখা বেশি ভালো লেগেছিল, শিরোনাম ছিল এরকম, ”গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ।” যুগযুগ ধরে লিখে যাক উনি এভাবে।’ সুফিয়ার আশাদীপ্ত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠলো। আবার দৃষ্টি ফেললো সে বাইরে। বাইরে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ইতোমধ্যে জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। সুফিয়ার দুচোখে যে আশা দেখেছে রিহান, তা নিভিয়ে দিতে চাইলো না। সুফিয়া যদি জানে নজরুলের লেখার হাত থেমে যাবে একেবারে, আর কয়েকমাস পরই নজরুল বাকশক্তি হারিয়ে ফেলবে, দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হবে, তাহলে খুব কষ্ট পাবে মেয়েটা। আশা নিয়েই বেঁচে থাকুক সে অন্তত এই কয়মাস…
[[চলবে…]]
#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০৩
লেখা: ShoheL Rana শামী
রাতে খাবার হিসেবে ছিল শুকনো চিঁড়া আর গুড়। দুজনের খাবার নিয়েছিল ওরা। কেবিনের সদস্য হিসেবে রিহান বেড়ে যাওয়ায় তিনজনে ভাগাভাগি করে কোনোমতে ক্ষুধা মেটালো। খেতে খেতে রিহান ভাবছিল, যদি সাথে করে সে কিছু তার যুগের খাবার নিতো, তাহলে খাওয়াতে পারতো ওদের। তখন এরাই হয়তো প্রথম মানুষ হতো, যারা কয়েক যুগ পরের খাবার ১৯৪২ সালে বসে খাচ্ছে! খাবার পর একটা পানির বোতল এগিয়ে দিলো সুফিয়া রিহানের দিকে। পানি পান করে বোতলটা সে ফিরিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালো। তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে কয়েকটা নাম্বারে ফোন দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। ফোনে নেটওয়ার্কই আসে না।
‘কী যন্ত্র এটা?’ বোতলটা একপাশে রেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সুফিয়া। ‘এমন যন্ত্র তো আগে কখনও দেখিনি।’
জাফর মাস্টারও অবাক হয়ে তাকান ফোনটার দিকে। তিনি রিহানের হাত থেকে ফোনটা চেয়ে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেন। তিনিও প্রশ্ন করেন, ‘কী জিনিস এইটা?’
‘আংকেল, এটাকে বলে মোবাইল ফোন। এটা দিয়ে ফোন করা হয়। দূরদূরান্তে ভিডিয়ো কলে যোগাযোগ করা যায়। গান শোনা যায়। আরও অনেক কিছু করা যায়।’
‘ওহ্!’ বলে ফোনটা ফিরিয়ে দিলেন তিনি রিহানের দিকে। তার আচরণে বোঝা গেল, ফোনটা দেখে যতটা অবাক হয়েছেন, ফোনের কাজ দেখে ততটা অবাক হননি। বিশ্বাসই করেননি হয়তো। হয়তো পাগলের প্রলাপ ভেবেছেন। কিন্তু সুফিয়া বিষয়টা সহজে ছাড়লো না। সে বললো, ‘আপনি বলতে চাইছেন টেলিফোনের মতো এটাও কাজ করে? দেখি, আমাকে আমার বান্ধবী চাম্পার সাথে কথা বলিয়ে দেন তো? পারবেন? পারবেন না। সেই থেকে আপনি উলটাপালটা বকতেই আছেন, বকতেই আছেন।’
‘উলটাপালটা বকছি না। সত্যিই এটা দিয়ে কথা বলা যায়। বলছি না আমি ভবিষ্যত থেকে এসেছি? ভবিষ্যতে এটা দিয়ে কথা বলার জন্য নেটওয়ার্ক আছে, কিন্তু এ সময়ে এটার কোনো নেটওয়ার্ক নেই। আপনাকে কীভাবে যে বুঝায়। আমার ফোনে গান বা মুভি ডাউনলোড করা থাকলে এখনই দেখাতে পারতাম। আফসোস! তাও নেই।’
‘হয়ছে মিস্টার। একটা যন্ত্র দেখাচ্ছেন বলে কি বিশ্বাস করে নেবো আপনার কথা? বুঝছি, আপনি যন্ত্রটা বানাতে গিয়ে একটু বেশি গবেষণা করে ফেলেছেন, তাই মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে।’ সরাসরি বলে ফেললো সুফিয়া কথাটা। মুখে যা আসে তা বলে ফেলা তার স্বভাব, ইতোমধ্যে বুঝে গেছে রিহান। অবশ্য এটা একটা ভালো গুণ। এদের অন্তরে যা, বাইরেও তা। এদের মনে কোনো প্যাঁচ থাকে না। রিহান আর বুঝানোর চেষ্টা করলো না যে, সে ভবিষ্যত থেকে এসেছে।
জাহাজটা এগিয়ে চলেছে নিজ গতিতে শব্দ করে। রাত আরও বেড়ে চলেছে। যাত্রীদের আওয়াজ থেমে গেছে। ইতোমধ্যে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকিরাও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।। ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে। সময়টা জেগে কাটানোর চেয়ে ঘুমিয়ে কাটানোটা ভালো। রিহান না থাকলে হয়তো জাফর মাস্টারও ঘুমিয়ে পড়তেন। যতই সে ভালো ছেলে মনে করে তাকে কেবিনে নিয়ে আসুক, তবুও মেয়ের সাথে একটা বাইরের ছেলেকে নিয়ে এসে তিনি এভাবে ঘুমোতে পারেন না। ঘন ঘন হাই তুললেও তিনি চোখ বন্ধ করলেন না। মেয়েকে ঘুমাতে বললেন তিনি। সুফিয়া হ্যাঁ/না কিছুই না বলে মাথাটা কাত করলো জানালার সাথে। আনমনে চেয়ে আছে সে জলের দিকে। ভারি বাতাসে তার চুলগুলো উড়তে লাগলো। রিহানের মনে এবার আসল ভীতিটা ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। কোথায় যাচ্ছে সে? ওখানে গিয়ে কী হবে? তাদের বাড়িটা কি থাকবে? নিশ্চিয়ই থাকবে না। তবে তাদের ভিটে-মাটিতে অন্য কোনো ঘর থাকতে পারে, বা খালি জমিও পড়ে থাকতে পারে। যদি কোনো ঘর থাকে, কারা থাকবে ওখানে? তার বাবার জন্ম ১৯৬০ সালে। তার দাদা নিশ্চয়ই থাকতে পারে। দাদা হয়তো এখনও বাচ্চা শিশু। কী হবে ঐ বাড়িতে গিয়ে যদি সে বলে, এই বাচ্চা শিশুটা তার দাদা। পাগল ভেবে হয়তো মারধর করবে। এ কোন পরিস্থিতিতে আটকে গেল সে? হঠাৎ মনে হলো, যা ঘটছে সবকিছু যদি মিথ্যে হয়ে যেত? যদি সবকিছু স্বপ্ন হতো। এখনও তার পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না এসব। সুফিয়ার দিকে চোখ যেতেই দেখলো মেয়েটা ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানালায় হেলান দিয়ে। জাফর মাস্টারও ঝিমোচ্ছেন। এই সুযোগে আরেকবার চিমটি কেটে দেখা যাক। এবার জোরে চিমটি কাটলো সে। ‘আহ!’ ব্যথায় ককিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলালো সে। মাথার চুল টানতে লাগলো। গালে চড় মারতে লাগলো, তবুও স্বপ্নটাকে শেষ করতে পারছে না। শেষ হবে কেমনে, যা ঘটছে সবই তো বাস্তব। তবুও মনকে আশ্বস্ত করতে ব্যথা পেলেও চিমটি কেটে চললো সে। সুফিয়ার দিকে আবারও তাকালো। মেয়েটা কাঁপছে। হয়তো শীত করছে তার। এগিয়ে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করতে হাত বাড়ালে হাতটা ধরে ফেলে সুফিয়া।
‘কী মিস্টার, কী অসভ্যতামি করছেন? গায়ে হাত দিতে চাচ্ছেন না-কি?’ মাথা তুলে রাগ ঝাড়লো সুফিয়া। জাফর মাস্টারের ঘুমটাও কেটে গেল। রিহান নরমস্বরে বললো, ‘আমি তো জানালা বন্ধ করতে চাইছিলাম, আপনার শীত লাগছে দেখে।’
‘থাক, আপনার বন্ধ করতে হবে না।’
‘তুই শুধু শুধু ছেলেটাকে এমন করছিস। শুন মা, মানুষ বিপদে পড়লে খারাপ চিন্তা মাথায় আসে না। ছেলেটাও বিপদে পড়েছে।’
‘হয়ছে বাবা, তোমাকে আর লোকটার পক্ষ নিতে হবে না।’ বলে আবারও জানালায় মাথাটা ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করলো সুফিয়া। রিহান মনে মনে ভাবলো, এ কেমন মেয়ে রে বাবা, ভালো করতে গেলেও খারাপ ভাবে। নিজের মতো করে থাকাটাই ভালো। মুখটা কালো করে বসে রইলো সে। কয়েক মুহূর্ত পর চোখদুটো একটু করে খুলে সুফিয়া রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আপনি আসলেই পাগল। যা করছিলেন করুন। চিমটি কাটতে থাকুন নিজেকে।’
রিহান কিছুটা লজ্জা পেল। এই মেয়েটা সব দেখে ফেলেছে। চোখ বন্ধ দেখে সে ভেবেছিল সুফিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। নাহ্, শয়তান আছে কিছুটা। যদি এই পরিস্থিতি থেকে কখনও বের হতে না পারে সে, তবে এদের সাথেই থাকতে হবে তার। আর কোনো উপায় নেই। একই সাথে এই মেয়েটাকে সামলানোর কিছু কৌশল রপ্ত করে নিতে হবে।
শেষ রাতে চোখে ঘুম নেমে এসেছিল রিহানের। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে জানে না। জাফর মাস্টারের ডাকে যখন তার ঘুম ভাঙলো, তখন চারপাশে আলো ফুটে ওঠেছে। নিজেদের ব্যাগ-সামগ্রী গুছিয়ে ওরা নেমে পড়লো জাহাজ থেকে। খানিকদূর হেঁটে ওরা একটা ট্যাক্সি ডাকলো। ওখান থেকে ট্যাক্সিতে করে ওরা রওনা দিলো গফরগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে। রিহান ট্যাক্সি থেকে আশেপাশের পরিবেশে চোখ বুলাতে লাগলো। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দালান সবকিছু বদলে গেছে। তার চেনা পরিবেশের সাথে কিচ্ছু মিল নেই। শহরে এত ফাঁকা জায়গা কখনও তার চোখে পড়েনি। উঁচু উঁচু বিল্ডিংও নেই। তবে রাস্তাটা একই পথেই গেছে। রাস্তার দুপাশে সারি-সারি গাছ। দূরে ধানক্ষেত। খানিক পরপর একেকটা গ্রাম, মুগ্ধ দৃষ্টিতে উপভোগ করতে লাগলো রিহান। পুরো রাস্তায় সে কোনো কথা-ই বলেনি। শুধু পরিবেশটা দেখেছে, আর ভেবেছে-কী সুন্দর পরিবেশটা হারিয়ে গেল তার সময়ে এসে।
পরিবেশটাতে একপ্রকার ডুবে গিয়েছিল রিহান। কোন সময় যে ট্যাক্সিটা গফরগাঁওয়ে পৌঁছে গেল বুঝতেই পারেনি সে। এত দূরের পথ মুহূর্তেই যেন শেষ হয়ে গেছে। সুফিয়া না ডাকলে হয়তো ধ্যানটা তার ভাঙতো না।
‘এই যে, কোথায় নামবেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করলো সুফিয়া।
‘গফরগাঁও।’
‘এটাই তো গফরগাঁও।’
‘আর একটু সামনে, ঐ যে সামনের এলাকাটায়।’
‘ওখানে কাদের বাড়ির ছেলে তুমি।’ জিজ্ঞেস করলেন জাফর মাস্টার। পুনরায় বললেন, ‘বয়সে ছোটো তুমি, তাই ‘তুমি’ করেই বলছি, কিছু মনে করো না।’
‘না না আংকেল, সমস্যা নেই। তুুমি করেই বলুন আমাকে।’ প্রথম প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রিহান।
গাড়ি থামলো রিহানের গন্তব্যে এসে। রিহান গাড়ি থেকে নামবে না-কি নামবে না দ্বিধায় পড়ে গেল। সুফিয়া তাগাদা দিলো, ‘কী হলো নামুন, আপনার এলাকা তো এসেই গেল।’
নেমে গেল রিহান ট্যাক্সি থেকে। নিজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলাতে ঝুলাতে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘আংকেল, আপনাদের বাসাটা কোথায়?’
‘কেন? আমাদের বাসা কোথায় জেনে কী করবেন আপনি? মুখের উপর বলে দিলো সুফিয়া। এই মেয়েটা দেখি তাকে একটুও সহ্য করতে পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটা খুব ভালো, আবার মনে হয় এর চেয়ে ত্যাড়া মেয়ে আর নেই। এই দীর্ঘ জার্নিতে রিহান বুঝতে চেয়েছে মেয়েটাকে। কিন্তু বড্ডো রহস্যময়ী মেয়েটা। সুফিয়া ওভাবে কথাটি বললেও তার বাবা নরম স্বরেই ঠিকানাটা দিয়ে দিলেন, ‘চর আলগীতে গিয়ে জাফর মাস্টারের বাড়ি কোনটা জিজ্ঞেস করলেই লোকে দেখিয়ে দেবে।’
‘ঠিক আছে, ধন্যবাদ আংকেল।’ ট্যাক্সিটা চলে যাচ্ছিল রিহানকে পাশ কাটিয়ে। ভেতর থেকে সুফিয়ার ক্ষীণ স্বর ভেসে এলো, ‘তুমি লোকটাকে বাসার ঠিকানা কেন দিলে বাবা?’
আনমনে হেসে ওঠলো রিহান। অল্প সময়েই মেয়েটাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে তার। কেমন যেন কঠিন, আবার নরম মেয়েটার মন। ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই হেঁটে চললো সে একটা বাড়ির দিকে। কিন্তু জানে না সে এটাই তার পূর্বপুরুষের বাড়ি কি না। টিনের ছাউনিতে যে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, ওটা তার যুগে নেই। এর জায়গায় একটা পাঁচতলা বিল্ডিং হয়েছে। ভিটের চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে দেয়ালও নেই এখানে। উঁচু উঁচু বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। এগুলো কখনও চোখে পড়েনি রিহানের। হয়তো কেটে ফেলা হয়েছে। তারপর ওখানে আরও একটা বিল্ডিং করেছে, যেখানে রিহানের বাবার এক চাচাতো ভাই স্বপরিবারে থাকেন। রিহান চারপাশের পরিবেশটাতে চোখ বুলাতে বুলাতে ভাবতে লাগলো, এই নারকেল গাছগুলো একসময় থাকবে না, এখানে বাবার এক চাচাতো ভাই বিল্ডিং তুলবে। ও পাশের খালি জমিটাতে তার এক ফুপু ঘর তুলবে। তার বাবা এখানে থাকবে না। এখানে যে বাড়িটা এখন আছে, ওটাতে পাঁচতলা বিল্ডিং তুলে থাকবে ছোটো চাচা, ছোটো চাচার সাথে দাদিও থাকবে। তার বাবা ঢাকায় জমি কিনে ওখানেই ঘর তুলবে পরে। ঢাকা থেকে রিহান সুযোগ পেলেই এখানে চলে আসতো, দাদা বাড়িতে। কিন্তু এবারের আগমনটা তার সম্পূর্ণ ভিন্ন। দাদা মারা গেছে বলে দাদাকে কখনও চোখে দেখেনি রিহান। এবার হয়তো দাদাকেও চোখের দেখা হয়ে যাবে তার। পিচ্চি একটা দাদা তার! এমন পরিস্থিতিতেও কথাটি ভেবে হাসলো রিহান। একটা বয়স্ক লোক এসে দাঁড়ালো তার কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আপনি? কাকে চান?’
‘আপনি কে?’ পালটা প্রশ্ন করলো রিহান।
‘এটা আমারই বাড়ি।’
‘ইউসুফের কী হন আপনি?’
‘ইউসুফ তো আমার পাঁচ বছর বয়সী নাতির নাম। আমি ওর দাদা।’
‘আর ইউসুফ হলো আমার দাদা।’ কথাটি বলতে গিয়েও থেমে গেল রিহান।
[[চলবে…]]