নয়নাভিরাম #পর্ব:০১

#নয়নাভিরাম
#পর্ব:০১
#আরশিয়া জান্নাত

ঠান্ডা মাথায় বসে ভাবছি কার উপর দোষটা দেওয়া যায়।ভাইয়ারা তখন বাসায় ছিল না,আপু তো কখনোই সেই রুমে যায় না।আমি ছাড়া আর কারো উপরেই সন্দেহ হবেনা।কি যে করি!
ঘটনাটা ঘটেছে আজ দুপুরে।দাদাজানের রুমে রাখা অনেক পুরনো কাঠের বাক্সটা আমি ভেঙে ফেলেছি।ঐ বাক্সটা দাদাজানের দাদা কিনে দিয়েছিলেন বৈশাখী মেলা থেকে।দাদাজান রোজ এটাকে তেল মালিশ করেন।এই বাক্সে কি আছে তা নিয়ে আমার অনেকদিনের কৌতুহল।আজ সুযোগ পেয়ে ওটা নিয়ে স্টোররুমে গেছিলাম।কিন্তু খোলার সিস্টেম ই বুঝতে পারছিলাম না।বিরক্ত হয়ে জোরে ফ্লোরে রাখতেই উপরের অংশ ভেঙে খুলে গেছে।তারপর কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে রুমে রেখে এসেছি।ভয়ে আমার হাঁটু কাঁপছে।
একটু পরেই ওর দাদীজান চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো।দাদীজানের চিৎকার শুনে বাবা-মা, ভাইয়া ছোট চাচ্চু সবাই উনার রুমে হাজির।দাদীজান বিলাপ করতে করতে বলছে,আল্লাহ গো আল্লাহ কে করলো এই কাম?তোগো বাপেরে এখন আমি কেমনে সামলামু।তাইনে যদি দেহে তাইনের এতো আউশের জিনিস ভাইঙ্গা লাইছে কিতা করবো আমারে?
বাবা চিন্তিত গলায় বললেন,কি বলেন আম্মা।কে ভাঙলো এটা?বাসায় তো অবুঝ কেউ নাই যে নিয়ে ভেঙে ফেলছে।
মা বললো,দেখো গিয়ে তোমার ছোট মেয়ে করেছে কিনা।মিমি এই মিমি এদিকে আয়,
আমে ততোক্ষণে পার্স নিয়ে গেইটের বাইরে চলে গেছি।এখন সেখানে যাওয়া আর জেনেশুনে আগুনে পা দেওয়া এক ব্যাপার।

আমি রুমাইসা তেহজিব মিমি।চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট।দুইদিন পরপর বাসায় ইম্পট্যান্ট জিনিসপত্র নষ্ট করা আমার অনিচ্ছাকৃত কীর্তি।এমন না যে আমি ইচ্ছে করে সেসব করি।আসলে ছোটদের সবকিছুতে কৌতুহল বেশি থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক তাই না?এখন কৌতুহলের জন্য কিছু নষ্ট হলে সে কি আমার দোষ??আমার মা আমার এই জানার অদম্য ইচ্ছেকে তো আর গলাটিপে হত্যা করতে পারেন না! এই যেমন সেদিন রান্নাঘরে ইউটিউব দেখে সানফ্লাওয়ার ওমলেট বানাতে গেলাম।কিচেনে সার্কেল শেইপের কাটার ছিল না তাই বিভিন্ন সাইজের গ্লাস ইউজ করেছি।পারফেক্টলি হয়েছে সেই খুশিতে যেই না হুররে বলে উঠলাম অমনি হাত লেগে চারটা গ্লাস মেঝেতে পড়লো।ঝনঝন করে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।আমার ওমলেটটা যে পারফেক্ট হয়েছে সেদিকে কারোই নজর গেল না।চারটা কাঁচের গ্লাস কি মেয়ের প্রতিভার চেয়ে বেশি দামী?হুহ!
বাঙালি যেদিন ট্যালেন্টের কদর দিতে শিখবে সেদিন গিয়ে আমার মতো জিনিয়াসদের এমন তুচ্ছ কারণে বকুনি শুনতে হবেনা।(আম্মাজানের যাবতীয় ব্যবহার্য জিনিসের মারও খেতে হবেনা)
সে যাই হোক এখন আপাতত আমি পার্কে বসে আছি।আমার অনেক ফ্রেন্ড তবে তাঁর মধ্যে নীলা আর ছোটন সবচেয়ে ক্লোজ।ওদের বাসায় যাওয়া আমার জন্য নিষিদ্ধ।কারণ আমি ইতিমধ্যে তাঁদের বাসায়ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছি।এজন্য আমারে কেউ বাসায় নেওয়ার রিস্ক নেয় না, সব ভালোবাসা ক্লাসে আর বাইরে।আমার মতো দুঃখী মেয়ে এই পৃথিবীতে আর একটাও আছে বলে আমার মনে হয় না।
পার্কে বসে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছি আর সামনে বসা কাপলদের ন্যাকামি দেখছি।মেয়েটার ন্যাকামি যেমন হাই লেভেলের ছেলেটার ধৈর্য ও পুরস্কারের দাবিদার।অনেকক্ষণ তাদের ড্রামা দেখে আমি এক পর্যায়ে উঠে গিয়ে বললাম,আরে বাপরে বাপ এতো ন্যাকামি করতে পারোস বোইন।তোরে দেইখা আমার মাথা ঘুরাইতাছে।ভাইসাব আপনার ধৈর্যের উপর আমি ক্রাশ খাইছি।এরে বাদ দিয়া আমার লগে প্রেম করেন।গ্যারান্টি দিলাম আমি এমন অসহ্যকর কোনো ডিমান্ড ই করমু না।
মেয়েটা রেগে বললো,এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার।চেনা নাই জানা নাই হুট করে এসে এসব কি বলছো।দেখে তো ভদ্রঘরের মনে হচ্ছে বিহেভ এমন কেন?
— লিসেন বোইনা,তুমি এতোক্ষণ ধইরা যতোকিছুর আবদার করলা মনে হচ্ছে এ তোমার বফ না বরং আলাদিনের দৈত্য।যে তোমার সব উইশ পূরণ করতে অফুরন্ত সময় আর টাকার বস্তা নিয়ে বসে আছে।ও ভাই ফ্রি এডভাইজ দিচ্ছি এমন মেয়েরে বিয়েতো দূর প্রেম ও কন্টিনিউ কইরোনা।পরখাওয়া মাইয়া একটা!
মেয়েটা রেগে আমার দিকে তেড়ে আসতে চাইলো আমি ততোক্ষণে দৌড় দিয়ে ওখান থেকেও পগারপাড়।রাতে চুপিসাড়ে বাসায় ঢুকছি তখন দাদাজান বললো,রুমাইসা এদিকে এসো।
কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।আমি ঢোঁক গিলে দাদাজানের সামনে দাঁড়ালাম।
তিনি বললেন,কোথায় গিয়েছিলে?
–এই তো পাশের পার্কে ফ্রেশ এয়ার নিতে গেছিলাম।জানেন তো ঢাকাশহরে এখন অক্সিজেনের কতো অভাব।বাসায় কেমন সাফোকেশন হয় ।দাদাজান ভাবছি ইনডোর প্ল্যান্ট কিনবো অনেকগুলো তাহলে আপনারাও ফ্রেশ অক্সিজেন পাবেন কি বলেন?
দাদাজান ঠান্ডা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল,বাক্সটা খুলতে গিয়ে ভেঙেছ তাইনা?
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল এখন নিরব থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে চুপ করে রইলাম।দাদাজান বললো,ওটাতে কি আছে তা জানার এতো কৌতুহল তোমার আমায় বললেই পারতে।এটা এমনিতেই পুরনো হয়ে ভঙ্গুর হয়ে গেছে।আমি নিজেই খুব সাবধানে এটা খুলি।এদিকে আসো দেখো এতে কি আছে।
আমি পাশে গিয়ে বসে দেখলাম সেখানে একটা বাঁশের বাঁশি,কয়েকটা চিঠি আর একটা থলিতে কিছু পয়সা আছে।দাদাজান বললেন,এই বাঁশিটা আমার মামা কিনে দিয়েছিলেন।আর এই পয়সাগুলো আমি বহুকষ্টে
সংগ্রহ করেছিলাম।তখনের যুগে পয়সা জমানো সহজ কথা না।এসব আমার জন্য খুব দামি।
আমি পয়সাগুলো ভালোমতো দেখে বললাম,চিঠিগুলি কিসের?
দাদাজান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,এগুলো রেণুর চিঠি।তোমার দাদীর সাথে বিয়ের হবার আগে আমি ওকে পছন্দ করতাম।আমাদের পাশের গ্রামের মেয়ে।ভেবেছিলাম বিয়ে করতে হলে একেই বিয়ে করবো।কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিল না,,
–দাদাজান আপনি কি এখনো উনাকে ,,,,
দাদাজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, প্রথম মানুষকে কেউ কখনোই ভুলতে পারেনা।তবে এটা সত্যি সময় মানুষের মন বদলে দেয়।তোমার দাদীজানকে আমি ভালোবাসি,সে আমার তিন সন্তানের জননী।তাঁর ত্যাগের কথা আমি অস্বীকার করতে পারবোনা।তুমি এখন যাও আর এসব কথা কাউকে বলোনা।
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে রুমে চলে এলাম।মনে মনে অনেকটা আফসোস হচ্ছিল,দাদাজানকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি একটা মেয়ের চিঠি এখনো যত্নে আগলে রেখেছেন।ভালোবাসা ব্যাপারটা আসলেই অদ্ভুত!

ইলহামের কলে আমার সকালের আরামের ঘুম হারাম হলো।কানে মোবাইল নিতেই সে কর্কশ গলায় বললো,তুই গতকাল এ কি কান্ড ঘটাইলি মিমি?
আমি হাই তুলে বললাম,আমি তো একটা কান্ড ঘটাই না।অনেকগুলো ঘটাইছি।কোনটা শুনতে কল দিছোস সেটা বল।
ইলহাম কটমট করে বললো,ঐ মেয়েটা আমার আপু ছিল।তুই আমার আপুরে এতো কথা বললি?তোর জন্য আমার বোনের ব্রেকাপ হয়ে গেছে।
–সে তোর বোন আমি জানমু কেমনে?তাছাড়া এটা তোর কেন আমার বোন হলেও এসব বলতাম।সত্যি বলতে মিমি ভয় পায় না।
–আসছে বড় সত্যবাদী তটীনি।এখন তুই বাসায় আয় আপু তোর ঘাড় মটকাবে।
–তোর বোইন আমারে চিনছে কেমনে?উনারে তো আমি চিনিনা?
–রাতে আমার ফোনে তোরে দেখছে।গ্রুপ ফটো ছিল যে।এতোদিন খেয়াল করেনাই কাল দেখে চিনছে।
–তো আমি কি করমু এখন?
–তুই আসবি আপুর বফরে বুঝাবি সব মিটমাট করবি।
–এহ ঠ্যাকা?
–এমন করিস না মিমি।আপু অনেক কান্না করতেছে মেহবুব ভাইকে অনেক ভালোবাসে তো।
–কান্না করার কিছু নাই।যে ছেলে অচেনা মেয়ের কথায় ব্রেকাপ করতে পারে তাঁরে ভালোবাসা উচিত না।
–তুই তো ভালোই পল্টিবাজ! তখন বললি আমার বোন খারাপ এর সাথে রিলেশন রাখা ঠিক না।মেহবুব ভাইয়ের ধৈর্যের উপর ক্রাশড হেনতেন।এখন আবার বলোস সে ভালোনা!!
–শোন যখন যা রাইট তখন তাই বলাটা পল্টিবাজী না।তোরে আমি এক্সপ্লেইন করতে পারমু কিন্তু এখন করমুনা।ফোন রাখ ঘুমাইতে দে।
–মিমি দোস্ত শোন,,,,,,
ফোন রেখে আমি আবার ঘুম দিলাম।পৃথিবীটা এতো ছোট ক্যান আমার বুঝে আসে না।ঘুরেফিরে সব চেনাজানা মানুষ।কাউকে সৎ পরামর্শ দিয়ে যে একটু সমাজসেবা করবো সেই সুযোগ নাই।হুহ!

ক্যাম্পাসে ঢুকতেই নীলা দৌড়ে এসে বললো,তোর কপালে আজকে শনি আছে,তাড়াতাড়ি ক্লাসে চল।
–আমার কপালে শনি থাকেনা কোনদিন?এতো প্যারা দিস না তো
–তুই কাজই করোস এমন।
–ইলহামের বোইনের কথা বলতেছস? দেখ ঐখানে আমার কোনো দোষ নাই।সেতি এমন লোভীর লোভী,,,
নীলা আমার হাত চেপে ধরতেই দেখি ইলহাম রাগী লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি হেসে বললাম,আরেহ দোস্ত তুই এখানে।
–কি বলছিলি তুই?
–আমি কখন কি বলছিলাম যে?
–একদম ভং ধরবিনা মিমির বাচ্চা
–হেই মিমির বাচ্চা কই?দেখাতো সুন্দর হয়েছে নি দেখি?দেখ আমিতো বহুত সুন্দর মেয়ে যদি আমার মতো না হয় তাহলে তো লস
ইলহাম রেগে তাঁর দিকে আসতেই সে দিল ভোঁ-দৌড়।
“কি এক জীবন আমার খালি দৌড়াইতেই হয়।
আচ্ছা আপনারাই বলেন আমি কি কাউকে গালি দিয়েছি?”

দৌড়াতে দৌড়াতে যেই না সামনে তাকাবো অমনি একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে আমার হাড়গোড় সব ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল। সামনে তাকাতেই মনে হলো, ” ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস কি টাইমমেশিন দিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে চলে এসেছে?” সে ততক্ষণে উঠে শার্ট ঝেড়ে বললো,চোখে দেখতে পান না নাকি! এমন বুঁনোষাড়ের মতো দৌড়াচ্ছেন কেন?
আমি রেগে বললাম,কি বললেন আপনি আমি বুঁনোষাড়?
–স্যরি জেন্ডার মিস্টেক বুনোগাভী বলা উচিত ছিল!
–আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না।এখানে আপনারো ফল্ট আছে ,আপনার তো উচিত ছিল সরে যাওয়ার।
–ওহ রিয়েলি এখন আমার দোষ?অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোতে খুব এক্সপার্ট দেখছি!
–এখানে দোষ চাপানোর কি আছে যা সত্যি তাই বলেছি।
–সরো তো ঝগড়ুটে মেয়ে একটা! তোমার জন্য আমার অযথাই টাইম নষ্ট হচ্ছে।
রাগে আমার পিত্তি জ্বলে গেল।এজন্যই বলে চেহারা দেখে মানুষ বিচার করতে নেই।দেখতে যতো সুন্দর এটিটিউড ততোই জঘন্য।
ক্লাসে ঢুকে বসতেই প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে ট্রয়ের বদরাগী রাজপুত্রটা ঢুকলো।
–এটেশন প্লিজ।তোমরা সবাই নিশ্চয়ই শুনেছ প্রফেসর ফয়েজ ট্রিটমেন্টের জন্য মাদ্রাজ গেছেন।তাঁর অবর্তমানে তোমাদের গেস্ট টিচার হিসেবে মিঃ আরশান আহমেদ জয়েন করেছেন। আশা করছি তোমরা সবাই তাঁকে রেস্পেক্টফুলি কোঅপারেট করবে
আমি ভয়ে ঢোঁক গিলে ভাবছি “আমার দিনটা আজ আসলেই খারাপ।উহুঁ,,,,,,,,,”

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here