#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),২১,২২
#মম_সাহা
পর্বঃ একুশ
ধীরে ধীরে খুব নিকটে আসা পায়ের শব্দ গুলো আবার ধীরে ধীরেই যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। তিস্তা তো ভীষণ রকমের ভয়ে মূর্ছে গিয়েছিলো। তার নাহয় আগে থেকেই কালি লেপন করা চরিত্রে, কিন্তু মাস্টারমশাই? মাস্টারমশাই তো শুদ্ধ পুরুষ, সম্মানিত মানুষ। তার শরীরে কালিটা যে ভীষণ বিদঘুটে লাগতো। মানী’র অসম্মান অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়।
পায়ের শব্দ গুলো একটু দূরে চলে যেতেই প্লাবন উঠে দাঁড়ালো। তিস্তা কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলো। প্লাবনকে উঠতে দেখে, থতমত খেয়ে গেলো। উৎকণ্ঠায় মুখ থেকে উচ্চারিত শব্দ গুলো জোড়ে বের হলো। অগোছালো শব্দ গুলো আকুতি করে বললো,
-‘যাবেন না কোথাও। আমার ভীষণ ভয় করছে।’
প্লাবন শীতল চোখে তাকালো। মেয়েটা এত বাতাস থাকা স্বত্বেও কেমন ঘামছে। ভয় পেয়েছে কী বেশি!
প্লাবন আদুরে হাতে স্পর্শ করলো তিস্তার মাথায়। খুব যত্নে হাত বুলিয়ে নিবিড় ভরসায় বললো,
-‘আমি আছি তো। ভয় কিসের?’
“আমি আছি তো” কথাটিই যেনো তিস্তার ভয়কে গোড়া থেকে উপড়ে ফেললো। সে শান্ত হলো। বন্ধ হলো তার উৎকণ্ঠা। তার নিজের মানুষ তো আছে তার সাথে। তবে চিন্তা কিসের?
তিস্তা শান্ত হতেই প্লাবন ছুটে গেলো। শব্দ বিহীন পায়ে দৌড়ে গেলো।
তিস্তা তখনও নিরব চোখে চেয়ে রইলো জলের দিকে। চাঁদের আলোয় আজ স্নান করছে জল। মধুসখী কি সুন্দর! এত আকর্ষণীয়! এই সুন্দর মধুসখী’ই বুঝি জমিদারের প্রাণ ভোমরা প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী’কে কেঁড়ে নিয়েছিলো! মধুসখী আমাদের কিছু কাছের মানুষের প্রতিচ্ছবি যেনো। যারা ভীষণ সুন্দর আর উপর উপর ভালোবাসে আমাদের। কিন্তু অন্তরে তাদের ভীষণ হিংস্রতা।
মিনিট পাঁচ পেরুতেই ফিরে এলো প্লাবন। কিছুক্ষণ আগের আর এখনের প্লাবনের মাঝে ভীষণ তফাত। প্লাবন উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
-‘তিস্তা, তাড়াতাড়ি উঠ। বাড়ি ফিরতে হবে।’
-‘আপনি এমন করছেন কেনো? ওখানে কী দেখেছেন? কে ছিলো?’
তিস্তার ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে ভ্রম ভাঙে প্লাবনের। ধাতস্থ করে নিজেকে। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-‘কিছু হয়নি। চল, বাড়ি যাবো। তোর আর কয়েকদিন পর পরীক্ষা না? পড়াশোনাও তো মনে হয় সিকে তুলেছিস। আজ গিয়ে ঘুমাবি। কাল থেকে সব শুরু।’
তিস্তা হেসে মাথা নাড়ালো। মনে মনে বললো, “আপনার অপূর্ণতায় বিদ্বেষ তৈরী হয়েছিল পুরো দুনিয়ায়। আপনি এবার এসে গেছেন,আমার সব ঠিক হয়ে যাবে। কারণ আপনিই তো আমার দুনিয়া।’
প্লাবন ভাবছে অন্য কিছু। অন্যমনষ্ক তার মনোভাব। গ্রামে কী আবার নতুন কিছু হবে। এত রাতে এ মানুষটা এখানে যে?
_
আজ অনেকদিন পর আমান শেখ গ্রামের হাটে বসেছে। এখন সে প্রায় সুস্থ। কেবল হাঁটার সময় ধীরে হাঁটতে হয়। তিস্তাও আজ স্নান করে তৈরী হচ্ছে। আজ থেকে আবার মধ্যাহ্নের পড়াশোনা শুরু। মাস্টারমশাই আবার পড়াবেন। পড়তে হবে তাকে। নাহয় মাস্টারনী হবে কীভাবে?
তিস্তা গটগট পায়ে তৈরী হয়ে ছুটে গেলো পাঠশালার উদ্দেশ্যে। লতিকা বেগমও নাতনির পিছে ছুটলেন। তিনি নাতনির আচরণে রিতীমতো অবাক। এমন নষ্ট চরিত্রের মেয়ে এত মুক্ত ভাবে উড়বে তা যেনো সে মানতে পারছে না। সবার সামনে যখন মেয়েটাকে ঠাটিয়ে দু’টো চড় দিতে পারবে তখনই মেয়েটা শান্তি হবে। এর আগে না।
তনয়া বেগম শাশুড়ীকে মেয়ের পিছে ছুটতে দেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। শাশুড়ীর মতিগতি আজকাল তার ভালো ঠেকছে না। কেমন যেনো করে সে। পারে না তিস্তাকে খেয়ে ফেলে।
_
‘আপনার কাছে তো মেয়েছেলে পড়ানোর জন্য দিছিলাম, মাস্টারমশাই। আপনি নষ্ট মেয়েমানুষও পাঠশালায় রাখেন জানতাম না তো!’
প্লাবনের পাঠশালার এক ছাত্রীর মায়ের এমন কথায় তিস্তার ঝুঁকে থাকা মাথা আরেকটু ঝুঁকে গেলো। ডান বাম গাল ফুলে লাল হয়ে আছে, দাদীর শক্ত চড়ে। পাঠশালায় প্রবেশ করার আগেই লতিকা বেগম নাতনির চুলের মুঠি ধরেই নোংরা গালাগালি আর চড় থাপ্পড়ের বর্ষণ করে।
হৈ চৈ শুনে আশেপাশের মানুষসহ প্লাবন, বিষাদিনী সবাই বের হয়ে আসে। তনয়া কোনো মতে ছুটে এসে মেয়েকে আগলে নেয়। দাদীর নোংরা ভাষায়, আচরণে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে তিস্তার।
লতিকার আচরণে পাড়ার লোকও সাহস পেলো এবার। ছুঁড়ে মারলো তাদের নোংরা কথার অস্ত্র। প্লাবন উত্তর দেওয়ার আগে আরেক মহিলা এগিয়ে এলো। বিশ্রী গালি দিয়ে বললো,
-‘এ মেয়ের মুখে কালি লাগাইয়া পুরা গেরাম ঘুরা। ওর উড়ার স্বাধ মিইটা যাইবো।’
তিস্তার কান্না আসে। ভীষণ কান্না। মহিলার কথার পরিপ্রেক্ষিতে সবাই সম্মতি দিয়ে বলে উঠলো,
-‘হ,হ। এই নোংরা মাইয়ারে শাস্তি দেওয়া উচিত।’
মিনিট দুয়েক এর মাঝে কালি নিয়ে হাজির গ্রামবাসী। তিস্তার সামনে আসতে নিলেই রুখে দাঁড়ালো প্লাবন। ধিক্কার জানিয়ে বললো,
-‘ছিঃ! আপনারা মানুষ? এতটুকু মেয়েটার সাথে এমন আচরণ করতে বাঁধলো না আপনাদের? আপনাদেরও তো ঘরে মেয়ে আছে।’
প্লাবনের কথায় হেলদোল হলো না কারো। বরং তাদের সবচেয়ে সম্মানিত মাস্টারমশাই’র বিবেকহীন কথার জন্য তারা মুখ চোখ বাঁকালো।
ভীড়ের মাঝে একজন মহিলা বলে উঠলো,
-‘মাস্টারমশাই সরল সোজা মানুষ। উনি ভদ্রতা দেখাবেই। তুমি যাও তো, গিয়ে আচ্ছা মতন কালি লেপে দেও ঐ পতি’তার মুখে।’
চেনা কণ্ঠে এমন নোংরা কথা শুনে তিস্তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঘৃণার অনুভূতি বয়ে গেলো। কণ্ঠটা তার বড্ড চেনা। তাকে খুব যত্নে ভাত মেখে খাইয়ে দেওয়া বকুলের মায়ের কণ্ঠ এটা।
সবার সম্মতি পেয়ে যখন একটা মহিলা এগিয়ে যাচ্ছিলো তিস্তার দিকে, তখন তিস্তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ালো এক অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন নারী। ব্যাক্তিত্ব যেনো তার হিমালয় পর্বতের চেয়ে উঁচু। তার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হলো কিছু শব্দ কণিকা। এক দলা থু সমাগমের মাঝে ফেলে বললো,
-‘এ থুতু টা ফেললাম আপনাদের নোংরা মন মানসিকতার উপরে। কালি যদি মাখতেই হয় তবে আপনাদের মানসিকতায় মাখুন। এর চেয়ে নোংরা যে আর কিছু হতেই পারে না। পদ্মফুল দেখেছেন? গোবরে কিন্তু পদ্ম ফুল ফুটে। তাই বলে কী পদ্মফুলের পবিত্রতা নষ্ট হয়? তিস্তাও সেই পদ্মফুল। যার পবিত্রতা কখনোই নষ্ট হবে না।’
সমাগম থমকে গেলো। এমন প্রতিবাদী কণ্ঠ তাও আবার মেয়ে মানুষের,কখনোই দেখে নি তারা। থমকে গিয়েও দমে যায় না মহিলারা। বিষাদিনীকে বুঝানোর চেষ্টা করে বললো,
-‘তুমি শহুরে মেয়েমানুষ। তাই তো বিয়া না কইরা জামাইর ঘর দেখতে আইছো, থাকতাছো, খাইতাছো। তোমাগো শহরের নিয়ম কানুন আলাদা। গেরাম আর শহর কী এক হইলো? আর এ বিষয়ে তোমার কথা কেউই শুনবো না। ওরে শাস্তি না দিলে গ্রামে বালা লাগবো। অলক্ষী ঢুকবো গেরামে।’
বিষাদিনী তাচ্ছিল্য হাসলো। ডান ভ্রু টা উঁচু করে বললো,
-‘ওহ্ তাই না-কি! কথা শোনানোর বেলায় তো কাউকে ছাড়ছেন না আপনারা। আপনাদের চেয়ে বড় অলক্ষী বোধহয় আসবে না গ্রামে। আর যদি,আমার কথা না শুনে ওর শরীরে কেউ একটু স্পর্শ করে, তবে পুরো গ্রামের লোককে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াবো। আমার বাবা’র ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনাদের শাস্তি দিতে আমার এক মুহুর্তও লাগবে না। তা,আপনারা কী চান?’
এবার দমে গেলো মানুষ। শহরের মেয়ে,বাপ অনেক ক্ষমতাবান লোক। পরে সত্যিই যদি হিতে বিপরীত হয়!
এবার রাসেলের মা উচ্চস্বরে হাঁক ছেড়ে বললো,
-‘রাসেল,চল। এই মাস্টারমশাই’র বাড়িতে আর পড়তে হইবো না। যতসব নোংরামি।’
রাসেল তিস্তার সহপাঠী। এবার এক এক করে সব মহিলা রাসেলের মায়ের সাথে যুক্ত হলো। সবার এক কথা। কেউ তাদের ছেলেমেয়ে এখানে পড়াবে না।
এতক্ষণে মুখ খুললো তিস্তা। মাথা নিচু করে ধীর কণ্ঠে বললো,
-‘আমিই আর পড়বো না, মাস্টারমশাই। আপনি সবাইকে পড়ানো শুরু করুন।’
মাস্টারমশাই এর রুক্ষ স্বর ভেসে এলো। ধমক দিয়ে বললো,
-‘তুই পড়বি না কেনো? তোর কী সমস্যা? যাদের সমস্যা তারা না পড়ুক। কারো পড়ার প্রয়োজন নেই। তবুও তুই পড়বি।’
এবার মহিলারা কানাঘুষা শুরু করলো। মাস্টারমশাই এর বুঝি আক্কেল জ্ঞানের মাথা খেয়েছে!
হঠাৎ ভীড় ঠেলে একটা মেয়ে এগিয়ে এলো। মেয়েটি আর কেউ না, কঙ্কণা। মোড়লের মেয়ে।
সবাই ভাবলো এবার জমবে মজা। কঙ্কণা যা মেয়ে, ছাড় দিবে না তিস্তাকে।
কঙ্কণা তিস্তার দিকে এগিয়ে গেলো। তিস্তার চোখের জল ক্ষাণিকটা মুছে দিয়ে বললো,
-‘আমিও পড়বো মাস্টারমশাই। আমায় পড়াবেন না?’
সবাই যেনো ভুল কিছু শুনে ফেলেছে এমন মুখ ভঙ্গি করলো। কঙ্কণার মতন মেয়ে এসব বলছে!
তিস্তা নিজেও অবাকে হা হয়ে রইলো। আবারও ভীড়ের মাঝে আরেকটা কণ্ঠ ভেসে এলো। রিনরিনে কণ্ঠে সে বললো,
-‘মাস্টারমশাই, আমিও পড়বো। আমায় পড়াবেন না?’
তিস্তা আবার তাকালো ভীড়ের মাঝে। অস্ফুটস্বরে বললো,”বকুল!”
বকুলের মা নিজের মেয়েকে দেখে অবাক হলেন। পরক্ষণেই জ্বলন্ত শিখার ন্যায় জ্বলে উঠলেন। মেয়ের চুলের মুঠি টেনে বললেন,
-‘বড্ড পড়ার শখ হয়েছে না তোর? চল আজ বাড়ি। কিসের এত পড়াশোনা? তোর না বিয়ে ঠিক করেছি? মান সম্মান খেতে চাস আমাদের? চল, বাড়ি।’
বকুল দাঁত কিড়মিড় করে মায়ের হাতটা এক ঝটকায় চুল থেকে ছাড়িয়ে নিলো। রক্তবর্ণ দৃষ্টি মায়ের উপর ফেলে বললো,
-‘আমি পড়বোই। আমি অনেক বড় হবো। ঐ শহুরে দিদিটার মতন বড় হবো আমি। তোমাদের বাঁধা নিষেধ আর মানছি না। আমি শুধু মেয়ে মানুষ না মানুষের মতনও বাঁচতে চাই।’
বকুলের মা থমকে গেলেন। কাল অব্দি যে মেয়ে কথার উপর কথা বলে নি, আজ সে মেয়ে তেজ দেখাচ্ছে!এইতো, এভাবেই শুরু হলো যুগবদল। আর মানুষ এবার খবর ছড়ালো,’শহুরে মেয়ে মাথা খেয়েছে গ্রামের মেয়েদের। পড়াশোনা জানা মেয়ে সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর।’
“যুগবদলের পালা এলো,মানুষ হতে চায়,মেয়ে,,,
এভাবেই মানুষ হওয়ার মন্ত্র, সমাজে গেলো ছেয়ে।”
#চলবে
#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা
পর্বঃ বাইশ
“তুমি ভীষণ সুন্দর। শহরে যারা থাকে, তারা বুঝি এমন পরীর মতন হয়?’
বকুলের প্রশ্নে হেসে দেয় বিষাদিনী। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। অবশেষে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে,
-‘তোমরাও তো ভীষণ সুন্দর। তোমরা তো শহরে থাকো না, তবে এত সুন্দর কেনো?’
বকুল লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
-‘সত্যি আমরা সুন্দর!’
-‘হ্যাঁ, অনেক সুন্দর। তোমাদের সৌন্দর্যের কাছে আমি কেবলই তুচ্ছ।’
বকুল এহেন প্রশংসায় লজ্জায় নুইয়ে গেলো। কঙ্কণা মিটিমিটি হেসে ঠাট্টার স্বরে বলে,
-‘আরে বকুল,এত লজ্জা পাচ্ছিস যে? বিষাদিনী কন্যা তোর সাথে মজা করছে।’
বকুলের লজ্জা মিশ্রিত মুখে ভর করলো অবাক। কঙ্কণা’র কথা সে রীতিমতো বিশ্বাস করে অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললো,
-‘তুমি আমার ছোট্ট হৃদয় টা খন্ড খন্ড করতে পারলা শহুরে দিদি! এটুকু মেয়ের এটুকু হৃদয়টা’র সাথে এমন মজা?’
বকুলের কথার ধরণে আবার হেসে দেয় বিষাদিনী। তার তো হুটহাট হাসা’র স্বভাব না। তবে আজ এই সপ্তদশীদের সাথে মিশে এত চঞ্চলতা ভর করলো যে? কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাস আবার ফিরে আসছে যে?
তাদের হাসি ঠাট্টার মাঝে একজন থম মেরে বসে আছে। যার আপাতত এই হাসিখুশি মুহূর্তে মনযোগ নেই। তার কেবল কিছুক্ষণ আগের ঘটনা নিয়ে ভীষণ ঝড় হচ্ছে হৃদয়ে। হুটহাট অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে। অশ্রুকণাদের আর্তনাদ নেই বলে তা গোপনে রয়।
বিষাদিনী’র হাসি’রা হঠাৎ থেমে যায়। ধ্যান ভাঙে। সুতো ছিঁড়ে ভাবনার। তার সামনে মেয়েটা এমন চুপচাপ বসে আছে,আর সে কিনা হেসে যাচ্ছে!
বিষাদিনী উঠে এলো। তিস্তার সাথে থাকা জায়গা টুকু দখল করে বসলো। প্রায় ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
-‘কী প্লাবন দা’র উচ্ছ্বসিত প্রেয়সী,মন খারাপ কেনো?’
তিস্তারও এবার ধ্যান ভাঙলো। বাঁধ ভাঙলো কান্নার। বিষাদিনী’কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-‘আপন মানুষ কেনো বদলে যায় বুবু? আজ দাদী’র জন্য সবাই আমার মুখে চুন কালি ছিটানোর সাহস পেলো। কিন্তু আগে এই দাদী’র সামনে আমায় কেউ কিছু বললে তার রক্ষে থাকতো না। মানুষ গুলো বদলে না গেলে খুব বড় ক্ষতি হতো বুঝি?’
বিষাদিনী থমকায়। আসলেই,মেয়েটার দাদী আজ যা করলো তা সত্যিই আঁচড় কাটার মতন। এটুকু মেয়েটাকে কত কিছুই না সহ্য করতে হলো! অবশেষে গ্রামের মানুষ সিদ্ধান্ত নিলো,মাস্টারমশাই’র কাছে কোনো ছেলেমেয়ে পড়বে না। কিন্তু কঙ্কণা আর বকুল সে সিদ্ধান্তের বিপরীতে গেলো। ওদের সমবয়সী আরও কয়েকটা মেয়েও তিস্তার পক্ষে ছিলো। কিন্তু অভিভাবকদের নির্দয়তা’র কারণে টিকতে পারে নি। বকুল’ই তো কত মার খেলো। তবুও সিদ্ধান্তে ঠাঁই অটল রইলো। অবশেষে ওর মা সারাজীবনের মতন মেয়ের মুখ দেখবেন না পণ করে বাড়ি ফিরে গেলো।
বিষাদিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। নাহ্, এখন তার দুঃখ বিলাস করার সময় না। এই ছোট্ট মেয়েটা’কে বুঝাতে হবে। হতাশার শ্বাস ফেলে নতুন উদ্যমে বিষাদিনী বললো,
-‘এর জন্য কান্না করা লাগে? যে তোমার চোখের জলের কারণ, সে কখনোই তোমার আপন না। আপন মানুষ কখনো ব্যাথা দিতে পারে? বলো?’
তিস্তা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘নাহ্।’
-‘তবে! এত কান্না কিসের? কথায় কথায় কান্না করলে মানুষ নরম ভেবে খামচে যাবে। কেনো মানুষকে সে সুযোগ দিবে?’
এবার তিস্তার কান্না থামলো। হ্যাঁ, সত্যিই তো। মানুষকে কেনো কাঁদানোর সুযোগ করে দিবে সে? নাহ্, আর না। সে আর কাঁদবে না।
চোখের জল তৎক্ষনাৎ মুছে ফেললো তিস্তা। ফোলা ফোলা চোখ গুলো নিয়ে বিষাদিনী’র দিকে তাকিয়ে করুণ হেসে বললো,
-‘তুমি এত ভালো কেনো? আমি আরও ভেবেছি তুমি অনেক গম্ভীর হবে। এত ভালো হবে যে ভাবি নি।’
বিষাদিনী হাসে। আগের চেয়ে কণ্ঠ আরেকটু খাঁদে নামিয়ে বলে,
-‘কেনো? আগে খারাপ ভেবেছিলে বুঝি? তোমার মাস্টারমশাই’কে বিয়ে করবো বলে খারাপ হয়ে গিয়েছিলাম নাকি?’
তিস্তা চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই নারী কী সর্বজান্তা? মনের কথা জানলো কীভাবে?
তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে মিটিমিটি হাসলো বিষাদিনী। তিস্তার বাহুতে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বললো,
-‘কী ভাবছো? কীভাবে জানলাম তাই তো? তুমি তীব্র ভাবে ভালোবাসতে জানলেও ভালোবাসা’র সবটুকু বিশ্লেষণ জানো না। কোনো রমনী তার প্রিয় মানুষটার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না। তা সে রমনী প্রাপ্তবয়স্ক হোক বা তোমার মতন সপ্তদশী হোক। নিজের ভালোবাসার ভাগ কেউ দিবে না।’
তিস্তা মুগ্ধ হয়ে শুনে বিষাদিনী’র কথা। মানুষটার মাঝে এত তৃপ্ততা!
পরক্ষণেই তিস্তা মুগ্ধ কণ্ঠে বললো,
-‘তুমি না অনেক ভালো।’
-‘মাস্টারমশাই’কে যদি আমি নিয়ে যাই,বিয়ে করি, তখনও এমন বলবে তো?’
বিষাদিনী’র কথায় ভড়কে যায় তিস্তা। ভয় জাগে হৃদয় কোণে।
কঙ্কণা আর বকুলও এবার এগিয়ে এলো। বকুল’কে দেখে তিস্তা’র এক ভাবনা কেটে আরেক ভাবনার উদয় হলো। সাথে সাথে সে প্রশ্ন করলো,
-‘বকুল,তুই এখন কোথায় থাকবি? জেঠিমা যে তোকে বাড়ি যেতে না করলো?’
-‘কেনো,আমার সাথে থাকবে। ওর মায়ের কাছে এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ওর যে সদ্য প্রতিবাদী মনোভাব টা জন্মেছে তা ভোঁতা হয়ে যাবে তাহলে। ও নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে অবশ্যই। মেয়ে বলেই কী পিছিয়ে যাবে নাকি?’
বিষাদিনী’র কথায় সবাই অবাকে হা হয়ে গেলো। বকুল বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-‘সত্যিই তোমায় সাথে আমাকে রাখবে!’
বিষাদিনী মুচকি হেসে বকুলের গাল টেনে বললো,
-‘একদম সত্যি। তোমার থাকতে সমস্যা হবে না তো?’
বকুল জলে টইটুম্বুর হওয়া চোখ নিয়ে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বললো,
-‘একদম সমস্যা হবে না। তুমি যে আমার মাথার ছাদ হয়ে দাঁড়িয়েছো সেটাই অনেক।’
বিষাদিনী হেসে এবার কঙ্কণা’র দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে বললো,
-‘কী কঙ্কণা? তুমি কোথায় থাকবে? তোমার মা বাড়িতে প্রবেশ করতে দিবে তো? না-হয় আমার সাথে থাকতে পারো।’
-‘আমার তো নিজের মা নেই। তবে,বাড়িতে বাবা’র দ্বিতীয় পক্ষের বউ আছে। তার অবশ্য আমার সম্পর্কে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মোড়লের মেয়ে বলে সবাই ভাবে কী রাজকীয় ভাবে আমি থাকি। কিন্তু যার মা নেই, তার তো দুনিয়া অন্ধকার। এটা কী সাধারণ মানুষ বুঝে?’
বিষাদিনী’র বুকের বা’পাশে ক্ষাণিক মোচড় দিলো৷ মেয়েটা’র মা নেই?
হঠাৎ করে বিষাদিনী’র রাজ্যের মায়া জন্মালো কঙ্কণা’র জন্য। মেয়েটাকে জাপ্টে ধরলো বক্ষ মাঝে। মেয়েটার কী দারুণ কষ্ট! বকুল আর তিস্তাও জড়িয়ে ধরলো ওদের। মানুষের উপর দেখে ভিতর বিচার করা সত্যিই সম্ভব না।
____
রাত নেমেছে ধরণীর বুকে। বকুল আর কঙ্কণা রয়ে গেছে বিষাদিনী’র সাথে। কঙ্কণা’র বাবা অবশ্য সন্ধ্যার দিকে লোক পাঠিয়ে ছিলো কিন্তু কঙ্কণা যায় নি। রয়ে গেছে বিষাদিনী’র সাথে। মোড়ল সাহেব অবশ্য কোনো হেলদোল দেখান নি। মেয়ে যেভাবে চলতে চায় সেভাবেই চলে। এতে বিশেষ বাঁধা তিনি দেন না। দিয়েই বা লাভ কী? সংসারে দারুণ ঝামেলা ছাড়া বিশেষ কিছুই হবে না।
তিস্তাকে প্লাবন দিয়ে এসেছিলো। মেয়েটাও হয়তো থাকতো যদি কলঙ্কিনী না হতো।
আজকে আকাশে বড় রূপোর থালার মতন একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় বিষাদিনী কলমে ফুটিয়ে তুলেছে বিষাদ। আবারও দু’লাইনের কবিতা জ্বলজ্বল করছে সাদা কাগজটাতে। কী বেদনা সেথায়। সাথে দু ফোঁটা চোখের জল। বিষাদিনী লাইন গুলো আবার পড়লো,
“মানুষ দেখলো বিশাল হাসি,দুঃখ তো অন্তরে চাপা,,
ভীষণ অশ্রু না ঝড়লে,কষ্ট নাকি যায় না মাপা!”
যথারীতি পৃষ্ঠা টা ছিঁড়ে গুটিয়ে ফেললো হাতের ভাজে। ছুঁড়ে ফেললো জানালার বাহিরে। বিষাদ কমানোর নতুন উপায় যেনো এটা।
‘এভাবে বুঝি দুঃখ কমানো যায়?’
হঠাৎ চমকে উঠলো বিষাদিনী। অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘কঙ্কণা! ঘুমাও নি?’
কঙ্কণা এবার বিষাদিনী’র পাশে এসে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বললো,
-‘ঘুম যে আসে না। তুমি যে আমার ঘুম কেড়েছো।’
বিষাদিনী অবাক হয়। অবাক কণ্ঠে বলে,
-‘আমি ঘুম কেড়েছি! কীভাবে?’
কঙ্কণা হঠাৎ যেনো ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। শক্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আমার মাস্টারমশাই’কে কেড়ে নিতে চেয়ে।’
বিষাদিনী অবাক হয়। কঙ্কণার হঠাৎ এহেন পরিবর্তন কেনো? হঠাৎ করে গভীর রাতে এত হিংস্রতা কেনো?
#চলবে