গল্প — মধ্যবিত্তের সুখদুঃখের কাব্য
পর্ব-৪,০৫,০৬
নার্গিস_দোজা
০৪
একসপ্তাহ পরে জয়ীতা স্কুলে এসে দেখে তার জন্য ফুলের তোড়া নিয়ে সহকর্মীরা অপেক্ষা করছে। এর পেছনে কার হাত আছে বুঝতে পারলেও ভালই লাগছে জয়ীতার। পরিবারের বাইরে তেমন খুব একটা সহানুভূতি পাবার সৌভাগ্য তার হয়নি। হাতবাড়িয়ে সহকর্মীদের আলিঙ্গন করে জয়ীতা। জামান সাহেব এগিয়ে এসে মৃদু কন্ঠ বলেন স্বগতম। সবার কানে তা না পৌছালেও জয়ীতার কানে তা ঠিকই পৌঁছে। কৃতজ্ঞতা ছোয়া হাসি ফুটে ওঠে জয়ীতার মুখে।রেষ্টরুমের পথে সে সহকর্মীদের সাথে পা বাড়ায়। জয়ীতার সম্পর্কে সবাই মোটামুটি জানে। সবার মধ্যেই তার জন্য একটা মমতা আছে।
জামান সাহেব ওরফে খালেকুজ্জামান খান সোনার চামচ না নিয়ে জন্মালেও মোটামুটি সচ্ছল শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নিয়ে ছিলেন। পিতা মনিরুজ্জামান খান সাহেব সরকারি কলেজের লেকচারার ছিলেন আর ওনার স্ত্রীও একটা বেসরকারী স্কুলের টিচার ছিলেন। রিটায়ারমেন্টে যাবার আগেই স্ত্রীর সাথে ছোটখাট একটা স্কুল দিয়েছিলেন। স্কুলটা তার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করা। স্কুলটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তার। গতানুগতিক হবে না তার স্কুল। ভালবাসা আর যত্নে গড়ে উঠবে শিক্ষার্থীরা। সে জন্য আর্লী রিটায়ারমেন্ট নিয়েছিলেন। জামান সাহেব তখন দেশোধ্যারের কাজে নিয়োজিত। ভার্সিটিতে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলন করতেন বামপন্থী ঘরানার। পাশটাশ করার পরও তাতেই লেগেছিলেন। চাকরিবাকরি পছন্দ ছিলনা। গোলামি করবেননা আগেই বাবাকে জানিয়ে দিয়েছেন। ধিরেসুস্থে বাবার স্কুলেই যোগদানের কথা চিন্তা করে রেখেছিলেন। কিন্তু মানুষের সিদ্ধান্তের সাথে বিধাতার সিদ্ধান্তের গড়মিল প্রায়শই হয়ে থাকে। তাই যেদিন জামান সাহেবের বাবা এক্সিডেন্ট করে পঙ্গু হয়ে গেলেন সেদিন থেকেই তাকে সংসারের হাল ধরে হোল। প্রথমবারের মতো তিনি উপলব্দি করলেন দেশোদ্ধারের স্বপ্ন দেখাটা যতই সহজ হোক দুঃসময়ের কালে নিজেকে নিজের পরিবারকে উদ্ধার করা ততোধিক কঠিন। অসুস্থ পিতা আর শোকে বিহ্বল মা বোন অথচ এই বিপদের দিনে তার পাশে দাড়ানোর মতো কাউকেই খুজে পেলেন না। বাস্তবতা এতোটাই কঠিন। ভার্সিতে পড়ার সময় একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। জ্বালাময়ী ভাষন দেয়া জামান যতটা তার পছন্দের ততটাই অপছন্দ সংসারজীবনের যাঁতায় পিষ্ঠ জামান। তাই জামান সাহেবের দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে পিতার পছন্দের পাত্রকেই বিয়ে করে ফেলা বেশি ভাল হবে ভেবে এক ধনীর দুলালের গলায় মালা পরালো। জামান সাহেব উপলব্দি করলেন চাঁদ আসলেই ঝলসান রুটিসম ক্ষুধার রাজ্যে।যদিও তিনি ততটা ক্ষুধার্ত ছিলেন না। তারপর থেকে স্কুলের হাল তিনিই ধরেছেন। ভাল চলছে স্কুলটা তার তত্বাবধানে। মা জাহেদা বেগম খুব একটা আসেননা স্কুলে আজকাল। একটাই বোন সায়লা।বিয়ে হয়ে গেছে। সেও স্কুলেই জয়েন করেছে। চাইলে চাকরি করতে পারতেন। কিন্তু স্কুলেই থাকাটা ভাল মনে করেছেন। হাজার হলেও পিতামাতার যত্নে গড়া স্কুল। জামান সাহেব জয়ীতাকে পছন্দ করে সায়লা সেটা বুঝতে পারে। যে জন্য জামান সাহেব যখন তাকে জয়ীতাকে দেখতে যাবার কথা বলেন সে দ্বিমত করেনি। গতকাল যখন জয়ীতা জানালো আজকে সে স্কুলে আসবে ভাইকে সেটা যথাসময়েই জানিয়ে দেয় সে। সকালে জামান সাহেব ফুলের তোড়াটা তার হাতে ধরিয়ে দিলে সে সহকর্মীদের নিয়ে জয়ীতাকে সেটা দেয়। জয়ীতাকে সেও পছন্দ করে। কিন্তু তার চিন্তা মা বাবাকে নিয়ে।
গল্প-মধ্যবত্তের সুখদুঃখের কাব্য
পর্ব-৫
জয়ীতা নম্রতাকে নিয়ে জুতোর দোকানে এসেছে শুক্রবার বিকালে। নম্রতার জন্য স্যান্ডেল কেনার পর কি ভেবে নিজের জন্যেও একজোড়া স্যান্ডেল কিনেছে সে। দোকান থেকে বের হবার সময় দুই বোনের সাথে দেখা হয়ে গেল জামান সাহেবের। তিনিও টুকটাক কিছু কেনাকাটার জন্যে মার্কেটে এসেছেন। জয়ীতাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে কেমন আছে তারা জিজ্ঞেস করার পর তাদের এককাপ চা খাওয়াতে চাইলেন তাদের আপত্তি না থাকলে। নুতন স্যান্ডেলের খুশিতে জয়ীতা কোনকিছু বলার আগেই নম্রতা একবাক্যে রাজি হয়ে গেল।বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে জয়ীতাও রাজি হয়ে গেল। টেবিলে বসে জামান সাহেব নম্রতাকে জিজ্ঞেস করলেন সে আর কিছু খাবে কিনা। সে না বলার পরও তিনি তার জন্যে একপ্লেট চটপটি আর নিজেদের জন্যে চপ দিতে বললেন।জয়ীতা এতোদিন যাবত একসঙ্গে কাজ করলেও কখনো জামান সাহেবের মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখেনি। আজ কি ভেবে তাকে ভাল করে চেয়ে দেখলো। তিরিশোর্ধ মানুষটার কানের পাশে দুএকটা চুলে পাকধরলেও চেহারায় একটা সৌম্যের ছাপ আছে।আর তার চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটোতে বুদ্ধমত্তার ছাপ ফুটে আছে।জয়ীতা জানে সে একটু অন্য ধরনের। ওনার বোনের মুখে শুনেছে তিনি ছাত্র জীবনে বামঘেষা ছিলেন। সাদাসার্ট আর কালোপ্যান্টে ভালই লাগছে ভদ্রলোককে।জয়ীতা নিজেও আশ্চয় হয়ে গেল নিজের চিন্তাধারা অন্য দিকে বইতে দেখে। আর এটাই তো স্বাভাবিক।। মানুষ অনন্তকাল ধরে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে থাকিয়ে থাকতে পারেনা।
শরফুদ্দিন সাহেব এশার নামাজ পড়ে এসে দেখলেন সবাই তার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে। টেবিলে চারটা খাবারের প্যাকেট রাখা। নম্রতা বক্সগুলো খুলে প্লেটে প্লেটে তেহারি ঢেলেদিতে লাগল। কিরে মা কি ব্যাপার? তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন জয়ীতাকে।নমির স্যান্ডেল কেনার জন্য দোকানে গেছিলাম। ওখান থেকেই কিনে আনলাম।জয়ীতা উত্তর দেয়।” জানো আব্বু ওখানে না আপুর স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল জামান সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিল। ঐ যে আপুকে দেখতে এসেছিল অসুখের সময়। আমাকে চটপটিও খাইয়েছেন উনি” হাসিমুখে বলতে থাকে নম্রতা। আপুর ভাইসপ্রিন্সিপাল সাহেবকে বেশ পছন্দ হয়েছে ওর।কতো বছর হয়ে গেল দুলাভাই মারা গেছেন। আপুর জন্যে তার কষ্ট হয় অনেক। আপুর শশুরবাড়ি মানুষগুলোও ভালছিলনা। দুলাভাই মারা যাবার পর অলুক্ষুনে অপয়া আরও সব অপবাদ দিয়েছিল আপুকে।আপুর জন্যেই নাকি দুলাভাই মারা গেছে। অন্য কারো সাথে বিয়ে হলে নাকি দুলাভাই বেঁচে থাকতো। মানুষ কিকরে এতো খারাপ হতে পারে নম্রতার বুঝে আসেনা।শরফুদ্দিন সাহেবের প্লেটে জয়ীতা একটা পলেথিন থেকে কাঁচামরিচ কাটা পেয়াজ আর লেবু তুলে দিল।জহুরা বেগমের প্লেটে জয়ীতা লেবু কাঁচামরিচ দিয়ে তাকে গ্লাস পানি ঢেলে দেয়।
রবিবার জয়ীতা বাবার সাথেই বাসা থেকে বের হয়। আগেই তাদের দুজনের দুপুরের খাবার সে লাঞ্চবক্সে ভরে রেখেছিল। স্কুলে জয়ীতাকে নামিয়ে দিয়ে শরফুদ্দিন সাহেব অফিসে রওনা হন। জয়ীতাকে নামিয়ে অফিস আসতে গেলে একটু দেরিতে পৌছানো হয় অফিসে তার । কিন্তু তিনি কিছু মনে করেন না তাতে কারন এই সময়টুকু তাদের বাপ-বেটির নিজস্ব সময়। মেয়েটার জন্য তার বুকের ভেতরটা হু হু করে। এক এক সময় ভাবেন তাড়াতাড়ি মেয়েটার বিয়ে যদি না দিতেন তাহলে হয় তো এই অল্প বয়সেই মেয়েটা তার বিধবা হয়ে যেতনা। দুপুরে লাঞ্চের সময় হটপট খুলতেই কষানো মাংসের সুগন্ধ ছড়াতে শুরু করে।রাতে জয়ীতা কি রান্না হবে তাগুছিয়ে রাখে সকালবেলায় কাজের মেয়েটা ঝটপট একচুলোয় বসিয়ে দেয়। শরফুদ্দিন সাহেব হাত ধুয়ে খাওয়া শুরু করেন।
গপ্প -মধ্যবিত্তে সুখদুঃখের কাব্য
পর্ব ৬
খালেকজ্জামান সাহেবের মনটা আজকে বেশ ভাল। ইদানিং তার বাবা মনিরুজ্জামান সাহেবের শারীরিক অবস্থার বেশখানিকটা উন্নতি হতে শুরু করেছে। উনি যদিও হুইলচেয়ার ব্যাবহার করেন। ক্রমাগত দুইবছর ধরে ফিজিওথেরাপি করার ফলে উনি পা নাড়তে পারছেন।ডাক্তার বলেছে বিদেশে নিয়ে হিপ রিপ্লেসমেন্ট করলে উনি আবার হাটতে পারবেন। কিন্তু সেটা অনেক ব্যাপার। কিন্তু যে ইম্প্রুভমেন্টটুকু হয়েছে সেটুকুতেই সে এমুহুর্তে সন্তুষ্ট। মনিরুজ্জামান সাহেব এতখরচের বিপক্ষে ছিলেন।কিন্তু জামান সাহেব বাবার কোন কথাই শোনেননি।তার ধৈর্য্য এতোদিনে ফল পেতে শুরু করেছে। জামান সাহেবের আর একটা কারনেও মন ভাল।
রাতে বোন আর বোন জামাইকে খেতে বলেছেন। মায়ের উপর উপর যাতে চাপনা পড়ে তার জন্য বাইরে থেকে কাবাব নান বোরহানী আনিয়েছেন।সায়লা ফোন করেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।বাঁধা কাজের লোকজন টেবিল রেডি করছে। জাহেদা বেগম সালাদ রেডি করছেন। তিনি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তার একমাত্র ছেলেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। তার বোহেমিয়ান ছেলেটা প্রিয় জগৎটা ছেড়ে এসে কি ভাবে বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ভার্সিতে থাকতে যে মেয়েটাকে পছন্দ করতো তার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাবার পর আর কোন মেয়েকে নুতন করে পছন্দ করে বলেও শোনেননি।কিছুক্ষনের মধ্যেই সায়লা এসে পৌছায় স্বামী পুত্রসন্তানসহ। সায়লা আগে তার বাবার সাথে দেখাকরে। সায়লার স্বামী কবির শাশুড়ির কাছে হাতে থাকা ব্যাগগুলো হস্তান্তর করে। জামান সাহেব রুম থেকে বের হয়ে আসে। হাসিমুখে হাত মেলায় ভগ্নিপতির সাথে।” বসো তুমি আমি আব্বাকে নিয়ে আসি”। ভগ্নিপতিকে বসতে বলে জামান সাহেব বাবা রুমের দিকে চলে গেলেন। খানিক পরে জামান সাহেব ওনার বাবাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে এলেন। কম্পিউটারাইজ হুইল চেয়ার স্মার্ট ফোনের সাহায্যে চালানো যায়। অনেক টাকা পয়সা খরচ করে জামান সাহেব বিদেশ থেকে আনিয়েছেন। জামান সাহেবের আউট সোর্সিং ব্যাবসাও আছে। তিনটার পর তার হাতে এনাফ সময় থাকে বেশিরভাগ দিনই। তার কিছুটা সময় তিনি আউটসোর্সিংয়ের কাজে ব্যাবহার করেন। ছোট বোন সায়লা মাঝে মাঝে খেপায় এইবলে যে ভাইয়া কি কান্ড তুমি তো দেখছি আস্তে আস্তে পুরোপুরিভাবে ক্যাপিটালিস্ট হয়ে যাচ্ছ। জামান সাহেব বোনে কথায় প্রানখুলে হেসে ওঠেন। আজও দুইভাইবোন হাসাহাসি করতে করতে মনিরুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে বের হয়ে আসে।জহুরা বেগম হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর কেউ না জানুক তিনি তো জানেন তার ছেলেটা কতো সহ্য করছে নিঃশব্দে। জহুরা বেগমের চোখ দুটো ছলছল করে।