মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই(২য় খন্ড),পর্বঃ এগারো

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই(২য় খন্ড),পর্বঃ এগারো
#মম_সাহা

বিষন্ন, ক্লান্ত বিকেল। আকাশটা আধাঁর না তবে ক্ষাণিকটা ঘোলাটে। আসমানী রাঙা পাঞ্জাবিটা আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে প্লাবনের চওড়া শরীরে’র সাথে। আসমানী’র সাথে শুভ্রা রঙের পাজামা’টা যেনো স্নিগ্ধ পুরুষের সৌন্দর্যতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

পর পর তিন জোড়া পা ব্যস্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের গন্তব্যে। এক জোড়া পায়ের মালিক প্লাবন। আরেক জোড়া পা তার মায়ের। আর আরও এক জোড়া কোমল নারী’র পা এগিয়ে যাচ্ছে। আর একটু পর বোধহয় ঝড় হবে, ভীষণ ঝড়। তার আগে বাড়ি পৌঁছাতে হবে যে দ্রুত।

জায়গাটা ঠিক সদর ঘাটের কাছাকাছি রাজকীয় এক বাড়ির সামনের বড় রাস্তা। বিশাল প্রাচুর্য ঘেরা এক মহল দেখা যাচ্ছে লোহার গেইটটার ভেতরে। দেশের রাজধানী বলে কথা, দু একটা দারুণ প্রদর্শন তো থাকতেই হয়।

প্লাবনের মা উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে প্লাবনের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘বাবু,এটা কিসের দালানরে! মহলটা তো রাজকীয়? নিশ্চয়ই কোনো ঐতিহাসিক জায়গা তাই না?’

প্লাবন হাঁটা থামিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তারপর হাঁপিয়ে উঠা ছোট্ট শ্বাসটা ফেলে সামনের বন্ধ দরজার উপাশে লাল মহলটার দিকে তাকিয়ে রয়। তার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। আজকাল মায়ের কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না। কিন্তু এ দিন দুনিয়ায় মা বড্ড একা তাই পারছে না সেই ইচ্ছে টা প্রকাশ করতে।

প্লাবনদের পাশে থাকা শাড়ি পরা অল্প বয়সের রমনী বোধহয় বুঝতে পারে প্লাবনের মনোভাব। সে দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই ঝড়ঝড়ে কণ্ঠে বলে উঠে,
-‘হ্যাঁ ফুপিমনি,এটা ঐতিহাসিক জায়গাই। আপনি হয়তো শুনেছেন আহসান মঞ্জিল সর্ম্পকে। এটা সেই মহল। এর প্রতিষ্ঠাটা নওয়াব আবদুল গণি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ্’র নামে এটার নামকরণ করে। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। দীর্ঘ অনেকদিনের যত্নে গড়া মহল এটা। ভিতরের পরিবেশ অসাধারণ। নবাবদের রাজকীয় চাল চলণের বেশ নিঁখুত প্রমাণ এটা। আপনাকে আমি বরং একদিন ঘুরতে নিয়ে আসবো। এখানে নবাবদেন স্নানাগার হতে বিশ্রাম কক্ষ অব্দি সব টুকুর জ্বলজ্বল সৌন্দর্যের নির্দেশন আছে৷’

প্লাবনের মা আশালতার চোখ দু’খানা কৌতূহলে ছলছল করে উঠে। তার চেয়ে বেশি সে গর্ববোধ করে নিজের পছন্দের উপর। মেয়েটা কত কিছু জানে! এমনি এমনি কী আর মেয়েটাকে তার মনে ধরেছে?

প্লাবন চুপ করে আর দু’কদম এগুতেই পিছন থেকে চিরপরিচিত ডাকটা ভেসে এলো। শহরে আসার পর ডাকটা যেনো বিলীনই হয়ে গিয়েছিলো। প্লাবন এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে পিছনে ফিরে তাকায়। ততক্ষণে ধুতি আর ঢিলে ফতুয়া পড়া বেশ বেটে, গোলগাল লোক এগিয়ে এসেছে। কালো চামড়ায় ছুটে আসার জন্য সদ্য জন্ম নেওয়া ঘাম উঁকি দিচ্ছে।

লোকটা প্লাবনের সামনে এসে হাতের উল্টো পিঠে মুখের ঘাম খানা বেশখানিকটা মুছে নিলো। হাত জোর করার ভঙ্গিতে বললেন,
-‘পেন্নাম নিবেন মাস্টারমশাই। তা,আপনার শরীর ভালা তো! আমারে চিনছেন? আমি হরপ্রসাদ ঠাকুর। ভ্রমরী’র জেঠতুতো ভাই।’

অকপটে নিজের পরিচয় গড়গড় করে মুখস্ত পড়ার মতন বলে থামলেন সিধেসাধা লোকটা। প্লাবন মলিন হাসলো। অবহেলার বাতাসে পথের ক্ষণিকটা মলিন ধূলোও উড়ে গেলো বোধহয়। আশপাশে তখন ঘোলাটে ভাবটা গভীর হলো। মানুষজন তেমন নেই৷ কিছু ফল ব্যবসায়ীর তাজা ফল গুলো একটু সজীবতা হারিয়েছে সারাদিনের তপ্ত রোদের উত্তপ্ততায়। তার সেই সামান্য অসজীব ফল গুলো গুটিয়ে নিচ্ছে তারা। বাড়ি যেতে হবে। অত রাত অব্দি বেচাকেনা করা যায় না এখানে।

প্লাবন ভদ্রতার সহিতে উত্তর দিলো,
-‘প্রণাম হরপ্রসাদ। তোমায় চিনবো না! কী বলছো এসব! কেমন আছো তুমি?’

মাস্টারমশাই এর প্রশ্নে হরপ্রসাদ বেশ খুশি হলো। যাক, তাকে এত বড় মানুষটা মনে রেখেছে সেটাই তো অনেক। খুশিতে জ্বলজ্বল করা চোখ খানা নিয়ে লোকটা বললো,
-‘ভালা আছি মাস্টারমশাই। আপনার কুশলাদি বলেন। ভালা আছেন! শহরে আইলেন কবে? কোনো কাজ আছে?’

প্লাবন ছোট্ট শ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘হ্যাঁ হরপ্রসাদ। আমার আম্মা একটু অসুস্থ হয়েছিলো তাই এসেছিলাম। তা তুমি এখানে তো কিসের যেনো কাজ করো তাই না?’

-‘হ মাস্টার। জেঠীমা, আপনি ভালা আছেন এখন?’

আশালতা দাম্ভিকতা বজায় রেখে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘হ্যাঁ ভালো আছি। তা বাবা আমার ছেলের বিয়ে এই সপ্তাহের শেষের দিন। শুক্রবারে। জুম্মার দিনে শুভ কাজটা করবো। তোমার দাওয়াত রইলো।’

মহিলার কথায় খানিকটা ভড়কে যায় হরপ্রসাদ। এতক্ষণে তার চোখ গেলো মাস্টারমশাই এর পাশে থাকা হালকা বেথুন রঙের শাড়ি পড়া সুন্দর,সুশীল মেয়েটার দিকে। মোটা এক বেণীগাঁথা তার চুলে। যে বেণীটা ডানপাশে এনে রাখা হয়েছে। একদম হাঁটু সমান। চোখে মোটা গাড়ো করে কাজল লেপ্টানো। মুখটা একটু লম্বাটে। মায়াবতী না হলেও বেশ রূপবতী। শরীরের শাড়ি আর সুগন্ধিটার সুগন্ধে বোঝা যাচ্ছে বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে। হরপ্রসাদ কিছুক্ষণ মৌন থেকে মাস্টারমশাই এর হবু অর্ধাঙ্গিনী’কে পরোখ করে বললো,
-‘ম্যালা সুন্দর বউ হইবো তাইলে আমাগো মাস্টারমশাই এর। তা বউ লইয়া’ই বুঝি গেরামে যাইবেন?’

-‘হ্যাঁ।’

হরপ্রসাদ আর কিছু বললো না কেবল নিরব দৃষ্টিতে তাকালো মাস্টারমশাই এর পানে। মাস্টারমশাই এর দৃষ্টি নিশ্চুপ,নিস্তেজ। হরপ্রসাদ যেনো কিছু প্রত্যাশিত কথা শুনতে চেয়েছিলো কিন্তু তা শুনতে না পেয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো। একটা তেঁতো ভাব খেলে গেলো তার শরীরে। আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে হলো না মাস্টারমশাই এর এত সুন্দর বধূর সামনে। দ্রুত বিদায় নিয়ে সে সোজা পথ ধরে হাঁটা ধরলো।

হরপ্রসাদ বলতে চেয়েছিলো তিস্তা’র নিখোঁজ হওয়ার খবর খানা কিন্তু মাস্টারমশাই এর দারুণ সুখে থাকার গল্প শুনে মিইয়ে গেলো সে ইচ্ছে। মাস্টারমশাই তবে বেশ ভালো আছেন। কিন্তু তিস্তা! সে কোথায়? মানতে পারবো তো এ খবর খানা?

সাধাসিধা হরপ্রসাদ এর মনে বিষাদের ছায়া নামলো। আজ থেকে প্রায় মাস তিন চার আগের কথা। সে শহরে কাজের ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো৷ তিস্তা ভ্রমরীর প্রাণপ্রিয় মানুষ ছিলো বলে তাদের বাড়িতে তিস্তার আনাগোনা বেশিই ছিলো।

একদিন হরপ্রসাদ সকালে গঞ্জের হাট থেকে সবে বাজার করে ফিরেছে। বাজারের জিনিসপত্র গুলো হেঁশেলে রাখার উদ্দেশ্যে যেতেই দূর হতে তিনজন রমনীর রিনরিনে হাসির শব্দ ভেসে এলো৷ একজন রমনী তার ঘরের বউ, বাকি দু’জন তিস্তা আর ভ্রমরী। হরপ্রসাদ কি ভেবে যেনো আর সামনে এগুলো না।

ইতিমধ্যে তার স্ত্রীর কথা ভেসে এলো। সে ঠাট্টার স্বরে বললো,
-‘দুইজনের তো গলায় গলায় ভাব। তা, বিয়ে কবে করবে দু’জন?’

ভ্রমরী ছটফটে উত্তর দিলো,
-‘আরও পরে। আগে অনেক পড়াশোনা করবো। তারপর বিয়ে করবো। তাই না তিস্তা?’

তিস্তা হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘হ্যাঁ। অনেক পড়াশোনা করবো।’

হরপ্রসাদ এর বেশ ছোটখাটো বউটা আবার বলে উঠলো,
-‘এত পড়াশোনা করে কী হবে? এ বয়সই তো বিয়ের বয়স। দেখো না আমার বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো।’

হঠাৎই তিস্তা লাজুক হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘এত পড়াশোনা করে আমি মাস্টারনি হবো। যেনো মাস্টারমশাই এর সাথে অনেক মানায়।’

কথাটা বলেই থমকে যায় সে। তারপর রান্নাঘরে হাসির বন্যা বয়ে যায়। হরপ্রসাদ এর বউ তিস্তার থুঁতনি ধরে আদুরে কন্ঠে বলে,
-‘ভালোবাসিস নাকি?’

তিস্তা জবাব দেয় না। তবে মুচকি হাসে। যে হাসিতে ছিলো মধুময় উত্তর।

হরপ্রসাদ সেই দিন গুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা যেনো কেমন আছে? কয়েকদিন আগেই তার বউ তাকে চিঠিতে জানিয়েছিলো তিস্তার নিঁখোজ হওয়ার কথা খানা। আজ চারদিন যাবত মেয়েটা নিখোঁজ। কিন্তু মাস্টারমশাই! সে কি সুন্দর হবু বউ নিয়ে ঘুরছে!

প্লাবন দ্রুত হেঁটে ঘাটের কাছাকাছি কাছাকাছি চলে এসেছে। রাত নেমেছে আকাশের বুকে। সামনে বিশাল বুড়িগঙ্গা নদী। যার অপরূপ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হবে যেকোনো মানুষ। পানি গুলো ভীষণ নীলাভ, স্রোতও ভীষণ নিবিড়। ঘোলাটে আকাশের ঝাপসা চাঁদের আলো নদীতে পড়াই চিকচিক করে উঠছে সে পানি। এর চেয়ে অসাধারণ, মনোমুগ্ধকর দৃশ্য যেনো হয় না। মোগলরা এ নদী’র মুগ্ধতায় ডুবেই ঢাকাকে রাজধানী করেছিলো।

কিন্তু এই মায়াবতী বুড়িগঙ্গাও মন ভুলাতে পারে নি প্লাবনের। তার সবকিছু কেমন বিষাক্ত মনে হচ্ছে। কতদিন হলো তিস্তা’কে দেখতে পারছে না। কেমন আছে সে জানেনা। মেয়েটা আগের মতন দুষ্টুমি করে তো? নাকি মাস্টারমশাই এর বিচ্ছেদে নিরব রয়? ছোট্ট চিরকুটটা পেয়েছে তো! এমন হাজার খানেক প্রশ্ন উত্তর বিহীন পোড়ায় তাকে। শান্তি মেলে না। তার উপর মা শহরে চিকিৎসার জন্য এসে তাকে কসম দিয়ে বিয়ের আসরে বসাতে চাচ্ছে। তারই মামাতো বোনের সাথে তার বিয়ে। কীভাবে আটকাবে বিয়েটা? নাকি, অপূর্ণ রবে তিস্তা প্লাবনের গল্প?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here