অবান্তর_চিরকুট_০১

#অবান্তর_চিরকুট_০১
♡আরশিয়া জান্নাত

“তুমিই বলো রাফসান তোমার সাথে আমার কোনদিকে যায়? পারিবারিকভাবে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে বাবা তাঁর বোঝা কমিয়েছেন, আমিও আবেগের বশে তোমাতে মশগুল ছিলাম। কিন্তু এখন আবেগ সরে গেছে, এখন এই সম্পর্কটা আমার কাছে গলার কাঁটার মতো।”
রেগে চিৎকার করে বললো সাফা। রাফসান মাথা নীচু করে বসে আছে সোফার এককোণে। তাঁর কানে যেন কিছুই ঢুকছেনা। সে এই সব কঠিন কথাবার্তা শুনতে চাইছেনা,

“কি ব্যাপার এমন ভেজাবেড়াল সেজে বসে আছো কেন? তুমি কি জানো তোমার এই এড়িয়ে যাওয়ার স্বভাবটা আমার কত্ত অপছন্দ? শোনো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই সম্পর্কে এখানেই শেষ করবো।”

রাফসান মুখ তুলে শান্তস্বরে বললো, তোমার এই মুহূর্তে মাথা ঠিক নেই সাফা। তুমি বরং একটু শান্ত হও তারপর আমরা এই বিষয়ে কথা বলবো।

“না আমার মাথা ঠিক আছে। আর শান্ত হয়ে ভাবার কিছু নেই। আমি এই সংসার আর করবোনা এটাই ফাইনাল। এখন তোমার কিছু বলার থাকলে বলো নাহয় আমি যাচ্ছি”

“সিদ্ধান্ত যখন নিয়ে ফেলেছ আমি এখানে আর কি বলবো? জোর করে বেঁধে রাখার ইচ্ছে নেই। আমাদের সংসারে টাকার অভাব ছিল কিন্তু ভালোবাসার অভাব ছিল না সাফা। এখন যখন সেটাই নেই তোমার ভাষ্যমতে তোমার চোখে বাঁধা মোহ কেটে গেছে তখন আর আমি কিছু বলবোনা। তুমি ভালো থাকো সবসময় এইটাই চাওয়া”

সাফা বিরক্তমাখা চেহারা নিয়ে বেরিয়ে গেল আর রাফসান আগের মতোই মাথা নীচু করে বসে রইলো।
আজ সাফার সামনে সে অযোগ্য, তাঁদের এতোদিনের সংসার আবেগের তাসঘর! এতো সহজে কিভাবে সব ভুলে গেল সে? রাফসান চাইলেই তাকে মনে করিয়ে দিতে পারতো যে যোগ্যতা নিয়ে আজ সে তাকে ছোট করছে সেই যোগ্যতা অর্জনে কার ভূমিকা ছিল। কিন্তু সাফা এটাকে টাকা দিয়ে বিচার করবে, হয়তো বলে বসবে যতো টাকা খরচ করেছিলে সব আমি ফেরত দিবো,তোমার দয়ার দায়ভার চুকিয়ে দিতে আমি অন্তত এই কারাগারে বন্দী হবোনা।

বহুদিন পর রাতে রাস্তায় নেমেছে আগের ছন্নছাড়া মানুষটা,বেশ তো ছিল সেই জীবন। সারাদিন পত্রিকা অফিসে টাইপিং আর রাতে ভবঘুরের মতো অলিতেগলিতে ঘুরে বেড়ানো। এই বিশাল ঢাকা শহরের বুকে তাঁর মতো এতিম ছেলের বেঁচে থাকতে আর কি চাই? নিকষ কালো অন্ধকারে কখনো বা ঝলমল করা নক্ষত্ররাজীর সমাগমে আকাশটা যখন পরিপূর্ণ হতো সে ঘাড় তুলে চেয়ে থাকতো বিশালতার দিকে। কত রাত যে বেঞ্চিতে কাটিয়েছে হিসেব নেই। ঘরে ফেরার তাড়া নেই, কারো অপেক্ষা নেই,নেই কোনো পিছুটান। তারপর সাফা এলো তাঁর জীবনে। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পড়তেই ছন্নছাড়া ভাব কেটে গেল। রাফসানের দূরসম্পর্কের ফুফু এই অনাথ ভাতীজাকে বড্ড ভালোবাসতো বলেই নিজ দায়িত্বে পাত্রী খুঁজে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ করিয়েছিলেন।
সাফা মেয়েটার বয়স তখন কত ছিল? সতেরো কি আঠারো! কত সুন্দর করে সামলে নিয়েছিল তাঁকে। রাফসানের একটা মানুষ হয়েছে ভাবতেই বুকটা ভরে যেত পরম শান্তিতে। এখন আর ঘরে ফিরে লাইট জ্বালাতে হয়না, আগে থেকেই কেউ একজন তাঁর অপেক্ষায় থাকে। তাঁর পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রাখে। সারাদিনের ক্লান্তি এক লহমায় হারিয়ে যায় সেই নিষ্পাপ হাসিমাখা অভ্যর্থনায়। বিয়ের আগেই সাফা বলেছিল সে পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চায়, তাঁর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে রাফসান ও বেশ খুশিই হয়েছিল। সংসারে ঝামেলা নেই অযথা সারাদিন ঘরে বসে থেকে কি করবে,তাঁর চেয়ে পড়াশোনায় থাকুক ব্যস্ত থাকবে।
ততদিনে রাফসান আগের জব ছেড়ে ভালো একটা কোম্পানিতে জয়েন করেছে। সংসারে স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করেছে, দুজনেই দুজনের ভালোবাসায় মত্ত। কোনোকিছুরই অভাব নেই, বেশ চলছিল জীবনটা।
বিয়ের দুই বছর পর সাফা কনসিভ করে, আনন্দের বন্যা বয়ে যায় রাফসানের মনে। তাঁদের জীবনে নতুন অতিথি আসতে চলেছে পারছিল না পুরো পৃথিবীর মানুষকে চিৎকার করে বলতে “শুনছো সবাই আমি বাবা হবো”। সাফা ওর পাগলামি দেখে হাসছিল যখন পুরো ঘরে যেন ঝনঝন করে সেই হাসির প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। তারপর থেকে সাফার প্রতি যত্নশীল হওয়া,বাসায় একজন হেল্পিং হ্যান্ড রাখা আরো কত কি। সাফার যেন কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য কোনোকিছুরই অভাব রাখেনি। কিন্তু চারমাসের সময় দূর্ভাগ্যবশত মিসক্যারেজ হয়ে যায়। মনে পাহাড়সম যন্ত্রণা লুকিয়ে তবুও সাফাকে সামলেছিল সে। রোজ রাতে সাফার চোখের পানিতে তাঁর বুক ভাসতো,আর সে সান্ত্বনার বাণী আওড়াতে গিয়ে নিজের চোখ ভেজাতো।

“স্যার চায়ের কাপটা?”

চাওয়ালার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে রাফসানের। পকেট হাতড়ে দশটাকা বের করে ভাংতি না নিয়েই হাঁটা ধরে উল্টোপথে।
টাইম দেখার জন্য ফোন বের করে দেখে ফুফুর দশটা মিসডকল। কল ব্যাক করতেই ফুফু বললো,রাফু বাবা কই তুই? কতগুলি কল করেছি ধরলি না যে?
এমন আদুরে গলা শুনে রাফসানের কষ্টগুলি দলা পাকিয়ে গলা অবধি এসে গেল যেন, চোখের পানিতে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেছে। ফুফু যেন তার অবস্থা টের পেয়ে গেল, ব্যস্তগলায় বললো, রাফু তুই আমার বাসায় চলে আয় বাবা। এখুনি আয় আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি। নাহয় বল কোথায় আছিস আমি নাঈম কে পাঠাই?
“না না ফুফু নাঈমকে কষ্ট করতে হবেনা, আমি আসছি”
_________________________

“তুই কি করে পারলি সাফা এমন স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবতে? যে তোকে পড়াশোনা করিয়ে আজ এই পজিশনে এনেছে তাকেই এখন তোর ভালো লাগছে না? মানছি রাফসান ভাইয়া তোর থেকে ছোট পজিশনে জব করছে কিন্তু তার মানে এই না সে তোর অযোগ্য! তোর মতো এডুকেটেড মেয়ের মাইন্ড এমন চিপ হতে পারে আমিতো ভাবতেই পারিনি”
কিছুটা জোরেই বললো ইপ্সিতা।

সাফা বিরক্তস্বরে বললো, শোন ইপ্সিতা এটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার। তোকে কেউ জ্ঞান দিতে বলেনি।আর শোন সে আমায় পড়াশোনা করিয়েছে মানছি তার মানে এই না সে আমার মাথা কিনে নিয়েছে। জীবন তো একটাই তাই না? এখন যদি কৃতজ্ঞতার বোঝা বইতে বইতে অসহ্যকর জীবন পার করি আর লাভ কি? ফ্রিডম কই আমার?

“মানে কি সাফা? কৃতজ্ঞতার বোঝা বইতে বললো কে? সে যেমন ভালোবেসে করেছে তুইও ভালোবেসে করবি। সত্যি করে বলতো রাফসান ভাইয়া কোনদিকে তোকে কষ্টে রেখেছে? কিসের অভাব তোর? আর স্বাধীনতা বলতে কি বুঝিস? আমার জানামতে তোর কোনোকিছুতেই ভাইয়া ইন্টারফেয়ার করেনি, এমন ডেডিকেটেড হাজবেন্ড পাওয়া সাত কপালের ভাগ্য”

“এতোই যখন দরদ তুই গিয়ে সংসার কর। যেখান থেকে আমার মন উঠে গেছে সেখানে আর যাবোনা আমি।”

“তুই আসলে লোভে অন্ধ হয়ে গেছিস। একটা ভালো মানের জব মানুষকে এতো অহংকারী করে তুলতে পারে তোকে না দেখলে জানতাম না। তোর মতো মেয়েদের জন্যই ছেলেরা বৌকে পড়াশোনা করাতে ভয় পায়। লয়্যালিটির দাম নেই তোদের কাছে। শোন, তোর কি ধারণা তোর কলিগ সোহেল তোকে বিয়ে করবে? দেখিস লোভে পড়ে সব হারিয়ে বসিস না।”

ইপ্সিতাকে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে পারলে শান্তি লাগতো সাফার। কিন্তু ইপ্সিতা সেই সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেছে। আসছে রাফসানের চামচা, যেন ওরে টাকা দিয়ে কিনে পাঠাইছে যা গিয়ে ওকিলাতি কর, যত্তসব! মেজাজটাই নষ্ট করে দিলো উফফ।

“আজ আমরা বাইরে লাঞ্চ করবো রেডি থেকো”

সোহেলের টেক্সট দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল সাফার। ছেলেটা কত্ত রোমান্টিক আর স্মার্ট, মাঝেমধ্যে মনে হয় সোহেল ওর বোরিং জীবনে রংধনু হয়ে এসেছে। বেশ ফুরফুরে মুডে শাওয়ারে ঢুকলো সে।

ঐদিকে রাফসান ব্যাগপত্র গুছিয়ে বান্দরবানের উদ্দেশে বেড়িয়ে পড়লো। এই যান্ত্রিক শহরে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে তাঁর….

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here