আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-১৫

আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-১৫
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

রুহি অবাক হয়ে গেলো। ওদের বাসায় কেন নিয়ে এসেছে? এখানে রুহির কী কাজ? তাছাড়া বিভোরের মা-বাবা সবাই তো ইভার ওখানে। তাহলে খালি বাসায় কেন নিয়ে এলো ওকে? বিভোরের মতলব ভালো ঠেকছেনা রুহির। বিভোর বলল,

‘ নামো গাড়ি থেকে।’

‘ নামবো না। আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন।’

বিভোর ধমক দিয়ে বলল,

‘ নামতে বলছি নামো।’

রুহি থম মেরে বসে রইলো। কিছুতেই নামবেনা ও। বিভোর রেগে গেলো। দরজা খুলে টেনে বের করলো গাড়ি থেকে। তারপর হাত ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলো। দারোয়ানকে গাড়ির চাবি দিয়ে বলল গাড়িটা পার্ক করে দিতে।

রুহি বলল,

‘ পার্ক করবে কেন? আমি বাসায় যাবো কখন?’

মুচকি হেসে বিভোর বলল,

‘ যাবেনা।’

‘ যাবোনা মানে?’

বিভোর গম্ভীরমুখে উত্তর দিলো,

‘ তোমার বর কী ভিক্ষুক? তার কী বাড়িঘর নেই?’

‘ জানিনা।’

‘ শুনো তোমার বর যথেষ্ট এস্টাবলিষ্ট। ওর যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে নিজের বউয়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। তাহলে তুমি কেন আরেকজনের বাড়িতে থাকবে?’

রুহিকে কোনোকিছু বলার অবকাশ না দিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাসার ভেতরে ঢুকলো। রুহিকে ছেড়ে দরজা বন্ধ করে ওকে বসতে বললো। ডাক্তারের হিংস্র চাহনি দেখে রুহি ভয় পেয়ে বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লো। ওর সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিভোর ঘরে গেলো ফ্রেশ হতে। ওদিকে রুহি অবাকের পর অবাক হচ্ছে। ডাক্তার বউয়ের দায়িত্ব নিতে চাইছে? সত্যিই নাকি ছলনা? বিভোর তো সবসময় ভনিতা করতে পছন্দ করে। এই পাঁচদিনে রুহি লোকটাকে মোটামুটি বুঝতে পেরে গিয়েছে। এমন তো আবার নয় যে, এখন দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলে পরে রুহিকে আবার ছেড়ে দিলো? শুধু স্বপ্ন দেখাচ্ছে? হতেই পারে। কিছু কিছু পুরুষ স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসে, তবে পূরণ করতে নয়। কে জানে বিভোর কেমন!

ফ্রেশ হয়ে আসতে বিভোর বেশ সময় নিলো। ঘড়ির কাটা দশের ঘরে। নিঝুম রাত। পাতার শনশন শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঝড় হবে বোধহয়। বিভোর মাকে ফোন করলো। নাসিমা রেগে আগুন হয়ে আছে। রুহি কোথায়, ওরা কোথায়, কী করছে, কী খেয়েছে, কখন বাসায় ফিরবে এসব প্রশ্ন করতে লাগলো। বিভোর শুধু বলল,

‘ আজ ফিরতে পারবোনা। মেয়েটা ঠিকই আছে। চিন্তা করোনা।’

‘ ফিরতে পারবিনা মানে কী?’

‘ মানেটা পরে বুঝিয়ে বলবো। আই হোপ তোমরা বুঝতে পারবে।’

‘ তোর মাথায় যে কী চলে, বুঝিনা।’

‘ তোমরা বাসায় চলে গিয়েছো?’

‘ হ্যাঁ। ওদেরকে নিয়ে এসেছি।’

‘ ভালোই হলো।’

‘ এই, তোরা কী ও-বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছিস?’

‘ সময় পাইনি।’

‘ তাহলে খাবি কী? আছিস কোথায় সেটাতো বল।’

‘ খাওয়া নিয়ে চিন্তা করোনা। পরে সব বলবো!’

‘ আচ্ছা।’

বিভোর আরও টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দিলো। খাওয়া নিয়ে সমস্যা নেই, রুহিকে দিয়ে রাঁধিয়ে নিবে। আবার এটাও ভাবলো, ওর বউ কেন রাঁধবে? ওর কী হাত-পা নেই? ওর বউ থাকবে রাজরানির মতো। শুধু বিভোরকে ভালোবাসলে, ওর পরিবারকে ভালোবাসলেই হবে। খুব সাধারণ একটা জীবন, কিন্তু চমৎকার হতে হবে। তাছাড়া বিভোর নিজেও রাঁধতে পারে। একেবারে অখাদ্য যে হয়, তা নয়।

বিভোর ড্রইংরুমে এসে দেখলো রুহি ঘুমাচ্ছে। বোধহয় হঠাৎ চোখ লেগে গিয়েছে। ওর ওড়না এলোমেলো হয়ে আছে। বিভোর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। ভাবলো ডাকবে কিনা! পরে নিজেই মনে মনে বলল,

‘ রক্তজবা তো আমারই বউ। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?’

বিভোর নিজেই রুহির ওড়না ঠিক করে ওকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলো। বাইরে বাতাস আছে বিধায় জানালাটা ফাঁক করে দিলো। জানালার ওপাশে আছে বিরাটাকার হিজল গাছ। গাছটাতে ফুটে আছে লালচে ফুল। রাতেরবেলা দেখতে অদ্ভুত লাগে। বিভোর চলে গেলো রান্নাঘরে। ফ্রিজ থেকে ডিম নিলো, মুরগীর মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখলো। ডাল রাঁধবে কিনা ভাবলো, যদিও এটা রাঁধতে পারে না। রুহি আজ প্রথম ওর রান্না খাবে, ভালো মতোই করতে হবে সবকিছু। বিভোর একবার ইউটিউবে সবকিছু দেখে নিলো। চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে রান্নায় মনোযোগ দিলো।

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটায়। তখনই টিকটিক করে ঘড়িটা শব্দ করতে লাগলো। ঘুম ভেঙে গেলো রুহির। কোথায় আছে প্রথমে বুঝতে পারলো না। ঘোর নিয়েই পিটপিট করে চারপাশে চোখ বুলালো। বিভোরের বাসায় আছে, হুম। রুহি ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় ঠেস দিয়ে বসলো। ঘুমের মাঝখানে বাঁধা পড়লে সারারাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয় রুহির। তার উপর আজ জায়গা বদল হয়েছে। কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছেনা। তবে এটা নিশ্চিত আজ ওকে এখানেই থাকতে হবে। কিন্তু লোকটা কই?

খালি বাসায় কেমন গা ছমছম করছে ওর। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। পা টিপে টিপে রুহি সেদিকে গেলো। বিভোর রান্না করছে। এখন সে পেঁয়াজ কাটায় ব্যস্ত। রুহিকে দেখতে পেয়ে মিষ্টি করে হাসলো। বলল,

‘ ঘুম ভেঙেছে মহারানির?’

‘ দেখতেই তো পাচ্ছেন। আর আমি কোনো মহারানি নই, আমিতো দাসী।’

‘ কে বলেছে এই কথা?’

রুহি একটা হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ সবাই পদে পদে বুঝিয়ে দেয়।’

বিভোর ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

‘ যেমন?’

‘ সত্যিই শুনতে চাইছেন?’

‘ ডেফিনেটলি!’

‘ আমার কথা শোনার সময় আপনার আছে নাকি!’

বিভোর মুখ টিপে হাসলো। পেঁয়াজ কাটায় আবারও মনোযোগ দিয়ে বলল,

‘ বলেই দেখোনা, শুনি কিনা।’

রুহি ইতস্তত করে বলল,

‘ এই যেমন আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, সেটাও ভেঙ্গে যাবে। সেদিন ইশতিয়াক ভাই সুযোগ নিতে চাইলো। ইভা আপুর বন্ধু নিরব সাহেবও সেই লিস্টে আছে। যদিও ওনি খারাপ মানুষ নন, ফ্রি মাইন্ডের। কিন্তু তাও, সবাই আমাকে দয়াই করে।’

বিভোর নিরবের কথা শুনে রেগে গেলো। হাতের ছুড়িটা দিয়ে শক্ত করে টেবিলের উপর আঘাত করলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ বিশ্রি ঘটনাটা ভুলে যাও, দ্যান ওই নিরবের কথা আমার সামনে কখনো তুলবেনা। গট ইট!’

‘ কেন?’

‘ লোকটাকে আমার সহ্য হয়না।’

‘ কিন্তু আমি তো আর আপনার মতো নই।’

বিভোর রেগে গেলো। বলল,

‘ তুমি কী মিন করতে চাইছো?’

‘ ওনি সবার চেয়ে আলাদা। ফ্রি মাইন্ডেড!’

বিভোর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

‘ হি ইজ আ বাস্টার্ড।’

‘ আপনার ভাষা ঠিক করুন। এগুলো আপনার সাথে যায়না!’

‘ তুমিও তাহলে এর কথা বলবেনা।’

‘ সেটা আমার ব্যাপার।’

‘ নেভার। আমার সাথেও জড়িয়ে আছে কজ ইউ আর মাই ওয়াইফ!’

রুহি অস্বস্তিবোধ করলো। চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আছে। হাতমুখ ধুতে পারলে ভালো হতো। বিভোরের প্রত্যেকটি কথায় কেমন আজব আজব। বুঝতে পারেনা রুহি। কোনো কথার মর্মার্থ উদ্ধার করা সম্ভব নয়। এতোই যদি বউ হিসেবে মানে তাহলে সমাজের কাছে পরিচয় দিতে চায়না কেন? ছাড়তে চায় কেন? জিজ্ঞেস করবে নাকি ডাক্তারকে?

রুহিকে অন্যমনস্ক দেখে বিভোর হালকা কাশি দিয়ে বলল,

‘ কিছু বলবেন মনে হচ্ছে বিবি সাহেবা?’

‘ আপনি রান্না করছেন?’

‘ জি বিবি সাহেবা।’

রুহি অবাক হয়ে বলল,

‘ কে বিবি সাহেবা? আমি কারো বিবি নই।’

‘ সেটা তোমাকে বলতে হবেন। যাও টেবিলে , খাবার নিয়ে আসছি।’

‘ আমি খাবোনা!’

বিভোর রেগে বলল,

‘ বললেই হলো? আমি এতো কষ্ট করে রাঁধলাম আপনার জন্য, আর আপনি এতো সহজে না করে দিলেন? বরের কথা না শুনলে কী হয় জানো তো? যাও বলছি এক্ষুণি।’

রুহি আমতা-আমতা করে বলল,

‘ আপনাদের ওয়াশরুমটা কোথায়?’

‘ বলো আমাদের!’

‘ যা-ই হোক, কোথায়?’

‘ ড্রয়িংরুমের টাতে একটা সমস্যা আছে, তুমি বাঁ দিকে গিয়ে ডান পাশের করিডোর ধরে এগিয়ে যাও। দ্যান আমার ঘর পাবে, ওখানে ওয়াশরুমটা ফাঁকা আছে।’

রুহির মাথা চক্কর মারলো। এতো প্যাঁচালো কথাবার্তা কেন বলে বিভোর! তা-ও ধীরেধীরে সেদিকে গেলো। বিভোরের ঘরটা অতি সহজেই চিনতে পারলো রুহি। ওর হাসিমুখে তোলা অনেক ফটো দেয়ালের ফ্রেমে ঝুলানো। সারা ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাপড়-চোপড়। খাতা-পত্র, বই, ফাইল সবকিছু এদিকওদিক পড়ে আছে। রুহি ওয়াশরুমে গেলো। বিশাল বড় ওয়াশরুম। বাথটাবও আছে, বড়লোকের বিরাট কারবার। রুহি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর যেইনা বেরুতে যাবে তখনোই সাবানের ফেনায় পা পিছলিয়ে পড়ে গেলো। কোমড়ে ব্যথা পেয়ে চিল্লিয়ে উঠলো। ডাইনিংয়ে খাবার সাজাচ্ছিলো বিভোর। রুহির চিল্লানি শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো। ভেতর থেকে দরজা খোলাই ছিলো, ও ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো রুহি পা পিছলে পড়ে গিয়েছে। বিভোর ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করলো, কিন্তু রুহি দাঁড়াতেই পারলো না। বাধ্য হয়ে রুহিকে একপ্রকার কোলে তুলে রুমে নিয়ে এলো বিভোর। রুহি কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আপনি এতো অলস? ফ্লোরে সাবানের ফেনা ফেলেছেন সেটা ধুলেননা কেন? নোংরা লোক একটা!’

বিভোর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো রুহির দিকে।

মন্তব্য জানাবেন আশা করি। আপনারা অপেক্ষা করবেন বিধায় মাঝারি করে হলেও দিয়েছি। রোজা তো, সেজন্য এরকম হচ্ছে।
ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here