মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই💙,০৮,০৯

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই💙,০৮,০৯
#মম_সাহা
পর্বঃ আট

আজ কতদিন যাবত একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির জন্য ঘরের বাহিরে পা রাখা যাচ্ছে না। তিস্তা মুখ ফুলিয়ে পাঠশালার বাহিরে তাকিয়ে রইলো। বরাবরই তার বৃষ্টি প্রিয় কিন্তু এখন বৃষ্টিতে তার রাজ্যের ভয়। বৃষ্টি হচ্ছে আর মধুসখী একটু একটু বাড়ছে। না চাইতেও মন কু ডাকছে। বাহিরের বৃষ্টিময় দৃশ্য টা অবশ্য তার খারাপ লাগছে না। ভিজে মাটি,সিক্ত পাতা। এ জেনো মনোরম কোনো দৃশ্য। যা সারাদিন দেখলেও শেষ হবে না।

মনের মাঝে আজগুবি ভাবনার ভাঁটা পড়লো মাস্টারমশাই’র ভরাট কণ্ঠে। সে গম্ভীর কণ্ঠে তিস্তার উদ্দেশ্যে বললো,
-‘বাহিরে কী দেখছিস তিস্তা? দু’দিন পর তোদের মাধ্যমিক পরীক্ষা। আর তুই বাহিরে তাকিয়ে আছিস! পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই?’

তিস্তার ধ্যান ভাঙে। মাস্টারমশাই’র দিকে তাকায়। মাস্টারমশাই আগে থেকে কেমন যেনো একটু শুকিয়ে গেছেন। দুশ্চিন্তায় চোখের নিচে কালি জমেছে যেনো। আজ প্রায় পাঁচদিন যাবত মাস্টারমশাই এর মায়ের শরীরটা ভালো নেই। মা ছাড়া তো আর কেউ নেই তার, তাই দুশ্চিন্তায় নিজের শরীরে আঁচড় কেটেছে অবহেলা।

তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো মাস্টারমশাই। রাশভারী কণ্ঠে বললো,
-‘তুই এখনই পাঠশালা থেকে বের হয়ে যা। পড়াশোনা না করলে এখানে আসবি না। যা, বের হ।’

তিস্তা অবাক হলো। মাস্টারমশাই এর মন মেজাজ খারাপ তা নাহয় সে জানে, তাই বলে সামান্য কারণে বের করে দিবে? আজব!

তিস্তা উঠে দাঁড়ালো নতজানু হয়ে বললো,
-‘আর বাহিরে তাকাবো না। এবারের মতন ক্ষমা করুন।’

মাস্টারমশাই আর কিছু বলেন নি। আজকাল যে তার বড্ড ভয় হয়। ভ্রমরী মারা যাওয়ার পর গুনে গুনে আঠারো দিন পাড় হয়েছে। আর অবাকবশত এই আঠারো দিনের মাঝে পুরো গ্রাম ভুলে গেছে ভ্রমরী নামক মেয়েটার কথা। সেই বিভৎস দৃশ্যের কথা। তিস্তাও আজকাল মোড়লের ছেলে মাহিনের সাথে বেশ ভাব জমিয়েছে। সে ছেলে ডাক্তার হলেও বেশ অসাধারণ ভাবে মিশে যায় বাচ্চা,বুড়ো সবার সাথে। এটাই প্লাবনকে অতিষ্ট করে দিচ্ছে।

হঠাৎ নিরবতা ভেঙে কঙ্কণা তিস্তার দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে বলল,
-‘তোর জন্য নাকি বিয়ের প্রস্তাব এসেছে? পরীক্ষায় বসবি না তাহলে?’

পুরো নিশ্চুপ ঘরখানায় টিনের বৃষ্টির শব্দ’কে ছাপিয়ে কথাটা যেনো মাস্টারের মস্তিষ্ক হতে হৃদপিণ্ডে তড়িৎ-গতিতে পৌঁছালো। বাহিরের ঝড়’কে পাল্লা দিয়ে শরীরের ভেতরে এক ভয়ঙ্কর তান্ডবলীলা শুরু হলো। সে ঝড় যেনো হঠাৎ করেই মাস্টারমশাই এর ভীত হৃদয়কে ভেঙে চৌচির করে দিলো। ঝড়ের পর,ভয়ঙ্কর বন্যায় হয়তো ডুবে যাবে হৃদয়খানা।

কঙ্কণার কথায় বিরক্তি প্রকাশ করলো তিস্তা। অসহ্য রকমের বিরক্ত ছুঁড়ে ফেললো কঙ্কণা’র মুখে। অসন্তোষজনক কণ্ঠে বললো,
-‘তুই কী সারাদিন আমার খবর নিয়ে বেড়াস কঙ্কণা? তোর কী আর কোনো কাজকর্ম নেই?’

কঙ্কণা মুখ ভেংচি দিলো। প্লাবনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘দেখেছেন মাস্টারমশাই,এ মেয়ের মাথায় এখন এসব ঘুরছে বলেই পড়াশোনায় মন নেই। কাউকে জানাতে চাচ্ছে না বিয়ের কথা।’

তিস্তা কঙ্কণার এমন অহেতুক কথায় বিরক্ত হলো। হ্যাঁ, পরশুদিন তার জন্য পাশের গ্রাম থেকে একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো ঠিকই কিন্তু তার বাবা তো সাথে সাথে না করে দিয়েছে। তবে, এটা নিয়ে এত মাতামাতির কী হলো?

মাস্টারমশাই তিস্তার মুখে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তিস্তা তো তাকে সব বলতো, তাহলে এটা বললো না কেনো? পর করে দিচ্ছে মেয়েটা তাকে? হুটহাট যে মেয়েটা আনমনে তার কাছে অদ্ভুত বায়না ধরে, সেটা কী তবে কেবল বয়ঃসন্ধির প্রভাব? মেয়েটার কেবল আবেগ হয়ে রইলো সে!

এমন হাজার খানেক গোপন প্রশ্ন নিয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো মাস্টারমশাই। হয়তো তাকে এ কথাটা বলতে ভুলে গেছে মেয়েটা। নানান তালবাহানা দিয়ে নিজের মনকে শান্ত করলো সে। কঙ্কণার দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-‘তুমি কীভাবে জানলে এ খবর? তিস্তা তো নিশ্চয় তোমাকে বলে নি।’

মাস্টারমশাই এর প্রশ্নে কঙ্কণা মনে মনে খুশি হলো। তার ধ্যান পাওয়ার জন্যই তো এই কথাটা তুলেছিলো। কঙ্কণা বেশ রসালো কণ্ঠে বললো,
-‘আমার বড়ভাই বলেছে। মাহিন ভাই এর সাথে তিস্তার তো বেশ ভাব। হয়তো তিস্তা মাহিন ভাইকে বলেছিলো, সেটাই পরে মাহিন ভাই কথায় কথায় আমাকে বলেছে।’

ব্যাস,আগেরপরের কোনো কথা মাস্টারমশাই এর কর্ণ অব্দি পৌঁছায় নি মাহিন নামটার পরে। এতটা পর হয়ে গেলো সে? এখন সব কথা মাহিন জানে কিন্তু সে জানেনা! এত ভাব মাহিনের সাথে?

অপরদিকে তিস্তার মনঃক্ষুণ্ন হলো। সে তো মাহিনকে যেচে বলে নি। মাহিন সাহেবই তো জিজ্ঞেস করেছিলো তাদের বাড়িতে এত মেহমান কেনো এসেছে। তখনই তো সে বলেছে। নাহয় কী বলতো? মাস্টারমশাইকেই তো সব বলে। এছাড়া কাউকে বলে না কোনো বিষয়। এখন মাস্টারমশাই এর মন মেজাজ খারাপ তাই বলে নি।

প্লাবনের মনটা হঠাৎ থিতিয়ে গেলো। ভীষণ তিক্ততা ছড়িয়ে গেলো শিরায় শিরায়। আর ভালো লাগছে না কিছু। দাঁড়িয়ে থাকাটাও কেমন অসহ্য লাগছে। কোনো মতে কাঠের চেয়ারটাই গিয়ে বসলো সে। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,
-‘আজ সবার ছুটি। বাড়ি গিয়ে পড়তে বসো। কিছুদিন পরই মাধ্যমিক পরীক্ষা। সবার তো আর তিস্তার মতন বিয়ে হবে না, তাই সবাই পড়ায় মন দেও।’

মাস্টারমশাই এর এমন কথায় বুকভার করা অভিমান জাগলো সপ্তদশী কন্যার। তার কি বিয়ে হবে নাকি? এ বয়সের মেয়েদের একটু আধটু তো বিয়ের সম্বন্ধ আসেই। পুরো ঘটনা না জেনেই মাস্টারমশাই সবসময় এমন করে।

ছুটির কথা শুনতেই সকল ছাত্রছাত্রী ছুট লাগালো। তিস্তা সবার শেষে ধীরে ধীরে ঘরের বাহিরে যেতে নিলেই মাস্টারমশাই এর খোঁচা মারা কণ্ঠ ভেসে এলো,
-‘তা কবে বিয়ে? দাওয়াত দিবি না?’

তিস্তা একটু থমকালো ৷ মাস্টারমশাই না জেনে এমন করে কেনো? মনের মাঝে একটা শক্তপোক্ত রাগ হলো। মুখটা শক্ত করে বললো,
-‘দাওয়াত দিবো না কেনো, অবশ্যই দিবো। খুব শীগ্রই পাবেন দাওয়াত।’

কথা শেষ হওয়ার সেকেন্ডের মাথায় বিশাল এক চড় পড়লো ডান গালে। মাথাটা ঝিমিয়ে এলো। শরীরের প্রতি শিরা কেঁপে উঠলো। মাস্টারমশাই এর হুঙ্কার ভেসে এলো,
-‘এ বয়সে এত বিয়ে করার শখ তোর? কত বয়স তোর? হ্যাঁ, কত বয়স! সারাদিন এ পাড়া ঐ পাড়া, এ ছেলে ঐ ছেলের সাথে উড়নচণ্ডী পানা করেও শখ মিটে না? আবার বিয়ে করবি? কিসের বিয়ে করবি এ বয়সে?’

তিস্তা খানিকটা কেঁপে উঠলো। অভিমান জমলো ছোট্ট মনের কোণে। আহত স্বরে বললো,
-‘কী বলছেন এসব, মাস্টারমশাই!’
-‘কী বলছি তুই বুজিস না? আর, এই, এই মেয়ে, তোর মাহিনের সাথে এত কী? ওর সাথে এত কিসের ঘুরঘুর? তোর হাত পা ভে’ঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো। এখন সব কথা মাহিনকে বলা হয় তাই? এত আপন ও!’

তিস্তার অশ্রু বাঁধ মানলো না। তিস্তা মুখ ঘুরিয়ে বললো,
-‘আপনি অনেক খারাপ মাস্টারমশাই। অনেক খারাপ। আমি আর আপনার মুখও দর্শনও করতে চাই না। কখনো না।’

প্লাবনের জ্বলন্ত অগ্নি শিখার ন্যায় রাগটা হঠাৎ ই শীতল বরফে পরিণত হলো। তার মুখদর্শন করতে চায় না মেয়েটা? সে এত খারাপ!

মাস্টারমশাই দু পা পিছিয়ে গেলো। কাঠের চেয়েরটাই বসে পড়লো বিনা শব্দে। তিস্তা ছুটে দরজা অব্দি চলে গেলো। কিন্তু বের হলো না। কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। নিজেকে ধাতস্থ করলো। মাস্টারমশাই এর দিকে না তাকিয়েই বললো,
-‘আমার কোনো বিয়ে ঠিক হয় নি। কেবল প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো। ডাক্তারকে আমি এটা বলি নি। সে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলো এত মেহমান কেনো এসেছে, তাই আমি বলেছিলাম। আপনার কতদিন ধরে মন খারাপ চাচীর অসুস্থতার জন্য তাই আপনারেও বলি নি। আপনি সবসময় কঙ্কণার কথা শুনেন। আর কখনো আসবো না আমি। কখনো না।’

প্লাবন কেবল চুপ করে বসে রইলো। কেমন যেনো অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো নিজের উপর। সে সত্যিই খারাপ?

_______

স্কুল প্রাঙ্গণে তিস্তা প্রায় ঘন্টাখানেক হলো এসেছে কিন্তু আজ মাস্টারমশাই এর দেখা পায় নি। হয়তো স্কুলে আসেন নি। কাল বাড়ি আসার পর আর মাস্টারমশাই এর সাথে দেখা হয় নি। সে আর বাহিরে বের হয় নি। কাল সারাদিন বৃষ্টি থাকলেও আজ আকাশ পরিষ্কার। রৌদ উত্তপ্ত।

মন মরা হয় সবটা ক্লাস করলো তিস্তা। মাস্টারমশাইকে কাল কত গুলো খারাপ কথা বলেছে সে। এজন্য মাস্টারমশাই তাকে আর পড়াবে তো? নাকি সত্যিই আর তার মুখদর্শন করবে না?

এমন ছয় নয় ভেবে পুরো সকালটা পাড় করলো সে। কারো সাথে কোনো কথা বলে নি। ছুটি দিতেই সোজা বাড়ি চলে গেলো। দ্রুত স্নান করে তৈরী হলো পড়তে যাবে বলে। আজ একটু সেজেছেও। মাস্টারমশাই এর পা ধরে ক্ষমা চাইবে দরকার হয়, তবুও সে মাস্টারমশাই এর কাছে পরবে।

নিজের উড়ন্ত মনে দ্রুত তৈরী হয়ে উঠোনে ব্যাগ নিয়ে আসতেই তনয়া বেগমের কণ্ঠ ভেসে এলো। সে বিষ্ময় মাখানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কোথায় যাচ্ছো তিস্তা?’

তিস্তা খানিক বিরক্ত হলো। প্রতিদিন এ সময়ে কোথায় যায় সে, মা জানে না? তবুও জিজ্ঞেস কেন করছে! বিরক্ত হয়ে সে বললো,
-‘পড়তে যাচ্ছি।’

তনয়া বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘কার কাছে পড়তে যাচ্ছো? তোমার মাস্টার তো বাড়িতে নেই।’

মায়ের কথা কর্ণকুহরে পৌছুতেই তিস্তার কপাল কুঁচকে গেলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘বাড়িতে নেই মানে? কোথায় গেছে?’

তনয়া বেগম বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-‘কেনো তুমি শুনো নি, তার মা যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে! তারা তো আজ ভোরে শহরে গেছে। বড় ডাক্তার না দেখালে তার মা মারা যাবে। অনেক চিকিৎসার প্রয়োজন। আর হয়তো গ্রামে আসবে না। চিকিৎসার জন্য তারা প্রবাসে যাবে মনেহয়।’

তিস্তা একটু থমকালো। মাস্টারমশাই শহরে গেছে? তাকে একবারও বলে গেলো না যে? মাস্টারমশাই কী তবে তাকে আর দেখবে না?

ছোট্ট মেয়েটার বুকের মাঝে বিষন্নতার পাহাড় নামলো। সে ছুুটে বেরিয়ে এলো মাস্টারমশাই এর বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পিছন থেকে তনয়া বেগম ডাকলেও শুনলো না। সে মানে না, মাস্টারমশাই তাকে না বলে চলে যাবে।

মাস্টারমশাইদের সদর দরজাটা বাহির থেকে ছিটকানি দেওয়া। তালা লাগানো না। দরজা টা খুলতেই ফাঁকা বাড়ি চোখে পড়লো তিস্তার। কাক পক্ষীও নেই বাড়িটাই। ধূ ধূ মরুভূমি যেনো। তিস্তা হঠাৎ খেয়াল করলো, এ বাড়িটার মতন তার হৃদপিণ্ড টাও খালি। চোখের কোণে বাঁধ মানলো না অশ্রুকণা। ক্ষেতের সরু মাটির পথটা দিয়ে ছুট লাগালো তিস্তা। মাস্টারমশাই এর নিশ্চয় অনেক অভিমান জমেছে। তাই তো তাকে বলে যায় নি। কবে আসবে মাস্টারমশাই? আর আসবে তো?

তিস্তার মনে পড়লো, প্রায় দু’বছর আগে ঠিক এ পথটাতেই দেখা হয়েছিলো এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল ওয়ালা, স্নিগ্ধ পুরুষের সাথে। মধ্যাহ্নেই আগমন হয়েছিলো মাস্টারমশাই এর। তবে, দু বছর পর তার বুকের বা’পাশ খালি করেই সে মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই চলে গেলো! একরাশ বিষন্নতার সমুদ্রে ডুবাতেই বুঝি এসেছিলো মানুষটা! আর আসবে তো এমন উত্তপ্ত মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই? নাকি অতিথি পাখির মতনই সে দেখা দিয়েছিলো!

মাস্টারমশাই এর পড়ার ঘরখানায় দমকা বাতাসে টেবিলের উপর থেকে একটা ছোট্ট চিরকুট পড়ে গেলো। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ছিলো,
-‘তিস্তা, যার মুখ হৃদয়ে অঙ্কিত, তাকে কীভাবে দর্শন না করি! আমি ফিরবো, কোনো মধ্যাহ্নে। অপেক্ষা করিস। করবি তো অপেক্ষা!

আমি ফেলে যাচ্ছি সপ্তদশীর কন্যাকে,
হৃদয় মাঝে যে প্রতিনিয়ত বসন্ত আকেঁ।’

তাড়াহুড়োতেও চিরকুট লিখতে ভুলে নি মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই। কিন্তু এ চিরকুট খানা যে সে অব্দি পৌঁছাতে পারলো না। তবে কী এক স্নিগ্ধ মধ্যাহ্নের শুরু হওয়া গল্প, এক বিষন্ন মধ্যাহ্ন দিয়েই শেষ হবে!

#চলবে

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা

পর্বঃ নয়

ভীষন যত্নে বিষন্নতা মাখানো দিন দুই পাড় করলো তিস্তা। মাস্টারমশাই ছাড়া কেবল মাস্টারমশাই এর বাড়িটা না, এ গ্রামের রাস্তা, স্কুলের মাঠ, মধুসখী’র ঘাট, তিস্তার পাড়, আর সপ্তদশী’র হৃদয় খানা যেনো হাহাকার করে উঠছে। এ কেমন যন্ত্রণা! এ কেমন রিক্ততা? পুরো দুনিয়া যেনো ধূ ধূ মরুভূমি। গ্রীষ্মের চৌচির হওয়া পুকুরের মতন ভীষণ খড়া পড়েছে হৃদয়ে। ইশ, একটু বৃষ্টি, একটু প্রিয় মানুষের দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণায় ছোট্ট লাল হৃদয়টা বিষন্নতায় নীল হয়েছে। বেদনার রঙ যে নীল!

চারদিকে আধাঁর করা সন্ধ্যা নেমেছে। তিস্তার রুমের দরজাটা হা করে খোলা। চাঁদ উঠেছে আকাশে। বেশ বড়সড় চাঁদ। রাত হলে বিদ্যুৎ থাকে না। এইতো বছর পাঁচেক আগে গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। কেবল নামের আসা আরকি। দিনের বেলায় সূর্য তার উদার হস্তে দু’হাত ভরে অনেক আলো দান করে। আর তখনই ঘরে ঘরে কৃত্রিম আলো মানে বিদ্যুৎও থাকে। কিন্তু যেই সূর্য ঢেকে যায় আধাঁরে তখনই কৃত্রিম আলোও চলে যায়। বিদ্যুৎ টা ঠিক সুসময়ের বন্ধু প্রবাদটার উদাহরণ হয়েছে।

গ্রীষ্মকালের দিনের উত্তপ্ত রোদ টিনের চালে পড়ে ঘর গরম হয়ে থাকে। রাত হলে ধীরে ধীরে সে গরম কেটে যায়। ঠান্ডা ভাব আসে। তবে আজ চারদিকে বাতাস নেই। কেমন থম মারা আবহাওয়া। তিস্তা হঠাৎ অনুভব করলো পাশের রুম থেকে বাবা,দাদী আর আম্মার কেমন যেনো ফিসফিস কণ্ঠ ভেসে আসছে। তিস্তা কান খাড়া করলো। আজকাল সবাই যেনো তার গোপনে কিছু বলে। কেনো? কী এমন কথা আছে যে সে জানতে পারবে না?

কোনো বাহ্যিক শব্দ না থাকায়, পাশের রুম থেকে কথা গুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তিস্তার মা রুক্ষ স্বরে বলছে,
-‘না,আমার মেয়ে এখনো ছোট। পাত্র যত সুপুরুষই হোক না কেনো বিয়ে দিবো না।’

তিস্তার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে। তার বিয়ের কথা হচ্ছে কেন আজকাল? সে কাউকে বিয়ে করবে না। মাস্টারমশাই যে অনেক রাগ করবে তার উপর।

তিস্তার ভাবনার মাঝে দাদীর গলা ভেসে এলো। সে বুঝানোর চেষ্টা করে বলছে,
-‘মাইয়া মানুষ পাড় করা হইলো বড় দায়িত্ব। কার, কী, কখন হইয়া যায় কে জানে! এর আগে ঘাঁড় থেকে বোঝা নামানো ভালা।’

-‘আম্মা,আপনি উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। আমার মেয়েটা ছোট। আর এসব ও শুনলে কষ্ট পাবে। এ কথা ওর কান অব্দি যেনো না পৌঁছায়।’

তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। যাক, বাবা মা তো তার পক্ষেই। হঠাৎ দাদীর হেয় কণ্ঠে বলা কথা ভেসে এলো,
-‘মাইয়া মানুষ হইলো অল্প সময়ের অতিথি। তাগোরে কয়েকবছর যত্ন কইরা পাইলা মাইনষের হাতে তুইলা দেওয়া হইলো উচিৎ কাম।’

-‘আমি তো আমার তিস্তাার মাঝে আপনারে দেখি আম্মা। মেয়ে মানুষ অল্প সময়ের অতিথি কেনো হবে? মেয়ের মাঝে যেখানে আমি আমার মা’কে দেখি!’

তিস্তার চোখ গড়িয়ে সামান্য অশ্রুকণা বালিশের উপর পড়লো। জল গুলো শুষে নিলো নরম তুলোর দল, দাঁগ রেখে দিলো বালিশের কভার খানা। জীবনও ঠিক এমনই। কেউ ক্ষত মুছানোর চেষ্টা করে, আর কেউ আমাদের ত্রুটি গুলো যত্নে রেখে দেয়। সারাজীবন আমাদেরকে সেই ত্রুটি মনে করিয়ে আমাদের মুক্ত হয়ে উড়ার ডানা গুলো কেটে দেয়।

তিস্তা পাশের বালিশটা নিয়ে মুখের উপর চেঁপে ধরলো। কান্না গুলো যেনো দরজা পেরিয়ে পাশের ঘরে না যেতে পারে। তার চোখের জল যেনো না ঝরে তাই নিয়ে বাবা-মায়ের কত চিন্তা, আর সে এমন অশ্রু বিসর্জন করছে দেখলে তাদের কতটা না কষ্ট হবে!

প্রনয় মানে এক ঝাঁক বিষন্নতা। বালিশে মুখ চেঁপে কান্নার নাম প্রনয়। মুখে হাসি রেখে ভিতরে অনলে পু’ড়ে যাওয়া হলো প্রনয়।

সপ্তদশী বুঝে, মাস্টারমশাই এর জন্য হওয়া অনুভূতি গুলো তাকে আজীবন এক ব্যাথাময় সুখ দিবে। কী লাভ তবে এত ভেবে! নীল রঙটা বেছে নিয়েছে তো সে নিজ ইচ্ছায়। আর সামান্য বেদনা সহ্য করতে পারবে না?

______

‘আজকাল তোমার কী হয়েছে? খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছো দেখি! সারাদিন জানালার শিকলটা ধরে কাটিয়ে দিচ্ছো। পরীক্ষা যে সামনে মনে আছে?’

মায়ের কথায় ধ্যান ভাঙে তিস্তার। মৃত দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকায়। তনয়া বেগম এগিয়ে আসে। একটু আগে রান্না শেষ হলো। গরম ভাত আর গরম ডালের সাথে বড় মাছের এক টুকরো ভাজি নিয়ে মেয়ের রুমে এসেছেন। মেয়েটা আজকাল কেমন মন খারাপ হয়ে থাকে।

মায়ের মুখখানা লাল হয়ে আছে গরমে। তিস্তা একটু নড়েচড়ে বসলো। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বললো,
-‘না তো আম্মা,কী হবে আমার! কিছুই হয় নি।’

তনয়া বেগম চৌকির উপর বসলেন। ভাত মাখিয়ে মাছের কাটা বেছে মেয়ের মুখের সামনে এক লোকমা ধরে বললেন,
-‘আমি তোমার পেট থেকে হয় নি, তুমি আমার পেট থেকে হইছো। আজকাল কথা লুকাতেও শিখেছো। তা স্কুল যাও না কেনো?’

তিস্তা ভাতটা মুখে নেয়। চুপ করে থাকার মোক্ষম মাধ্যম এটা।

তনয়া আবার মাছের কাটা বাছতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কাটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
-‘আবেগের বয়সে আবেগ দেখাতে গিয়ে বিবেকের কাছে লজ্জিত হইও না। মেয়ের জাত এমনেতেই দুর্বল ভাবে মানুষ। তার উপর যদি আবেগ ধরে বসে থেকে সব জলাঞ্জলি দেও তাহলে তুমি মূর্খ। যা হচ্ছে তা বদলানোর সাধ্যি তোমার না থাকলে তা নিশ্চুপে হতে দেও আর নিজের কাজ নিজে করে যাও।’

তিস্তা জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মা কী তবে কিছু বুঝে গেলো?

কোনোমতে সে ভাতটা গিলে নিলো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আরে না আম্মা। তুমি ভুলভাল বলছো। কয়দিন পর পরীক্ষা তো, তাই আমি পড়াশোনায় মন বসাতে চাইছি। স্কুল গিয়ে আর কী হবে? সব পড়া তো দাগানো শেষ। এখন বাড়িতে পড়বো। আর মাস্টারমশাইও তো নেই।’

মাস্টারমশাই এর কথা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই কথা থেমে গেলো তিস্তার। মাস্টারমশাই নেই! কে বলেছে নেই? সবসময় স্ব শরীরে থাকাকেই থেকে যাওয়া বলে? না থেকেও যে সারাটা সময় ভীষন গভীরে লেপ্টে থাকে, তাকে থাকা বলে না?

তনয়া বেগম আর কিছু বললেন না। মেয়েকে চুপচাপ খাইয়ে দিলেন। এঁটো থালাটা নিয়ে উঠে দরজা অব্দি গিয়ে ফিরে তাকালেন। বেশ শীতল কণ্ঠে বললেন,
-‘ভালো নাম্বার না করলে মাস্টারমশাই রাগ করবে। তুমি কী চাও, তোমার মাস্টারমশাই অন্য লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসুক রাগ করে?’

তিস্তা উত্তর দেয় না। কেবল ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। মা কি বললো? অন্য বউ মানে!

তনয়া বেগম চাপা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের মন মেয়েকে না বুঝলে কাকে বুঝবে?

_____

বাহিরে রাতের আঁধারে হুতুম পেঁচা ডাকছে। রাতের বিভীষিকাময় আঁধারকে আরও একধাপ ভয়ঙ্কর অবস্থায় রূপান্তরিত করছে এ ডাক।

হারিকেনের আলোটা উঠোনের মাঝে নিভু নিভু ভাবে জ্বলছে। পিঁড়ি পেতে বসে আছে তিস্তা তার বাবার ফেরার অপেক্ষায়। লতিকা বেগম ক্লান্ত হাতে, তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। তনয়া দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

দূর হতে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। লতিকা বেগম বাতাস করতে করতে বললেন,
-‘যা তিস্তা, ঘরে গিয়া ঘুমা। এত রাতে মাইয়া মাইনষের বাইরে থাকতে নাই।’

তিস্তা দাদীর কথায় একটু বিরক্ত হলো। সবার বাবার জন্য চিন্তা হচ্ছে আর দাদী কিনা আজগুবি ভাবনায় ব্যস্ত।

তনয়া বেগম নিজের মেয়ের অভিব্যক্তি বুঝলেন। ছোট্ট কণ্ঠে বললেন,
-‘থাক না আম্মা। উনি আসলে নাহয় যাইবো।’

দাদী আর কিছু বলতে যাওয়ার আগে হুড়মুড় করে তাদের বাড়িতে কেউ প্রবেশ করলো। ভড়কে গেলো তারা তিনজন। দাদী ভীত কণ্ঠে বললো,
-‘কে? কে রে?’

ব্যতিব্যস্ত এক পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বললো,
-‘চাচী, আমি। আমি আলতাফ।’

সবাই একটু ধাতস্থ হলো। তাদের প্রতিবেশী চাচার ছেলে আলতাফ। দাদী বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আঃ মরণ। দাম’ড়া হইছোছ কী বাতাসে? এমন কইরা কেউ আহে?’

লোকটা যেনো গায়ে মাখলো না দাদীর কথা। কেবল উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
-‘আহা চাচী, আপনারা আমার সাথে বাজারে চলেন। তাড়াতাড়ি।’

এই সময় এমন কথা শুনে সবাই বিস্মিত হয়। দাদী অবাক কণ্ঠে বলে,
-‘এই রাইতে আমরা বেডি মানুষ গঞ্জের হাটে গিয়া কী করমু? নেশা করছোছ নাকি রে ছেমরা?’

ছেলেটা নিজের কণ্ঠে আকুতি ঢেলে বললো,
-‘না চাচী। আপনাগো সর্বনাশ হইছে। আমান ভাই এর পরাণ যে যায় যায় অবস্থা। বড় পথ দিয়া আসার সময় তার সাইকেল নাকি গাড়ির লগে ধাক্কা খাইছে। পা’টা শেষ। জানটা না আবার চইলা যায়। তাড়াতাড়ি চলেন।’

কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতেই সবার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। ভুল শুনছে না তো? হুতুম পেঁচা’র কু ডাক বুঝি সত্যি হলো!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here