নেকড়ে_মানব,পর্ব:-০৭

#নেকড়ে_মানব,পর্ব:-০৭
#আমিনা_আফরোজ

তখন বেশ রাত হয়েছে এই রাতে কারও আসার কথা নয় তাও বাহিরে এত বৃষ্টির মধ্যে এসব ভাবতে ভাবতেই আবারো কাঠের দরজায় টোকার আওয়াজ পাওয়া গেল। মনে হচ্ছে কেউ যেন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে ।

ডক্টর আয়মান ভেতর থেকে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,

–” কে বাহিরে? আসছি আমি, একটু অপেক্ষা করুন।”

দরজার ওপাশ থেকে ক্ষীণস্বরে আওয়াজ এলো,

–” আমি সুশান্ত। দরজাটা একটু খুলুন।”

ডক্টর আয়মান এর কাছে লোকটির নাম অপরিচিত মনে হলো আর লোকটির কন্ঠস্বরটাও কেমন যেন লাগছিল তার কাছে। অবশ্য এই পাহাড়ী এলাকায় জনা কয়েক লোক ছাড়া প্রায় সবাই ওনার কাছে অপরিচিত।

দরজাটা খুলে দরজার এক পাশে একটি লোকের অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পেলেন ডক্টর আয়মান। বাহিরে তখনো ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কাঠের দরজার ওপাশে দাঁড়ানো লোকটি বেশ লম্বা। কাধ থেকে হাত দুটো যেন ঝুলে পড়ছে তার। অবশ্য অতটাও আশ্চর্যের বিষয় নয় এটি। ছোটবেলা জীবিকার তাগিদে গাছ কাটার জন্য দড়ি টানতে টানতে এই পাহাড়ী এলাকার প্রায় সবার হাতই এমন ঝুলে গেছে।

ডায়মন এবার লোকদের উদ্দেশ্যে মৃদু স্বরে বললেন,

–” ভিতরে আসুন”

লোকটি ভিতরে আসতে কেমন যেন ইতস্তবোধ করছিলেন। লোকটির এমন কাণ্ড দেখে ডক্টর আয়মান এবার লোকটিকে বেশ ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,

–” বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়া বাঁধানো শখ হয়েছে বুঝি আপনার। এমনিতেই বেশ ভিজে গেছেন আপনি। দয়া করে আর ভিজবেন না। ভেতরে আসুন।”

পুবগ শুনে লোকটা এবার ঘরে ঢুকলো । লোকটার মাথা থেকে পা অবদি ভিজে চুপসে রয়েছে। ডক্টর আয়মান দরজা বন্ধ করার আগে আকাশটা একবার দেখে নিলেন। এত বৃষ্টির মাঝেও আকাশের চাঁদ দেখে তিনি অবাক হলেন কিছুটা। মেঘের চাদর ছেড়ে আকাশে গোল চাঁদ উঠেছে আজ। পূর্ণিমার চাঁদ এটা। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক। তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন,

–” যাও ওই চেয়ারটায় গিয়ে বসো আর এই গামছা দিয়ে গাটা ভালো করে মুছে নাও। ”

এই কথা বলে ডাক্তার আয়মান লোকটার দিকে একটা গামছা ছুড়ে দিলেন কিন্তু লোকটার মধ্যে কোন ভাবান্তর এলো না। লোকটি মাথা নীচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। লোকটির এমন কান্ডে বেশ অবাক হলেন ডক্টর আয়মান। তাই নিজেই এগিয়ে এসে লোকটার গা মুছে দিতে লাগলেন। গা মুছে দিতে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়ল ডক্টর আয়মানের। লোকটির শরীরের হাড় যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। শরীর শুকিয়ে গেছে অনেক। মনে হচ্ছে কত দিন অব্দি তিনি কোন কিছু খান নি । আরো একটা জিনিস গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন ডক্টর আয়মান। লোকটির পুরো শরীরে বড় বড় লোমে ভর্তি। ঘাড়ে, গলায় এমনকি শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বড় বড় লোম। এত বড় লোম কি কোন মানুষের হয়? গা মোছা শেষে ডক্টর আয়মান লোকটির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

–” কি যেন নাম বলেছিলেন আপনার?”

–” আজ্ঞে সুশান্ত।

–” সুশান্ত বেশ ভালো নাম। এবারের চেয়ারটাতে বসো।”

ডক্টর আয় মনের কথাই লোকটির মুখে একটু ইস্ততা বোধ ফুটে উঠলো আবারো। ইস্ততা বোধ নিয়েই চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ারে বসার সময় টেবিলের উপর A louissinia folklore এর “The Rougrarou” গল্পটা দেখে বিস্ময়ে বলল,

–” দেখলে বিষয়ে খুব কৌতুহল বুঝি আপনার?”

সুশান্তের কথা শুনে ডক্টর আরমান মুচকি হেসে বললেন,

–” তেমন কিছু নয় । ঐ যে কথায় আছে না, নাই কাজ তো খই ভাজ অমনই। বসে বসে সময় কাটানোর জন্য পড়ছিলাম আর কি।”

ডক্টর আয়মনের কথা শুনে লোকটি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

–” ও।”

এরপর লোকটি নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো কিছুক্ষন । লোকটির চোখে মুখে ফুটে উঠেছে অনুশোচনা। আত্মগ্লানি স্পষ্ট তার মুখে। মনে হচ্ছে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধরা গলায় বললেন,

–” একটা গল্প শুনবেন?”

ডক্টর আয়মান ঠান্ডা গলায় বললেন,

–” বলুন।”

লোকটি ধরা গলায় বলতে লাগলেন,

–” নেকড়ে টিলার এক অজ পাড়া গাঁয়ে জন্ম আমার। আমার বাবা ছিলেন একজন কাঠুরে। সারাদিন বনে গাছ কেটে আমাদের সংসার চালাতেন। আমার মা বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় গহিন অরণ্যে থেকে ভেষজ ঔষুধি গাছ তুলে এনে সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করতেন। সেই টাকায় দিন কতেক বেশ আরামে চলে যেত আমাদের তারপর আবারো সেই অভাব অনটন। আমরা ছিলাম দুই ভাই। আমার বড় ভাইয়ের বয়স যখন বছর আট তখন হঠাৎ করেই কলেরা হয়ে মারা যায় ও। সেবার কলেরার শুধু আমার ভাই মারা গিয়েছিল এমনটা নয় ,সেবার আমার বাবাও আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। বাবা মারা যাবার পর সংসারের সব ভাড় এসে পড়ে আমার মাথায়। আমার বয়স তখন কতোই আর হবে। বছর সাত কিংবা আট। তবুও সেই ছোট বয়সেই কাজে লেগে পড়ি আমি। গ্রামের লোকজন আমাকে বনে গাছ কাটার কাজে নেয়। আমার কাজ ছিল গাছ কাটার সময় দড়ি টানার। সেই থেকে শুরু হয় আমার কর্মজীবন। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকি আমি। আমার বয়স তখন বছর পনেরো। শক্তিশালী এক তাগড়া যুবক আমি। হাতে পায়ে তখন অঠেল শক্তি। বনে গাছ কাটার পাশাপাশি তখন আমার ভেষজ ঔষুধি গাছ নিয়ে অল্পবিস্তর জ্ঞান হয়েছে। এমন সময় আমার মায়ের মাথায় আমার বিয়ের পাগলামির ওঠলো। অগত্যা মায়ের কথা রাখতেই সে বছর বিয়ে করলাম আমাদের গ্রামেরই এক মেয়েকে। নাম তার নন্দিনী। বড্ড শান্ত স্বভাবের মেয়ে সে। আমার কিংবা আমার মায়ের সাথে কোন দিনই উচ্চস্বরে কথা বলে নি নন্দিনী। পরম মমতা আর ভালোবাসায় তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল আমাদের সংসার। বিয়ের বছর চারেকের মাথায় আমাদের ঘরে আলো করে জন্ম নিলো আমার দুইজন জমজ কন্যা সন্তান। তাদের আগমনে আমি তখন খুশিতে আটখানা। ছেলে না হওয়াই আমার মায়ের মন খারাপ হলেও নন্দিনী আর আমি ছিলাম ভিষন খুশি। এদিকে তখন আমার কাজের চাপ বেড়ে গেল দ্বিগুন। রিতিমত নিঃশ্বাস ফেললাম সময়টুকুও নেই আমার। ঘরে নতুন অতিথি এসেছে তাই জন্য তো কিছু আয় করতে হবে তো নাকি? তাই আমি রাতের অন্ধকারেও গভির অরন্যে কাছ কাটার পরিকল্পনা আটলাম। কিন্তু আমার এই ভাবনাটাই যে আমার কাল হয়ে দাঁড়াবে তা জানতাম না।”

এতটুকু ফলেই থামল লোকটি। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ক্ষনিকের মাঝে। ডক্টর আয়মান এতক্ষণ খুব মনোযোগ সহকারে শুনেছিল লোকটির গল্প। লোকটিকে হঠাৎ এভাবে কাঁদতে দেখে টেবিল থেকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিলো লোকটির পানে। লোকটি ডাঃ আয়মানের হাত থেকে ছো মেরে গ্লাসটি নিয়ে মুখ লাগলো গ্লাসটিতে তারপর এক নিঃশ্বাসে শেষ করল পুরো গ্লাসের পানি।

ডাঃ আয়মান আবারো ঠান্ডা গলায় বললেন,

–” তারপর, তারপর কি হলো?”

–” সেদিন ছিল সোমবার। গ্রীষ্মের শেষ সপ্তাহ। সূর্যের তীব্র দহনে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে তখন। গাছের সবুজ পাতারাও শুকিয়ে কালচে রং ধারণ করেছে। সারাদিন গরমে হাঁস ফাঁস লাগছিল আমার। সন্ধ্যার পর বাড়িতে এসেই স্বস্তি পেলাম না। তাই কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে চলে গেলাম গভির জঙ্গলে। জঙ্গলের এক বড় গাছের নিচে বসে দেখলাম সেদিনও আকাশে উঠেছে গোল পূর্নিমার চাঁদ। উঁচু গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে আছড়ে পড়ছে মাটিতে। এদিকটা আমার বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। হঠাৎ করে দক্ষিনা ঝিরিঝিরি হাওয়া এসে দোল খেয়ে গেলো আমার শরীর। দেখলাম গরমের সেই গুমোট ভাবটা আর নেই। সেখানে তখন বইছিল ঠান্ডা হাওয়া। আমি সবুজ নরম ঘাসে গামছা বিছিয়ে সেইখানে শুয়ে চোখ বুঝলাম। সেভাবে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই কিন্তু যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন চাঁদ আমার মাথার ওপরে। আর কিছুক্ষণ পরেই ঢলে পড়বে পুব আকাশের কোলে। হঠাৎ আমার গলার কাছে কেমন যেন ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনতে পেলাম। সেই সাথে শুনতে পেলাম চুকচুক একটা আওয়াজ। মনে হচ্ছিল আমার পাশে বসে কে যেন তরল জাতীয় কোন পানীয় পান করছে। আমি কাধ ফিরতেই দেখলাম লোমশ একটা প্রানী আমার গলার কাছে মুখ নিয়ে কি যেন চুসছে। দৃশ্যটা দেখতেই বুকের মাঝে কেমন যেন ধ্যাত করে উঠল আমার। ভয়ে দিশাহারা হয়ে ধরমরীয়ে ওঠেই দিলাম এক চিৎকার। প্রানীটি আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে পালিয়ে গেল গহিন অরণ্যে। আমার হঠাৎই চোখ গেল চাঁদের দিকে। চাঁদ তখন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। যেন কেউ চাঁদের গায়ে লেপের দিয়েছে রক্তের আলপনা। আমার স্বম্ভিত কাটতেই মনে হলো আমার গলা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ তরল পদার্থ। আমি হাত দিয়ে আমার গলার ক্ষতস্থান চেপে ধরে প্রান পনে দৌড় দিলাম নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে। যেখানে আমার পরিবার অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here