#একরত্তি_প্রেম,পর্ব_২
#Alisha_Anjum
দোলা পায়চারি করছে রুমের মধ্যে। একটার পর একটা ফোন দিয়েই চলেছে দীপকে। কিন্তু দীপের ফোন তোলার কোন নাম গন্ধই নেই! দোলা হতাশ হল। হাল ছেড়ে দেবে দেবে ভাবছি সেই সময় দীপের মর্জি হলো। ফোনটা ধরেছে সে। দোলায় এপাশে খেঁকিয়ে উঠলো। রাগের মাত্রা তার পরিপূর্ণ।
— তোকে কতবার ফোন দিলাম? এটা কেমন স্বভাব হ্যাঁ? যখন ইচ্ছে হবে ফোন ধরবি, যখন ইচ্ছে হবে না ফোন ধরবি না। অন্যদের কি আপদ বিপদ হতে পারে না?
ফোনের ওপাশে দীপ নির্বাক। কিছুই বলছে না সে।দোলার রাগ এখন অত্তুঙ্গে উঠল। আবারো সে ভয়াবহ রাগ নিয়ে বলল।
— কি সমস্যা ফোন ধরিস নি কেন? আর ধরেছিস যখন কথা বলছিস না কেন? কথাই যদি না বলবি তাহলে ফোন ধরলি কেন? না ধরাই ভালো ছিল।
দীপ এবার মুখ খুলে বাঁক ফুটালো। ভরাট কন্ঠে বলল
— ইচ্ছে হয় নাই তাই ফোন ধরি নাই। তুই তোর প্রেমিকের কাছে যাস নি? মনে হচ্ছে আমার বাড়িতেই আছিস।
দীপের কন্ঠস্বরে অন্যরকম সুখ। দোলা সূক্ষ্ম অপমানের আঁচ পেল। মৃদু স্বরে বলল
— তোর জন্য বসে আছি বাসায় আয়।
ওপাশের দ্বীপের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। শুধু দু’সেকেন্ড পরে টুথ করে ফোনটা কাটার আওয়াজ হলো। দোলার মন যেন কেমন করে উঠলো। কোত্থেকে একফালি মন খারাপ এসে বাসা বাঁধলো বুকে। সেদিন দীপের চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে ভাঙলেও ভাগ্য থেকে বিয়ে ভাঙ্গেনি। একটা মেয়ের পরিবারের জন্য অপমানজনক বিয়ে ভাঙ্গা। দোলার বাবা ভেঙ্গে পড়ে। মা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। ছেলের পরিবারের মাথা নত। দুপরিবারের মুরব্বীদের একটা সমাবেশ বসানো হলো সেই রাতে রাতেই। দোলা জানেনা সে সমাবেশে কি হয়েছিল। শুধু জানে দীপের বাবা ছেলের বড় চাচা হিসেবে দোলার বাবার কাছে মাফ চান। মান-সম্মান পরিবারের বানের জলে ভেসেছে। সবশেষে উনি নাকি দোলার বাবার কাছে প্রস্তাব রাখেন দীপের সাথে দোলার বিয়ে দেওয়ার। এ প্রস্তাবে দোলার বাবা বিষাক্ত পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য হলেও রাজি হয়ে যান। কিন্তু দীপ? সে মোটেও রাজি হতে চাইল না। কিভাবে সম্ভব? সেইতো আঁধার আর দোলার একতার জন্য ভয় ডর এড়িয়ে সকলের অগচরে বিয়ে ভাঙলো। আর সে কিনা আবার নিজেই বিয়ে করবে দোলাকে? অসম্ভব! এটা কখনো করতে পারবে না। অজানা আশঙ্ক্ষা নিয়ে দীপ পা বাড়ালো তার বাবার দিকে। সবাই তখন নতুন করে পুনঃপরিপাটি হতে ব্যস্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে। দীপ অত্যধিক সাহস নিয়ে তার বাবাকে সোজা না করে দেয় বিয়ের ব্যাপারে। সে দোলাকে বিয়ে করবে না। দীপের সেদিন না শব্দটা মুখ দিয়ে বলতে দেরি হয়েছিল কিন্তু বাবার থাপ্পর মারতে দেরি হয়নি। অবশেষে রাগ, দুঃখ, দ্বিধা নিয়ে বিয়ে করতে হয় দীপের।
— কি বলবি তাড়াতাড়ি বল।
দীপের কন্ঠে দোলার ভাবনা ভঙ্গো হল। সম্মুখে দৃষ্টি তাক করে দেখে উদাসীন দীপ দাঁড়িয়ে। মুখটা কেমন শুকনো লাগছে। চুলগুলো প্রতিবারের মতো পরিপাটি নয়।বেজায় এলোমেলো। দীপ আর যাই হোক নিজের স্মার্টনেস নিয়ে প্রচুর সিরিয়াস। দোলার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠল। চাঞ্চল্যতায় ভরাট ছিমছাম সুন্দর মুখখানায় যদি মলিনতা আশ্রয় নেয় তাহলে যে কারোরই মারা হবে।
— তোর মুটা এমন শুকিয়ে গেছে কেন?
— তুই কি আমাকে এই কথা বলার জন্য অফিস থেকে টেনে নিয়ে আসলি?
দীপ কটাক্ষ সূচক একটুখানি হাসি হাসলো। দোলা তোয়াক্কা করল না। সে চরম অবাক। দীপ এ অবস্থায় অফিসে ছিল? ভাবা যায়! যে কিনা মেয়েদের মত সেকেন্ডে সেকেন্ডে রূপচর্চা করে আয়না দেখে সে কিনা এলোমেলো হয়ে পাবলিক প্লেসে ছিল? দোলা আশ্চর্য হয়ে বলল
— তুই এমন ভাবে অফিসে গিয়েছিলি? কখন গেলি আমি তো দেখলাম না? তুই এমন এলোমেলো কেন?
দীপ দরজায় দাড়িয়ে ছিল। ঘরে ঢুকলো সে। বিছানায় বসতে বসতে বলল
— বলে আর কি হবে। চলেই তো যাবি। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে কি লাভ?
দ্বীপের কণ্ঠ ছিল রাশভারী, তাচ্ছিল্য মাখা। না চাইতেও কথাটা দোলার বুকে এসে লাগলো। হৃদয় দুলে উঠলো, মন আবেগের স্পর্শ পেল। দোলা কিছু বলতে চেয়েও যেন বাঁক হারিয়ে ফেলল। চোরা চোখে একবার চাইল দীপের দিকে। দীপ জড় বস্তুর মতো বসে আছে মাটির পানে চেয়ে। দোলা ধাতস্থ করলো নিজেকে। হৃদস্পন্দন কেন যেন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। অস্বাভাবিকভাবে লাফালাফি করছে বুকে লুকিয়ে থাকা হৃদপিণ্ডটা।
— আঁধার হয়তো এসে গেছে এয়ারপোর্টে। আমার যেতে হবে।
শুষ্ক গলায় কথাটা বলল দোলা। দীপের মাথা এখনও নাত। সে চুপটি করে স্তব্ধ হয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। আশপাশ যেন বন্যায় ডুবে ভেসে গেলেও সে মাথা তুলবে না। চাইবেনা ভূমিহীনা অন্যদিকে। দীপের গুমোট ভাব দোলাকে ভীষণ ব্যাথিত করলো। কেন দীপ দোলার দিকে চাইছে না? যাওয়ার মুহূর্তে একবার তো তাকাতে পারে? দোলা কি কিছুই হয়না তার? তুলি মেয়েটা আসলে তো ঠিকই জমিয়ে গল্প করতে পারে দীপ। আবার যাওয়ার সময় অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত দিব্যি কোলে করে দিয়ে আসে। এইসব ঢং দেখলে দোলার হিংসা হতো। প্রচুর হিংসা হতো। দোলার ইচ্ছে করতো ঐ মেয়েটাকে আছড়িয়ে আছড়িয়ে ধরে এপার-ওপার করে একদম নদীতে ছুড়ে ফেলতে। দোলার কান্না পাচ্ছে। কেন তার সাথে কথা বলছে না দীপ? দলে দলে অভিমানেরা এসে আস্তানা গড়ে নিল বুকের মাঝে। আর একটা বাক্য ব্যয় করলোনা দোলা দীপের জন্য। ছল ছল নয়নে ঠোট উল্টিয়ে সে তল্পিতল্পা হাতে নিল। কিছু বলবে না সে। চলে যাবে। পায়ে ধরে কথা বলার ইচ্ছা তার কোনদিনও হয়না। অভিমানে কতনা ইচ্ছে বাসা বাঁধে বুকে কিন্তু মনের কারণে আবারো উড়ে যায় তারা। দোলাও পারলো না দীপের সাথে কথা না বলে চলে যেতে। কোথাও একটা টান, একটু আবেগ, একটু মায়া থেকে কথা বলেই ফেলল সে
— ভালো থাকিস।
কথা বলার জন্য যেন পরোক্ষ একটা হাক দিল দোলা। যদি একটু কথা বলে দীপ! কিন্তু একগুঁয়ে দীপ তাকালো না পর্যন্ত দোলার দিকে। ব্যাথাতুর হৃদয় নিয়ে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ফিচেল হেসে শুধু বলল
— তুইও ভালো থাকিস আঁধারের সাথে।
কথাটা বলে দীপ দুইহাতে মুখ ঢেকে নিল। হয়তো এসেছে চোখে জল, ঝরবে গাল বেয়ে। দোলা ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দীপের দিকে। সে বোঝেনি দীপের বুকের জ্বালাপোড়া। ঘুণাক্ষরেও টের পেল না সামনের মানুষটার বুক জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তারই জন্যে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয় তার মস্তিষ্কে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিল। দোলা হঠাৎই খেয়াল করলো এই ঘর ছেড়ে চলে যেতে তার কষ্ট হচ্ছে। এই ঘরের প্রতিটি জিনিসপত্র, আসবাবপত্র তাকে যেন ডাকছে। হাত বাড়িয়ে ডাকছে। দোলার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এক মাসে কত মায়া ঠাই নিয়েছে হৃদয়! দোলা ভেজা ভেজা চোখে দীপের দিকে চাইল। দীপ তখনও নির্বিকার হয়ে নতমুখে বসে আছে। কোন সাড়াশব্দ নেই। দোলা তড়িঘড়ি করে এক প্রকার দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সে থাকতে চায় না এখানে। মন উল্টাপাল্টা কথা বলছে, টেনে আনছে অজস্র যুক্তি।
.
দোলার হয়তো ঘর থেকে বের হতে দেরি হয়েছে কিন্তু দ্বীপের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে যেন একটু গাফিলতি হলো না। রক্ত লাল চোখ থেকে টুপ টুপ করে গড়িয়ে পড়ল ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুজল। দীপের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে জানেনা কিভাবে দোলা তার মন কখন নিয়ে নিয়েছে! অহর্নিশি প্রাণোচ্ছল দোলা চোখের সামনে থেকে রবে রবপ কখন তার মন কেরেছে! দীপের মনে হচ্ছে নারী ছলনার জিনিস। চোখের সামনে থাকলে তাদের উপর মায়া না চাইতেও আকড়ে ধরে মন। কিন্তু এমনটা করা তো দোলার মোটেও ঠিক হলো না! দীপ মানতে পারছেনা। এই মায়া কতদিন থাকবে? দীপের যে অসহ্য কষ্ট হচ্ছে! বুকের এই অসহ্য যন্ত্রনা কতদিন স্থির থাকবে? দীপ অস্থির হয়ে পড়ল। সবকিছু অসম্ভব লাগছে তার। ঘরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে দোলার স্মৃতি। কি হবে তার? সে তো পাগল হয়ে যাবে। দোলার কথা সব সময় মনে পড়বে। তার কষ্ট বেড়ে দ্বিগুণ হবে! দীপ হঠাৎ ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। না, সে দোলাকে যেতে দেবে না। দোলা শুধুই তার। তার বিয়ে করা বউ। নিশ্চয়ই আঁধারের চাইতে তার অধিকার বেশি। দীপ এক মুহূর্ত দেরি না করে করে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে।
চলবে…..
( ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। কেমন হলো জানাবেন। )