#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে,01,02
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
#সূচনা_পর্ব
বরাবরের মত সাদা শাড়িটা শরীরে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে চোখের পানি ফালানোটা মনে হয় নিত্যদিনের সাথী হয়ে দাঁড়িয়েছে জুঁইয়ের জীবনে । জীবনের তিনটা বছর যে কিভাবে অতিবাহিত হয়ে গেলো টেরও পায় নি সে । ভালো-মন্দ , হাসি-খুশি এইসবের মাঝে কিভাবে যেন চোখের পলকে তিনটা বছর পার হয়ে গেলো তার জীবন থেকে । ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকেও আজকাল বড্ড বেশি অচেনা লাগে তার ।
– কতটা বদলে গেছি আমি । কলেজের সেই হাসি খুশি প্রাণচঞ্চল মেয়েটা আজ এই সাদা শাড়িতে লেপ্টে থাকা এক অঙ্গার নারী । গত এক বছরে সাদা রঙ শরীরে এতটাই লেপ্টে আছে যে এখন আর অন্য রঙ এই শরীরে মিশতে চায় না । চেহারার মাধুর্যতা কমে গেছে নাকি বেড়েছে বুঝতে হয়তো মোটা ফ্রেমের চশমা লাগবে কয়দিন পর ।
জুঁইয়ের ভাবনায় ছেদ করে তার মায়ের প্রবেশ ঘটে রুমে । মেয়েকে বিভোর হয়ে ধ্যানে মগ্ন থাকতে দেখে সামনে এগিয়ে গিয়ে মেয়ের কাঁধে হাত রাখেন ফয়জুন্নেসা বেগম । চেনা হাতের স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকায় জুঁই । মাকে দেখে মলিন মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে হালকা স্বরে কথা বলে ,
– কিছু বলবা মা ?
– উহু ,
– ওহ ,
– রেডি হয়ে গেছিস ?
– হ্যাঁ , প্রায়ই ।
এমন সময় খাট থেকে নান নান শব্দ করে
জুঁইয়ের ছোট্ট মেয়েটা হাতে ইশারা করছে
জুঁইকে । হ্যাঁ জুঁইয়ের একটা দেড় বছরের মেয়ে আছে । মুখে আধো আধো বুলি তার । মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে জুঁই । তারপর শাড়িতে পিন আটকে খাটের সামনে গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নেয় জুঁই ।
– আম্মুন উঠে গেছেন আপনি ? আরও আগে উঠলে কি হতো । আম্মুন তো এখন চলে যাবো । নানুমনির কাছে থাকতে হবে আজ আপনাকে ।
মেয়ের কোল থেকে নাতনিকে কোলে তুলে নেয় ফয়জুন্নেসা বেগম । তিনিও বুঝেন এই কলিজার টুকরাটা ছাড়া তার মেয়ের বাঁচার অবলম্বন কিছুই নেই ।
– ইফসি সোনা নানুমনির কাছে থাকবে । তাই না নানু ?
নানুর কোলে গিয়ে ছোট্ট ইফসি যেন চুপ করে নানুর কাঁধে মাথা ফেলে শুয়ে থাকে ।
জুঁইও তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয় । ওমনি ফয়জুন্নেসা বেগম দাঁড় করায় জুঁইকে ।
– খেয়ে যাবি না ?
– নাহ , আজ আর খাবো না । তাছাড়া নতুন জায়গায় প্রথম পোস্টিং । বুঝোই তো ।
– ওহ ,
– আর মা শুনো , আসার সময় ভাবছি একটা বাসা দেখবো ।
– হঠাৎ বাসা ?
– আমি ছোট বাচ্চা নই মা । সবই বুঝি , ভাই আর ভাবী কাল রাতে তোমাকে যা যা বললো সবটাই কানে এসেছে আমার । বিপদে পড়ে আসি নাই তোমাদের সংসারে আমি । ট্রান্সফার করেছে বলেই আসা । আমাকে বলতে পারতো যে জুঁই তুই কি সংসারে কন্ট্রিবিউট করতে পারবি কি না । আর তাছাড়া ওরা ভাবলো কি করে মা যে আমি এখানে বসে বসে খাবো । সম্পর্ক গুলো তিক্ততায় রুপ নেয়ার আগে সরে যাওয়া ভালো মা । ইফসিকে খিচুড়িটা খাইয়ে দিও মা । আমি বের হচ্ছি মা , আসসালামু আলাইকুম ।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম , সাবধানে যাস ।
ছোট্ট ইফসি হাত দিয়ে তার মাকে টা টা করে দেয় ।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায়
জুঁইয়ের । চেনা শহরের এই রাস্তায় আজ আবার তিন বছর পর দাঁড়ানো । রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের সাথে কথা বলে জুঁই ,
– রাজশাহী থেকে এখানে ট্রান্সফার না করলেই ভালো হতো । চেনা শহরে তিন বছর আগে সব মাটি চাপা দিয়েছিলাম । এখন আবার সেই পুরাতন ঘা টা জীবিত হবে হয়তো ।
হঠাৎ করেই একটা রিক্সা এসে সামনে দাঁড়ায় তার ।
– মামা কই যাইবেন ?
রিক্সাওয়ালার কথায় রিক্সাওয়ালার দিকে তাকায় জুঁই ।
– মামা ১০ নাম্বার যাবা ?
– হ উডেন ।
রিক্সা নিয়ে জুঁই তার গন্তব্যে রওনা হয় । বিগত এক বছর যাবত রাজশাহীতে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে যাচ্ছে জুঁই । গত মাসেই তাকে ঢাকার হেড অফিসে ট্রান্সফার করা হয়েছে । যার জন্যে আবার ঢাকায় আসতে হলো তাকে । পিছুটান তো কবেই পিছনে ফেলে দিয়েছিল সে । কিন্তু নিয়তির কাছে সবার হাত পা বাঁধা । ভাগ্য বা কপাল মানুষকে একদম কাঠের পুতুল বানিয়ে রেখে দিয়েছে , যখন যাকে যেভাবে পারছে নাচাচ্ছে । তেমনটাই হচ্ছে জুঁইয়ের সাথে ।
হঠাৎ রিক্সাওয়ালার ডাকে ধ্যান ভাঙে জুঁইয়ের ।
– মামা ১০ নাম্বার আইয়া ফরছে ।
ভাড়া মিটিয়ে অফিসে পা রাখে জুঁই । সেখানে আগে থেকেই জুঁইয়ের জন্যে কেবিন ঠিক করে রাখা ছিল । জুঁই গিয়ে পরিচয় দেয়ার পর পরই তাকে তার কেবিন দেখিয়ে দেয়া হয় । কেবিনে বসার পর পরই টেবিলে থাকা ল্যান্ড লাইনে একটা ফোন আসে । জুঁই কিছু না ভেবেই ফোনটা রিসিভ করে নেয় ।
– আসসালামু আলাইকুম , নাদিরা ইয়াসমিন বলছি ।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম । পিওনকে পাঠানো হয়েছে , ওনার সাথে আমার কেবিনে আসুন ।
– জ্বি ।
জুঁইয়ের ধারণা যতটুকু তিনি তার বস ছিলেন । এরই মাঝে পিওন এসে হাজির । পিওনের পিছন পিছন বসের কেবিন পর্যন্ত যায় জুঁই ।
– এটাই স্যারের রুম , ম্যাডাম ভেতরে যান
– ধন্যবাদ ।
রুমের ভেতরে প্রবেশ করে জুঁই । সে দেখে একজন ভদ্রলোক সেখানে চেয়ারে বসা ।
– স্যার আসবো ?
– জ্বি আসুন ,
জুঁই সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । ডেস্কে থাকা নেইমপ্লেটে একটা নাম তার নজরে পড়ে ।
” মোঃ মাহবুব হোসেন ”
জুঁই বুঝে যায় স্যারের নাম মাহবুব হোসেন । জুঁইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় তাকে বসতে বলে মাহবুব সাহেব ।
– নাদিরা ইয়াসমিন জুঁই ?
– জ্বি স্যার ,
– আপনার ওয়ার্কিং নিয়ে অনেক সুনাম শুনেছি । এইবার আমরাও দেখতে পাবো , কি বলেন ?
– জ্বি স্যার ইনশাআল্লাহ ।
– অল দ্যা বেষ্ট , কোন সমস্যা হলে জানাবেন ।
– জ্বি স্যার ,
– আপনি এখানে নতুন ?
– রি অফিসে নতুন আর শহরটা অনেক পুরাতন ।
– বুঝলাম না ?
– স্যার জীবনের ২২ টা বছর এই শহরেই অতিবাহিত করেই তবে অন্য শহরে পা দিয়েছিলাম ।
– ওহ আচ্ছা , বাড়িতে কে কে আছেন আপনার ?
– নিজের বলতে আমি আর আমার দেড় বছরের মেয়ে । বাবার বাসায় মা ভাই ভাবী
– আর স্বামী ?
– আমি বিধবা ,
মাহবুব সাহেবের সব কথাগুলো কোথায় যেন উবে গেছে । একদম চুপ হয়ে আছেন তিনি । নিরবতা ভেঙে জুঁই বলে ওঠে ,
– স্যার আমি কি যেতে পারি ?
– জ্বি অবশ্যই ।
কেবিনে এসে নিজের উপর নিজেই হেসে উঠে জুঁই । হাসতে হাসতে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে যায় চোখ দিয়ে ।
– আজও বিধবা বললে সবার কথা বন্ধ হয়ে যায় । হয়তো আমার শরীর কিংবা বয়সের সাথে বিধবা ট্যাগটা যায় না । রাজশাহীর অফিসেও প্রথম প্রথম এমনটা হয়েছে । এখানেও হয়তো প্রথম প্রথম হবে পরে ঠিক হয়ে যাবে ।
চট করেই ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে নেয় জুঁই । কলমের ছিপি খুলে ডায়েরির মাঝ পাতায় লিখা শুরু করে ,
” আমি আমাতেই বিলীন
আমি আমাতেই অঙ্গার
আমি আমাতেই উচ্ছসিত
আমি উচ্ছ্বাসের মাঝে নুয়ে যাওয়া এক কলি মাত্র
কথা দিয়েছিলে ফিরবে ”
চোখের পানি মুছে নিয়ে ডায়েরি রেখে ফাইলে মুখ গুজে জুঁই । কাজের পরে আবার বাসা খুঁজতে হবে তার । জীবন অতিমাত্রায় তাকে কষ্টের দিকে ধাবিত করছে । আর সে অতি আনন্দেই সেই কষ্টকে আপন করে নিচ্ছে
চলবে…………..
#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
ভাড়া বাসা দেখে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ৮ টা বেজে গেছে । জুঁইয়ের অন্য কোন চিন্তা নেই তার একটাই চিন্তা আর তা হচ্ছে ইফসি । এতটাইম সে তার মেয়েকে ছাড়া থাকে নি । রাজশাহীতে থাকা কালীন অবস্থায় জুঁই অফিসে ইফসিকে নিয়ে যেতো । জুঁইয়ের জীবনটাই সংগ্রামের জীবন । তার ছোট্ট মেয়েটা আজ কেঁদেছে হয়তো । এত টাইম মাকে ছেড়ে সেও কখনো থাকে নি । তার উপর আজকে আবার নতুন অফিস বলে মোবাইল ধরারও সুযোগ পায় নি সে । বাসার দরজার কাছে এসে কলিংবেল দেয় জুঁই । ফয়জুন্নেসা বেগম দরজা খুলে দেয় । মেয়েকে খুব ক্লান্ত লাগছিল তবুও মেয়ে তার সামনে মলিন হাসি দিয়ে সালাম দেয় । জুঁইয়ের বরাবরের অভ্যাস , বাসার বাহিরে যাওয়ার আগে একবার সালাম এবং বাসায় ফিরে দরজায় একবার সালাম দিবে ।
– আসসালামু আলাইকুম ,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম , আসলি তবে ?
– হু , ইফসি কই মা ?
– তোর ভাবীর কাছে ।
– বিরক্ত করেছে আজকে তাই না ?
– দুপুরের দিকে একটু কান্না করছিল পরে তোর ভাবী কোলে নিছে পরে চুপ হয়েছে ।
– ওহ , মা ব্যাগ টা রাখো । আমি ইফসির কাছে যাই ।
মায়ের কাছে ব্যাগ দিয়ে জুঁই তার ভাবীর রুমে পা বাড়ায় । রুমে ঢুকতে একটু সংকোচ করছিল তবুও মেয়েকে দেখবে বলে পা বাড়িয়ে রুমে প্রবেশ করে জুঁই ।
ভেতরে গিয়ে দেখে ইফসিকে নিজের পেটের উপর বসিয়ে খেলা করছিল জুঁইয়ের ভাবী ফারজানা । তার পাশেই জুঁইয়ের ৫ বছরের ভাইয়ের ছেলে যাওয়াদও ইফসির গালে ধরে আদর করছে । জুঁই তখন পেছন থেকে ইফসি বলে ডাক দেয় । মায়ের গলার স্বর শুনে ছোট্ট ইফসি পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় । ইফসিকে দেখে জুঁইয়ের দুচোখ জুড়িয়ে গেছে । ইফসির একবছর পর জুঁই আর ইফসিকে বেল্লু মাথা করে নি চুল বড় করে রেখেছে । সেই চুলের দুপাশে দুটো ঝুটি বাঁধা , চোখে হাল্কা করে কাজল দেয়া । ইফসি দেখতে অবিকল জুঁইয়ের মত । দুধে আলতা তার গায়ের রঙ ঠিক যেন তার মা জুঁই । ইফসিকে দেখলে যে কেউই আদর করবে । মাকে দেখে মামীর কোলে থেকেই দু’হাত বাড়িয়ে আধো আধো বুলিতে ” আম্মুন ” বলে হেসে দেয় । জুঁইকে দেখে ফারজানাও উঠে বসে বলতে শুরু করে ,
– ইফসি সোনার আম্মুন চলে আসছে ,
তা দেখে যাওয়াদও উঠে বসে বলতে শুরু করে ,
– বনুর মা আসছে , আমার ফুপিমা আসছে আসছে ।
যাওয়াদ মাশা-আল্লাহ অনেক লক্ষী একটা ছেলে । জুঁইয়ের যখন বিয়ে হয় যাওয়াদ তখন দুই বছরের । ফুপিমা ছাড়া সে কিচ্ছু বুঝতো না । আর জুঁইও যাওয়াদকে আগলে রাখতো । যাওয়াদ ইফসিকে বনু বলে ডাকে । খাটের কাছে এসে আগে যাওয়াদকে কোলে নেয় জুঁই ।
– আব্বাজান , আপনি কেমন আছেন ?
– আলহামদুলিল্লাহ ফুপিমা , বনু কান্না করছে । আম্মু চুপ করাইছে ।
– তাই ? বনু পঁচা , কেমন ?
– এহহহ আমার বনু ভালো ।
যাওয়াদকে চুমু দিয়ে খাটে রেখে নিজের মেয়েকে কোলে নেয় জুঁই । ফারজানাকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
– আজকে খুব জ্বালাইছে , তাই না ?
– নাহ তেমন না । একটু কান্না করছিল , পরে ঠিক হয়ে গেছে ।
– খেয়েছে আজকে ?
– হ্যাঁ , আমি ভাত খাইয়ে দিলাম ।
– ওহ ,
– ও-কে আমার কাছেই দেও । মামুনির কাছে থাকবে ইফসি । আম্মুন ফ্রেশ হবে এখন ।
মামীর কথায় মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ইফসি । তার ভেতরের মনোভাব হচ্ছে , সে মাকে ছাড়বে না । পরে ফারজানা খাট থেকে নেমে ইফসিকে কোলে নিয়ে নেয় ।
– তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে । যাও ফ্রেশ হয়ে নেও , ততক্ষনে ইফসি না হয় আমার কাছেই থাকুক ।
– আচ্ছা , আম্মুন মামুনিকে জ্বালিও না কেমন ? আম্মুন ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো ।
এই বলে জুঁই রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে যায় । শরীরটা বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে তার । অফিস শেষ করে পাক্কা দুই ঘন্টা যাবত অফিসের আশেপাশে বাসা খুঁজেছে জুঁই । অবশেষে একটা দুই রুমের ছোট বাসা পছন্দ হয়েছে তার । ছোট দুইটা রুম আর তার সাথে একটা টয়লেট আর একটা রান্নাঘর । ওদের মা মেয়ের দিন কেটে যাবে । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির পিন খুলতে খুলতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় জুঁই ।
এমন সময় ফরজুন্নেসা বেগম মেয়ের কাছে আসে । মেয়ের সাথে কিছু কথা আছে ওনার ।
– জুঁই,,,,,,,,,,,,,,?
– হেএ মা , কিছু বলবা ?
– আসা যাবত দেখছি কি জানি একটা ভেবে যাস তুই ।
– আল্লাহ পাক আমায় ভাবনার নসীব দিয়েছে মা , না ভেবে উপায় কি বলো ?
– সব কিছুকে ভাগ্য ভেবে ভুলে যা মা ।
– হাসালে মা , আমি কি সব ধরে রেখে দিয়েছি নাকি ।
– চাপা ব্যাথা রেখে দিয়েছিস তো ?
– এইসব কিছুই না মা ।
– ফ্রেশ হয়ে খেতে আয় ।
এই বলে ফয়জুন্নেসা বেগম পিছন ফিরে চলে যেতে নিলে জুঁইয়ের ডাকে আবারও মেয়ের দিকে ফিরে তাকান তিনি ।
– কিছু বলবি ?
– বাসা দেখে এসেছিলাম । পছন্দ হয়েছে আমার , আমার আর ইফসির জন্যে ঠিকাছে । এডভান্স করে আসছি , এই মাসেই উঠে যাবো ।
– সব ঠিক করে এলি তাহলে ?
– হ্যাঁ মা , এখানে থাকলে সম্পর্কগুলো তিক্ততায় পরিণত হবে । তাছাড়া যাওয়াদ বড় হচ্ছে ওর পড়াশোনাও শুরু হবে । বাড়তি ঝামেলা হয়ে যাবে ।
– আমি জানি ফারজানার কথায় তুই হয়তো কষ্ট পেয়েছিস ।
– নাহ তেমন কিছু না । ভাবী তো খারাপ কিছু বলে নি , শুধু খারাপ লাগলো আমায় বলতে পারতো ।
– আমি দেখি রাসেলের সাথে কথা বলবো
– নাহ মা , একদম না । মা দিন শেষে তোমাকে ওদের সাথেই থাকতে হবে । দয়া করে বাড়তি ঝামেলায় যেও না । তুমি বরং আমার কাছে গিয়ে কয়েক দিন থাকবে । আর মা ভাবীও পরের মেয়ে । সংসার করতে আসছে এখানে , অবিবাহিত ননদ থাকা এক আর বিবাহিত ননদ সাথে বাচ্চা নিয়ে থাকা আরেক । বাদ দাও , অশান্তি চাই না আমি ।
– আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে নে ।
– হু
রাতে ইফসিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজের রুমে শুইয়ে দেয় জুঁই । তারপর নিজে খেতে যায় । সেখানে তার বড় ভাই রাসেল ভাবী ফারজানা এবং মা ফরজুন্নেসা বেগম উপস্থিত ছিলেন । নিজের ভাইয়ের দিকে চোখ যায় জুঁইয়ের । জুঁইয়ের কাছে আজকাল আপন ভাইকে পরের মত লাগে । তার মনে হয়তো সংকা কাজ করছে দুর্মূল্যের বাজারে নিজেদের সংসারও ঠিক মত চালাতে বিপদে পড়তে হয় তার উপর তার বোন ভাগনি এসে জুটেছে । সব মিলিয়ে যে তার ভাইয়ের চিন্তাচেতনা তা বুঝতে বাকি নেই জুঁইয়ের । খাবার টেবিলে অনেকটাই নিরবতা । আগে খাবার টেবিলেই ওরা ৩ জন অনেক মজা করতো । এখন সব আনন্দ মিশে গেছে মাটিতে । চুপ করে থাকলে কথা রয়ে যাবে । সময় চলে গেলে সেই কথার দাম থাকে না । তাই নিরবতা ভেঙে জুঁই নিজেই তার ভাইকে বলে । কারণ জীবন যখন মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়েছে তখন বাকি রাস্তা তাকে একাই চলতে হবে
।
– বুঝলা ভাইয়া , অফিস থেকে আসার সময় একটা বাসা দেখে এলাম । আমার বেশ ভালো লাগলো । ভাবলাম এই মাসেই উঠে যাবো ।
জুঁইয়ের কথা শুনে একদম চুপচাপ হয়ে যায় তার ভাই ভাবী । তারাও ভাবে নি যে জুঁই একদিনে এতটা করে ফেলবে । তখন ফারজানা মানে জুঁইয়ের ভাবী বলে ,
– এত তাড়াতাড়ি এত সব করে নিয়েছো ?
– হ্যাঁ ভাবী , করতে যখন হবে তাহলে দেরি করে লাভ কি ?
– এখানেই থেকে যাইতা ।
ফারজানা যে মুখের কথাটুকু বলেছে এতেই জুঁই অনেক খুশি । মলিন মুখে হালকা হাসি দিয়ে জুঁই তার ভাবী ফারজানার দিকে তাকায় ।
– এখানে থেকে যেতে বলার আগে গতকালের কথা গুলো ভাবা উচিত নয় কি ভাবী ?
এইবার জুঁইয়ের কথায় ফারজানা একদম চুপ হয় যায় । রাসেলের মুখেও কথা নেই , রাসেল যেন বোবা হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে রাসেলের এই বোবা হয়ে থাকাটাই ফয়জুন্নেসা বেগমকে সব থেকে বেশি কষ্ট দেয় । নিজের ছেলে যদি এইভাবে চুপ করে থাকে কোন মায়ের ভালো লাগে ।
– এখানে থাকলে সম্পর্কগুলো খারাপ হবে । এর থেকে ভালো আলাদা হয়ে যাই । মাঝে মাঝে তোমরা যাবে আমার বাসায় । আমি আসবো তোমাদের বাসায় । কি করবো বলো , এখন পরিস্থিতিটাই এমন । সব কিছু না চাইতেও করা লাগবে ।
– ইফসিকে সামলাতে পারবে ?
– এটা কি বলো ভাবী ? ৮ মাস বয়স থেকে এখন দেড় বছর তার । আমিই তো সামলে নিলাম । আমার হয়ে একটা মানুষতো দেখলাম না যে আমার বাচ্চাটাকে সামলেছে । ৮ মাস বয়স অবদিও আমিই দেখেছি । দাদা দাদী থেকেও ছিল না থাকার মত ।
– হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক ।
– সেই হিসাব করতে গেলে তুমি খুব ভাগ্যবতী , জাওয়াদ তার দাদুন এবং ফুপিমা দুজনেরই আদর ভালোবাসা পেয়েছে আর আমার ইফসি সব থাকতেও অনাথ ।
তখন রাসেল মুখ খুলে ,
– কেন তোর কি অজানা নাকি সব কিছু , তুই জানতিস না তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেমন ছিল ।
– এখন তো তাহলে বলতে হয় , বিয়েটাও তো তোমরাই দিয়েছিলে তাই না ভাইয়া ?
যাই হোক , আমার খাওয়া হয়ে গেছে আমি উঠি ।
এই বলে জুঁই উঠে যায় । রাসেলের মুখ জুঁইয়ের এক কথাতেই বন্ধ হয়ে যায় ।
রাতের মধ্যভাগ ,
আজকে চুলের মুঠি ধরে মেরেছে জুঁইকে তার স্বামী । জুঁই বার বার আকুতি মিনুতি করেও ছাড়া পাচ্ছে না । জুঁইয়ের মাথা ব্যাথা করে তাই তার মাথায় আঘাত করা যায় না । কিন্ত তিনি তা বুঝে না । জুঁইয়ের আজকের অপরাধ , সে আজকে রাতে জুঁইকে কাছে পেতে চেয়েছে কিন্তু জুঁই অসুস্থ । সিজারিয়ানের পর মাঝে মাঝে সেলাইয়ের জায়গায় টান লাগে জুঁইয়ের । যা জন্যে এই মুহূর্তে সঙ্গম তার পক্ষে সম্ভব নয় । সে বুঝবে কি সে তো বুঝার চেষ্টাও করে নি । লাষ্টবার যখন জুঁই না করে দিল তখনই সে জুঁইকে মারে । তার মা’র বলতে হাত মুচড়ে ধরা , চুলের মুঠি ধরা , গালে চড় দেয়া ইত্যাদি । তবে নরপিশাচের মত মারে না । চুলের ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে জুঁই তার স্বামীকে বলতে থাকে ,
– ফারুক লাগছে আমার , ছাড়ো আমায় , আমি ব্যাথা পাচ্ছি । ফারুক আমার শরীর ভালো না , ছাড়ো আমায় ।
জুঁই জোরে কথা বলতে পারে না কারণ ইফসি তখন ছয় মাসের । ঘুমাচ্ছিল সে তখন । হঠাৎ করেই ফারুক মানে জুঁইয়ের স্বামী জুঁইকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয় ।
জুঁই তখন লাফ দিয়ে উঠে বসে যায় । পুরো শরীর তার কাঁপতে থাকে । বিছানা থেকে নেমে পানি খায় সে । আবার ইফসিকে দেখে , তার দেড় বছরের বাচ্চাটা তখন গভীর ঘুমে মগ্ন । গত এক বছরে এমন বহুবার হয়েছে যে হুটহাট করেই এইসব স্বপ্ন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার । অতীত কি শেষ হয়েও পিছন ছাড়ে নি তার । শরীরের কাঁপুনি কমিয়ে নিয়ে ডায়েরিটা নিয়ে বসে যায় জুঁই । কিছু একটা লিখে নিয়ে লাষ্ট দুটো লাইন লিখে ফেলে ,
” অতীত আমায় ছাড়ছে না পিছু
আমি তো আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার অনেক কিছু
কথা তো দিয়েছিলে ফিরবে ”
চলবে…………