#নয়নাভিরাম,পর্ব-৩,৪
♡আরশিয়া জান্নাত
০৩
ফুটন্ত পানিতে চা পাতা দিয়ে বোকা বনে গেছি,অন্য সময় চা পাতা দিতেই কালার চেইঞ্জ হয়ে চা-পাতার ঘ্রাণ বের হয়। সেই ঘ্রাণটা আমার ভীষণ প্রিয় বলেই চা বানানোর সময় মায়ের পাশে থাকি। কিন্তু আজ কেন ঘ্রাণ বের হচ্ছেনা বুঝে আসছে না। বেশ কিছুক্ষণ সিদ্ধ করে বিরক্ত হয়ে মা কে ডেকে আনতেই উনি চেঁচিয়ে বললো,তুই কি রে মিমি এখনো চা পাতা আর কালো জিরার মধ্যে পার্থক্য বুঝিস না? তোকে আমি কিভাবে বিয়ে দিবো বুঝিনা!
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,এজন্য ভালো করতে নেই। ভাবলাম আজ বিকেলের চা আমি বানিয়ে সবাইকে দিবো তাও হলোনা। তুমি জারে লেভেল এটে দিবা না?
মা আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো ,তুই ছাড়া এই সমস্যা বাসার আর কারো হবেনা।
মনের দুঃখে ছাদে গিয়ে দেখি নাহিদ আর সিয়াম ক্রিকেট খেলছে। আমি গিয়ে ঢুকতেই ওরা খেলা বন্ধ করে চলে যাচ্ছিল। আমি ওদের থামিয়ে বললাম,চলে যাচ্ছিস কেন তোরা? চল আমিও খেলবো।
নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বললো,হ্যাঁ তোমার সঙ্গে খেলবো আর তুমি বল মেরে অন্য বিল্ডিং এর গ্লাস ফাঁটাবে লাগবেনা তোমার সঙ্গে খেলার।
— ক্রিকেট খেলবি আর কিছু ভাঙবে না তা হয় নাকি? সাকিব আল হাসান কি পাড়ার কারো গ্লাস ভাঙা ছাড়া ক্রিকেটার হয়েছে? এতো সুন্দর ছক্কা মেরেছি সেই প্রশংসা করলিনা,অথচ গ্লাস ভাঙার দোষ দিলি। যা এবার আস্তে খেলবো,চল।
সিয়াম–না না তুমি আস্তে খেললে আরেক ভেজাল, ছাদের টব ভাঙবা।
–উফফ। তাহলে চল মাঠে যাই?
সিয়াম–মাঠে বড় ভাইরা খেলতে দিলে তো?
–আমি গেলেই দিবে দেখিস
নাহিদ–আগে প্রমিস করো আমার ব্যাট ভাঙবা না।
–ভাঙলেও কিনে দিবো।
তারপর মাঠে গিয়ে দেখি সবাই জায়গা দখল করে আরামছে খেলছে। ছোট ভাইয়াকে ডাক দিতেই ভাইয়া এসে বললো,কি রে তুই আবার এসেছিস?তোকে না বলছি এখানে খেলতে আসবিনা।
–ভাইয়্যু খেলতে মন চাইছে। তোর টিমে নে নাহয় জায়গা করে দে আমরা খেলি।
–হ এরপর কারো না কারো মাথা ফাটাবি। তোরে দেখলেই এখন সব কয়টা ভাগবো। যা তো বাসায় গিয়ে টিভি দেখ।
–জানতাম তো তুই আমার সৎ ভাই। আজ যদি আমি তোর রক্তের বোন হতাম এটা বলতি না।আমাকে তো ডাস্টবিন থেকে তুলে আনছে।তাই দাম নাই আমার।
–মিমি নাটক করবিনা একদম। যা তো সিরিয়াস খেলা চলতেছে।
আমি রাগ করে লেকে চলে গেলাম(লেকটা আমাদের বাসা থেকে দশ মিনিট দূরে। তাই ওখানে প্রায়ই যাওয়া হয়)। ধুরর কেউ ভালোবাসেনা আমারে, জীবনডা বেদনার।
লেকের সামনে বসে একটার পর একটা ঢিল ছুড়ছি আর নিজে নিজে হাজারটা কথা বলছি।এমন সময় একজন এসে বললো, Excuse me Medam?
আমি তাঁর দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম,কি সমস্যা?
সে কাঁচুমাচু করে বললো,সমস্যা কেন হবে।কোনো সমস্যা না।
–তাহলে কি চাই?
–আপনি এভাবে রেগে কথা বললে তো বলতে পারবো না মেডাম।
–আপনি আমার চেনা কেউ? নাকি প্রাণের সখা যে হেসে হেসে কথা বলবো?
–আপনি এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? সেদিন এই পার্কেই তো আমাদের দেখা হয়ে ছিল। আপনি আমায় এডভাইজ দিয়েছিলেন আমি যেন ব্রেকাপ করি।
আমি তাঁর দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললাম,আপনার নাম মেহবুব?
তিনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?
–ভালোই হয়েছে আপনি এসেছেন।এমনিতেও আপনার সঙ্গে আমার কথা বলার ছিল।
–সিরিয়াসলি?? আমাকে খুঁজছিলেন আপনি? Wow, What a pleasant surprise for me!
–এতো আনন্দিত হবার কি আছে?
–আপনাকে আমি কত খুঁজেছি জানেন?
–মানে? আমাকে খোঁজার কি ছিল!
–তো খুঁজবো না? আপনি সেদিন বললেন না আমার ধৈর্যের উপর আপনি ক্র্যাশড? আমি যেন আপনার সঙ্গে,,,,,
–আরেহ মিয়া কিসব কন এসব? ঐটা তো কথার কথা বলছি আপনার গফের ঢং দেইখা। যাই হোক শোনেন আমার মতো অচেনা মেয়ের দু তিন লাইন কথা শুনে ব্রেকাপ করা টা আপনার ভুল ছিল।যদিও ব্রেকাপ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হইছে।তবুও এখন এখানে আমার উপর পুরা দোষ আসছে, এটা ঠিক না। আপনি আপনার গফের সাথে সব মিটমাট করেন…..
–কিন্তু এটা তো সম্ভব না।
–কেন সম্ভব না? এতো দিন তো ঠিকই সম্ভব ছিল এখন কেন অসম্ভব?
— এতোদিন তো আপনাকে দেখি নি মেডাম!
–মেডাম মেডাম করেন কেন আমি আপনার কোন ক্লাসের মেডাম?
–আপনি সবসময় এভাবে রেগে কথা বলেন?
— হ্যাঁ।কোনো সমস্যা?
–আপনি বোধহয় আজ খুব রেগে আছেন আমি বরং পরে এ বিষয়ে কথা বলবো। আচ্ছা আপনার ফোন নাম্বার বা ঠিকানা পেতে পারি?
আমি রেগে তাঁর দিকে তেড়ে যেতেই সে বলল, ওহ স্যরি আমি যাই বরং পরে কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ
আচ্ছা পাগল জুটছে দেখি! দুইদিনেই পুরান ভালোবাসা ফুড়ুৎ? এতো সহজ নাকি প্রেম ??
______________
আপুর সাথে শপিংমলে এসে আমি মহাবিরক্ত হয়ে গেছি।একটা মানুষ এতো সময় নিয়ে ঘুরতে পারে আপুর সাথে না আসলে জানা যেত না।এজন্য আমি শপিং এ আসিনা।কিন্তু আজ এসেছি পাহারা দিতে।আমার ক্ষীণ সন্দেহ আপুর বফ আছে।শপিং এর বাহানা দিয়ে সে তাঁর সঙ্গেই মিট করতে এসেছে।সন্দেহ টা আরো পাকাপোক্ত হলো যখন আমি সঙ্গে যাবো বলায় আপু সাথে সাথে ফোন হাতে নিলো।এমনিতেই আমার ডিটেকটিভ মাইন্ড সবকিছুতে রহস্য খুঁজে,তার উপর এমন লক্ষণ তো এড়ানো যায় না।আপু ইচ্ছে করে দুনিয়ার ড্রেস দেখছে কিন্তু কিছুই নিচ্ছেনা।শেষে আমাকে তিনটা ড্রেস ধরাই দিয়ে বললো,যা তো ট্রায়াল দিয়ে দেখ সব ঠিকঠাক আছে কিনা।
–আমার জন্য দেখছো কেন? আমিতো কিনবোনা
–তোরে কিনতে বলছে কে? এগুলো আমি তোরে কিনে দিবো। যাস না মাপ সব ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে আয়।
আমি ঠিকই বুঝলাম নিশ্চিত ঐ পোলা আশেপাশেই আছে।সেজন্যই আপু আমাকে ট্রায়াল রুমে পাঠাচ্ছে।আমিও কম না ট্রায়াল রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চুপি চুপি বেরিয়েছি।
খানিকটা দূরে দেখি আমার ধারণাই সত্যি।আপুর সঙ্গে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।ঝটপট দু চারটা ছবি তুলে পিছু ফিরে যেতেই একজনের পায়ে পাড়া দিয়ে বসলাম।
“স্যরি স্যরি! আমি একদম দেখতে পাইনি আপনি ঠিক আছেন তো?”
সে রেগে বললো,আপনি কি কখনোই দেখে চলতে পারেন না মিস রুমাইসা? সবসময় কোন দিকে মনোযোগ থাকে আপনার?
আমি চেহারার দিকে তাকিয়েই আৎকে উঠে বললাম, স্যার আপনি এখানে?
–হাইট তো কম না তারপরো এমন ডাকাত মার্কা হিল পড়েছেন কেন? আমার পা বোধহয় শেষ স্টুপিড মেয়ে একটা।
স্যার রেগে আরো কিছু বকাঝকা করে চলে গেল।আমার কপাল কত্ত ভালো তা ভেবে মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে যাই।শহরে কি আর কোনো শপিং মল ছিল না স্যারকে এখানেই আসতে হলো!
বাসায় ফিরেই দাদীজানের রুমে গিয়ে উনার কোলে মাথা রেখে বললাম,দাদীজান আমি কবে ঠিকঠাক চলতে পারবো বলো তো! যতো চাই সাবধানে চলাফেরা করবো কিছু ভাঙবোনা কাউকে সমস্যায় ফেলবোনা ততোই এসব বেশি করি।আমার আর ভাল্লাগেনা
দাদীজান আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না বুবু। আমাগো একেক জনেন একেক খুঁত আছে। কেউই সবদিক দিয়া ভালা না। যখন তোর বিয়া হইবো বাচ্চাকাচ্চা হইবো দেখবি সব ঠিক হইয়া যাইবো।
–তোমার সব কথার একটাই কথা বিয়ে। তোমার ধারণা সবকিছুর একটাই সমাধান! বিয়ে করলেই যদি সব ঠিক হয়ে যেত তাহলে সবাই বিয়ে করতো অন্য কিছু করতো না।
–হিহিহি বিয়াই তো সব সমস্যার সমাধান। দেখ বুবু আমাগো আদি পিতা আদম আঃ যখন জান্নাতে আছিল,তাঁর কোনোকিছুর অভাব ছিল না।জান্নাতের খানা,সুন্দর বাগান, কিছুরই তো অভাব নাই।তাও মন কিন্তু শান্তিতে আছিল না।তাইনের মনে কিসের একটা অভাব।আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তো সব জানেন।তাইনে আদম আঃ এর বুকের পাঁজর দিয়া মা হাওয়া আঃ রে বানাইছে।তখন গিয়া আদম আঃ এর মনের অশান্তি দূর হইছে।আমাগো জীবনে যতো অশান্তিই থাকুক না কেন জান্নাতের সাথী মানে জীবনসঙ্গী যদি পাশে থাকে সব দূর হইয়া যায়। কঠিন রাস্তাও সহজ লাগে,অসম্ভব ও সম্ভব হইয়া যায়।
–ওহ এই ব্যাপার! কিন্তু বিয়ের পর যদি দেখি বর সুবিধার না? তখন সমস্যা আরো বাড়বেনা?
— নিয়্যত ভালা রাখ। নিয়্যত আরমানে বরকত। যদি খারাপ ও হয় তাইলে বুঝবি ভাগ্যে আছিল এটা আল্লাহ পরীক্ষা নিতাছে,এর বিনিময়ে নিশ্চয়ই মাফ করবো। সবসময় আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবি বুবু।যাই হোক কখনো নিরাশ হবিনা।
–তুমি অনেক ভালো দাদীজান। I love u উম্মাহ।
দাদীজান হাসতে হাসতে বললো, I love u too বুবুন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, বাব্বাহ আনজুমান বেগম এটাও কয় এখন?
–তুই কি ভাবোস শুধু তোরাই জানোস আমরা জানিনা?
–না না সেটা ভাবমু ক্যান। আমি জানিতো আমার দাদীজান সব জানে। দাদাজানরে বলছিলা কোনোদিন?
দাদীজান লাজে রাঙা হয়ে বললেন, এসব মুখে কইতে হয়না। মনে জানলেই চলে।
আমি মুগ্ধ চোখে আমার প্রৌঢ়ত্ত্বে পৌঁছানো দাদীজানের নিষ্পাপ হাস্যোজ্জল চেহারা দেখি।জীবন থেকে বিশেষ কোনো চাহিদা না থাকা মানুষটা এভাবেই দাদাজানের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে থাকুক বাকিটা সময়।
______________
আফরোজা আহমেদ সেই কখন থেকে ছেলের অপেক্ষায় বসে আছেন। এ কয়দিন ছেলেটার কি যে হলো তাঁর বুঝে আসেনা। সবকিছু ঘড়ির কাটা মাফিক করা ছেলেটা আজকাল কোনোকিছুই সময়মতো করছেনা। রাতে ঠিকঠাক খেতেও চায় না,তাই তিনি নিজে বসে থেকে জোর করে খাইয়ে তবেই ঘুমাতে যান। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের কত রকম হতাশা থাকে, পরিবারের মানুষদের ঠিকঠাক বলেনা। কিন্তু আরশান তো সব কথা তাঁর মা কে বলতো। এবার কি এমন হলো যে মাকেও বলতে চাইছেনা?
আফরোজা আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,ইয়া আল্লাহ আমার ছেলেটার মন শান্ত করো। বিপদআপদ থেকে হেফাজত করো রাহমানুর রাহিম।
আরশান কলিং বেল চাপতেই তাঁর মা দরজা খুলে দিলো।আরশান মুচকি হেসে বললো,মা কত করে বলেছি এতো রাত অবধি জেগে থেকোনা।তবুও তুমি অপেকগ থাকো,
–যতোদিন না তোর জন্য অপেক্ষা করার কাউকে আনছি ততোদিন আমিই অপেক্ষা করবো।মায়ের জন্য টান থাকলে এতো দেরি করে ফিরতিনা।
আরশান হাতমুখ ধুয়ে চেয়ারে বসলো।তাঁর মা প্লেটে ভাত দিতে বললো, হ্যাঁ রে খোকা তোর কি কিছু হয়েছে? এমন মনমরা থাকিস কেন? ক্লাস নেওয়াতে প্রেশার হচ্ছে বেশি?
–না মা। আমি ঠিক আছি।
–মিথ্যে বলবিনা আমার সঙ্গে। কি হয়েছে বল না মা কে? তুই না আমার সোনা ছেলে এমন কষ্ট পাচ্ছিস কেন বাবা?
আরশানের বুকের পাথর যেন গলে গেল,জমিয়ে রাখা কষ্টের বাঁধ ভেঙে হঠাৎ করেই শব্দ করে কেঁদে ফেললো। কান্নামিশ্রিত গলায় বললো, মা নিপুণ আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমি নাকি ওর লাইফ পার্টনার হবার যোগ্যতা রাখিনা। আমার সঙ্গে থেকে ওর এতোগুলো বছর অযথাই নষ্ট হয়েছে। ও আমায় আর ভালোবাসে না মা,,,
চলবে,
#নয়নাভিরাম (পর্ব-৪)
♡আরশিয়া জান্নাত
আজ বহুদিন পর আরশানের মনটা হালকা লাগছে। সকালের নতুন ভোরে সূর্যের মৃদু রশ্মিতে দাঁড়িয়ে সে ঠিক করলো সবকিছু ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করবে। মায়েদের কাছে বোধহয় সৃষ্টিকর্তা একটা বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন।সন্তানেরা যখন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে মায়ের কাছে সবটা খুলে বলে,তখন সবকিছু শান্ত হয়ে যায়।সকল নেগেটিভ এনার্জি যেন মায়েরা শুষে নিয়ে পজিটিভ এনার্জি সাপ্লাই করে। না হয় এতোদিন ধরে কষ্ট পাওয়া ছেলেটার আজ এতো ভালো লাগছে কেন?
আফরোজা আহমেদ ফজরের নামায পড়ে এখনো জায়নামাজে বসে আছেন। তাঁর এতো শক্ত ছেলেটা যে কি না ব্যথা পেলেও কখনো কাঁদেনি একটা মেয়ের জন্য এভাবে কাঁদলো! অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ঠিক করলেন নিপুণের চেয়ে হাজারগুণ বেস্ট একটা মেয়ে তিনি খুঁজে আনবেন তাঁর ছেলের জন্য। এমন একজন যে আরশানের মনের সকল ক্ষত দূর করে দিবে ভালোবাসার প্রলেপ দিয়ে। সেদিন নিশ্চয়ই আরশান বলবে, মা ভালোই হয়েছে নিপুণ চলে গেছে। এখন আমি অনেক ভালো আছি।
____________
বেডের উপর বসে ডোন্ট কেয়ার মুডে বই খুলে বসে আছি,আর আপু অস্থিরভাবে পায়চারি করছে।
একটু পরপর আমার দিকে চেয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছেনা।অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি কখন বলবে কিন্তু না এর থেকে সহজে কিছু বের হবেনা।আমি সিরিয়াস গলায় বললাম,শপিং মলের ছেলেটা কে ছিল আপু?
আপু দপ করে বসে গেল। নেতিয়ে যাওয়া গলায় বললো,তুই সব দেখেছিস তাই না মিমি!
–সেসব জেনে কি হবে? কতদিন ধরে চলছে এসব হু?
আপু ফের পায়চারি শুরু করলো কিসব ভেবে বললো,মিমি একটা সমস্যা হয়ে গেছে। এখন আমি কি করবো বুঝতে পারছিনা,,,,
–কি হয়েছে বলো তো?
–সেদিন যাকে দেখলি তাঁর নাম সাকিব।দুই বছর ধরে রিলেশন চলছে।অনেক মেধাবী ছেলে,জাপানে স্কলারশিপ পেয়েছে।কিছুদিন পর চলে যাবে তিন বছরের জন্য।
–বাহ! ভালোই তো। তো সমস্যা কি এখানে?
–সমস্যা কি বুঝতে পারছিস না? এই নিয়ে কতগুলি প্রপোজাল বাদ দিয়েছি দেখেছিস? এখন ও যদি তিন বছরের জন্য চলে যায় আমি এদিকে কিভাবে সামলাবো?
–উনাকে বলো যাওয়ার আগে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে যেতে। তাহলেই তো আর প্যারা নাই।
–ওর ফ্যামিলি রাজী হবে? এখনো স্টাবলিশ হয়নি। ওর ক্যারিয়ার নিয়ে সবাই খুব সিরিয়াস। এখন বিয়ের কথা বলা কিভাবে সম্ভব!
–তাহলে আর কি তাঁকে বলো ঢিংঢিং করে জাপান চলে যেতে, যাওয়ার আগে ব্রেকাপ করে নাও। ছেলেদের অপেক্ষা করা ঠিক না আপু। মুভিতে দেখো না বিদেশ গেলে ছেলেরা কেমন বদলে যায়? তখন আর দেশি মেয়ে ভাল্লাগেনা। তুমি বরং এসব বাদ দিয়ে বাবার পছন্দমতো বিয়ে করে আমার রাস্তা ক্লিয়ার করো।আমি বাপু তোমার জন্য এতো বছর কুমারী থাকতে পারবোনা।
আপু অবিশ্বাসী চোখে চেয়ে বললো, তুই আমার বোন মিমি?? এতো সহজে বলে ফেললি ব্রেকাপ করে অন্য কাউকে বিয়ে করতে! কোথায় বোনকে একটু সান্ত্বনা দিবি, বুদ্ধি দিবি তা না তুই তো সব শেষ করে দিতে এক্সপার্ট!
–বি প্র্যাকটিক্যাল বোইনা! তুমি এখন সাকিব ভাইয়াকে ফোন করে বলো হয় তুমি সম্পর্ক শেষ করে চলে যাও নাহয় বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নাও।আমি তিন বছর বিয়ে না করে মিমিকে বুড়ি হতে দিতে পারবোনা।
— এখানে তোর বুড়ি হবার কথা আসছে কেন? তিন বছরে তোর বিশেষ কি হবে?
— পিরিতের পেত্নিও ভালা। তুমি তোমার আশিকের কাছে ঠিকই এভারগ্রিন থাকবা কিন্তু আমার বয়স তো বসে থাকবেনা। আমি যদি তখন হৃতিক রৌশনের মতো কাউকে পেয়েও বেশি বয়সের জন্য রিজেক্ট হই আমার মন ভাঙবে না?
— তোর আজগুবি সব লজিক শোনার টাইম নাই আমার। সবকিছুতে নিজের লস টা ক্যালকুলেট করা তোর খুব জঘন্য স্বভাব। তুই খুব সেলফিস। ভুলেও কথা বলবি না আমার সাথে।
আপু রেগে আগুন হয়ে চলে গেল। আমি হাসতে হাসতে সাকিব ভাইয়ার আম্মুকে ফোন করে বললাম,আস্সালামু আলাইকুম আন্টি আপনারা কাল বিকালে আমাদের বাসায় আসেন, এড্রেস টেক্সট করছি।
(সাকিব ভাইয়ার আম্মু হচ্ছে সেদিন সকালের ঐ আন্টিটা যাকে আমি হেল্প করেছিলাম। আপুর ফোন চেক করতে গিয়ে সাকিব ভাইয়ার ফ্যামিলি ফটো দেখেই আমি আন্টির সঙ্গে মিট করেছি। আঙ্কেল আন্টির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে আগেই সব ঠিকঠাক করে এসেছিলাম। উনারা খুশিমনে রাজী হয়েছেন। এখন অফিশিয়ালি প্রপোজাল নিয়ে আসলেই হবে। বাবা-মা অলরেডি আপুর বিয়ে নিয়ে খুব টেনসড। আশা করছি এমন ভালো পাত্র পেলে অমত করবেনা।)
ওরে কত্তদিন পরে বিয়া খামু, উড়াধুরা নাচমু ,কত্ত মজা হবে ইয়েএএএ
______________
ঘুম থেকে উঠে দেখি 8:30 বেজে গেছে। এতো দেরি কিভাবে হলো আয়হায়। পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে বের হয়ে ক্লাসের সামনে গিয়ে পৌছাতে নয়টা বিশ বেজে গেছে।পাক্কা দশ মিনিট লেট,ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি আরশান স্যার ক্লাসে।পিছু ফিরে চলে যাবো ভাবতেই স্যার বললো,মিস রুমাইসা কাম ইন।
আমি না চাইতেও দোআ পড়ে ক্লাসে ঢুকে বললাম,গুড মর্নিং স্যার।স্যরি স্যার আসলে রাস্তায় জ্যাম ছিল তাই আসতে ,,,
স্যার হাসিমুখে বললো, ইটস ওকে মিস রুমাইসা।আপনি গিয়ে সিটে বসুন।
আমি চোখ গোল গোল করে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। কি হলো এটা স্যার আমার সঙ্গে হাসিমুখে স্বাভাবিকভাবে কথা বললো! এ ও কি সম্ভব??
সামনের বেঞ্চগুলোতে জায়গা থাকা সত্ত্বেও আমি যখন পেছনের দিকে যাচ্ছিলাম তখন স্যার বললো,সামনে খালি রেখে এতো পেছনে যাচ্ছেন কেন? বসুন সামনের দিকে।
আমি নীলার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বললাম,আজ স্যারের কি হয়েছে বল তো? এতো ভালো কথাবার্তা!
নীলা খাতায় লিখে দিলো, স্যার আজকে ক্লাসে এসেই তোকে খুঁজেছে। আমরা তো সবাই অবাক।
–হতে পারে ডিউরেশন শেষ হয়ে আসছে তাই!
–কি জানি।
ক্লাস শেষে স্যার বললো,মিস রুমাইসা ছুটির পর আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
রিমি এসে বললো,ব্যাপার কি রে স্যারের মন দেখি 180° এঙ্গেলে ঘুরে গেছে।কি ম্যাজিক করেছিস তুই?
–ব্ল্যাক ম্যাজিক করছি। তোর কাউরে করা লাগবো? খবর দিস পার তাবিজ 1001/-
রিমি বিরক্ত হয়ে চলে যেতে যেতে বললো, ঢঙ্গি একটা।
ফাহিম বললো,মিমি স্যার তোমাকে কেন ডেকেছে অনুমান করতে পারছো?
–আমারে তোর কি মনে হয় বল তো? স্যার তাঁর স্টুডেন্টকে ডাকতেই পারে। স্কুল হলে বলতাম পরীক্ষার খাতার বোঝা বয়ে নিতে ডাকছে। এখন কি বলতাম?
–তুমি কিন্তু কেয়ারফুলি থাকবা। বলা তো যায় না প্রপোজ টপোজ করে বসলে ,,
–আরেহ ধুরর। কিসব যে বলোস! আমারে প্রপোজ করতে যাবে কোন দুঃখে? তোর মাথা কি গেছে?
ফাহিম বিড়বিড় করে বললো,তোমার মতো মেয়েকে কেউ দুঃখে প্রপোজ করতে চাইবেনা বরং মনের সুখেই প্রপোজ করবে। কয়েক শতাব্দীতে তোমার মতো একজন জন্মে!
আমি বললাম,কিরে কি বলোস শুনিনা তো?
ফাহিম হেসে এড়িয়ে গেল।
সবার কথা লাপাত্তা মুড নিলেও মনে মনে আমি ঠিক ভয় পাচ্ছি। স্যার কোনোভাবে আমার নাম্বারটা চিনে ফেলেনিতো? চেনার তো কথা না। আর যদি চেনেও আমার কি? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি।
মনকে বুঝ দিলেও হাঁটু আমার ঠিকই কাঁপছে। এই হাঁটু কাঁপাটা কি কখনোই কন্ট্রোলে আসবেনা?
___________
হিজলতলায় দাঁড়িয়ে ভাবছি গেইটের দিকে যাবো নাকি টিচার্স রুমের দিকে। ছোটন বললো,এতো প্যারা নেওয়ার কিছু নাই তুই যা আমরা তো আছিই।
ফাহিম– মিমি আমি কি তোমার সঙ্গে আসবো?
— আরেহ তোরাও না আমি কাউকে ভয় পাই নাকি? আমিতো এখানে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম ক্লাসে কিছু ভুলে এসেছি কি না।
ইলহাম হেসে বললো, মিথ্যুক একটা। ভাঙবি তবু মচকাবি না।
— হ তোরে কইছে।
নীলা–তোরা অহেতুক পোক করতেছস। আরশান স্যার অতোটাও খারাপ না।
আমি–তোর কাছে হ্যান্ডসাম কোনো ছেলেই খারাপ না
নীলা–মুখ খোলাবি না মিমি।তুই যে প্রথম দিনই,,
আমি নীলার মুখ চেপে বললাম,চুপ থাক নীলু।
ইলহাম– ভীতুর ডিম মিমি হেহেহে
আমি–কে ভীতুর ডিম?
ইলহাম–তো যা না এখনো দাঁড়াই আছোস ক্যান?
আমি–যাচ্ছি যাচ্ছি।
টিচার্স রুমে যাওয়ার সময় পথেই আরশান স্যারের সঙ্গে দেখা।তিনি মুচকি হেসে বললেন,ওহ মিস রুমাইসা আমার খোঁজেই যাচ্ছিলেন নাকি?
–জ্বি স্যার।ছুটির পর দেখা করতে বলেছিলেন না?
–হ্যাঁ।আপনার জন্য গুড নিউজ আছে।আজকে আমার লাস্ট ডে ,আগামীকাল থেকে ফয়েজ স্যার জয়েন করবেন ইনশাআল্লাহ।
–আল্লাহ কি বলেন স্যার এটা গুড নিউজ হবে কেন? আপনার ক্লাস অনেক মিস করবো আমরা(ভদ্রতার মিথ্যা ডায়লগ)
—হাহাহাহা, ফর্মালিটি দেখাচ্ছেন! আমাকে আপনি মোটেও মিস করবেন না বরং বলুন আপনি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। এখন থেকে আর কেউ বকাঝকা করবেনা আপনাকে।
–না না স্যার কি যে বলেন?
— Anyway, Thank you Miss Rumaisa!
–কেন স্যার?
–সে আপনি ভালো করেই জানেন।আচ্ছা চলি, আল্লাহ হাফেজ ভালো থাকবেন।
আমি স্যারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই বিরক্তিকর লোকটা চলে যাওয়ার প্রতীক্ষায় তো ছিলাম এতোদিন। তবুও কেমন জানি মন খারাপ লাগছে, এটা কি কেবল বিদায়ের প্রভাব নাকি মনে থাকা সুপ্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ??
সাথে সাথে ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠলো,আমি ফোন হাতে নিতেই দেখি আরশান আহমেদ এর মেসেজ,
“আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ ছিল সেই অজ্ঞাত মানুষটা আপনি কি না।এখন সিওর হলাম,,,”
আমি দূরে তাকিয়ে দেখি সে পিছু ফিরে হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আচ্ছা এই পিছু ফিরে তাকানো শাহরুখ খানের কোন মুভির একটা অংশ ছিল যেন? এটা কি সেই পজিটিভ সাইন??
Ops high expectation……
চলবে,,