#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৩,৪,৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
৩
অফিসে সারাদিনের ব্যস্ততার পর নতুন বাসার ঝামেলার মাধ্যমে এই কয়েকদিন অনেকটা হাপিয়ে উঠেছে জুঁই । শরীরটাও ইদানীং ভালো না তার । নতুন বাসা পরিষ্কার করা ফার্নিচার সেট-আপ করা সব একা হাতেই করে জুঁই । পরিস্থিতি তাকে এতটাই শক্ত পাথর তৈরি করে দিয়েছে যে তার কাউকেই প্রয়োজন হয় না । তার জীবনে যদিও ভালোবাসা বলে কিছু থাকে তা হলো ইফসির জন্যে । মাঝে শুধু একদিন রাসেল এসে কিছুটা গুছিয়ে দিয়ে গেছে ।
শুক্রবার দিন , আজ অফিসও বন্ধ । তাই জুঁই ঠিক করেছে আজকেই নতুন বাসায় চলে যাবে । সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের মাকে বুঝিয়ে ইফসিকে নিয়ে জুঁই বেরিয়ে যায় নিজের বাবার বাসা থেকে । জুঁইয়ের ভাষ্যমতে , যেখানে তার এবং তার মেয়ের থাকা নিয়ে নিজের ভাই আর ভাবীরা আলোচনা করে সেখানে সে এক মুহুর্তের জন্যও থাকবে না ৷ দূরে থাকলে কাছের মানুষগুলো হয়তো দূরে থাকবে কিন্তু সম্পর্কটা বেঁচে যাবে । যার জন্যে জুঁইয়ের এই সিদ্ধান্ত । রইলো বাকি ইফসির কথা । ইফসি মাশা-আল্লাহ তার মাকে অনেকটাই বুঝে । দেড় বছর বয়সে সে বুঝে তার মা একা এটাও বুঝে তার মায়ের পৃথিবীতে কেবল সেই আছে । আল্লাহ পাক যেন বাচ্চাটাকে ঠিক সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন । ৮ মাসের মাথায় এতিম করে দিয়েছে ইফসিকে । আল্লাহ পাক নাকি যা করে ভালো করে কিন্তু ৮ মাস বয়সী বাচ্চার মাথার উপর থেকে বাবার হাত সরিয়ে নিয়ে কি ভালো করলেন এর উত্তর আজও জুঁই খুঁজে বেড়ায় ।
জুঁইয়ের আর তার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক ততটা ছিল না । বিয়েটা হয়তো কোন একভাবে হয়ে গেলেও বিবাহিত জীবনে সে কখনই সুখী ছিল না সে । কিন্তু কোন এক গভীর কারণে ছেড়ে চলে যেতে পারে নি সে তার সংসারকে । যার জন্যে সবটাই সহ্য করে থাকতে হয়েছিল তাকে । কিন্তু আল্লাহ পাক সেইখান থেকেও তাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন ।
মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা গুলো , যেদিন ফারুক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে । সেদিন এক ফোঁটা চোখের পানি পড়ে নি জুঁইয়ের চোখ দিয়ে । একদম পাথর ছিল সে । কষ্ট গুলো এতটাই খেপিয়ে দিয়েছিল তাকে যে , সে পাথর হতেও বাধ্য হয়েছিল । জানালার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে ভাবছিল সেই দিনের কথা গুলো । অবশ্য ভাবছিল না সব কিছু যেন চোখের উপর ভেসে উঠছে তার ।
রাজশাহী শহরে একটা মফস্বল এলাকার গলি নাম্বার ৫ এর হাউজ নং ৫৫ এর তৃতীয় ফ্ল্যাটে জুঁই তার শ্বশুরবাড়িতে থাকতো । ৫ম তলার একটি এপার্টমেন্টের মালিক ছিলেন জুঁইয়ের শ্বশুর । আর ওনারই একমাত্র ছেলে ছিল জুঁইয়ের স্বামী মানে ফারুক ।
টাকা পয়সা কম ছিল না তাদের । তবে ব্যবহার ছিল অনেকটা কুকুরের মত । জুঁইয়ের পিছনেই লেগে থাকতো তারা সর্বক্ষণ । জুঁইয়ের দু পা একদিনের জন্যেও এক জায়গায় স্থির রাখতে দেয় নি তারা । ফরমায়েশ ছিল তাদের হাজার রকম । জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও ফারুক নিজের কর্মের ফল ভোগ করে গেছে ।
জুঁই তার শ্বশুরবাড়িতে কোন রকম শান্তি পায় নি । একটার পর একটা অশান্তি হয়েই গেছে । তিন বছরের বিবাহিত জীবনে সুখ বলতে কি ছিল তার জীবনে সে আদৌ বুঝে উঠতে পারে নি । স্বামী স্ত্রীর মাঝের সম্পর্কটা শুধু বিছানা অবদিই নয় । কিন্তু জুঁইয়ের বিবাহিত জীবনটা সেটাই ছিল । ফারুক আর তার মাঝের সম্পর্কটা ওই বিছানা অবদিই ছিল । ফারুক তার শারীরিক চাহিদা মেটাতো আর জুঁই তাকে খুশী করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতো । কয়েকবার হয়তো নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েও থাকতে হতো ফারুকের সাথে তাকে ।
একদিন রাতে , শরীরের অসহ্য যন্ত্রনা আর জ্বরের তাড়নায় অনেক খারাপ অবস্থা ছিল জুঁইয়ের । কিন্তু সেদিনও ফারুকের কামনার কাছে হার মানতে হয়েছিল তাকে ।
– আমার শরীরটা ভালো লাগছে না ফারুক ।
– তোমার কি সারাদিনই শরীর খারাপ থাকে ?
– তুমি এই কথা কিভাবে বলো ফারুক , তুমি কি এটা দেখতে পাও না আমি সারাদিন তোমার সংসারে কি পরিমাণ খাটি ।
– আমি কাছে আসলেই তোমার হাজারটা বাহানা থাকে ।
– আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখো তুমি । সন্ধ্যা থেকেই প্রচুর জ্বর আসছে আমার । আর তুমি কিনা ?
– ধুর ,
এই বলে ফারুক ওইদিকে ফিরে যায় । জুঁইও তখন লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে । কিন্তু ১০ মিনিট পর ফারুক আবারও এই দিকে ফিরে জুঁইকে আঁকড়ে ধরে । সে রাতে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েও ফারুককে সুখ দিতে হয়েছে জুঁইকে ।
হঠাৎ ইফসির আম্মুন ডাক শুনে পিছনে ফিরে তাকায় জুঁই । চোখের পানি মুছে মেয়েকে হাত বাড়িয়ে কোলে নেয় জুঁই ।
– আম্মুন উঠে গেছেন আপনি ? ঘুম ভেঙেছে আমার আম্মুনের ।
মায়ের আদর খেয়ে পরম আদরে মায়ের গলা জড়িয়ে নেয় ইফসি । তার কাছে মা মানেই শান্তি ।
.
.
চলবে…………….
#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৪
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
জুঁইয়ের পৃথিবীতে এখন ইফসি ছাড়া কেউ নেই । জুঁইয়ের পুরো দুনিয়া একদিকে ইফসি একদিকে । যদিও ইফসি অযাচিত ভাবেই এসেছিল । মূলত ইফসির জন্যই জুঁইয়ের বেঁচে থাকা । নয়তো জুঁই আগেই শেষ হয়ে যেতো । জুঁইয়ের এখনও মনে পড়ে ইফসি যখন প্রথম তার গর্ভে আসে । মান্থ মিস হয়ে যাওয়ার পর প্রেগন্যান্সি স্টিক দিয়ে যেদিন পজিটিভ রেজাল্ট পায় যে সে মা হতে যাচ্ছে সেদিন সে প্রায় ১ ঘন্টার মত স্তব্ধ হয়ে যায় । অযাচিত ভাবে অনাগত ভবিষ্যত তখন তার গর্ভে জায়গা করে নিয়েছে । সে চায় নি এই সন্তান । যেখানে তার নিজের ঠিক ঠিকানা ছিল না । সে তার স্বামীর কাছ থেকে শুধুই দৈহিক কষ্ট পেয়ে গেছে মনের শান্তি পায় নি কখনো ।
তারপর একে একে ৮ টা মাস পার করে জুঁই । ফারুক শুধু রাতে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতেই ব্যস্ত ছিল কখনো খবর নেয় নি তার স্ত্রী কেমন আছে ।
জিনিস গুলো এখন খুব করে ভাবায় জুঁইকে ।
– মানুষটা চলে গিয়েও কেমন যেনো লেগে আছে আঠার মত । জীবনটাকে নিয়ে শেষ জুয়াটা না খেললেও পারতাম । জুয়ার মজলিশে আজ আমি হেরে যাওয়া জুয়ারি মাত্র ।
কিছুক্ষণ পর চোখের পানি মুছে নিজেকে তৈরি করে নেয় জুঁই । শাড়িতে কুচি দিতে দিতে হঠাৎ ভাবনায় মত্ত্ব হয়ে যায় জুঁই ।
– তার সাথে মনের মিলনটা ছিল হয়তো ঠিকই । কিন্তু আবদ্ধকরণ টা ছিল অনেক বেশি । হয়ত এটাকে প্রেম বলা চলে ভালোবাসা নয় । ভালোবাসা হলে আজ পরিস্থিতি অন্যরকম হতো ।
অঝোর ধারায় চোখের পানি পড়ছে তার চোখ দিয়ে । ভালোবাসার নামে জুয়া খেলেছিল সে আর পরবর্তীতে বিয়ের নামে আরও একবার নিজেকে জুয়াতে নিয়োজিত করে দিয়ে শেষ জুয়াটা আমিও খেলে দিলাম ।
রাস্তা দিয়ে উদাস মনে হেটে যাওয়া জুঁইয়ের খবরও নেই যে রিক্সাওয়ালা তাকে সাইড হতে বলছে তাকে ।
– আরে ওই আফা হরেন না ,
– দেখি নাই ভাই , যান আপনি ।
– রাস্তা দিয়া হাডেন কেমনে , নিজের লগে বাচ্চাডারেও মারবো মনে অয় ।
রিক্সাওয়ালার কথাও তার কান অবদি পৌঁছায় না । এতটাই উদাস সে যে তার সাথে তার দেড় বছর এর মেয়ে ইফসিও আছে তার খেয়াল নেই । জুঁই রাস্তার মাঝ বরাবর এসে হাতের ইশারা দিয়ে রাস্তা পার হয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে ওপাশে চলে আসে । মাঝে মাঝে ইফসিকেও হাটায় সে । সবাই হয়তো ভাববে দেড় বছর এর মেয়েটাকে হাটাচ্ছে ,এ কেমন মা , আর সে ক্ষেত্রে জুঁইয়ের জবাব হয় , ” আমার মেয়ে আমার মতই সাধারণ মানুষ হিসেবে বড় হয়ে উঠবে , কারণ কে বলতে পারে যে বড় হয়ে সে তার মায়ের মত কষ্ট নিয়ে হাটবে না ”
কিছু দূর এসে ইফসি হাত পা ছুড়ছে , তার হয়ত পা ব্যাথা করছে । মায়ের দিকে দু’হাত পেতে ইশারায় বলছে ,
– আম্মুন কোলে কোলে ,
মেয়ের কথায় জুঁই কোলে তুলে নেয় ইফসিকে । মায়ের কথায় দুই ঝুটি দুলিয়ে মিষ্টি হাসি দেয় ইফসি । যে হাসিতে জুঁই তার শত কষ্ট নিমিষেই ভুলে যায় ।
– আম্মুনকে একটা পাপ্পা দিবা না মা ?
– উম্মাহ উম্মাহ , আম্মুন উম্মাহ উম্মাহ উম্মাহ
রাস্তাতেই অনেক গুলো চুমু দিয়ে দেয় তার মাকে । মা মেয়ের সম্পর্ক দেখে হয়তো আশপাশের সবকিছুও হিংসা করে । জুঁই ইফসির সাথে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ।
হঠাৎ করেই একটা বাইক পেছন থেকে এসে জুঁই আর তার বাচ্চাকে ধাক্কা মারতে মারতে ব্রেক টেনে ধরে । বাইকে বসা পুরুষ যখন বাইক থেকে নেমে হেলমেট খুলে জুঁইয়ের সামনে দাঁড়ায় ওই মুহুর্তে জুঁইয়ের মাথা নষ্ট হয়ে যায় । পায়ের নিচ থেকে মাটি গুলো সরে যাচ্ছে এমন অবস্থা । ইফসিকে কোলে রাখা অবস্থাতেও জুঁইয়ের হাত নড়ে চড়ে ওঠে ।
এ কাকে দেখছে সে । সেই চোখ , সেই নাক , সেই চাহনি , সেই মাধুর্যতা , সেই শ্যাম বর্ণের জাদুকর আজও প্রায় একই রকম আছে । কেন যেন জুঁইয়ের ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে । কেন যেন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় সে । ইফসিকে শক্ত করে ধরে রেখে চোখের কোণ থেকে বেয়ে পড়া পানি গুলো শাড়ির আঁচলে মুছে নেয় জুঁই । লম্বাটে শ্যাম বর্ণের পুরুষটি ধীর পায়ে অসার শরীর নিয়ে জুঁইয়ের দিকে এগিয়ে যায় ।
ইফসি তার মাকে কাঁদতে দেখে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে । মায়ের চোখের পানি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বাচ্চাটাও ।
পুরুষটি এগিয়ে এসে অবাক এবং শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে ,
– কেমন আছো জুঁই ??
সেই চেনা কন্ঠস্বর আজ প্রায় তিন বছর আবারও জুঁইয়ের কানে এসে লাগে । নিয়তির নিষ্ঠুর খেলায় বলি হতে হয় কেন জুঁইদের । চেনা শহরে কিছু পুরাতন ধুলো বালি পড়ে জমে থাকা কিছু স্মৃতি কেন এত দিন পর তার সামনেই এসে পড়ে । মেয়েকে আরও আঁকড়ে ধরে দুই পা কে নিজ আয়ত্ত্বে এনে অত্যন্ত শান্ত গলায় জবাব দেয় জুঁই ,
– মরার মত মরে নেই , আবার বাঁচার মত বেঁচেও নেই ।
তারপর হঠাৎ জুঁইয়ের মন অজান্তেই বলে ওঠে ,
– কথা তো দিয়েছিলে ফিরবে
তারপর বিষন্নতার মাঝে একটুকরো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে রাস্তার বুকে
.
.
চলবে……………………
#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
অফিসের কেবিনে বসে ভাবছে অনেক কিছুই । পাশের সিটে ছোট্ট ইফসি বসে আছে চুপ করে । ইফসি বড্ড বেশি শান্ত । একদম যেন দ্বিতীয় জুঁই । ইফসি ক্ষুধা লাগলেও কাঁদবে না । আর সে জোরে ব্যাথা না পাওয়া ছাড়া কাঁদে না , আর এমনি পেলেও কাঁদবে না । আসলে আল্লাহ পাক হয়তো ইফসিকে শক্ত মাটি দিয়েই বানিয়েছে । ফাইল খুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে জুঁই । যেইভাবে বসিয়ে রেখেছে ঠিক সেইভাবেই আছে ইফসি । ছোট ছোট দুইটা পুতুল দিয়ে খেলছে সে । মাকে একদম জ্বালাচ্ছে না বুড়িটা । হঠাৎ করে জুঁইয়ের মন চাইলো মেয়ের সাথে কথা বলতে ,
– আম্মুন তুমি করতেছো ?
মায়ের কথায় ঝুটি দুটো নাড়িয়ে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় সে । একটু হাসি দেয় আর পুতুল দেখিয়ে বলে
– আমি তেলি (খেলি)
মেয়ের কথায় মুচকি হেসে দেয় জুঁই আর কাজে আবারও মন বসায় সে । ফাইল গুলো অনেক নিখুঁত ভাবেই পর্যবেক্ষণ করে জুঁই । অন্যদিকে ইফসি চেয়ার থেকে নেমে পুরো কেবিন হাটছে । ঠিক এইভাবেই জুঁইয়ের সকাল থেকে দুপুর আর দুপুর থেকে সন্ধ্যা হয়ে যায় । তারপর আবার ঘরের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হয় ।
রাতে মেয়েকে খাইয়ে শুইয়ে দেয় জুঁই । জানালার পাশে এসে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সে । আল্লাহ পাকের এই সুন্দর পৃথিবীতে যদি দিন মুছে দেয়ার নিয়ম থাকতো তাহলে সে আজকের দিনটা অনায়াসে মুছে দিতে পারতো । কারণ আজকে এমন কাউকে দেখতে হলো তাকে আর এমন কারো কন্ঠস্বর শুনতে হলো তাকে যাকে সে তিন বছর আগেই মুছে দিতে বাধ্য হয়েছিল । অবহেলা পেতে পেতে শুকিয়ে যাওয়া গলাও তার চুপচাপ হয়ে যায় এক অন্ধকারের বদ্ধ ঘরে ।
চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে জুঁইয়ের । যেই পুরুষটিকে মনে প্রাণে এত বেশিই ভালোবেসেছিল সে আজ সেই পুরুষটিই আবার তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে । তাও কিনা যখন তার সন্তান তার কোলে ছিল ।
হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় সেইদিনের কথা যেদিন পার্কে প্রায় দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিল জুঁই । আর সে এসেছিল পিছনে , চুপি চুপি এসে জুঁইয়ের চোখ চেপে ধরেছিল । আর জুঁইও তখন খপ করে সেই এক জোড়া হাত ধরে নেয় আর বলে ওঠে ,
– নাফিস , এই আসার সময় হলো তোমার ?
– আমি তো জানি অপেক্ষায় রত আছে আমার কাদম্বরী ,
– কথা নাই তোমার সাথে আর ?
– রেগে থাকলে বেশ লাগে আমার কাদম্বরীকে ,
– সব সময় মজা ভালো লাগে না কিন্তু ,
– রাগলে তোমায় লাগে যে ভালো
কাদম্বরী আমার আমি তোমাতেই
মিশে আছি পাও কি খুজে আমার
অস্তিত্ব
– আমাকে কাব্য আর কিছু কবিতা দিয়েই দমাতে পারো তুমি ।
– আমার তোমায় দমাতে হয় না তুমি আমাতে এমনি দমে আছো ।
– তাই তো এমন করো ,
– ভালোবাসি তোমায় আমি
এমন তো করি নি
চেয়েছি রাঙাতে এই মন
সাথে চেয়েছি তোমারই আরাধন
– ভালো ভালো খুব ভালো ।
ধ্যান ভেঙে যায় জুঁইয়ের । জানালার পাশে বসে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয় জুঁই । তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালার থাই গ্লাসটা টেনে দিয়ে ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা নিয়ে বেতের সোফায় বসে যায় জুঁই । মাঝের পাতায় কিছু লিখে নিচে দুটো লাইন লিখে দেয় সে ,
হারিয়ে গিয়েও আবার এলে কাছে
কাছেই যদি এলে তবে হারিয়ে কেন গেলে
ডায়রিটা বন্ধ করে ব্যাগে রেখে লাইট অফ করে বিছানায় এসে শরীর এলিয়ে দেয় জুঁই । তারপর আস্তে করে চোখ বন্ধ করে নেয় সে । কারণ আগামীকাল আবারও তার যুদ্ধ করতে হবে ।
অন্ধকার ঘরে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধো শোয়া অবস্থায় আছে একজন পুরুষ । তার চোখে বার বার ভেসে আসছে আজকে রাস্তায় দেখা এক নারীকে । যার চাহনিতে আগে থাকতো খুশির ঝলক আর এখন এক বিষন্নতার মেঘ জমা । পায় পাতলা শুকনো গঠনের নারীটি আজ অনেকটাই বদলে গেছে । নারীর কোলে ছোট বাচ্চা থেকে কেন যেন পুরুষের বুকের বাম পাশের জায়গাটায় চিন চিন করে ব্যাথা শুরু হয়েছিল ।
হয়তো আজকের এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র তার জন্যেই । নারীর তো কোন অন্যায় ছিল না । নারী তো মন উজার করে শুধু ভালোবেসেছিল । আর সেই ভালোবাসায় ছিল না কোন ছলনা ছিল না কোন বাধ্যবাধকতা । খোট ছিল তার ভালোবাসার মাঝে । খোট ছিল তার ভরসার মাঝে । যার জন্যে নারীটি হারিয়ে গিয়েছিল তিনটি বছর আগে ।
একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে পুরুষ । চোখের নোনাজল গুলো গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে । হঠাৎ মুখ দিয়ে কিছু বেরিয়ে যায় তার ,
– শত বছরের সাথে থাকার ওয়াদা দিয়ে
হারিয়ে গিয়েছিলাম অতল গহ্বরে
আজ আবার তোমার সাথে দেখা
আমার কাদম্বরী
বুকের পাশে জমে থাকা চিন চিন
ব্যাথাটা আজ আবারও জ্বলে উঠেছে
আপনা আপনি
এই মুহুর্তে তার পাগল পাগল লাগছে । বার বার তাকেই মনে পড়ছে । কেন যেন মনে হচ্ছে আজ আর তার ঘুম হবে না ।
– গত তিনটি বছর এই যন্ত্রণাটা সহ্য করে বেশ ভালোই তো ছিলাম আমি কাদম্বরী
আজ আবার সামনে দাঁড়িয়ে লাভা জ্বালিয়ে দিয়েছ আমার মনের আঙিনাতে
ছোট বাচ্চা মেয়েটার মুখটাও বার বার চোখে ভাসছে তার । কেন যেন খুব মায়া হচ্ছিলো তার ।
– বাচ্চাটা হুবুহু জুঁইয়ের মত দেখতে হয়েছে । হয়তো তারই মেয়ে । কিন্তু আমার কাদম্বরীর পরনে সাদা শাড়ি কেন ছিল ?
প্রশ্নটা বার বার আহত করছে তাকে । ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে তার । পাগল করে দিচ্ছে । সিগারেট জ্বলেই যাচ্ছে একটার পর একটা । আজ হয়তো সিগারেটও নিস্তার পাচ্ছে না তার থেকে । এমন সময় একটা কথা তারও মনে পড়ে যায় । দিনটি ছিল ভালোবাসা দিবসের দিন । যাকে বলা হয় valentine day. সেদিন জুঁই লাল শাড়ি পরেছিল । খোঁপায় বেলীফুলের মালা লাগিয়েছিল । হাত ভর্তি চুড়ি দিয়েছিল । একদম লাল পরীর মত লাগছিল সেদিন তাকে , হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্যাম্পাসে । তাকে দেখে এক গাল হেসে জুঁই সামনে দাঁড়িয়ে যায় । তারপর গোলাপ গুলো তার সামনে বাড়িয়ে দেয় আর বলে ,
– ভালোবাসি , এই পুরুষ শুনছো
ভালোবাসি আমি তোমায়
ভালোবাসি অন্তরের অন্ত স্থল থেকে
এই পুরুষ আমি তোমায় ভালোবাসি ,,
জুঁইয়ের কথায় এক গাল হেসে সেদিন সেও উত্তর দেয় ,
– ওগো মোর কাদম্বরী
লালে তোমায় লাগছে গো ভালো
আমি সেই লালের মাঝে হারিয়েছি
তুমি কি জানো ,
কাদম্বরী আমি তোমাকেই ভালোবাসি
সেদিন ক্যাম্পাসে সবার সামনে জড়িয়ে ধরেছিল জুঁই তাকে । আর সে পরম যত্নে আঁকড়ে ধরে নেয় জুঁইকে ।
হঠাৎ সিগারেটের জ্বলন্ত আগুন তার হাতের আঙুলকে ছুঁয়ে দেয়ায় ধ্যান ভাঙে তার । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে নেয় সে ,
– আমি নাফিস শুধু ভালোবাসার নামে ছলনাই করে গেলাম । তুমি জুঁই আমায় এতটা ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলে আর আমি দায়িত্বের অযুহাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তোমায় । আমার কাদম্বরী আমায় ছেড়ে গিয়েও আমার সাথেই মিশে আছে অবিরত । নাহ নাহ আমিই তো তাড়িয়ে দিয়েছিলাম তাকে আমার দুনিয়া থেকে ।
হয়তো আজ আর এই চোখের পানির মূল্য নেই । দুজনের পথ আজ দু দিকে বেকে গেছে । সময়টাও আজ অনেক দূরে অবস্থিত । শুধু রয়ে গেছে এক বুক হাহাকার আর এক চোখ নোনাজল ।
.
.
চলবে………………….