#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-15)
♡আরশিয়া জান্নাত
কাঁচ গলে বৃষ্টির পানি পড়ছে, বর্ষার এখন আর কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। কখন বৃষ্টি হবে ঠিকঠিকানা নেই। তাহজীবের অফিসে ঢোকার আগেও কেমন ঝকঝকে আকাশ ছিল, অথচ এখন বৃষ্টি হচ্ছে। সামনে রাখা গরম কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে,অথচ তাহজীবের খবর নেই। খানিকটা বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে রাফসানকে টেক্সট করলো সে যেন তাঁকে নিতে আসে। এই অসময়ের বৃষ্টিতে এখানে ক্যাব পাওয়া যাবে কি না কে জানে!
সিতারা প্রথমে চেয়েছিল বাসায় গিয়ে কথা বলবে কিন্তু আফসানার থেকে যখন শুনলো সে বাসায় রাত এগারোটার আগে ফেরেনা তখন অফিসে আসাটাই শ্রেয় মনে হলো।
বেশ খানিকক্ষণ পর তাহজীব কেবিনে এলো। এসেই ডোন্ট কেয়ার মুডে বসে বললো, কি ব্যাপার মিসেস রাফসান এখানে?
সিতারা মিষ্টি করে হেসে বললো, ছোটবোন কি তার ভাইয়ের কাছে আসতে পারেনা?
তাহজীব পেপার ওয়েট নাড়াচাড়া করে বললো, কি বলতে এসেছিস বলে ফেল, আমার হাতে একদম সময় নেই।
সিতারা উঠে গিয়ে তার ছবি বাঁধাই করা ফ্রেমটা সরিয়ে আফসানার ছবির ফ্রেম রাখলো। তাহজীব চুপচাপ সিতারার কার্যকলাপ দেখছে।
“এইবার ঠিক আছে।”
“এটা রিপ্লেস করতে এসেছিস?”
“শুধুমাত্র ডেস্ক থেকে না মন থেকেও রিপ্লেস করতে এসেছি। আপনার একটা অহেতুক জেদের কারণে একটা মেয়ের জীবন অযথাই জাহান্নামে পরিণত হয়েছে। সে এখন আপনার সন্তানের মা হতে চলেছে, কোথায় তার প্রতি যত্নশীল হবে তা নয় উল্টো অবহেলা করে এড়িয়ে যাচ্ছেন!”
“আমি তো তাকে ভালোবাসিনা তাঁরা! তার প্রতি যত্নশীল হবার মনোভাবটাই আসেনা,,,”
“ভালোবাসেন না অথচ জৈবিক চাহিদা মেটাতে পিছপা হননি! শুনুন অতীত থেকে শিক্ষা নিতে না পারা একটা মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আমাদের সম্পর্কটা আজ এমন জটিল হয়েছে শুধুমাত্র আপনার অবহেলায়। এটা রিপিট করে স্ত্রী সন্তানকে হারাবেন না। সে আপনার অংশ নিজের মাঝে লালন করছে এই কৃতজ্ঞতায় অন্তত সঠিক যত্ন নিন।”
“জ্ঞান দেওয়া শেষ? আর কিছু বলার আছে?”
“রাফসান সাহেবের সঙ্গে আমি অনেক সুখে আছি। সে আমার খুব কেয়ার করে। মন খারাপ করা তো দূর চুপচাপ বসে থাকতেও দেয়না। সবসময় হাসিখুশি রাখে। জানেন আফসানার অবস্থা দেখে এখন মনে হয় ভাগ্যিস আমি আপনার স্ত্রী হইনি,,,,”
“তোর সত্যিই সেটা মনে হয় তাঁরা? ওর জায়গায় তুই হলে হয়তো এমন হতো না।”
“আপনার সঙ্গে সাত বছর সম্পর্ক ছিল আমার। বিয়ের পর আর কি-ই বা বদলাতেন শুনি?”
“তুই এখন চলে যা তাঁরা, তোর কথা শুনে গায়ে জাস্ট আগুন ধরে যাচ্ছে।”
“মনে আছে বহু আগে একটা স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিলাম? ভালোবাসা হচ্ছে প্রজাপতির মতো, মুঠোবন্দি করলে মরে যায়, হালকা করে ধরলে উড়ে যায়। তাই স্থির হয়ে এটাকে বসতে দিতে হয়। তারপর মায়ায় পড়ে অনুভবের জোয়ারে স্থায়ী হয়ে যায়।
আপনি সেটার মর্মার্থ বোঝেননি কখনোই। শেষে শুধু এটাই বলবো যাকে পেয়েছেন তাঁর কদর করুন, যাই আল্লাহ হাফেজ”
তাহজীব আফসানার ছবিটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। সিতারা যে এই ঝুম বৃষ্টিতে একা বেরিয়েছে সেইদিকে তার হুশ নেই।
অফিসের নীচে দাঁড়াতেই রাফসান সিএনজি নিয়ে এলো। খানিকটা কাকভেজা হয়ে সিএনজিতে উঠে বসলো সিতারা।
“এ কি আপনিতো পুরোই ভিজে গেছেন!”
“আরেহ ব্যাপার না। আসলে গাড়ি খুঁজে পেতে টাইম লাগছিল। ছাতাও নেই নি তাই ভিজে গেছি,,”
“আপনি বাসায় ছিলেন না? ছাতা নিয়ে আসবেন ভেবেছি”
“না বাসায় ছিলাম না। মিটিং ছিল একটা ঐখানে গিয়েছিলাম এরপরই তো বৃষ্টি, আপনার টেক্সট পেয়ে সোজা এখানে চলে এসেছি।”
“এমনভাবে ভিজেছেন আপনি উফফ ঠান্ডা লেগে যাবে তো। দেখি মাথাটা মুছে দেই।”
বলেই সিতারা তার উড়না দিয়ে রাফসানের মাথা মুছে দিতে লাগলো।
সিতারার বাবার বাসায় ফেরার কথা থাকলেও সেদিকে না গিয়ে রাফসানের ওখানেই চলে গেল।
“কি মনে হয় তাহজীব পরিবর্তন হবে?”
“জানিনা। তবে আশা করি একটু হলেও বদলাবে,,”
“তাকে ফেইস করতে কষ্ট হয়?”
“নাহ! আগে হতো এখন আর হয়না।”
“সত্যি বলছেন?”
“মিথ্যে না পুরোপুরি। কষ্ট হয়না সত্যি তবে মন খারাপ লাগে,,,”
“স্বাভাবিক।”
সিতারা রান্নাঘরে গিয়ে চুলোয় চায়ের পানি বসালো। রাফসান কি ভেবে হঠাৎ বললো, সিতারা বেগুনী রঙের শাড়িটা পড়বেন আজ?
সিতারা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রাফসানের দিকে। রাফসান মাথা চুলকে বললো, অনেকদিন শাড়ি পড়েন না তাই আর কি,,,সমস্যা হলে থাক এমনিই বলেছি।
সিতারা ফিক করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতেই বললো, নিজের বৌকে শাড়ি পড়তে বলায় এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আপনিতো পুরো লাল হয়ে গেছেন হিহিহি। আপনি বসেন আমি দুই মিনিটে শাড়ি পড়ে আসছি।
রাফসান পকেট থেকে গোলাপ ফুল আর নুপুর বের করে টেবিলে রেখে চা বানাতে চলে গেল।
সে কখনোই সরাসরি নিজ হাতে সিতারাকে কিছু দেয়না। মেয়েটা সব কিছুতে হেসে লজ্জায় ফেলে দেয়। এমনিতেই রাফসান খুব লাজুক স্বভাবের তার উপর এমন হাসি দেখলে নার্ভাস লাগে। সিতারা রাফসানের এই লুকোচুরিটা বেশ ইনজয় করে। কেমন জানি এক অধিকারবোধ দুজনের মাঝে। রাফসান যেমন বিনাশব্দে এটাসেটা এনে রেখে দেয় সিতারাও কিছু না বলেই সেইসব জিনিস সাথে সাথেই পরম যত্নে পড়ে নেয়। মজার ব্যাপার রাফসান কখনোই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনা। এমন ভান করে থাকে যেন দেখতেই পায়নি, কিন্তু সিতারার প্রতিটি পদক্ষেপ তার নখদর্পণে। সে যখন খোঁপায় মালা জড়িয়ে স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে বেড়ায় তাঁর খুব ভালো লাগে। মনের মাঝে অনুভব হয় অদ্ভুত এক তৃপ্ততা। দুজনের জীবনের অতীত যাই থাকুক না কেন সম্পর্কে তা প্রভাবহীন। বন্ধুর মতো একে অন্যের পাশে থাকা,মনের কষ্ট অনুভব করা কিংবা ছোটখাটো আবদার পূরণ করার দারুণ এক সম্পর্ক। সেই পবিত্র সম্পর্কে ভালোবাসাটা হতে কতক্ষণ??
_____________
—আমি বুঝিনা সাফা তোমার মাইন্ড এতো ন্যারো কেন? কলিগদের সাথে ডিনারে যাওয়া নিয়ে এতো ইনকোয়ারি করার কি আছে?
—তুমি তো অনেকের সঙ্গে যাওনি সোহেল। এখানে স্পেসিফিক একজন ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করছি তানিয়াকে নিয়ে ডিনারে গেলে কেন?
— স্ট্রেইঞ্জ! তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো?
— সন্দেহ করার কথা আসছে কেন। প্রশ্ন করে শর্টকাটে উত্তর দিবে। এতো কথা শোনানোর কি আছে আমিতো বুজতে পারছিনা।
— এটা সন্দেহ নয়তো কি? তোমার সঙ্গে বিয়ের আগে অনেকবার ডিনারে গেছি, ক্লায়েন্ট এটেন্ড করতে গিয়ে কতবার এমন ঘটেছে। সেইসব জানা সত্ত্বেও এমন প্রশ্ন করাটা নীচু মানসিকতার প্রমাণ কি দিচ্ছেনা??
—তুমি শুরুতেই বললে পারতে ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিং আছে,,
— আসলে সমস্যা কি জানো কেউ যখন কাউকে ঠকায় তখন আর অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারেনা। সবাইকে নিজের মতো ধোঁকাবাজ ভাবে।
সাফা রেগে বললো, কি বললে তুমি আমি ধোঁকাবাজ? এইসব তোমার মনে?? আমিতো ভাবতেই পারছিনা এই ধারণা পুষে রেখেছ তুমি।
সোহেল বিরক্ত হয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। রেগে গেলের সাফার গলার স্বর তিনগুণ বেড়ে যায়। ঐ সময়টায় যে সামনে থাকবে তাঁর কান ফেটে যাবে নিশ্চিত। উফফ কিভাবে যে সোহেল সহ্য করে সে নিজেও ভেবে কূল পায় না।
চলবে,,,,