আমার_হৃদয়ে_সে,০৭,০৮

#আমার_হৃদয়ে_সে,০৭,০৮
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৭

আমার কথা শুনে মার চোখজোড়া চকচক করে উঠে।অধীর কন্ঠে বলে উঠেন,

“হ্যাঁ রে মা, হ্যাঁ।এটাই করিস।আমি চাই তোদের ভুল বোঝাবুঝিটা নিজেদের মাঝে সংশোধন করে সুন্দর মতন আবার সংসারটা শুরু কর।”
“এতকিছু হবার পরও তুমি এখনো বলছো আমি অভির ঘরে যেতে?”

মা আমার এ’কথার পিঠে চুপ হয়ে যান।আমিও আর কিছু বলি নি।তারপর হাতের মুঠোয় বদ্ধ থাকা ফোনটার দিকে একফোঁড় তাকিয়ে আমার রুমের দিকে ফিরতে ব্যস্ততুর হয়ে যাই।রুমে ফিরতে আমার সামনে থেকে পেছন ঘুরতে আবার মা বলে উঠেন,
“তাহলে এখন কি করবি ভেবেছিস?”

আমি মার দিকে খুব প্রশস্তভাবে না তাকিয়ে খানিকটা ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিই,

“দেখি কি করা যায়।”
বলে একটা গাঢ় শ্বাস ছেড়ে আমার রুমে চলে আসি।ফোনটা বিছানার দিকে ছুঁড়ে জানলার পাশে যাই।গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকাই।আকাশে থালার মতন বড় চাঁদ ওঠেছে।তার জোৎস্নায় চারপাশে কেমন চকচক করছে।দূরে অদূরে তার তারসাথে তাল মিলিয়ে জোনাকীদেরও দেখা যাচ্ছে।তারা নিজেরা নিজেরা খেলা করছে।তবে তাদের ওতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।তাকিয়ে থাকলাম খানিক্ষন সেদিকে।খুবই সজীব এবং প্রাণবন্ত লাগছে চারপায়।এত সজীবতা এবং প্রাণবন্ততার মাঝেও আমার ভেতরটায় একজোড়া কালো মেঘ দখল করে আছে।চোখ বুঁজলেই অভির এবং বাবার তিক্ত মুখগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে।কতগুলো অপবাদ পেলাম অভির।সাথে বাবারও তালে তাল মেশানো বুলি!একটা মেয়ে তার বাবার থেকে কীভাবে এসব ডিজার্ভ করে?পরের ছেলে বলতেই পারে তাই বলে সাথে বাবাও?এভাবে অপবাদ আর কতো?.. আবারো গলাতে কান্নার দলা বেঁধে যায়।চোখ থেকে ঝরঝরে অশ্রু সারা গালে উপচে পড়ে। আঁচলটা টেনে দুই হাত দিয়ে কিছুক্ষণ মুখ চেপে কান্নার বাঁধ থামাই।তারপর আবারো নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করে চোখের অশ্রু মুছে জানলা থেকে বিছানায় গিয়ে বসি।বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে খালামণির নাম্বারে কল দিই।খালামণির বাসা উত্তরায়।কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হয়,

“হ্যাঁ,পারিসা?কেমন আছিস?”
“ভালো খালামণি।খালামণি তোমার বাসায় কি থাকার জায়গা হবে?”
“হ-হঠাৎ এমন কথা যে!?এই কিছু হয়েছে নাকি বাসায় আবার?”
“নাহ কিছু হয়নি।কি হবে আর।আচ্ছা আগে বলো জায়গা আছে বাসায়?”
“থাপড়ামু!এভাবে বলতেছিস কেনো!?আমার পুরো বাসা খালি!আয় তাড়াতাড়ি।”
“ধন্যবাদ,খালামণি।”

বলে কলটা কাঁটি।হাসি চলে এলো খালামণির শেষ কথাগুলো শুনে।আসলে আমার একজনই খালামণি।খালামণি মার বয়সে ছোট্ট।আই মিন আমার ছোট্ট খালামণি।খালামণির মেয়ে নেই।একটাই ছেলে।সবে ক্লাস ফোরে পড়ে। মেয়ে নেই বিধায় খালামণি আমাকে একদম উনার মেয়ের মতনই ভাবে।আবার মতন যে বলছি তাও না।বলতে গেলে আমিই যেন উনার মেয়ে এতটাই স্নেহ করেন আমাকে।এখন ডিসিশন খালামণির বাসায় যাবো।থাকবোও।দেখি ওখান থেকে কোনো একটা জবের ট্রাই করতে পারি কি না।এমন মিথ্যে অপবাদে এই ঘরটা বড্ড অসহ্য লাগছে।দূরে চলে যাবো এখান থেকে!আর কারো দৃষ্টিগোচর আসবো না!

৮.
পরদিন সকাল আঁটটায় জামাকাপড়গুলো কাবার্ড থেকে বের করি তরহর করে।সবগুলো জামা গুছিয়ে ট্রলিতে ঢুকাতে থাকি।এমন সময় মা আসেন রুমে।আমাকে ট্রলিতে জামাকাপড় ঢুকাতে দেখে চিন্তিত কন্ঠস্বরে বলেন,

“জামাকাপড় গুছাচ্ছিস যে,পারিসা?”

মার কথার জবাব দিই নি।নিজ মনে ট্রলিতেই জামাকাপড় ফুঁড়তেছি।আমার জবাব না পেয়ে মা আবার বলেন,

“কিছু বলছিস না কেন?কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

এরমাঝে জামাকাপড় সবগুলো মোটামুটি গোছগাছ শেষ হয়ে যায়।এবার মাথা তুলে মার কথার জবাব দিই,

“খালামণির বাসায় যাচ্ছি।আর হ্যাঁ,একথা বাবাকে বলবে না।আর আমি যদি খালামনির বাসায় যেয়ে যদি জাহান্নামেও যাই তাও বলবে না।”
“এটা কেমন কথা বললি,পারিসা?বাবাকে কেউ এভাবে বলে?”
“বাবা ও কি তার মেয়েকে কিছু বলার আগে ইতস্ততা বোধ করে?!নাকি পর লোকের সাথে কথার তাল না মেলালে পয়সা পায় না!”
“পারিসা?বাবারা একটু ভুলবাল করেই।সেটা তেমন কিছু না!আর তোর বাবা কি এখন অভির সাথে ঝগড়া করবে?আর পরের ছেলের সাথে ঝগড়া করলেই ত সমস্যা। সংসারে ঝামেলা হবে!একজন বাবা তা চায় না।বাবাদের চাওয়া কীভাবে পরের ছেলেকে শান্ত এবং দৃঢ় স্থির রেখে মেয়ের সংসারটাকে টিকিয়ে রাখতে।কারণ উনার নিজের মেয়ের সংসার।মেয়ের কিছু হলে তো বাবারই চিন্তা। আর চিন্তাও করছে তোর বাবা এখন।বিশ্বাস না হলে গিয়ে দেখ কতটা চিন্তায় আছে।খাবার টুকু পর্যন্ত খাচ্ছে না!আমি সেই সাতটার দিকে টেবিলে খাবার দিয়ে এসেছি।খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে তারপরও খেতে ভাবান্তর আসছে না।ওদিক দিয়ে অফিসেরও লেট হয়ে যাচ্ছে।”

আমি মার কথা বলার দিকে তাঁকিয়ে আছি।কতটা ব্যাকুল ভঙ্গিতে মা কথাগুলো বলতেছেন।আসলে মা এরকমই।একটু স্বামী ভক্তি টাইপ আর কি।ছোট্টবেলা থেকেই মার এহেন আচরণ দেখে আসছি।একবার হলো কী আমার নানু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।অসুস্থতায় নানু ত একদম মৃত্যুশয্যা ব্যক্তিদের মতন হয়ে যান।নানু খালি বারবার পানি চায়।নানুর এহেন দেখে খালামণির সে কি কান্না এবং মামাদেরও!পুরো বাড়ি যেন কান্নাতে ভরে যায়।আশপাশের সব মানুষ কান্নার আওয়াজ শুনে বাড়ির আনাচেকানাচে জড়ো হয়।আর এদিক দিয়ে আমার মা তার সোনায় সোহাগা স্বামীকে সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে ব্যাকুল।কারণ,বাবার এগোরটার দিকে ওষুধ আছে।সেই ওষুধটা খেয়েছে কিনা তা জিজ্ঞেস করতে!কোথাও তুফান হোক,ভূমিকম্প হোক যদি বাবার হালকা পাতলা হেরফের হয় তা ওই তুফান এবং ভূমিকম্প থেকেও মার বাবার প্রতি তাগোদ বেশি।
মার অভ্যসেটাকে আমার ফুপী নাম দিয়েছে স্বামী পাগল।” অবশ্যি মার এই অভ্যসেটা মা কার থেকে পেয়েছে তাও জানি না।আমার দেখামতে আমার নানাদের এবং দাদাদের বংশের কারো এরকম অভ্যেস নাই।আর মার এই অভ্যসেটা এখন আমার জন্যে অনেক কাল।এতটা দুঃখ সময় আমার!তারপরও আমার কষ্টগুলো থেকে তার স্বামীর বলা কথাগুলো খুব বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।খাবারটা ইম্পর্ট্যান্ট। আমার কষ্টগুলো ইম্পর্ট্যান্ট না।কিছুক্ষণ আগে বলা বিয়ের আগে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটাও না।খুবই আফসোসের কথা।এই কারণে আমার কপালটা এতটা আটপৌরে!মা আবার জবাব না পেয়ে বলেন,

“দ্যাখ মা,সব মাটি দিয়ে দে।তোর বাবা কি বললো অভি কি বললো সব মাটি দিয়ে দে।মানুষ রাগের বশে কতকিছুই বলে তাই না?রাগ কমে গেলে দেখবি সব ঠিকঠাক!”

এবার মাকে না বলে আর পারলাম না,

“অতিরিক্ত স্বামী ভক্তি যারা তারা কখনো স্বামীদের অত্যাচার বুঝে না।মা একটু স্বাধীনচেতা হতে শিখো।নিজে নিজে অনুধাবন করে বুঝতে শিখো।অন্যের উপর জীবন চলে না।অভি যেসব কথাবার্তা বললো ওসবে কি একটুও আত্মসম্মানের প্রশ্ন আসে না?ও আমার কতটা আত্মসম্মানে আঘাত করেছে বুঝতে পেরেছো?বুঝো নি।বুঝলে এভাবে আমাকে কখনোই বলতে না।আসলে পরের ছেলে কি দোষ দেবো? তোমরা আমার নিজের মা-বাবা হয়ে নিজেরাই আমাকে বুঝতে পারলে না।”
“পারিসা?আমি কি তোকে সেরকম কিছু বলেছি?আমি কি বলেছি তুই সব করেছিস?আরেহ আমিতো জানি তুই কিছুই করিস নি!আমি বলতে চাইলাম তোর বাবা বয়স্ক তার হিসেবে সে হয়তো ঠিক ভেবে বলেছে।আবার একেবারেও যে ঠিক তাও না। এখন রাগের মাথা।আস্তে আস্তে রাগ কমলে তখন অন্যকিছু ভাববে।প্লিজ মা বুঝার চেষ্টা কর।বাবাকে সময় দে একটু।বাবাস সাথে এবং অভির সাথে এভাবে রাগ করে কোথাও যাস না।”
“গুণীদের একটা কথা জানো কী মা জানো?সবকিছু বিসর্জন দিতে পারো,তবে তোমার আত্মসম্মানটা না।আমার কাছে আমার আত্মসম্মানটা অনেক বেশিই দামী।আর আরেকটা কথা আমি খালামণির বাসা গেলে আমাকে কলটল দিবা না।আসি।”

বলে ট্রলির হাতল ধরে মাকে পাশ কেঁটে সুড়সুড় করে চলে আসি।রিক্সা করে খালামণির বাসায় পৌঁছাই।খালামণি আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে যান।বুকে জড়িয়প নিয়ে বলেন,

“অনেক খুশি হয়েছিস এসেছিস।আগের বিয়ে সেই যে বেড়িয়ে গেলি।আর আজ এলি।তা অভিকে সাথে নিয়ে আসলি না কেন?”
“কে অভি!!”
“মানে কী?”
“প্লিজ খালামণি আমাকে অভির কথা আর বলো না!”

বলার মাঝেই আমার চোখজোড়া পানিতে ঝাপসা হয়ে আসে।তা খালামণি ধরে ফেলেন।গাল চাপড়ে করুণ স্বরে বলেন,

“এই পারিসা কিছু হয়েছে নাকি তোর?”

আমি কোনোকিছু না বলে খালামণিকে এবার জড়িয়ে ধরে অস্ফুট স্বরে কেঁদে উঠি।আমার কান্না দেখে খালামণি হতভম্ব।বলেন,

“আরেহ এভাবে ছোট্ট বাচ্চাদের মতন কাদছিস কেনো?কি হয়েছে তোর?কী হয়েছে?বল আমাকে?”

আমি তারপরও কান্না থামাতে পারছি না।কান্নার বেগ যেন আরো বেড়ে যাচ্ছে।তা দেখে খালামণি হতাশ হয়ে যান।হতাশ ভাবটা নিজের মাঝে স্বাভাবিক করে এবার আমাকে আলতো করে ছাড়ান।তারপর দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে সোফায় এনে বসান।মুখের, মাথার এলোমেলো চুলগুলো মাথায় আবার পরিপাটি করে দিয়ে নরম কন্ঠে এবার বলেন,

“হয়েছে টা কী,পারু?বল খালামণিকে?”

বলতে পারি নি।মুখ দিয়ে কোনো কথা ই আসছে না।তারপর খালামণি আবার একে একে তিন তিনবার জিজ্ঞেস করেন।আমি চতুর্থ বারের সময় জবাব তুলি।জবাব দিতে কষ্ট হয়েছে প্রচন্ড!তারপরও বারকয়েক হাঁক ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে পুরো ব্যাপারটা খালামণিকে বলি।খালামণি আমার কথা শুনে চোখজোড়া কপালের দিকে তুলে ফেলেন।আমার বলা শেষ হওয়া মাত্রই খালামণি বলে উঠেন,

“অভি এতটা খারাপ!?কত ভদ্র ভেবেছিলাম ছেলেটাকে!আর তোর বাবাও না কি,ছিঃ!নিজের মেয়েকে কেউ এতটা অবিশ্বাস করে?শোন?কোনো টেনশন নিবি না!ওদের এতটা জঘন্য কথা,হীনমন্যতা কথা,অপবাদের কথা নিজেকে একদম দুর্বল ভাববি না।জাস্ট, ট্রাই টু স্ট্রং ইউরসেলফস!সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“সব ঠিক হয়ে যাবে খালামণি মানলাম।তবে অভির সংসার আমি করবো না এটাই সত্যি।”

“পৃথিবীর সব মানুষ ভুল করে।সেই ভুলে মানুষগুলো তার প্রায়শ্চিত্তও আবার ভোগ করে।দেখিস অভিও পাবে।পাওয়ার পর সে তার ভুল বুঝে ফেলবে।ইভেন তোর কাছে ক্ষমাও চাইতে আসবে।আর এরকমই পৃথিবীর সব।পৃথিবীর নিয়ম এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলছে।”

বলে খালামণি মুখে হাসি টেনে আমার দিকে তাকান।এ’কথার পিঠে আমার মাঝে আর কোনো ভাবান্তর পাননি।তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,

“তুই রুমে যা।ফ্রেশ হ।আমি দেখি কি রান্না করা যায়।”

আমি খালামণির কথায় সায় দিয়ে রুমে চলে এলাম।

চলবে….

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৮

চারদিকে রাত নামলে আমি একটা কাজ করি তা হলো অভিকে রাফি ভাইয়ার ব্যাপারটা নিয়ে অনেকগুলো টেক্সট করে দিই।টেক্সটগুলো লেখার শেষে তাকে কিছু আমার অপিনিয়ন জানাই।তা হলো-

“সবকথা বললাম।পড়ছেন নিশ্চয়ই?এবার এসব বিশ্বাস করা না করা তা আপনার ব্যাপার!ওকে?তবে হ্যাঁ,কেউ যখন অন্যায় না করার পরও হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে সে সত্যিই অন্যায় করেছে তখন সত্যি খুব খারাপ লাগে।আগে ভালো মতন কেনোকিছু জাস্টিফাই না করে কাউকে অপবাদ দেওয়া কতবড় জঘন্যতম কাজ আশা করি তা জানেন।যাইহোক আর প্যাঁচাল পাড়ছি না।ভালো থাকবেন!”

মেসেজগুলো করে ফোনটা রেখে দিলাম।জাস্ট জানিয়ে দিলাম।কারো কাছে মিথ্যে অপবাদ পাওয়ার ইচ্ছে আমার একদমই নেই!আমি ওই রাফিকেও খুঁজে বের করবো।বের করেই ওর সামনে নিয়ে যাবো।তবে তা এখন না।সময় আসুক।ভাবনার মাঝেই,

“পারিসা?খেতে আয়?”

ওপাশ থেকে খালামণির ডাক আসে। আমি ওড়নাটা ঠিকঠাক মতন গাঁয়ে জড়িয়ে ডাইনিং এ যাই।ডাইনিং আঙ্কেল মিস্টার মেহরাব শেখ বসে আছেন।আঙ্কেলের পাশের চেয়ারে ফাহিম।আর খালামণি খাবার বেড়ে দিচ্ছেন।আমি চেয়ারে বসতেই আঙ্কেল আমাকে দেখলেন।বলে উঠেন,

“হাই,পারিসা?হোয়াট’স আপ?কখন এসেছো?”

এই বাসায় আসার পর এখন মাত্র আঙ্কেলের সাথে আমার দেখা হলো।আজ সারাদিন অফিসেই ছিলেন।আমি আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলি,

“আলহামদুলিল্লাহ। সকালে এসেছি আঙ্কেল।”
“তুমি সকালে এসেছো অথচ তোমার খালামণি আমাকে কিছুক্ষণ আগে বললো।একটা কল করেও জানালো না!”
বলে খালামণির দিকে নিরস দৃষ্টিতে তাকান।তা দেখে খালামণি বলেন,

“বলি নি।তোমার জন্যে এটা জাস্ট সারপ্রাইজ ছিল!”
“আচ্ছা?তা সারপ্রাইজটা একটু অন্যরকম হলে ভালো হত না?”

আঙ্কেলের দিকে এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।আঙ্কেল হেসে উঠে বলেন,
“আই মিন আমার জামাই বাবার কথা বলেছি।তোমাকে এবং অভিকে একসাথে দেখতে পেলে সারপ্রাইজটা আরো ভালো হতো।অভিকে সঙ্গে আনলে না কেন?”

আঙ্কেলের কথায় মুখটা মলীন হয়ে যায়।চোখের পাতা দ্রুত উঠানামা করে। আঙ্কেলকে প্রত্যুত্তর করতে যেয়েও ঠোঁটজোড়া বারবার কেঁপে উঠে।আমার অবস্থা খালামণির সচেতন মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে যায়।তিনি কথার ফোঁড়ন কেঁটে আঙ্কেলকে বলেন,

“অভি আসবে না।”
“কেন?”

তারপর খালামণি আঙ্কেলকে বিস্তারিত সব বলেন।আঙ্কেল খালামণির থেকে আমার এবং অভির ব্যাপারটা শুনে খুব আপসেট হয়ে যান!প্রথমতো দুই তিন মিনিটস চুপ থাকেন।তার খানিক্ষন পর নিজেকে ধাতস্থতা করে বলেন,

“অভিকে আমিতো খুব ভালো জেনেছি।আর সে এরকম কিছু করে ফেলবে অবিশ্বাস্য!আসলে রাহেলা,এখনকার মানুষদের চেনা খুবই মুশকিল।তোমার সাথে একজন মানুষ সার্বক্ষণিক থাকবে।তোমার ব্যাপারে সে সব জানবে।তুমিও তার ব্যাপারে সব জানবে।মানে দুজনে খুব ক্লোজ থাকবে।।আর পরে দেখবে কি না সেই মানুষটাই পেছনে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে লোকদের কাছে তোমার বদনাম রটাচ্ছে।সো।স্যাড!”

বলে আঙ্কেল একটা আক্ষেপ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।পাশ থেকে ফাহিম বলে উঠে,

“বাবা?তোমার এসিস্ট্যান্ট টা না এরকম?”
“কে বললো তোমাকে?”
“তুমিই তো একবার মাকে বলেছিলে।তখন আমি শুনেছি।”

আঙ্কেল ফাহিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

“বাবা তুমি এখনো ছোট্ট।এসব মনে রাখতে নেই।তোমার মনে রাখতে হবে শুধুই পড়াশুনা।ওকে?”
“আচ্ছা,বাবা।”

বলে ফাহিম আবার খাবারে মনোযোগ দিলো।ফাহিমের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার আঙ্কেল আমার দিকে তাকান।বলেন,

“পারিসা যা হবার হয়েছে।সব ভুলে যাও।আমি বুঝতেছি তোমার অবস্থাটা। অভি তোমাকে ভুল বুঝেছে ওটা ওর ফল্ট ছিল।ওর ওই ফল্ট ভাঙ্গাতে এখন শুধুই ওই রাফি নামের ছেলেটাকে লাগবে।তুমি কি ওকে।খুঁজে অভির কাছে নিয়ে যেতে চাও?”
“নিয়ে গেলে ত ও তখন বুঝবে আমার কোনোই দোষ ছিল না।”
“রাইট।”
“আর পরে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে।তবে আঙ্কেল আমি চাই না আমি ওর কাছে নিজে যেয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার এবং ও পরে আমাকে সরি বলার।ওর তখন ওই সরিটা খুবই অর্থহীন মনে হবে!”
“এখন তোমার তাহলে কি ডিসিশন?”
“যে কোনো বিষয় ভালোভাবে না জাস্টিফাই করে আমাকে ভুল ভাবলো এবং শেষে আমার চরিত্র নিয়েও কথা তুললো তার কাছে ফিরে যাওয়াহবে কি না আমি নিজেও জানি না।আমি জব করবো আঙ্কেল। এটাই এখন এটাই আমার ডিসিশন।আপনি আমার জন্যে ভালো একটা জব দেখুন।”
“বুঝলাম।আমি যেহেতু আছি জব তোমার পাক্কা।ওটা নিয়ে টেনশন করতে হবে না।টেনশন টা শুধু অভি এবং তোমাকে নিয়েই।ডিভোর্সের কথা যেহেতু তোলা হয়েছে তবে এখানে ভুল বোঝাবুঝি টাই কি প্রাধান্যতা পেল না?”
“আমি অভিকে ভুলবোঝাবুঝির বিষয়টা টেক্সটে করেছি ক্লিয়ারলি!তারপরও যদি ওর আমাকে বিশ্বাস না হয় বাট নাথিং টু ডু আঙ্কেল।আর এটা ভেবে এখন চিন্তা করারও সময় নাই।এখন আমার চিন্তা শুধু মুভ অন মাই ফিউচার।”
“ইয়েস!রাইট স্যা,মাই ডটার।জব করতে পারলেই তোমার মা-বাবার এবং তোমার ওই অযোগ্য স্বামীকে উচিত জবাব দিতে পারবে।আমি চাই ওরা নিজেরাই তোমার কাছে এসে নত হোক!”

আঙ্কেলের এ’কথার আর জবাব দিলাম না।নির্লিপ্ত খেয়ে উঠলাম।রুমে এসে ফোন হাতে নিলাম।ফোনে অভির আর কোনো রেসপন্স মেসেজ এলো না।একঘন্টা হয়ে গেছে মেসেজ পাঠানোর। এতক্ষণে হয়তো দেখেও ফেলেছে মেসেজগুলো।দেখার পরও….!এবার কেনজানি মুখে খুব তাচ্ছিল্যকর একটা হাসি ফুঁটে উঠলো।তবে “তাচ্ছিল্য হাসি দেওয়ার” কারণটা মাথায় নিলাম না।তা এড়িয়ে যেয়ে সোঁজা ফেসবুকে ঢুকলাম।নিউজফিড স্ক্রল করতে চোখ পড়লো একটা ডিপিতে।ডিপিটি অভির।নিউ ছবি।কিছুক্ষণ আগে সে ছবিটা আপলোড দিয়েছে।ছবিতে সে অন্যদিক তাকিয়ে হেসে আছে।গাঁয়ে ব্লু কালারের গেঞ্জি।পড়নে জিন্স।হেয়ার জেড এঙ্গেলে কাঁটা।এই লুকে তাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে।সাথে হাজারো লাইকস,কমেন্টস।কমেন্টসের রিপ্লাইগুলোর বাক্য খুবই নির্লিপ্ত আর প্রাণবন্ত।দেখেই বুঝা যাচ্ছে বড্ড সুখে আছ সে।মেসেজগুলোও একটিবারের জন্যে তার হৃদয়ে নাড়া দিলনা।বড়ই পাষাণ আর নিষ্ঠুর!ছোট্ট একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো।তারপর নিজেকে আবার সামলালাম।এখন আর নিজেকে আবেগে রাখবো না।আবেগে রাখলে আবার আগের মতন সেই কষ্ট পেতে হবে।এখন আর কষ্ট পেতে চাই না।এখন নিজেকে শক্ত করতে চাই!শক্তটাই আমার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শেষ ভরসা!ভাবনার মাঝেই ফাহিম ভেতরে ঢুকলো।এসেই বললো,

“আপু?একটা কাজ করো ত?”
“বলো।”

সে আমার দিকে একটা কাগজ এবং কলম এগিয়ে দিয়ে বলে,
“সুন্দর দেখে একটা আর্ট করে দাও আমাকে।মা বললেন তুমি নাকি খুব ভালো ড্রয়িং জানো?”

আমি কিছুটা অসংযত হয়ে যাই।মন ভালো নেই।তারউপর আবার ড্রয়িং!খানিকটা বিরক্তিও লেগে যায়।বলি,

“রাত তো অনেক হয়েছে।ঘুমাবে না?”
“আমি এত তাড়াতাড়ি ঘুমাই না।”
“কেন?”
“মাত্র ন’টা বাঁজে এটা কোনো রাত হলো নাকি?জ্ঞানীরা জানো কখন ঘুমায়?”
“কখন?”
“পড়াশুনা শেষ করে!”
“তোমার পড়াশুনা শেষ হয়নি?”
“য়ুহু।”
“কি পড়া বাকি আছে? ”
“ড্রয়িং।শুধুই ড্রয়িং।”

বলে ফাহিম দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে।ভেতরে আমার আরেক রাশ বিরক্তি ছুঁয়ে যায়।ফাহিম বলে,

“ঘুমানোর আগে আমি যদি রংতুলি নিয়ে না বসি তাহলে রাতে আমার ভালো ঘুম হয় না।আমি রংতুলি করলে রাতে খুব ভালে ড্রয়িং এর স্বপ্ন দেখি।স্বপ্নে দেখি অনেক বড় একজন আর্টিস্ট হয়েছি।”
“তোমার ড্রিম কি আর্টিস্ট হবার?”
“জ্বী।কিন্তু বাবা চাইছেন না।”
“তুমি যদি ভালো আর্ট জানো।বড় বড় প্রতিযোগিতা জয়েন করো তাহলে অবশ্যই তিনি একদিন রাজি হবেন।”
“দোয়া করো আপু।আমি বাবাকে রাজি করাবই।”
“সিউর।যাইহোক অনেক কথা বললাম।এবার তাড়াতাড়ি ড্রয়িং করে দিয়ে আমাকে বিদেয় করো।”
“আজ না করলে হবে না?”
“য়ু হু।আমার এখনই চাই।”

এই একটা ঝামেলা!ছোট্টদের যদি কোনো আবদার এই একবার রাখি তাহলে ত হলোই..!সারাক্ষণ কানের কাছে খালি ঘ্যানঘ্যান করবে আর বলবে,”আপু ড্রয়িং,আপু ড্রয়িং।”এদের এই ছোট্ট বাচ্চাগুলোর এই এক হলো বদভ্যাস!তারপরও খালামণি যেহেতু কথাটা বলেই দিলো তাহলে ত আবার ড্রয়িং না করে দিলে খালামণির কাছে ছোট্ট হয়ে যাবো।নাহ ড্রয়িং করেই দিই।ছোট্ট মানুষ।ড্রয়িং করে দিলে খুশি হয়ে যাবে।ভাবতলই বিরক্তি ভাবটা মসৃণ হয়ে যায়। মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বলি,

“দাও”

খসখস পেন্সিলের আওয়াজে একটা স্কেচ করে দিলাম।স্কেচ করা শেষ হলে ফাহিম সে কি খুশি!খুশির লগন যেন তাকে ধরছেই না।সে টপ করে কাগজাট হাতে নিয়ে বলে,

“সে কি,তুমিতো খুব ভালো স্কেচ পারো।কি সুন্দর একটা মেয়ে এবং একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।আচ্ছা রং টা আমি করবো?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা করা শেষ হলে তোমাকে দেখাতে নিয়ে আসবো।হ্যাঁ?”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”

ফাহিম আমার উত্তর পেয়ে স্কেচ নিয়ে ওর রুমের দিকে ছুট দিল।ফাহিম বড্ড পাকনা ছেলে।বয়স তেমন না।এই এগারো। ক্লাস মাত্র সিক্স!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here