#পঁচিশটি_মোমবাতি
#পর্ব:- ০৪
সফিক বললো,
– আপনি কি নিশ্চিত যে স্যারকে লিমন সাহেব খু-ন করেছে?
– খু-ন করেছে বলিনি, বলেছি পরিচিত কাউকে দিয়ে কিংবা ভিন্ন উপায়ে বাবাকে মেরেছে। কারণ আমি জানামতে বাবার কোনো শত্রু নেই, তবে…
– তবে?
– আমার মনে হচ্ছে আমরা যেখানে যাচ্ছি সেই গ্রামের বাড়িতে কিছু একটা আছে। বাবা কখনো গ্রামের বাড়িতে যেতে চাইতেন না। আমি যখন মায়ের কাছে বলতাম মা নিজেও বলতেন সেখানে দেখার কিছু নেই। তাছাড়া তোমার বাবা যেতে দিবেন না।
সফিক চুপ করে রইল। তার প্রচুর মাথা ব্যথা শুরু করেছে। মাঝে মাঝে এরকম হয়, একবার শুরু হলে ঘন্টা খানিক খুব কষ্ট হয়। এখন তার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ। নিধি চলে গেলে সফিক কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবে কিন্তু এই মেয়ের চলে যাবার কোনো লক্ষন নেই।
– সফিক সাহেব।
– বলেন।
– গ্রামের মধ্যে বাবা কারো সঙ্গে হয়তো বেঈমানী করেছে। কোনো এক মানসিক অজ্ঞাত কারণে বাবা তাকে ভয় পেতেন।
– আমার তো মনে হয় না। কারণ সেরকম কিছু হলে তিনি আপনার নানা বাড়ির এলাকায় তো হাসপাতাল করতে চাইতেন না।
– আপনি কি অসুস্থ?
– মাথাটা ব্যথা করছে।
– ঠিক আছে আপনি তাহলে একা একা থাকুন আমি বিরক্ত না করে চলে যাই।
– আচ্ছা।
নিধি ছাঁদ থেকে নেমে গেল। সফিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নদীর দিকে। ছোটছোট নৌকায় আলো জ্বলছে, নদীর পাড়ে দুরে যেসব গ্রাম দেখা যায় সেখানে কিছু বাতি তারার মতো লাগছে। এরকম একটা পরিবেশ, ফারজানার সঙ্গে আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে৷ রাত বেশি হয়নি, ঢাকা শহরে এখন সবাই জেগেই আছে। তাছাড়া বিগত কদিন ধরে অনেক রাত পর্যন্ত ফারজানাকে অনলাইনে দেখা যায়।
– স্যার আপনার নাকি মাথা ব্যথা করছে? ম্যাডাম আপনাকে চা দিতে বললো।
সফিক ঘুরে তাকালো, রূপা চায়ের ফ্লাক্স আর কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সফিক তার দিকে ফিরে তাকাতেই সে বললো,
– চা খাবেন?
– তুমি এখানে?
– ম্যাডামের সঙ্গে যাচ্ছি, তিনি আমাকে তার সঙ্গে যেতে বললেন।
– আমি তো জানতাম না।
– আমিও জানি যে আপনি জানেন না। ম্যাডাম দুদিন আগে আমাকে বলেছে তার সঙ্গে যেতে হবে।
সফিক খানিকটা অবাক হয়ে গেল। তারমানে নিধি চৌধুরী আগে থেকেই যাবার পরিকল্পনা করেছে। শফিককে সে বুঝতে দেয়নি, এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সফিক চিন্তিত হয়ে গেল, বড়লোকের অহংকারী মেয়ে কারণ ছাড়া কোনো কাজ করবে না। মেয়েটার সকল কাজ সন্দেহের সৃষ্টি করে তার মনে।
– স্যার চা দেবো?
– হ্যাঁ দাও।
রূপা চা বানাতে লেগে গেল। সফিক বললো,
– অফিস থেকে কে কে যাচ্ছে?
– ম্যানেজার সাহেবও যাচ্ছেন। আমি আর ম্যাম সহ মোট সাতজন যাচ্ছি।
– তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
– জ্বি স্যার!
– লিমন নামের কাউকে তুমি চেনো? বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে।
– জ্বি লিমন ভাইয়া।
– তোমার সঙ্গে তার পরিচয় কি?
– আমার ভাবির পরিচিত, ভাবির নাকি ক্লাসমেট ছিল সে। ভাবির গ্রামের স্কুলে তিনি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।
– তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে কতদিন আগে?
– দেড় দুই বছর তো হবেই। একদিন রাস্তায় হঠাৎ করে ভাবির সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। ভাইয়ার বাবা সরকারি চাকরি করতেন, ক্লাস এইটে পড়ার সময় তার বাবার বদলি হয়ে যায়। তারপর থেকে ভাবির সঙ্গে আর পরিচয় ছিল না। কিন্তু সেদিন রাস্তায় দেখে নাকি তিনি চিনতে পারেন। তারপর আমাদের বাসায় এসেছিলেন।
– তোমাদের বাসায় আসার পরে তোমার সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে তাই তো?
– জ্বি স্যার, আর তার সম্পর্কে যা কিছু বলছি সব ভাবির কাছে শুনেছি আমি। ভাবি তো মাঝে মাঝে আফসোস করেন। তার ক্লাসমেট কতো ভালো, পড়াশোনা করে এসেছেন বিদেশ থেকে। এখন ভালো চাকরি করবেন, আর ভাবির জীবন গরীব ঘরে কেটে গেল।
– তুমি কি জানো লিমন সাহেব নিধি ম্যাডামের পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ায় তাদের পরিচয়, ম্যাডাম কি তোমাকে এসব বলেছে?
– না স্যার বলেন নাই।
– ঠিক আছে আমি যে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি এসব কাউকে বলার দরকার নেই।
– স্যার লিমন ভাইয়ের সঙ্গে আমার তেমন বেশি পরিচয় নেই। আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে গেলে আমি তেমন কথা বলতাম না।
রূপা একটু টেনশনে পরে গেল। সে ভাবছে তার স্যার কি বিষয়টা অন্য কিছু ভাবছে নাকি? রূপা তো লিমনকে পছন্দ করে না, কিন্তু স্যার সেরকম কিছু যদি মনে করে। হায় আল্লাহ।
– সফিক সাহেব, মাথা ব্যথা কমেছে?
নিধি দাঁড়িয়ে আছে, তার পরনে কালো রঙের একটা শাড়ি। সুন্দরী এক মেয়ে গায়ে কালো শাড়ি জড়িয়ে আছে, বাহ সুন্দর তো।
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সে শাড়ি কোথায় পেল?
এই রহস্যময় মেয়েটার উদ্দেশ্য কি?
ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করা দরকার। আর কি কি প্ল্যান করেছে কে জানে?
– ভাবলাম ছাঁদে দাঁড়িয়ে চা খেলে আপনার মাথা ব্যথা কমতে পারে। তাই রূপাকে দিয়ে আপনার কাছে চা পাঠালাম। সেই ফাঁকে পোশাক পরিবর্তন করে শাড়ি পরেছি, এবার নিশ্চয়ই আপনার রাতের প্রকৃতি দেখতে বাঁধা নেই।
– হঠাৎ করে শাড়ি পেলেন কোথায়?
– এটা রূপার শাড়ি। ভাগ্যিস সে তার কাপড়ের সঙ্গে নিয়ে এসেছে নাহলে তো আপনার প্রকৃতি দেখতে পারতাম না।
রূপা লজ্জা পেয়ে গেল। সে চায়ের কাপ আর ফ্লাক্স নিয়ে উঠে গেল, তার হয়তো থাকতে লজ্জা করছে। একটু আগে নিধি যখন কেবিনে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– রূপা তোমার শাড়ি আছে?
– জ্বি ম্যাডাম আছে।
– কি কি কালার আছে?
– ম্যাডাম আমার তো সব ধরনের শাড়ি আছে।
– তাহলে কালো বাদে যেকোনো রঙের একটা শাড়ি দাও আমি এখনই পরবো।
রূপার মুখ ছোট হয়ে গেল, কারণ সে তার সঙ্গে করে মাত্র একটা কালো শাড়ি নিয়ে এসেছে। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করাতে সে তার বাসায় নিজের যে শাড়ি আছে সেগুলো বলেছে। কিন্তু ম্যাডাম যে এখন তার শাড়ি চাইবে সে বুঝতে পারেনি।
রূপা তার ব্যাগ থেকে কালো শাড়িটা বের করে নিধির হাতে দিল। নিধি তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বললো,
– তোমাকে কালো বাদে যেকোনো রঙের একটা শাড়ি দিতে বলেছি। কালো দিতে বলিনি।
– ম্যাডাম কালো শাড়িই আছে।
– একটু আগে যে বললে?
– ওগুলো তো সব বাসায়।
– বুঝতে পারছি। ঠিক আছে তাহলে এটাই পরবো সমস্যা নেই। তুমি এক কাজ করো, ছাদে সফিক সাহেব একা একা বসে আছে। তার মাথা ব্যথা করছে, তুমি গিয়ে তাকে একটু দিয়ে আসো। আমি ততক্ষণে কেবিনে বসে শাড়ি পরে ফেলি।
রূপা আনন্দিত হয়ে চা আর ফ্লাক্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ম্যাডাম আসার সময়ই সঙ্গে করে চা নিতে বলেছে, সেখান থেকে সফিক এখন পাবে।
★★★
রূপার সঙ্গে সঙ্গে নিধিও চলে গেল। শরীরে কিছু একটা কামড়াচ্ছে, পিপড়া নাকি ছাড়পোকা বোঝা যাচ্ছে না। এখনই শাড়ি বদলে ফেলতে হবে। সে ছাঁদ থেকে নামার পরে সফিক আবারও নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়ে দুটো , বিরক্তিকর!
মনে মনে বললো, আর যেন কেউ ফিরে না আসে। আর যদি কেউ আসে তাহলে সে নিচে গিয়ে আর আসবেন না সিদ্ধান্ত নিলেন। দরকার হলে কেবিনে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকবে।
– Excuse Me Brother, কেমন আছেন?
টগবগে তরুণ এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। আবার কোন বিরক্তিকর ঝামেলা, সফিক মনে মনে বললো, ঠিক আছে ক্ষমা করলাম এবার তুমি বিদায় হও ভাই। কিন্তু মুখে শুধু বললো,
– Hi,
– আমার নাম লিমন তালুকদার, আপনি নিশ্চয়ই নিধির অফিসে চাকরি করেন।
লিমন…! তারমানে লিমনও লঞ্চে আছে? নিধি কি এটা জানে? জানলে সফিকের কাছে বললো না কেন? বলেই বা কি হবে, মেয়েটা তো এমনিতে একটু রহস্যময়।
– হ্যাঁ, আমার নাম সফিক আহমেদ।
– আমি নিধির পরিচিত, বন্ধু বলতে পারেন।
– আচ্ছা, তো আপনিও কি ম্যাডামের সঙ্গে সেই গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন?
– আপনার ম্যাডাম এখনো জানেন না যে আমি যাচ্ছি। সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিচ্ছি, কালকে সকালে তার সঙ্গে দেখা করবো।
রূপার কাছে করা প্রশ্ন লিমনকেও করতে ইচ্ছে করছে সফিকের। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিধির কথা তার মনে পরে গেল। নিধি চুপচাপ নিজের মতো করে সবকিছু বের করার চেষ্টা করছে। সফল যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে বেচারা কিছু আন্দাজ করতে পারে।
– নিধিকে দেখলাম আপনার সঙ্গে কথা বলতে। তাই ভাবলাম কিছুক্ষণ গল্প করবো। একা একা ভালো লাগে না ভাই।
– আপনি চাইলে নিধি ম্যাডামের সঙ্গে আগেই দেখা করতে পারেন। সকালের চাইতে এখনই বেশি সারপ্রাইজ হবে মনে হয়। তাছাড়া দুজন মিলে গল্প করতে করতে চলে যেতে পারবেন।
– হুম তা ঠিকই বলেছেন।
– দুঃখিত লিমন সাহেব, আপনার সঙ্গে আর থাকতে পারছি না। আমার বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাথার মধ্যে যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি এখন কেবিনে গিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করবো।
– ওহ্ শিওর, কোনো সমস্যা নেই।
– ধন্যবাদ আপনাকে, শুভ রাত্রি। আগামীকাল সকালে দেখা হবে ইন শা আল্লাহ।
সফিক নিচে এসে অযু করলো। লঞ্চের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা স্থানে নামাজের স্থান আছে, সেখানে গিয়ে এশার নামাজ পড়লো। তারপর নিজের কেবিনে চলে গেল। নিধি রূপা ম্যানেজার সবাই কে কোথায় আছে জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মাথা অতিরিক্ত যন্ত্রণা দিচ্ছে তাই কেবিনে চলে গেল।
★★★
রাত একটা।
রুপা নিধি ঘুমাচ্ছে, রূপা আস্তে করে কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। তারপর সাবধানে দরজা বন্ধ করে এদিক সেদিক তাকিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। খানিকটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে লিমন। রূপা তার কাছে যেতেই লিমন বললো,
– নিধি কি ঘুমিয়ে গেছে?
– হ্যাঁ।
– তুমি ঠিকমতো কাজটা করতে পারবে তো? হাতের যেকোনো শিরায় ইঞ্জেকশন দিতে হবে, খুব সাবধানে।
– আমার ভয় লাগছে লিমন ভাই।
– কোনো ভয় নেই, তুমি কোনরকমে ইঞ্জেকশন দিতে পারলেই শেষ। ঘুমের মধ্যেই নিধি তার বাবার কাছে চলে যাবে। এই বিষ খুবই মারাত্মক। একবার রক্তে মিশে গেলে সেই মানুষ আর বাঁচে না।
.
.
কেমন লাগছে অবশ্যই জানাবেন।
ভুলগুলো ক্ষমার নজরে দেখবেন।
আসসালামু আলাইকুম।
.
.
চলবে….
~~~ মোঃ সাইফুল ইসলাম।