ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ৬
(নূর নাফিসা)
.
.
তৃতীয়দিনের মাথায়, লিখতে বসে খেয়াল হলো তার পেন্সিল দুই তৃতীয়াংশ শেষ! বাবাইকে যে বলেছিলো পেন্সিল এনে দিতে বাবাই তো দিলো না। এইযে তার পেন্সিলটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, ঠুস ঠাস দুইবার মাথা ভেঙে গেলেই তো লেখার অযোগ্য হয়ে যাবে! কিছুটা রাগ হলো বাবাইয়ের উপর। এইমাত্রই ফিরেছে তার বাবাই। দরজা খুলতেও তাকেই পাঠিয়েছে ফাইজা। নিজে গেছে কিচেনে, খাবার রেডি করে দিয়ে আসতে। নওরিন দরজা খুলেই বললো,
“বাবাই তুমি আমার পেন্সিল নিয়ে আসোনি কেন?”
“মনে নেই।”
হাঁটার পথে জবাব দিয়ে চলে গেলো নোমান। বাবার এমন হেয়ালিপনা জবাবও যেন পছন্দ হলো না নওরিনের। বরং রাগটা স্থির উপস্থিত রইলো। তাই সে তার এইটুকু পেন্সিলটা হাতে নিলো এবং বাবার কাছে পাশের রুমে গেলো। পাকা বুড়ির মতো এক হাত কোমড়ে রেখে আরেক হাতে পেন্সিল দেখিয়ে বললো,
“এই দেখো, দেখো… তোমাকে যে বললাম আমার পেন্সিল শেষ। তাই পেন্সিল এনে দিতে। তুমি তো বিশ্বাস করলে না। দেখেছো, কতটুকু পেন্সিল যে আছে? এইটুকু পেন্সিল শেষ হয়ে গেলে আমি লিখবোই কি করে আর! তুমি কোনো কথা শুনো না আজকাল!”
আগের নোমান হলে হয়তো পাকা বুড়ির নাক টেনে আদর দিয়ে বলতো কালকের মধ্যে এনে দিবে, কিংবা আর না ভুলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসতো। কিন্তু এই বদলে যাওয়া নোমান যেন বাচ্চার পাকামোতে বেশ ক্ষেপে গেলো। তাই ধমকে উঠে বললো,
“বলেছি না মনে নেই! একবার শুনতে পাওনি? যাও এখান থেকে! যাও!”
হঠাৎ ধমকে উঠায় আৎকে উঠেছে নওরিন। বেশ ভয় পেয়েছে ধমক এবং বাবার রাগান্বিত চোখমুখ দেখে। ভয়ে কান্নাও চেপে গেছে ভেতরে, মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে আছে। অথচ বাবার সামনে কাঁদতেও ভয় পাচ্ছে। সে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে মাকে দেখতে পেয়েই চিৎকার দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো মায়ের কাছে। নোমানের হঠাৎ ধমকে উঠা শুনে এদিকে কাজ থেমে গেছে ফাইজারও। সে এগিয়ে দরজার কাছে আসতেই নওরিন ছুটে এসেছে তার কাছে। মেয়ের চিৎকারে এখন বুক জ্বালা করছে তারও। মেয়ে তো সহজে কাঁদে না! নোমান তাকেও মেরে বসেনি তো কোনো কারণে? এমন রাগলো কেন বাচ্চার উপর! সে মেয়ের মাথা পেটে চেপে ধরে বললো,
“কি হয়েছে মা? কি হয়েছে?”
চিৎকারের মাত্রায় কথা বলতে পারছে না নওরিন। ফাইজা তাকে পাশের রুমে নিয়ে গেলো। খাটে বসে, মাথায় চুমু দিয়ে, চোখ মুছে দিয়ে, ক্ষণে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বারবার বলছে,
“কাঁদে না, মা। এইযে আমি। আম্মু তোমাকে আদর করে দিচ্ছি।”
মায়ের আদুরে আদুরে কথায় কান্না কমানোর চেষ্টা করলো নওরিন। হেচকি উঠে গেছে তার এটুকুতেই। ফাইজা মাথার দুপাশে ধরে বৃদ্ধা আঙুলে গাল মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
“কাঁদছো কেন তুমি? বাবাই মেরেছে তোমাকে? হুম? বলো আমাকে। মেরেছে বাবাই?”
নওরিন হেচকি তুলতে তুলতেই মাথা দুপাশে নাড়লো। ফাইজা আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“কাঁদছো কেন তবে? বাবাই বকেছে?”
নওরিন এবার ইতিবাচক মাথা নাড়লে ফাইজা পরপর দুইবার জিজ্ঞেস করলো,
“কেন বকেছে? দুষ্টুমি করেছো তুমি?”
নওরিন মাথা দুদিকে নেড়ে মায়ের জবাব দিলো,
“আমি পেন্সিল এনে দিতে বলেছি তাই বকেছে, বাবাই। আমার এইটুকু পেন্সিল শেষ হয়ে গেলে আমি লিখবো কি করে!”
ফাইজা মেয়ের হাতে পেন্সিলের দিকে তাকিয়ে ধীর নিশ্বাস ছাড়লো। সামান্য পেন্সিলের জন্য এভাবে রেগে যেতে হবে বাচ্চার উপর! সে কি জানে না গলা শক্ত রেখে কথা বললেই তার বাচ্চা মন খারাপ করে বসে? সে অবুঝ, আহ্লাদ করে নিজের প্রয়োজন বলতেই পারে। তাই বলে এভাবে ধমকাতে হবে? নিজের বাচ্চা কেমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, আর কেমন রিয়েক্ট ধারণ করতে পারে, সেই সম্পর্কে কি তার ধারণা নেই? মাথা কি পুরোই খেয়ে নিয়েছে ওই মেয়ে?
শুধু নোমানের উপর না, নিজের উপরও রাগ হচ্ছে ফাইজার। তারই খেয়াল হলো না কেন মেয়ের পেন্সিল শেষ। নোমানের আশায় কেন বসে রইলো। টাকা তো তার কাছেও কিছু আছে। তাকে স্কুলে দিয়ে আসে, নিয়ে আসে। তখন সে-ই তো পারতো দুইটা পেন্সিল কিনে দিতে। ওদিকে তার খেয়াল হলো না কেন, মেয়ের পেন্সিল চাই। মেয়েও কি একবার তার কাছে বলতে পারলো না! মেয়েরই বা কি দোষ। সে জানে দ্রব্যাদির চাহিদা পূরণ করে তার বাবা, তাই হয়তো বাবার পিছুই আবদার নিয়ে ঘুরে। মাকে একবারও বলেনি, “পেন্সিল কিনে দাও।”
ফাইজা ঠিকঠাকভাবে নওরিনের চোখ মুছে বললো,
“আমি তোমাকে কিনে দিবো পেন্সিল। তোমার পেন্সিল লাগবে, সেটা আমাকে বললেই তো আমি তোমার স্কুলের সামনে থেকে কিনে দিতাম। কেঁদো না আর। আমি কালই তোমাকে পেন্সিল কিনে দিবো দোকান থেকে। আরও কিছু লাগলে আর আব্বুকে বলতে যেয়ো না। আমার কাছে আগে বলবে। ঠিক আছে?”
নওরিন মুখের শব্দ থামালেও চোখের পানি ফেলতেই আছে। ফাইজা তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। যখন মনে হলো শরীরের ভার সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে নওরিন, তখন তাকিয়ে দেখলো ঘুমিয়ে পড়েছে। কম্পিত নিশ্বাস ফেলে মেয়েকে বিছানায় তুলে শুয়িয়ে দিলো। ঘুমানোর আগে একবার ওদিকটাও দেখতে গেলো। নোমান খেয়ে উঠে গেছে আরও অনেক্ক্ষণ হয়। সবটা গুছিয়ে রেখেই ঘুমাতে এলো ফাইজা। চোখের পানিটা গত দুদিনের চেয়ে আজ বেশিই ঝরলো মেয়েটাকেও এভাবে আঘাত করায়। এইটুকু বাচ্চার উপরও তার এভাবে ক্ষেপে যেতে হবে! ভাবতে গেলেই রাগ হয়, কষ্ট বাড়ে। প্রতি মোনাজাতে প্রার্থনা করে মানুষটার হেদায়েত হোক।
সকালে রান্না করার সময় দেখলো কাপড়চোপড়ের একটা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যাচ্ছে নোমান! আজ ঘুম থেকেও উঠেছে তাড়াতাড়ি। নাস্তাও চায়নি। ওইতো, বেরিয়ে যাচ্ছে! ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে সে? বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো ফাইজার। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নোমান ধীর পায়ে বের হয়নি। দিকবিক না তাকিয়ে দ্রুত পায়েই চলে গেছে। ভেতরের ভয়টা চোখে পানি এনে দিয়েছে ফাইজার৷ সে আরও এগিয়ে মেইন দরজার পাশে গেলো৷ ততক্ষণে হয়তো বাড়ির সীমানাও ছেড়ে দিয়েছে নোমান। সে কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাড়িয়ে রইলো। তারপর দরজা লাগিয়ে ফিরে এসে খুবই বেখেয়ালিভাবে রান্না শেষ করলো। নওরিনকে ডাকতে হয়নি আজ। সময়মতো উঠে গেছে। মাকে না পেয়ে সোজা চলে এসেছে কিচেনে৷ গতরাতের কান্নার ছাপ যেন এখনো চেহারায় লেগে আছে। মনটা ভীষণ রকমের খারাপ করে রেখেছে। আজ মা মেয়ের মন খারাপের দিন!
নওরিনকে স্কুলের জন্য রেডি করে সাথে নিয়ে বের হলো ফাইজা। এসময়ে ঘনঘন বাইরে চলাচলটা তার জন্য একটু ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও নিরুপায় সে। মেয়েকে স্কুলে দেওয়ার জন্য এবং নেওয়ার জন্য আসতেই হবে তাকে। রিকশা থেকে নেমে স্কুলের গেইটে ঢোকার আগে নওরিনকে নিয়ে গেলো স্টেশনারি দোকানে। দুইটা পেন্সিল নিলো৷ আরও কিছু নিবে কি না জিজ্ঞেস করলে নওরিন একটা ম্যাংগো ফ্রেভারের রাবার চাইলো। ফাইজা কিনে দিলো তার কাঙ্ক্ষিত রাবার। কিছুটা খুশিমনেই এবার স্কুলে প্রবেশ করলো। গেইটে দাঁড়িয়ে মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময়ই দেখা পেলো সাবিহার। কেমন কটাক্ষ চোখে তাকিয়ে চলে গেলো সাবিহা। ফাইজারও অসহ্য লাগলো এর মুখ দেখায়! সে বাড়ি ফেরার জন্য আবার রিকশার খোঁজ করলে রিকশা পেলো না। মাথার উপরে কড়া রোদ, ঘামিয়ে দিচ্ছে একেবারে। দুরত্ব খুব বেশি না। মাত্র সাত-আট মিনিটের পথ। কিন্তু হাঁটতে গেলে যদি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যায়! সেই ভয়ে এই সাত আট মিনিট না হেটে রিকশার অপেক্ষায়ই দাঁড়ালো গেইটের ছাউনির নিচে। চারপাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর রিকশা পাওয়া গেলে সাবধানে উঠে আবার রওনা হলো বাড়ি পথে। বাড়িতে এসে আজ আলমারি খুললো। আলমারিতে থাকা নোমানের অর্ধেক কাপড়চোপড়ই নেই! হৃদপিণ্ডটা যেন আবারও কেঁপে উঠলো। টাকাপয়সা কিছু আছে এখানে৷ কতটা নিয়ে গেছে তা অজানা। কারণ নোমান কত রাখছে, আর কত নিয়ে যাচ্ছে, তার কোনো হিসেব রাখে না সে। কদিন যাবত তো আলমারিই খোলা হয় না তার দ্বারা। তাই চোখও পড়ে না টাকার ওদিকে।
দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতও চলে যাচ্ছে কিন্তু নোমান ফিরছে না। ফেরার জন্য তো আর কাপড়চোপড় নিয়ে যায়নি সাথে! বসে বসে কিসের অপেক্ষা করছে ফাইজা? একদম একটা পাথরের মতো বসে আছে এই মধ্যরাতেও। বাঁধন ছিঁড়ে সে না গেলেও যার জন্য তার থেকে যাওয়া, সে-ই চলে গেছে আজ তাকে ছেড়ে। ভালোবাসার এ কেমন পরিণতি দেখতে হলো তাকে? এর জন্যই কি ভালোবাসার সৃষ্টি হয়? ভালোবাসার সৃষ্টি তো ভালো থাকার জন্য হওয়া উচিত। তবে কোথায় সেই ভালো থাকা? নাকি ঠিকমতো ভালোবাসাই হলো না তাদের?