নেকড়ে_মানব,পর্ব:-১৪

#নেকড়ে_মানব,পর্ব:-১৪
#আমিনা_আফরোজ

সাজেক ভ্যালির সেই মাঝারি পাহাড়ের পাদদেশে এসে থামল নিলয়রা। ঘড়ির কাঁটা তখন চারের ঘর পেরিয়ে পাঁচ ছুঁই ছুঁই করছে। ভোর হতে খুব একটা দেরি নেই। ইতিমধ্যেই রাতের আঁধার কাটতে শুরু করেছে ধরনী থেকে। তবে এই পাহাড়ি এলাকায় জনমানবের সাড়া এখনো পাইনি নিলয়রা। হয়তো এখনো সবাই ঘুমিয়ে আছে নিজ নিজ কুঠিরে । ওরা দুজনে আর সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে উঠতে লাগলো পাহাড়ের গা বেয়ে। ওদের হাতে সময় বেশি নেই। যে কোন সময় কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে । শুধু ডক্টর আয়মান বিপদের মুখে নেই, পুরো রাঙামাটি জেলা আজ নেকড়ে মানব নামক এক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। বেশি বিপদে আছে বড়কল গ্রামের গ্রামবাসীরা। সুশান্তের প্রথম টার্গেট তারায় হতে চলেছে। যে করেই হোক ওদের থামাতে হবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিলয়রা যখন সেই কুটিরের সামনে এসে দাড়ালো সূর্য্যিমামাও ততক্ষণে উদিত হয়েছে ধরণির বুকে। তার সোনালি কিরন ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি পাহাড়ের ঢালের গায়ে। সূর্যের সেই সোনালী কিরনের স্পর্শে জেগে ওঠেছে পাহাড়ি জনপদ। ঘুমের আলস্যে ভেঙে সবাই বেরিয়ে এসেছে ঘরের বাহিরে। গুটিকয়েক জন আবার লেগে পড়েছে তাদের দৈনন্দিন কাজে। কর্মব্যস্ততা ঘিরে ধরেছে তাদের।

নিভৃত এবার দরজায় তিনবার মৃদু টোকার আওয়াজে ভদ্রলোকটি অর্থাৎ প্রফেসর সৌমিক চ্যাটার্জিকে জানান দিলো ওদের অস্তিত্বের কথা। দরজার ওপাশের কামরায় তখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কোন শব্দ নেই ওপাশটায়। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না নিভৃতদের। মিনিট পাঁচেকের মাথায় হঠাৎ খুট শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা। তারপর একজোড়া বরফ শীতল হাত ওদেরকে টেনে নিয়ে গেল দরজার ওপাশে। হঠাৎ এমন ঘটনায় হকচকিয়ে গিয়েছিল নিভৃত ও নিলয় দুজনেই। দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে একসাথে তাকিয়ে রইল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির দিকে। ভদ্রলোকটির পরনে কালো আলখেল্লা জাতীয় পোশাক যা আবৃত করে রেখেছে ভদ্রলোকটির পুরো শরীর। ভদ্রলোকের মাথার চুল এলোমেলো,চোখ ফোলা এবং চোখে রাত জাগবার দাগ স্পষ্ট। ভদ্রলোকের এহেন দুরাবস্থা দেখে নিভৃত বিষ্ময়ে জিঙ্গেস করল,

–” একি! আপনার এই অবস্থা হলো কি করে? কি হয়েছে আপনার?”

নিভৃতের প্রশ্নে ভদ্রলোকটি স্মিত হেসে বললেন,

–” আমার কথা ছাড়ুন । আমি ঠিক আছি। আপনারা বরং আপনাদের কথা বলুন। কি হয়েছে আপনাদের? আপনাদের চোখে মুখে দুশ্চচিন্তার ছাপ। তাছাড়া এত ভোরে আমার এখানে এসেছেন, কোন খারাপ কিছু ঘটে নি তো?”

ভদ্রলোকের কথা শেষ হতেই নিলয় এগিয়ে এলো লোকটির সামনে। ভদ্রলোকের থেকে হাত দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের দিকে যেন লোকটির মুখ পড়ে কিছু জানার চেষ্টা করছে। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,

–” এত ভোরে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত প্রফেসর। কিন্তু বিষয়টা এতটাই জটিল যে আপনার কাছে না এসে পারলাম না। আসলে গতরাতে ডক্টর আয়মান হাসপাতালের ওনার ঘর থেকে নিখোঁজ হয়েছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে আমরা সন্দেহজনক তেমন কিছুই পাই নি। তবে আমাদের মনে হচ্ছে ডক্টর আয়মানের এই রহস্যজনক নিখোঁজের পিছনে নেকড়ে মানবের হাত আছে। যদিও এইটা আমাদের নিজস্ব ধারনা মাত্র । কেননা এই বিষয়ে আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই।”

নিলয়ের কথা শুনে প্রফেসর সৌমিক চ্যাটার্জি অবাক হয়ে বললেন,

–” নেকড়ে মানব?”

–” জি নেকড়ে মানব। কোন মানুষের পক্ষে দোতলার থাইগ্লাস ভেঙে ডক্টর আয়মানকে তার বিছানা সমেত উঠিয়ে নিয়ে যাবার মতো শক্তি থাকতে পারে না।”

নিলয়ের কথা শুনে ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

–” ডক্টর আয়মানকে পাবার আশা ছেড়ে দিন আপনারা। আপনার কথা অনুযায়ী যদি ওনাকে সত্যিই নেকড়ে মানব উঠিয়ে নিয়ে যেয়ে থাকে তবে আমার মনে হয় না এখনো বেঁচে আছেন তিনি।”

প্রফেসর সৌমিক চ্যাটার্জির কথা শুনে ওরা দুজনেই চুপ করে রইলো। দু’জনের মুখেই অনুতাপ। প্রফেসর ওদের উদ্দেশ্যে বললেন,

–” আমি জানি আমার কথাগুলো মানতে কষ্ট হচ্ছে আপনাদের। তবুও বলবো আমার বলা প্রতিটি কথাই সত্য। নেকড়ে মানব যদি কাউকে ওর আহারের জন্য নিয়ে যায় তবে তাকে এতক্ষণ জীবিত রাখে না।”

–” তাহলে এখন কি করণীয় আমাদের?” মলিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল নিলয়।

–” আজ পূর্ণিমা। শয়তানটার শক্তি আজ বৃদ্ধি পাবে পূর্বের থেকে দ্বিগুণ পরিমানে। এক কথায় আজ ওর সামনে যাওয়ার অর্থ মৃত্যুকে সাদরে নিজ ইচ্ছায় আহ্বান জানানো। তাছাড়া আজ এই পূর্ণিমার রাতে ও যাকে ওর শিকার বানাবে সেও ওর মতোই নেকড়ে মানবে পরিণত হবে। এ কথা আগেও বলেছিলাম আপনাদের। আপনাদের মনে আছে কি না জানি না। তাই আজকের রাতে কিছুই করার নেই আমাদের, শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া।”

প্রফেসরের কথায় রেগে ওঠল নিলয়। নিলয় জানে প্রফেসরের প্রতিটি কথা সত্যি কিন্তু নিরীহ মানুষগুলোর কথা মনে হতেই রাগে, ঘৃণায় বোধশক্তি হারিয়ে ফেলল নিলয়। রাগত স্বরে বলে উঠলো,

–” শয়তানটা একের পর এক হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে আর আমরা কিছু না করে শুধু হাতের ওপর হাত রেখে অপেক্ষা করে যাচ্ছি। আর কত দিন এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো প্রফেসর? এর কি কোন শেষ নেই ?”

–” আপনি যদি চান তাহলে আমরা আজকেই অভিযান শুরু করতে পারি। তবে সেক্ষেত্রে লাভের লাভ কিছুই হবে না। কারন আমাদের কাছে না আছে রুপোর বুলেট আর না আছে ঐ শয়তানটাকে থামাবার বিকল্প পদ্ধতি। ”

নিলয়ের উদ্দেশ্যে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন তিনি। নিলয়ও হয়তো প্রফেসরের কথার উওরে তৈরি হয়েই ছিল তাইতো প্রফেসরের কথা শেষ হতেই বলে উঠলো,

–” গত দুইদিনে একশ বুলেট তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো থানাতেই আমাদের হেফাজতে আছে এখন। আর বাকিটা কিছুটা আজ সারাদিনে হয়ে যাবে বলে আশা করছি। আমার মন বলছে ডক্টর আয়মান জীবিত আছেন এখনো। শয়তানটা এখনো কোনো ক্ষতি করে নি ওনার। আজ যদি শয়তানটার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিই তবে হয়তো বেঁচে যেতে পারে একটা প্রাণ।”

–” কিন্তু…… ‌

–” কিন্তু কি প্রফেসর?”

–” নাহ্ তেমন কিছু নয়। ঠিক আছে আপনি যেহেতু আজকেই যেতে চাচ্ছেন তাহলে আমরা আজ রাতেই যাবো সেই নেকড়েটিলায়। আপনারা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করুন। আমিও আমার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করি। ঠিক সন্ধ্যায় আমি আমি আপনাদের থানায় উপস্থিত হবো। তারপর সেখান থেকে যাবো নেকড়েটিলায়। তবে এই অভিযানে যাবার পূর্বে আপনাদের একটা কথা বলতে চাই। এই অভিযানে আপনাদের কিংবা আমার নিজের প্রাণের কোন নিশ্চয়তা নেই। যে কোন সময় আমাদের প্রাণ সংশয় ঘটতে পারে।”

–” সে নিয়ে আপনার কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না প্রফেসর। আমরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই অভিযানে যাচ্ছি। আমাদের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যদি শয়তানটার ভবলীলা সাঙ্গ হয় তবে এর থেকে শুভ আর কিছু হবে না। শয়তানটার মৃত্যু হওয়াটা জরুরি তানাহলে আরো কত মায়ের কোল শূণ্য হবে কে জানে।”

–” বেশ তবে তাই হবে। এবার আপনারা আসুন। সন্ধ্যায় দেখা হবে আপনাদের সাথে।”

–” ঠিক আছে প্রফেসর। এবার তাহলে আসি আমরা।”

কথাগুলো বলেই নিভৃতকে সাথে নিয়ে নিলয় চলে এলো সেখান থেকে। পুরোটা সময় নিভৃত নিশ্চুপ ছিল। একটা কথাও বলে নি সে। কেবল শুনে গেছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে নামতে এই প্রথম কথা বলল নিভৃত,

–” নিলয় আমার কিন্তু প্রফেসরের মতিগতি ভালো লাগছে না।”

নিলয় ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করল,

–” কেনো?”

–“তুমিই ভেবে দেখো প্রফেসর নিজেই প্রথমে আজ যেতে চাইলেন না, তারপর হঠাৎ করেই রাজি হয়ে গেলেন। বিষয়টা সন্দেহের নয় কি?”

–” হয়তো আমার কথায় রাজি হয়েছেন তিনি। এই নিয়ে আর অযথা মাথা ঘামিয়ো না । এখন দ্রুত পা চালাও। থানায় পৌঁছাতে হবে তো। ঢের কাজ বাকি এখনো।”

তারপর আর কোন কথা হল না দুই বন্ধুর মাঝে কেবল দ্রুত পদধ্বনি শোনা গেল তাদের। অন্যদিকে নিলয়রা চলে যেতে প্রফেসর সৌমিক চ্যাটার্জী বিছানায় বসলেন । ওনার কপালে তখন চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠেছে । মুখ-চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। প্রফেসর মিনিট পনেরো বসে রইলেন সেভাবেই। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। মাথার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে গত রাতের পুথি হাতে বেরিয়ে পড়লেন কুঠির ছেড়ে।

এদিকে টিনের দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে ধরণির বুকে নেমে এলো অন্ধকার। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চারিদিক ছেয়ে গেল নিস্তব্ধতায়। শুধু শুনতে পাওয়া গেল একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, তারপর সব শান্ত। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার নীল আকাশের বুকে উদয় ঘটলো পূর্ণিমার রুপোলি চাঁদের। চাঁদের ঝলমলে আলোয় ভেসে গেল পুরো ধরণি। বুনোফুল আর চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় ভেসে যেতে লাগলো চরাচর। সেই স্নিগ্ধ আলোয় জনা দশেক লোক রাইফেল উঁচিয়ে প্রবেশ করলো নেকড়ে টিলার বিপদসংকুল গহীন অরণ্যে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here