#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি,পর্ব ১৪
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও দুই সপ্তাহ। আজ প্রিয়কের দেশে ফেরার দিন। সব থেকে খুশির দিন আমার জন্য। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা, তারপরই অপেক্ষার পালা শেষ। পুরো ব্যস্ত আমি আজ। প্রিয়কের পছন্দের খাবার রান্না করেছি নিজ হাতে। মামনিও হেল্প করেছে। আজ সময় যেন কাটছেই না। তবুও অপেক্ষার পালা শেষ হয়। আমারও হলো। বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যার আভাস আসতেই প্রিয় মানুষটার দর্শন পেলাম। তার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকাতেই সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই হারিয়ে গেল। তবে তার সামনে যাওয়ার সাহস হচ্ছিল না আমার। কেমন যেন এক অনুভূতি। যা বলে বোঝানোর মত নয়। আড়াল থেকেই দেখে চলেছিলাম মানুষটাকে। এক সময় তার দৃষ্টিতে আবদ্ধ হই আমি। চোখে চোখ পড়তেই নিজেকে লুকিয়ে নিই৷ তবে তার ওষ্ঠদ্বয়ের মৃদু হাসি নজর এড়ায় না৷ কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে নিজের রুমে চলে আসি। বুকের মাঝে এক অদ্ভুত অনূভুতির সৃষ্টি হলো। যা এর আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। গেট খোলার আওয়াজে বুঝতে পারি প্রিয়ক রুমে এসেছে। সে রুমে আসতেই আমি চলে যেতে নিই। তবে তা আর হয় না। হাত ধরে এক টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। হঠাৎ এমন হওয়ায় ঘাবড়ে যায় আমি। লুটিয়ে পড়ি তার বুকের মাঝে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে মানুষটা তার শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় আমাকে। মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,
” আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?”
“কই পালাচ্ছি? ”
আমতা আমতা করে জবাব দিই আমি। প্রিয়ক তার চোখে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল,
“তাহলে লুকাচ্ছিস কেন নিজেকে? আর লজ্জা পাচ্ছিস কেন?”
“ধ্যাত। কি সব বলো না তুমি। ছাড়ো তো। ”
বলে প্রিয়ককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসি। আসার সময় তার উচ্চ শব্দের হাসির আওয়াজ হৃদমাঝারে ঝংকার তুলে। বাইরে এসে সোজা চলে যায় রান্না ঘরে। বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে থাকি। কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে? মানুষটা তো আর নতুন নয়। তাহলে?
“এই ভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন তুই?”
কথায় চমকে উঠি। খেয়ালই করিনি মামনি যে এখানে। এখন মামনি আমাকে কি ভাবছে কে জানে? কোনো মতে বলি,
“তাড়াতাড়ি নেমেছিতো। তাই।”
বলে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আছি। আঁড়চোখে পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলাম মামনি মিটমিট করে হেঁসে চলেছেন। আমি আর কিছু না বলে পুনমের কাছে চলে যায়।
মাঝরাত। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে সময় এখন তিনটার ও বেশি। শীতের আগমনী সূর আসতেই চারপাশ মৃদু শীতলতায় ছেয়ে গিয়েছে। সারাদিন গরম ভাব থাকলেও রাত নামতেই প্রকৃতিতে নেমে আসে শীতের ঠান্ডা আবহাওয়া। এরই মাঝে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় আমার। ভালো করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলাম একজোড়া গভীর দৃষ্টিতে আবদ্ধ আমি। তার চোখের দিকে তাকানো যায় না। অদ্ভুত শিহরন বয়ে যায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজেকে প্রিয়কের বুকের মাঝে লুকিয়ে নিলাম। যেন মানুষটাও আমায় দেখতে না পারে। মামুষটা তার ওষ্ঠদ্বয়ের উষ্ণ পরশ আঁকে আমার ললাটে। দিশেহারা হই আমি। আরো বেশি করে গুটিয়ে নিই নিজেকে।
সূর্যের সোনালী আলোয় ঝলমল করে উঠে প্রকৃতি। শীতের আগমনী বার্তাকে টেক্কা দিয়ে রবি নিজের উত্তাপে ধরনিতে ছড়িয়ে দিতে থাকে উষ্ণতা। পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত হয় চারপাশ। কর্মব্যস্ত মানুষ ছুটে চলে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে। আর আমাদের সারাবাড়িতে ছোটাছুটি করে চলেছে আমাদের ছোট বার্ডটা। আমার কাছে সে পাখির মত চঞ্চল হলেও প্রিয়কের কাছে সে ফুলের মতো স্নিগ্ধ আর পবিত্র। মানুষটার প্রান আমাদের পুনম। ওকে স্কুলের জন্য রেডি করতে প্রতিদিন সকালে আমাকে ওর পিছনে ছুটতে হয়। এক মিনিটও স্থির হয় না। প্রায় ১ঘন্টা ওর পিছনে ব্যয় করার পর রেডি করাতে পারি। ওকে রেডি করিয়ে নিজেও তৈরি হয়ে নিই। আগের মতোই প্রিয়কই আমাদেরকে ড্রপ করে দিবে। মামনির থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা দেই। প্রথমে পুনমকে স্কুলে দিয়ে তারপর আমাকে নিয়ে যায়। ক্যাম্পাসের সামনে এসে আমাকে নামিয়ে দেয়। সেই সাথে প্রিয়ক ও নেমে আসে। ক্যাম্পাসের বাইরেই অপেক্ষা করছে হাসি, মুনিয়া, তন্নি আর রিয়ন। সেদিকে এগিয়ে যায় আমরা দুজন। প্রিয়ককে দেখে হাসি ফুটে উঠল সবার মুখে। বিভিন্ন কথা বার্তায় পার হয় বেশ কিছু সময়। তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে প্রিয়ক চলে যায়। আর আমরাও ক্লাসে চলে যায়। ক্লাস শেষ করে বাহিরে আসতেই দেখলাম আবির গেইটের বাইরে পায়চারি করছে। আমাদের দেখে এগিয়ে আসে। এসেই বলল,
“এসব কি প্রিয়তা। তোমাদের না ডিভোর্স হওয়ার কথা। তাহলে এখনো কেন ওই অমানুষটা তোমার সাথে?”
আবিরের কথা শেষ হতেই খুব জোরে থাপ্পড় মারলাম ওকে। যথাসম্ভব নিজের রাগ চেপে বললাম,
“অমামুষ প্রিয়ক নয়, অমানুষ তুমি।”
আমার কথা আর থাপ্পড়ে বিস্মিত হয়ে থাকিয়ে থাকে আবির। কিন্তু পরক্ষণেই চোখে মুখে ধরা দেয় রাগভাব। তবে তা খুব সাবধানে এড়িয়ে যায়। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে সবার প্রতিক্রিয়া দেখে নেয়। যা দেখে হাসি পাই আমার। নিজের গালে হাত রেখে বলে,
“মাথা কি পুরোটাই গেছ তোমার। তুমি আমাকে মারছো। তোমার প্রিয়ককে মারা উচিত। তা না করে আমাকে! কি করেছি আমি? শুধু তো তোমাকে ভালোবেসেছি৷ আর তো কিছুনা। ”
আবিরের কথা শেষ হতেই আমি তাচ্ছিল্য স্বরে হেসে বললাম,
“ভালোবাসো? লজ্জা করে না এই কথাটা বলতে? তোমার মত ছেলেরা কখনই কাউকে ভালোবাসতে পারে না। পারে শুধু মেয়েদের মন নিয়ে খেলা করতে। আর তা ছাড়া তোমাদের কাছে তো মেয়েদের অনুভূতির কোনো মূল্যেই নেই। তোমরা তো মেয়েদের শরীরটা দেখো। নিজেদের কামনার সঙ্গী মনে করো৷ এছাড়া তো আর কিছু না। যেমনটা আমাকে করতে চেয়েছিলে৷”
“এসব কি বলছো প্রিয়তা৷ পাগল হয়ে গেছো তুমি? নিশ্চয় তোমার ওই ভাই তোমাকে আমার বিরুদ্ধে বলেছে তাই না। তুমি কি করে আমাকে এমন ভাবতে পারো?”
“কেন নিজের বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে আমার সাথে অভিনয় করো নি? কলেজ প্রোগ্রামের দিন নিজের বন্ধুদের দিয়ে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে নিজেই তা থেকে বের করে এনে আমার সামনে ভালো সাজোনি? অস্বীকার করতে পারবে আমাকে নিজের কামনা.. ছিঃ আমার বলতেও বাঁধছে। ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি। যে তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। নিজের একজন বন্ধু মনে করতাম। ভাবতাম তোমায় ভালোবাসি আমি। এসবের জন্য নিজেকেই ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা হয়। আর কত গুলে মেয়ের জীবন নষ্ট করবে তুমি? কম মেয়ের জীবন নিয়ে তো আর খেলো নি। আর কত?”
আমার কথা শেষ হতেই আবির আবার ও নিজের সাফাই দিয়ে বলতে লাগল,
“দেখো প্রিয়, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। যা ভাবছো তার কোনোটাই সত্যি না। আমি এরকম কিছু করিনি। বিশ্বাস করো। আমি..
” হে আবির। এতদিন এত কষ্ট করে কী লাভ হলো বলতো। সেই তো পাখি অন্য খাঁচায় বন্দি হয়ে গেল৷ তোর তো কোনো পাত্তাই রইলো না।’
কেউ একজন বলে উঠল। তার কথার প্রতিত্তোরে অন্য একজন বলল,
‘আসলেই আবির। এবারের বাজিটা বোধহয় হারতে চলেছিস তুই।’
বলেই হেঁসে উঠল সবাই।
‘ তাহলে তোরা এখনও আবিরকে চিনলিই না। আবির কখনও কোনো বাজিতে হারেনি। আর আগেও হারবে না। প্রিয়তাকে তো আমার বেডে আনবোই৷ আজ হোক বা কাল। ওকে আসতেই হবে।’
আবিবের কথা শেষ হতেই অন্য কারো কন্ঠে শোনা গেল,
‘আর কি করে আনবি বলতো? বিয়ে তো হয়ে গেল ওর। ‘
‘তাতে কি হয়েছে? আমি প্রিয়তার সামনে নিজেকে এমন ভাবে উপস্থাপন করেছি যে ও ভাবছে আমি ওকে এতটাই ভালোবাসি, ওর জন্য নিজের জীবন দিতেও রাজি৷ প্রিয়তা বড্ড ইমোশনাল বুঝলি। একটুতেই দূর্বল হয়ে পড়ে। ‘
‘দেখা যাক। তবে এবার কিন্তু আমাদেরও ভাগ দিতে হবে। একা একা খেলে চলবে না কিন্তু। ‘
‘সে আর বলতে। বেচারী। ধর্ষিতা না হয়েও তার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। এবার তা সত্যি সত্যিই হবে।’
শোনা গেল উচ্চস্বরে কিছু নোংরা হাসির আওয়াজ। ”
একটা ভয়েস রেকর্ড ছিল এটা৷ যা শোনার পর আর কিছু বলার থাকলো না আবিরের। তার কথা সেখানেই আটকে গেল। তবে বের হয়ে এলো তার আসল রুপ। যা সবসময় লুকিয়ে রেখেছিল আমার থেকে।
“ও তাহলে সব জেনে গেছিস৷ ভালোই হলো৷ আর নাটক করতে হবে না। আমিও বোর হয়ে গেছি এক নাটক করে করে৷ হ্যাঁ সবটাই আমিই করেছি। এরকম বাজি প্রায় প্রায় ধরি আমরা। তোকে নিয়েও বাজি ধরে ওরা। তাই প্রোগ্রামের দিন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আমার বন্ধুদেরই বলেছিলাম তোর উপর আক্রমণ করতে৷ যাতে তোকে সেখান থেকে সেইফ করে তোর কাছাকাছি আসতে পারি৷ আর হলো ও তাই। তুই আমার কাছে শুধু মাত্র আমার বেড পার্টনার হওয়ার যোগ্য। আমার ভালোবাসার নয়৷ ”
আবিরের কথা শেষ হতেই আমি আবিরের গালে আরো একটা থাপ্পড় মারলাম। এবার আবির আমাকে মারতে নিলেই চোখ বুঁজে নিই। কিন্তু কিছুকাল পার হওয়ার পর ও কোনোরুপ আঘাত না পাওয়ায় চোখ মেলে তাকাই। প্রথমেই চোখ যায় প্রিয়কের উপর। আমার দিকে উঠানো আবিরের হাত শক্ত করে ধরে আছে মানুষটা। হাতে মোচড় দিতেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠে আবির। প্রিয়ক বলল,
“জন্ম থেকেই প্রতিটা বিপদে ওর ঢাল হয়ে থেকেছি আমি। কোনো আঘাত ওর শরীরকে স্পর্শ করতে দেই নি। ওকে কেউ সামান্য আঘাত করলে তার অবস্থা এমন করেছি যে দ্বিতীয়বার ওর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হয়নি। আর সেখানে তুই আমার প্রিয়তার এত বড় ক্ষতি করতে চেয়েছিলি। সেটা জেনেও চুপ ছিলাম শুধু মাত্র সঠিক সময়ের জন্য। আর আজ তুই ওকে আঘাত করতে নিয়েছিলি। ”
বলে আরো শক্ত করে মোচড় দেয়। আবিবের চোখমুখ তখন দেখার মতো ছিল। আমি প্রিয়ককে ছাড়িয়ে নিই। প্রিয়ক ওর হাত ছেড়ে বলল,
“এর পর যদি প্রিয়তার আশেপাশেও তোকে দেখেছি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আর প্রিয়তার ক্ষতি করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে যাইস না। তাহলে সেখানেই মরবি। মনে রাখিস যতদিন আমি বেঁচে আছি ততদিন প্রিয়তার গায়ে কোনো রকম আঘাত আমি লাগতে দিবো না।”
প্রিয়কের কথা শেষ হতেই আমার হাত ধরে নিয়ে আসে। বাকিদের বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসি আমরা। গাড়ি চলতে শুরু করলে চোখ বুঁজে সিটে মাথা এলিয়ে দিই। আবিরের ব্যাপারে এসব কথা প্রিয়ক আমাকে জানিয়েছিল বাইরে যাওয়ার আগে। সেদিন নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল। আবিরের কথা জানার পর প্রিয়ক আবিরের সম্পর্কে সব খোজখবর নেয়৷ যখন এই সত্যিটা জেনেছিল তখন প্রিয়কের মাঝে ঠিক কী চলছিল তা বুঝতে বাকি থাকে না। আবির এরআগেও অনেকগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও জড়িত আছে অনেক খারাপ কাজে। ফলে প্রিয়কের এখানে না থাকার সময়ে যদি আবির জানতো আমি ওর ব্যাপারে সব জানি। তাহলে আমার ক্ষতি করতে পারতো। আর ভাবতে পারছি না। এতটা নিখুঁত অভিনয় মানুষ কিভাবে করে? প্রিয়ক হয়তো আমার অবস্থা বুঝেছিল। একহাতে আমাকে তার বুকের মাঝে নিয়ে নেয়। শক্ত করে জরিয়ে রাখে।
চলবে..??