#নেকড়ে_মানব,পর্ব:- ০৬
#আমিনা আফরোজ
অয়ন এর সাথে নিভৃত মিনিট পনেরো এর মাঝেই ওদের বাড়ি চলে আসলো। দুতল বাড়িটি বাস স্ট্যান্ড থেকে খুব একটা বেশি দূরে নয় মোটে মিনিট পনেরো লাগে। নিচতলায় দুটো রুম নিয়ে ভাড়া থাকে অয়ন। ব্যাচেলর মানুষ অয়ন, এখনো বিয়ে থা করে নি সে। রান্না-বান্না কখনো নিজে করে আবার কখনো সখনো বাহির থেকে খেয়ে আসে। তবে এবার একটা বুয়া ঠিক করতেই হবে অয়নকে। এখন তো আর সে একা নয় সাথে এক ভাই জুটেছে তার , যদিও সে দুঃসম্পর্কের ভাই তবুও অয়ন হেলাফেলা তো আর করতে পারবে না তাকে।
এদিকে দুরুম বিশিষ্ট ছিমছাম বাসাটা বেশ পছন্দ হয়েছে নিভৃতের। অবশ্য পছন্দ না হলেও কিছু করার ছিল না ওর। এত অল্প সময়ের মধ্যে থাকার জায়গা হয়েছে এই তো অনেক বড় কিছু ওর জন্য। ডানদিকের রুমটা নিভৃতের জন্য পরিপাটি করে রেখেছিল অয়ন। ঘরে একখানা কাঠের চৌকি আর পড়ার টেবিল ছাড়া আর কিছু নেই। নিভৃত ভাবল আগামীকাল বাজারে গিয়ে ট্রাংক কিনে নিয়ে আসবে একখান।
কাপড় – চোপড়ের সংখ্যা তো আর কম নয়, সেগুলো গুছিয়ে গাছিয়ে ট্রাংকে ভরে রেখে দিবে। এসব ভেবে নিভৃত ফ্রেস হয়ে নিজের রাখা বরাদ্দ ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়ল। আগামীকাল ৭টাই আবার ওঠতে হবে তাকে। বাকি রাতটুকু আর কোন সমস্যা হয় নি ওর।
সকাল সাতটা। নিভৃত অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। অফিসের প্রথম দিন আজ। তাই আজ একটু তাড়াতাড়িই যাচ্ছে ও। রাঙামাটির কাউখালী উপজেলায় একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি হয়েছে ওর। বাড়িতে কাজের ফাঁকে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল নিভৃতের। আজও তার হেরফের হয় নি। পত্রিকার প্রথম পাতার ৪নং কলামে একটা খবর পড়ে হঠাৎ হকচকিয়ে ওঠে ও। গতকাল ঢাকা থেকে আসা ওদের বাসটা যে জায়গাই থেমেছিল ঠিক সে জায়গায় একটি মাথাবিহীন লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও মৃত লাশটির সারা গায়ে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে। পুলিশ ভাবছে এইটা কোন সাইকো কিলার এর কাজ। তবে নিভৃতের মনে হচ্ছে এইটা কোন সাইকো কিলার এর কাজ হতে পারে না। ওর কেবলই মনে হচ্ছিল গতকাল রাতের দেখা সেই অদ্ভুত বিভংস জন্তুটির সাথে এই খুনের কোন সম্পর্ক আছে। তবে এইটা নিছক নিভৃতের একান্ত নিজের ভাবনা এর থেকেও আরো একটি খবরে কলামে চোখ আটকে গেল নিভৃতের। গতকাল ঢাকা থেকে রাঙামাটি আসা বাসটা নেকড়েটিলার খাদে পড়ে বিষ্ফোরন ঘটেছে। ঘটনাটাটা ঘটেছে ঢাকা যাওয়ার পথে। জানা গেছে সেই বাসের কোন যাত্রীই আর বেঁচে নেই। খবরটা পড়ে আপাতত আজ আর কিছু ভাবতে পারছে না ও। ওর কেবলই মনে হচ্ছে সেই জন্তুটা ওকে খুঁজতেই বাসটির সকল যাত্রীদের খাদে ফেলেছে।
পুলিশের চাকরিতে নিভৃত এর এক বন্ধু কাজ করে। তাই এই বিষয়গুলো ওর সেই বন্ধুর সাথেই আলোচনা করবে বলে ঠিক করল নিভৃত। সারাদিন খুব ব্যস্তই কেটেছে নিভৃতের। তবে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে নিভৃত দেখল, এখানকার লোকজন সন্ধ্যা আগেই ঘরে ফিরছে। কিসের যেন এক আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে সবাইকে। সেও সবার মতো সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে আসলো। আজ অবশ্য বিকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে এখানে। অগত্যা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই বাড়িতে ফিরতে হয়েছে নিভৃতকে।
একতলা চেম্বারের দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে এলেন ডক্টর আইমান সিদ্দিক। বাইরে বেরিয়ে দেখলেন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে আজ। এত বৃষ্টিতে বাসায় যাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া এখন বাজে রাত 9:00। এত রাতে অবশ্য এই পাহাড়ী এলাকায় মানুষ তেমন আসবেনা তার চেম্বারে, তার ওপর আজ এত বৃষ্টিতে কারো আসার সম্ভাবনা ছিটে ফোঁটাও নেই কিন্তু ঐ যে কথায় আছে, পেশেন্ট য থাক বা না থাক ডাক্তারদের চেম্বার খোলা রাখতেই হযবে। বিপদ কাউকে বলে আসে না কখনো । আর এই পাহাড়ি এলাকায় অশিক্ষিত লোকদের সমস্ত সমস্যার একমাত্র ভরসা ডাক্তাররাই।
ডক্টর আয়মান অবশ্য নতুন এসেছে এই জুরাছড়ি উপজেলায়। অত বেশি মানুষদের চিনেন না তিনি। তার আগে অবস্য অন্য ডাক্তার ছিলেন এখানে কিন্তু কোনো এক কারণে তিনি বদলে নিয়ে চলে যান অন্য জায়গায়। আর ডাঃ আয়মানকে আসতে হয় এই পাহাড়ী এলাকায়। এসব ভাবতে ভাবতে একটি সিগারেট ধরালেন ডক্টর আয়মান। বাইরে তখন অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারা ঝরছে। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ শুনতে তার খুব একটা খারাপ লাগে না । ঢাকা থেকে এত দূরে পাহাড়ি এলাকায় অনেক কিছুর শূন্যতা অনুভব করেন তিনি। এই পাহাড়ী এলাকায় সন্ধ্যা মানে অনেক রাত, আর রাত নামলেই কেমন নিশ্চুপ হয়ে থাকে পুরো এলাকাটা। সিগারেট খাওয়া শেষ করেই ছুড়ে দূরে ফেলে দিলেন তিনি। দরজার বাইরে বাতি নিভে গেছে অনেকক্ষণ আগে। ঘরের ভেতরের বাতিও টিপটিপ করে জ্বলছে। মোমবাতি আছে হয়তো, ওগুলো দিয়েই এই দু-তিন ঘণ্টা চলা যাবে। আজ বৃষ্টির ফলে রাস্তার যে অবস্থা তাতে বাসা অবদি যেতে বেশ বেগ পেতে হবে তাকে। মোমবাতি আর ম্যাচ টেবিল এর উপর রাখলেন তিনি। বাতিটা কখন নিভে যায়, কে জানে। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থ টেনে ইংলিশ হরর গল্প সমূহের একটি মোটা বই বের করলেন ডাঃ আয়মান। উদ্দেশ্যে বাকি সময়টুকু ভূতের গল্প পড়া। এমন বৃষ্টির রাতে ভূতের গল্পের বই পড়ার মজাই আলাদা। তাই চেয়ারটাতে বেশ আয়েশ করে বসলেন তিনি কেবল বইয়ের পাতা টি খুলেছেন অমনি বাতিটি দপ করে নিভে গেল একটু বিরক্ত হলেন ডোরেমন টেবিল থেকে ম্যাচ নিয়ে একটি মোমবাতি জানালেন তিনি মোহাম্মদপুরের সামনে রেখে চশমা ঠিক করে নিলেন তারপর বই খুলে A lowsiana folklore এর “THE ROHGAROU” গল্পটি পড়তে শুরু করলেন। গল্পটি আধা মানুষ আর আধি নেকড়ের গল্প। দেখতে সাধারণ মানুষের মতই, তবে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি মানুষ নয়। শুধু পূর্ণিমা রাতে সে মানুষের রূপ ছেড়ে পুরো নেকড়ে রূপ ধারণ করে। সারা গা লোমভর্তি, হাতে-পায়ে ধারালো নখ , মানুষের রক্তের গন্ধে লকলক করে তার জিভ । তাই ছুটে চলে যায় জঙ্গলে যেখানে থাকে ছোট ছোট লোকালয়। সে রাতে সে যাকে কামড়ায় সেও হয়ে ওঠে আর একটি নেকড়ে মানব । এটি একটি ইউরোপীয় কাল্পনিক গল্প । তবে ডাঃ আয়মান বিশ্বাস করেন এই রকম কোনো প্রানীর অস্তিত্বই নেই পৃথিবীতে। তার কাছে বেশ বিরক্ত লাগে এসব গল্প। মাত্রাতিরক্ত রক্তারক্তি কাণ্ড। যেন গল্প পড়তে পড়তে মানুষের রক্তের গন্ধ পাওয়া যায়। এ বইয়ের বাকি ভূতের গল্প গুলো আগেই পড়া শেষ হয়েছে ওনার । তাই আজ অগত্যা বসে বসে সময় কাটানোর জন্যই পড়া গল্পটা । কিন্তু আজ যেন ওয়ারউলফ্ এর গল্প করতে তার বেশ ভালো লাগছে। সে যেন এক নতুন দুনিয়ায় চলে গেছে। মোমবাতির আলো নিভু নিভু করে চলেছে, এই আলোতে বই পড়তো বেশ কষ্ট হচ্ছে ওনার। তবুও বইটি রাখতে পারছেন না তিনি। গল্পটা যে এত ভালো লেগে যাবে তা তার নিজেই জানা ছিল না। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বাইরের দরজায় ঠক আওয়াজ শুনতে পেলেন ডাঃ আয়মান সিদ্দিক।
চলবে