নিরুদ্দেশ পর্ব ৫

নিরুদ্দেশ
পর্ব ৫

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে মাঘের শীত বাঘেও ভয় পায়। মাঘ মাসের দ্বিতীয় দিনে যেভাবে শীত পড়েছে তাতে এই কথাটা সত্য হিসেবেই বিবেচিত হয়। চারিদিকে কুহেলিকায় ঢাকা। টপটপ করে গাছের পাতা থেকে শিশির পড়ছে। খুব কাছের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। পুব আকাশে হালকা লাল আভা পড়লেও তা স্পষ্ট নয়। খুব ভোরে অনেকটা দৌড়ানোর পর সদ্য বাড়ি ফিরেছে সংকেত। পায়ে নোংরা জমেছে। জল দিয়ে ধুতে কষ্ট। কোনোরকম ধুয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। বাবা এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। গতকাল কাজেও যায়নি। তিনি কি অসুস্থ? না, বেশ সুস্থ স্বাভাবিক তো রয়েছে। তবে কাজে কেন যাচ্ছে না বুঝতে পারছে না সংকেত। জিজ্ঞেসও করা হয়নি। হয়তো, একটু অবসর নিতে চায়। ব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি চায়। কিন্তু বাবা যে কাজে প্রবৃত্ত তাতে ছুটি তো খুব কম। তাছাড়া সময়টা টুরিস্টদের জন্য উপযুক্ত। এই সময় মানুষ বড় অলস হয়ে ওঠে। পিকনিক করতে,বাইরে কোথাও যেতে পছন্দ করে। তাই হোটেলের লোকেদের ছুটি থাকে না। তাদেরকে এই সময় আরও বেশি কাজ করতে হয়। কিন্তু বাবা এই সময়ে অবসর খুঁজছে! একটু হলেও অস্বাভাবিক। তিনি এমনটা কখনো করেনি। ঘুম থেকে উঠলে সবকিছু জানতে চাইবে সংকেত, মনে মনে তাই প্রতিজ্ঞা করলো। কিছুক্ষণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার পর তার লাগানো গাছগুলোর দিকে চোখ
পড়ল। যদিও প্রত্যেকটা গাছ সবুজের দেওয়া। সবুজ অসম্ভব ভাবে গাছকে ভালোবাসে। বাজারে গেলে কিছু খাবার খাওয়ার আগে সর্বপ্রথম গাছ কেনে সে। সে-ই গাছ গুলো শুধুমাত্র নিজের বাড়িতে লাগায় না বন্ধুদের জন্যও পাঠিয়ে দেয়। বেশি বেশি গাছ লাগাতে বলে। সময় মত জল দিতে বলে। গাছের চাইতে নাকি মানুষের ভালো বন্ধু কেউ হতে পারে না। সংকেতের গাছের প্রতি কখনো ভালোবাসা ছিল না। সবুজই সর্বপ্রথম গাছের প্রতি ভালোবাসার জন্ম দিয়েছিল তার মনে। তারপর গাছেদের প্রতি ভালোবাসা বেড়েছে। শীতকালে গাছগুলোকে রুক্ষ সুক্ষ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে খারাপ লাগলো। গাছের বৃদ্ধি থেমে গেছে। ফুল ফুটছে না। সংকেত গাছ গুলোর কাছে গিয়ে বসলো। আশেপাশে আগাছা পরিষ্কার করল। কোদাল দিয়ে গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করলো। কিছুক্ষণ পর কাঁধে কারোর কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করল। একটু আগে আগড় খোলার শব্দ শুনে ছিল। তবে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। এবার একটু অবাক হয়ে পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠলো। এত সকালে তৃধা! তাদের বাড়িতে কি জন্য? চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল। তৃধা নিজের শরীরকে মোটা পোশাক দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ভালো করে তার মুখ দেখা গেল না। শিশিরে কিছুটা ভেজা কিছুটা শুকনো সে। শীতের সকালে এতটা পথ অতিক্রম করায় আরও বেশি শীত পেয়ে বসেছে তাকে। থরথর করে কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,’এত সকালে বাইরে বসে আছো কেন? শিশির পড়ছে ভেতরে যাও। রোদ বেরলো বাইরে আসবে।’ সে কোথায় কথা বলা শুরু করবে তা না করে তৃধা শুরু করে দিয়েছে তাও আবার ধমক দিয়ে। মাথা নাড়ালো সংকেত। বলল,’তুমি এত সকালে আমার বাড়িতে!’
‘জ্যাঠামশাই এর সঙ্গে দেখা করব। তিনি কি অসুস্থ? কাজে যাননি কেন?’ তার হাত নাড়ার ভঙ্গি দেখে হাসি পেল সংকেতের। কোনোরকম হাসি চেপে রেখে বলল,’বাবা ঠিক আছে‌ তবে কাজে যাচ্ছে না কেন বলতে পারবো না।’
‘জ্যাঠামশাইকে ডাকো তো। বাবা উনার সঙ্গে কথা বলবেন।’ একটু খটকা লাগলো সংকেতের মনে। বাবার কাছে তো ফোন রয়েছে। যদি কিছু দরকার হতো তাহলে কাকামশাই বাবাকে ফোন করে নিতে পারতেন। তিনি ফোন না করে মেয়েকে পাঠাতে যাবেন কেন? টালির চালে গুঁজে রাখা দোলনা টেনে আনলো। দোলনায় তৃধাকে বসতে বলে ভেতরে গেল সে। বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। মনের সংকোচন দূর করার জন্য ফোনটা হাতে নিয়ে কল লিস্ট চেক করলো। কাকামশাই কাল সকাল থেকে অনেকবার ফোন করেছেন কিন্তু বাবা ফোন রিসিভ করেনি। সমস্ত কিছু জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেল সংকেতের কাছে। কোনো কারণে বাবাকে কেউ আঘাত করেছে কিংবা কোনো কারণে কষ্ট পেয়েছে তাই একা থাকতে চাইছে। ফোন না ধরায় কাকামশাই হয়তো ভেবেছেন বাবা অসুস্থ কিংবা ফোন হারিয়ে ফেলেছেন। তাই তিনি মেয়ের হাতে ফোন দিয়ে পাঠিয়েছেন। যাদে এদের বাড়ির ফোন হারিয়ে গেলে কিংবা খারাপ হয়ে গেলেও কথা বলা সম্ভব হয়। এত ভোরে তৃধাকে দেখে একটু অবাক হলেন জ্যোতির্ময় বাবু। একটুআধটু কথা বলে তৃধা বাবাকে ফোন করলো। তিনি জ্যোতির্ময় বাবুর সাথে কথা বলতে চাইলেন।
‘কি মশাই? কাজে আসছেন না কেন? এমন সময় কাজ বন্ধ করা তো উচিত নয়। আপনি কি অসুস্থ?’জ্যোতির্ময় বাবু চুপ করে রইলেন। জবাব দিলেন না। জবাব না পেয়ে রবিশংকর বাবু আবার বললেন,’আপনি অসুস্থ? যদি ছুটি দরকার তাহলে আগে থেকে বলতে পারতেন। রান্নার ব্যাপার। আগে থেকে রাঁধুনি খোঁজ করতে হতো। এভাবে হয় না মশাই।’
‘আসলে…..।’ জ্যোতির্ময় বাবুকে সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করতে দিলেন না। মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,’জানি জানি আপনি কেন কাজে আসছেন না। আপনার কাছে আত্মসম্মানটা যেমন বড় তেমনি আমার কাছে আত্মসম্মান আর ব্যবসা দুটোই অনেক বড়। আপনি শুধু একটা ফোন করে বলতে পারতেন এ মাসে আপনার পক্ষে টাকা শোধ করা সম্ভব নয়। এটুকু বললেই হতো। তাছাড়া প্রত্যেকদিন আমাদের দেখা হচ্ছে। আপনি আমার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। ভালো করে চিনি। আপনি আমার টাকা মারবেন না। একদিন ঠিক শোধ করে দেবেন।’ বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন জ্যোতির্ময় বাবু। পেছনে ঘুরে দেখলেন তাদের কথা ছেলেমেয়েরা শুনছে কিনা! না, তাদের এ দিকে মনোযোগ নেই। তারা অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে। অন্য বিষয়ে মজে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। এবার পুজোর পরে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে মেদিনীপুর। তাতে জ্যোতির্ময় বাবুর বাড়ির পেছনের অংশ সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। ওই অংশটা মেরামতের জন্য জরুরী হয়ে উঠে। তাই তিনি রবিশংকর বাবুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। আর কথা দিয়েছিলেন পৌষ মাসের মধ্যে টাকাটা শোধ করে দেবেন। কিন্তু তিনি পারেননি। ছেলের পড়াশোনা আর সংসারের একটু বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। ভীষণ আত্মসম্মানীয় ব্যক্তি। কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারায় মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। তাই তিনি কাজে যাননি। কোথাও মনে হয়েছে তিনি ছোট হয়ে গেছেন। এভাবে কথা রাখতে না পারাটা অপরাধ। রবিশঙ্কর বাবু গলা খাঁকরে বললেন,’দেখুন মশাই, আপনি যদি সুস্থ থাকেন তাহলে আজকে কাজে চলে আসুন। টাকার কথা ভাববেন না। আপনার সুবিধামত আপনি শোধ করে দেবেন। আপনার উপর আমি জোর করছি না। আপনি মানুষটা সুন্দর। আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস রয়েছে।’ জ্যোতির্ময় বাবুর মুখে এবার হাসি ফুটলো। মালিকের ব্যবহারের মুগ্ধ তিনি। ভালো মানুষের কদর সবাই বোঝে না -ভগবান বোঝে। ভগবান যেন দেবদূত হিসেবে রবিশংকর বাবুকে পাঠিয়েছেন। নিজের কাজ হারালেন না অন্যদিকে আরও সময় পেলেন টাকা শোধ করার জন্য। এবার আর অসুবিধা হবে না। কাজের জন্য প্রস্তুত।
‘আচ্ছা বাবু, আমি সঠিক সময়ে কাজে পৌঁছে যাবো।’
‘আর শুনুন, আজ আমি হোটেল যাচ্ছি না। আপনি একটু দেখে নেবেন। আর রাতে বাড়ি ফেরার সময় আমার বাড়িতে একবার আসবেন। জরুরী কথা আছে। আসবেন তো?’
‘আসবো।’
কথা দিয়ে দিলেন ঠিকই তবে মনে সংকোচন জন্মালো। উনি হঠাৎ করে নিজের বাড়িতে ডাকছেন কেন? কিছু কি হয়েছে? উনি তো ভালোভাবে কথা বললেন এতক্ষণ। যদি কিছু দরকার থাকতো তাহলে ফোনে বলতে পারতেন। কিন্তু বললেন না। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু রয়েছে।
তিনি তৈরি হয়ে বাইরে এসে দেখলেন তৃধা তখনো বাড়ি ফেরেনি। সংকেতের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছে। দুজনকে মুড়ি খেতে দিলেন। আর কাজে যাওয়ার আগে তৃধাকে বারবার বলে গেলেন, সে যেন বেশি দেরি না করে। সঠিক সময়ে বাড়ি ফিরে যায়। না হলে বাবা রাগ করবেন। সে মাথা নাড়িয়ে সমর্থন করল। খাওয়া শেষ হওয়ার পর তৃধা উঠে দাঁড়ালো। আর থাকা সম্ভব নয়। বাবা বকবে। বাড়ি ফিরতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে জুতো পরলো। উঠোনে অনেকগুলো আকর্ষণীয় গাছ দেখে লোভ হলো। তার পেছনের সংকেত ছিল। তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’আমাকে এখান থেকে কয়েকটা গাছ দেবে গো? আমিও বাড়ির সামনে এমন গাছ লাগাবো।’
‘না।’
‘কেন?’
‘এখানে সমস্ত গাছ সবুজের। তার জিনিসের উপর অধিকার কেবল আমার আছে। কাউকে দিতে পারবো না।’
‘একটা দিলে অসুবিধা কোথায়?’
‘জানি না। তবে দিতে পারব না কাউকে। মাটি থেকে গাছ তুলেছি জানতে পারলে বকুনি দেবে।’
‘সে তো এখন এখানে নেই। জানতে পারবে না।’
‘ও কখনো কাউকে মিথ্যা কথা বলে না। তাই আমিও অন্তত তাকে কখনো মিথ্যা বলতে পারবো না।’ আগড় থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার পর তৃধা সাইকেলে চেপে বসল। প্যাডেলে চাপ দেওয়ার আগেই সংকেত বলল,’তুমি কি রাগ করলে?’ তৃধা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল।
‘তুমি রাগ করে থাকলে দুঃখিত। আমার পক্ষে সম্ভব নয় আমার বন্ধুর কোনো জিনিস তোমাকে কিংবা অন্য কাউকে দেওয়া। বন্ধুর জিনিস গুলো শুধু আমার।’ তৃধা খুব হাসলো। বলল,’বন্ধুকে খুব ভালবাসো?’
‘অনেক, আমার জন্য ছেলেটা বাড়ি ছেড়েছে। জানি না কোথায় আছে। খুব মিস করি ওকে।’
‘চিন্তা করো না। একদিন ঠিক ফিরে আসবে।’
‘সে-ই আশায় বসে আছি। তার যদি কোনোদিন কিছু হয়ে যায় তাহলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। খুব কাঁদবো।’ শেষের কথাটা শুনে তৃধার আবার হাসি পেল। হাসি চেপে রেখে বলল,’অলক্ষুণে কথা একদম মুখে আনবে না। ঠিক ফিরে আসবে। আমি আসছি,কেমন!’ দ্বিতীয়বার প্যাটেলের চাপ দিলো কিন্তু সাইকেল গড়লো না। সংকেত সাইকেল টেনে থামালো।
‘কি হলো, সাইকেল থামালে কেন?’
‘এত সকালে তুমি আমাদের বাড়িতে এলে কেন? তন্ময় আসতে পারল না?’
‘দাদার তো সকালে টিউশন ছিল। তাই বাবা আমাকে আসতে বলল।’ সংকেত অন্য কোনো উত্তরের প্রত্যাশায় ছিল। এমন উত্তরে সম্পূর্ণ হতাশা হলো। মুখ কালো করে ফেলল। তৃধা আর কিছু বলল না। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো।
জ্যোতির্ময় বাবু রাতে বাড়ি ফেরার পথে সবার প্রথম রবিশংকর বাবুর বাড়িতে পৌঁছালেন। মনে অনেক উৎকণ্ঠা জমা হয়ে আছে। সকাল থেকে ঠিকঠাক কাজে মন দিতে পারেননি। কি এমন দরকার যে তাঁকে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। অনেক কৌতুহল আর সংকোচন নিয়ে বাড়ির ভেতরে গেলেন। আতিথিয়তায় কোনো অভাব হলো না। রবিশংকর বাবু সন্ধ্যায় কোথাও বেরিয়েছেন। ফিরতে একটু দেরি হবে। তাই তাঁকে অপেক্ষা করতে হলো। একা বসে বসে বোর হচ্ছিলেন এমন সময় তৃধা এসে পাশে বসলো। গল্প করল। তবুও নিজের মনকে ভালো করতে পারলেন না। ছেলের জন্য মনটা আকুল হয়ে উঠলো। তিনি নিশ্চিত, তাঁর বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। সংকেত ভূতকে ভয় পায়। রাত বাড়লে সে ভয় পাবে। সবুজ থাকলে তাদের বাড়িতে চলে যেতো। কিন্তু এখন কি করবে কে জানে! সূর্যময়ের বাড়ি তো অনেক দূরে। সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। তিনি যথাসময়ে চলে এলেন। রাত বাড়ছে তাই কথা বেশি ঘোরালেন না। সোজাসুজি প্রসঙ্গে চলে এলেন। রবিশংকর বাবু নিজের ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি্র জন্য শহরে বড় লজ বানিয়েছেন। সমস্ত কিছু ঠিক থাকলে কয়েক দিন পরেই উদ্বোধন হবে। সেখানে রান্নার জন্য একজন সুদক্ষ সৎ রাঁধুনির দরকার। আর সে-ই সুদক্ষ রাঁধুনি যে জ্যোতির্ময় বাবু তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওখানে রান্না করার জন্য প্রস্তাব দিলেন। তিনি প্রস্তাবে রাজি হলেন না। বললেন,’আমি সামান্য রাঁধুন। আমার পক্ষে সম্ভব নয় এত বড়ো জায়গায় কাজ করা। তা ছাড়া, অতদুর থেকে প্রত্যেকদিন কোনোভাবেই বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। আমাকে সেখানে থাকতে হবে। কিন্তু আমার ছেলের কি হবে? তাকে রান্না করে কে খাওয়াবে? দেখাশোনা কে করবে? মার্জনা করবেন আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘আরে মশাই! পুরো কথাটা তো শুনুন! আমি যখন আপনাকে প্রস্তাব দিয়েছি তখন আপনার পরিস্থিতির কথা ভেবেছি। আমি জানি আপনি শহরে চলে গেলে আপনার ছেলে একা হয়ে পড়বে। ছেলে বড় হচ্ছে একা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তারপর এক বছর পর ছেলে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করবে। তারপর তাকে পড়তে বাইরে পাঠাতে হবে। ছেলেকে তখন কোলে আটকে রাখবেন? ওকে বড় হতে দিতে হবে,-তাই না?’
‘তা ঠিক। তবে এই মুহূর্তে আমি আমার ছেলেকে ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে পারবো না। ও ছোট। অনেক ছোট।’
‘বাবার কাছে সন্তানরা কখনো বড়ো হয় না। আপনি এবং আপনার ছেলে দুজনেরই থাকার ব্যবস্থা করেছি। এখন ক’টা দিন আর স্কুল হয়! স্কুলে না গেলে তেমন কিছু হবে না। ওইখানে থেকে পড়াশোনা করুক। পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দিয়ে যাবে। তাছাড়া, প্রত্যেক সপ্তাহে একদিন করে ছুটি পাচ্ছেন চাইলে গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে যাবেন।’
তাড়াতাড়ি কথা দিতে পারলেন না জ্যোতির্ময় বাবু। ভাবলেন। অনেক কিছুই ভাবলেন। তবুও কথা দিতে পারলেন না। উদাস চোখে তাকিয়ে রইলেন। রবিশংকর বাবু আবার বললেন,’আপনাকে আমি জোর করছি না। আপনি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর ভাববেন না ওইখানে শুধুমাত্র আপনি একা রান্না করবেন। আপনার সঙ্গে আরও অনেক রাঁধুনি থাকবে। তবে প্রধান রাঁধুনি হিসেবে আমি আপনাকেই চাই। খাওয়া-দাওয়া ঘর ভাড়ার বাদেও আপনার মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হবে। দু-বেলা রান্না করাটা সহজ নয়। আপনি আপনার প্রাপ্যটুকু পাবেন। সে বিষয়ে ভয় পাবেন না।’
কথা না দিয়ে বাড়ি ফিরে আসলেন। ভেবে নিজের সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছেন। অনেক ভেবেও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেন না। নিজের ভিটেবাড়ি ফেলে রেখে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার না গিয়ে উপায় নেই। এখানে থাকলে সে-ই একই মাইনে দিনের-পর-দিন পাবেন। সে-ই মাইনেতে সংসার চালাতে অর্ধেক চলে যাবে। সেখানে থাকলে অনেক সুবিধা। সংসারের খরচ বাঁচবে। মাইনেও বাড়বে। আজ না হোক কাল ছেলে যখন কলেজে উঠবে তখন তার পড়াশোনার খরচ বাড়বে। তখন এত টাকা কোথায় পাবেন? সব ধারদেনা করে চালাবেন? তা তো সম্ভব নয়। যদি একটু কষ্ট করে শহরে যাওয়া যায় তাহলে মন্দ হবে না। টাকার অংকটা বাড়বে। আবার নিজের রান্নার দক্ষতা অনেকের কাছে পৌঁছাবে। সবাই তাঁর তারিফ করবে। নিজের প্রশংসা শুনতে অবশ্যই ভালো লাগবে। একটু সুখে থাকার জন্য নিজের সিদ্ধান্ত বদলালেন। তিনি মন থেকে মেনে নিলেন শহরের যাবেন বলে। এবার পালা সংকেতের! তাকে কোনোভাবে রাজি করাতে হবে। তাকে বলা মাত্রই রাজি হয়ে গেল। একই জায়গা থেকে থেকে সে বিরক্তবোধ করছে। একটু বাইরে যেতে চায়। চেনা গণ্ডির বাইরে গিয়ে থাকলে ভালো লাগবে। খুব সহজে ছেলেকে রাজি হয়ে যেতে দেখে একটু অবাক হলেন। বন্ধুদের ছাড়া সে বাইরে থাকতে পারবে তো? ক’দিন পর আবার ফিরে আসতে চাইবে না তো? সংকেতের মনেও একই দ্বিধা জন্ম নিল। পরিচিত জায়গা ছাড়তে যেমন ইচ্ছে করছে না তেমনি বন্ধুদের কথা মনে গেঁথে রয়েছে। তাদের ছাড়া আদৌ কি থাকা সম্ভাব?
সারাটা দিন সংকেত সূর্যময়ের সঙ্গে কাটালো। তার শহরে যাওয়ার প্রস্তাব সামনে থেকে মেনে নিলেও ভেতর থেকে মেনে নিতে পারেনি সূর্যময়। তার এই শহরের যাত্রায় প্রতি অভিযোগ রয়েছে। সে চায় না বন্ধু দূরে চলে যাক। তার গ্রাম নুড়ি বিছানো পথ, জঙ্গল,বাঁশবন, সমুদ্র, পুকুর,ঘামে মাখা মানুষ, দিগন্তের পর দিগন্ত মাঠ এগুলোই পছন্দ। এখানে ঘুরে বেড়াতে তার ভালো লাগে। আলসেমি ভাবে গোটা দিন কাটিয়ে দিতে ভালো লাগে। সংকেত চলে গেলে সে সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবে। কার সাথে মাঠের পর মাঠ দৌড়ে বেড়াবে? কাকে নিয়ে মাছ ধরতে যাবে? কার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলবে? কার সঙ্গে স্কুলে যাবে? কার পাশে রোজ বসবে? কিন্তু কিছু করার নেই। আজ নয় কাল মানুষকে বাসা পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ যে যাযাবর। এক বন্ধু কোথায় হারিয়ে গেছে জানে না। আমার এক বন্ধু শহরে চলে যেতে চাইছে। তার তৈরি করা বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কোথাও যেন ভিত্তিহীন। সে-ই সংজ্ঞার সঙ্গে বাস্তবে মিলছে না। সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। কোথাও মিল নেই।
দিগন্তের একেবারে শেষে সূর্যের লাল আভা এখনও মিলিয়ে যায়নি। সন্ধ্যার পূর্বে গোধূলি বেলা। শীতের সন্ধ্যা। গায়ে মোটা পোশাক দিয়ে একে অপরের হাত ধরে সবুজের বাড়ির রাস্তা ধরে হাঁটল। বেশ অনেকগুলো মাস হয়ে গেল সূর্যময় এদিকে আসেনি। তার চোখ কিছুটা নতুনত্ব দেখছে। সংকেতের কাছে কোনো কিছু নতুনত্ব নয়। রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় আশেপাশের সব কিছুই চোখে পড়ে। গল্প করতে করতে তারা সবুজের বাড়ির সামনে পৌঁছালো। সংকেত ভেতরে যেতে চাইলো কিন্তু সূর্যময় বাধা দিল। ইচ্ছে নেই। সে জোর করল। বাধ্য হয়ে ভেতরে গেল। এদের বাড়িতে সন্ধ্যার সময় ঠাকুরের কাছে বেশ জমজমাট করে সন্ধ্যা দেওয়া হয়। অনেক প্রসাদ হয়। নিশ্চয়ই প্রসাদ মিলবে। তিন বন্ধুর মধ্যে একে অন্যের বাড়ি যেতে কেউ-ই পিছুপা হয় না। কিন্তু এই বাড়িতে যেতে হলে কেমন একটা ভয় লাগে। সঠিকভাবে ভয় বলা যাবে না। তবে মনের মধ্যে অনেক ভাবনা আসে। প্রথম কোনো অচেনা ব্যক্তির বাড়িতে গেলে মনে যে ভাবনার উদয় হয় ঠিক একই ভাবনার উদয় হয় সবুজের বাড়ি যাওয়ার পূর্বে। জানেে না কেন এমন হয়। অথচ এই বাড়ির কেউ-ই কিছু বলে না। এঁরা হাইক্লাস জীবন যাপন করেন। সবাইকে পছন্দ করেন না। পরিবারের প্রত্যেকের (সবুজ বাদে) মধ্যে একটু খিটখিটে ভাব রয়েছে। কিন্তু তাঁরা কখনও এই দুইজনকে কিছু বলেন না। অন্তত সামনে থেকে তো কখনই নয়। তাঁরা যেমন তাদেরকে তাচ্ছিল্য করে না তেমন বেশি ভাবও জমায় না। নিজেদের মতো থাকে। তাই এই পরিবারের সাথে তাদের পরিবারের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি হয়েছে। আর এই প্রাচীর বড়ো করেছে সবুজের হারিয়ে যাওয়া। প্রবেশের মুখে ডান দিকে একটা বিশাল বাগান রয়েছে। বাগান দেখে মুগ্ধ হলো।বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সবুজের দাদার রিপন। তার চোখে-মুখে অসংখ্য ভাবান্তর। বাগানের চতুর্দিকে কেমন রুক্ষ শুষ্ক ভাব। গাছগুলো পরিচর্যার অভাবে নেতিয়ে পড়েছে। আবার প্রকৃতির নিয়মে শীতের সময় অনেক গাছ পাতা ঝরিয়ে ফেলেছে। আর সেগুলো এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। এক কথায় সবুজের অনুপস্থিতি ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। হালকা অন্ধকারের বুক চিরে তারা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। কারোর পায়ের শব্দ শুনে ভাবান্তরের ব্যাঘাত ঘটলো রিপনের। সশব্দে বলল,’কে? কে ওখানে?’
‘আমি?’
‘আমিটা কে?’
‘আমি সংকেত।’
‘সাথে কে, সূর্যময়! এখন আবার কি দরকার?’ কেউ জবাব দিল না। সংকেত খুব ভালো করে জানে যে রিপন সূর্যময়কে একদম পছন্দ করে না। শুধু সূর্যময় নয় রিপন পড়াশোনা করে না ‌আর একটু ফাজিল টাইপের ছেলেমেয়েদের একদমই চোখে দেখতে পারে না। নিজে মেশে না আবার পরিবারের কাউকে মিসতেও দেয় না। এই জন্য সূর্যময় এদের বাড়িতে আসতে চায় না। অন্ধকারের মধ্যে কারোর মুখ সঠিকভাবে দেখা গেল না। তবে বুঝতে অসুবিধা হলো না রিপনের মুখমণ্ডল তাচ্ছিল্যে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। সূর্যময় রাগে গনগন করছে।রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক! খারাপ হোক ভালো হোক নিজের বাড়িতে খেয়ে অন্যের কথা শুনতে কে চাইবে? সংকেত তার হাত জাপ্টে ধরল। শীতের মধ্যেও গরম হয়ে আছে। বিশ্বাস নেই রাগ করে বেরিয়ে যেতে পারে। এমন সংকোচনের অবসান ঘটালো সবুজের জননী। তিনি সে-ই মুহূর্তে সেখানে পৌঁছালেন। বাগানে আলো জ্বালালেন। তাদেরকে দেখে হাসি বিনিময় করলেন। পুকুর ঘাট থেকে এক ঘটি জল তুলে তাদেরকে নিয়ে ভেতরে এলেন। তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জননী তাদেরকে হল ঘরে বসিয়ে দিয়ে ঠাকুর ঘরে গেলেন সন্ধ্যা দিতে। অকারণেই দুজন বেশ অবাক হলো। এই বড়িতে সকল সদস্যেরা হাসি খুশি রয়েছে। এমন কি সবুজের জননীও। এই বাড়ি থেকে একটা ছেলে যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে তার প্রভাব যেন কারোর উপর পড়েনি। পড়লে কি এত সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারতো! এত আনন্দ লেগে থাকতো? কখনই না। সবুজের অনুপস্থিতিটা এঁদের কাছে স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে এঁদের কাছে মানুষের চাইতে টাকা কিংবা হ্যাপি থাকাটাই জরুরী। সংকেতের মনের মধ্যে অদ্ভুত ভাবে একটা ভালো লাগাও শুরু হলো। জননী সন্ধ্যা দিতে গেছেন। সবুজের মুখের কতবার শুনেছে তাদের সকাল বেলায় এবং সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরের জন্য অনেক ফলমূল কেটে প্রসাদ বানানো হয়। সংকেত আশায় রইল, জননী সন্ধ্যা দেওয়া শেষ করলে দুজনকে প্রসাদ দেবেন। তাছাড়া এরা বড় বাড়ির মানুষজন। না খেয়ে ছাড়বে না। কিছু খাবার তো দেবেই। সূর্যময় চলে আসতে চাইল।সংকেত তাকে জোর করে আটকে রাখল। কিন্তু কিছুই হলো না। সময় গড়িয়ে গেল। কেউ তাদের সঙ্গে মিশে দু’দণ্ড কথা বলল না। চুপচাপ বসে বিরক্ত হলো। তারা কি জন্য এসেছিল তাই ভুলে গেল। বাধ্য হয়ে শেষমেষ স্থান ত্যাগ করল। বাড়ির বাইরে বেরিয়েছে এমন সময় জননী এসে বললেন,’তোমরা চলে যাবে?’
‘হ্যাঁ।’ সূর্যময় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল।
‘কিছু খেয়ে যাও!’
‘না থাক, পরে কোনো দিন খাবো। কিছুক্ষণ আগে খেয়েছি।’ জননী আর কিছু বললেন না। শুকনো মুখে দুজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো। খুব রাগ হলো উভয়ের। জেনেশুনে অপমানিত হলো। এমনটা না করলেও পারতেন তাঁরা। দুজনকে সামান্য প্রসাদ দিলে এমন কি হয়ে যেত? ঠাকুরের প্রসাদ তো! তারা তো প্রত্যেকদিন খাচ্ছে। একদিন না খেলে কিংবা কম খেলে তেমন কোনো অসুবিধা হতো না।

পর্ব ০৬ আসছে।
বিঃদ্রঃ আজকে পাঠক বন্ধুদের জন্য একটি প্রশ্ন রইলো। কমেন্টে নিজস্ব মতামত জানাবেন।
জ্যোতির্ময় বাবুর শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কি সঠিক?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here